ঠাকুমার ঝুলি হইতে কখন যে গল্পটি মার্জার হেন লাফাইয়া খোলা দোরের সীমানা ডিঙাইয়া পথে নামিল ভ্রমেও সেদিকে কেহ লক্ষ্য করে নাই। তৎকাল হইতে এই কালে পড়িয়া গল্পটির বেজায় নাজেহাল দশা হইল। গল্প ঠাহর করিয়া উঠিতে পারিল না কোন দিকে যাইবে।
গল্প ভাবিল যাহা আছে কুল কপালে, দুই চক্ষু যেদিকে যায় সে পথেই যাইব। এই কালে সকল পুরী গমগমা, সকল রাজ্য রমরমা। রাজায় রাজায় যুদ্ধ শেষ হইয়াছে। উলুখাগড়ার প্রাণান্তটুকু শুধু রহিয়া গেছে। বাংলারাজ্য অনেক কাল আগে পূর্ব আর পশ্চিমে দুই ভাগ হইয়াছে। দুই রাজ্যের নাম মধুপুর আর ক্ষীরপুর। ধর্ম দিয়া প্রজাও ভাগ হইল। এখন মধুপুর আর ক্ষীরপুরের দুই রাজমহল সূর্যের আসন ছোঁয়, চাঁদের আসন কাড়ে। দুই রাজ্যের রাজোদ্যানে হীরার গাছে মোতির ফুল। ফুলে-ফলে দোদুল দুল। ফুলের গন্ধে, পাখির ডাকে রাজপুরী ভরপুর। মধুপুরের রাজমহল শ্বেতপাথরে ধবধব। দুয়ারে দুয়ারে রূপার কবাট! ক্ষীরপুরের রাজমহল শ্বেতমাণিকে রবরব। চূড়ায় চূড়ায় সোনার কলসী! মার্জারবেশী গল্প বহু পথ হাঁটিয়া ইতিহাসের পাতা উল্টাইয়া মধুপুরে ঠাঁই গাড়িল।
মৃগয়ার ডঙ্কা বাজিল। মধুপুরের রাজা মৃগয়ায় যাইবেন। রাজ্যে হুলস্থুল পড়িল। হাতী সাজিল, ঘোড়া সাজিল, সিপাই সাজিল, মন্ত্রী-সান্ত্রী সাজিল। পঞ্চকটক নিয়া রাজা মৃগয়ায় গেলেন। রাজার তো নামে মৃগয়া। দিনের বেলায় মৃগয়া করেন। হাতীটা বাঘটা মারেন। রাত হইলে রাজা ছদ্মবেশ ধরিয়া প্রজার সুখ-দুঃখ দেখেন। এক রাতে রাজা মহেশখালির এক ঘরের পাশ দিয়া যাইতেছিলেন। ঘরের ভেতর এক যুবক আর এক কিশোরের কথাবার্তা শুনিলেন। যুবক প্রশ্ন করিল। কিশোর উত্তর দিল।
তোমার নাম কী?
উলু।
উলু? পদবী কী?
উলু দে।
তাহলে তো বাঙালিই তোমরা।
না, আমরা হিন্দু।
বাঙালি তবে কারা?
ওরা, যারা রোজা রাখে, নামাজ পড়ে।
রাজা কান পাতিয়া রহিলেন। যুবক মন্তব্য করিল- ‘ইতিহাসের বৃত্ত তবে পূর্ণ হইয়া আসিল। এই বাংলার মাটিতে দাঁড়াইয়া একদিন বলা হইতো, ওরা বাঙালি না, ওরা মুসলমান। আর আজ তুমি বলিলে- আমরা বাঙালি না, আমরা হিন্দু!’
শুনিয়া রাজা চলিয়া গেলেন। বাঁশের আগে যে কাক ডাকিল, ঝোপের আড়ে যে শেয়াল কাঁদিল, রাজা তাহা শুনিতে পাইলেন না।
রাজা মৃগয়া সমাপ্তি ঘোষণা করিলেন। রাজগৃহে ফিরিবার আয়োজন শুরু হইল। বার্তা শুনিয়া রাজগৃহে রানি কোলের ছেলেকে নাওয়াইয়া স্তন্য পান করাইয়া ঘুম পাড়াইল। আলো ঝলমল ছেলের কপালে চাঁদ চিবুকে তারা। রাজকুমার চন্দ্রমাণিকতুল্য অপরূপ। রানি ছেলের তুলতুলে গণ্ডে আহ্লাদে চুমু খাইয়া রাজার জন্য দুশো মাছের মুড়ো রাঁধিতে গেল। রাজার থালে পঞ্চপরমান্ন অষ্টরন্ধন, ঘিয়ে চপ চপ সপ্তব্যাঞ্জন সাজাইয়া রাখিল। রাজদুয়ারে আলপনা আঁকিল।
রাজার ফিরিবার সময় হইয়া আসিল। শত শত দীপ ধূপ জ্বালাইয়া রানি স্নানে গেল। হলুদ মাখিয়া কপিলা গাইয়ের সাত ঘড়া দুধ গায়ে ঢালিল। রাজদাসী পায়ে ঝামা ঘষিয়া আলতা পরাইয়া দিল। রানি আপন ঘরে সিঁথিপাটি কাটিয়া চোখে কাজল পরিল। কৌটা খুলিয়া সোনার নূপুর বাহির করিয়া পায়ে পরিল। নূপুর রুনুঝুনু বাজিয়া উঠিল। পেঁটরা আনিয়া ময়ূরপেখম শাড়ি খুলিয়া পরিল। শাড়ির রঙে ঘর উজল, শাড়ির শোভায় মন উতল। গলায় শতেক নহর হীরার হার ঝলমল করিয়া উঠিল। রানি মোতির ফুলের নোলক পরিল, মণিমাণিক্যের সিঁথি পরিল। শুধু গজমোতির হারখানি তুলিয়া রাখিল। রাজা আসিয়া নিজ হাতে কণ্ঠে পরাইয়া দিবেন।
রাজদাসী হীরামোতির বেলকুঁড়ি রানির খোঁপায় গাঁথিয়া দিতে দিতে টুক করিয়া ওষুধের বড়ি ঢুকাইয়া দিল। রানি সোনার টিয়া হইয়া টি টি করিতে করিতে উড়িয়া গেল। রাজদাসী আসলে ছিল রাক্ষসী। কবেই মানুষ রাজদাসীকে খাইয়া রাক্ষসী রাজদাসীর ভেক ধরিয়া ছিল। রানিকে খাইবার সুযোগ পায় নাই। এইবার রানিকে টিয়া বানাইয়া নিজে রানি সাজিয়া রহিল। রাক্ষসীরানির মনে কাল, রাক্ষসীরানির জিভে লাল। ঘোমটার আড়ালে জিভ লকলক করে। রূপ দেখতে তরাস লাগে দেখতে করে ভয়, কেমন করে রাক্ষসীরা মানুষ হয়ে রয়। রানি যে রাক্ষসী কেহই জানে না। রাজাও জানিল না।
কোথায় কী হইল? রাজা পঞ্চব্যঞ্জনের দিকে ফিরিয়া তাকাইলেন না। দুশ্চিন্তায় রাজার ঘুম হইল না। জটিল ধাঁধাঁর সঙ্কেত বুঝিতে পারিয়া তাঁহার মনে শান্তি অবশিষ্ট রহিল না। মধুপুরের হিন্দু নিজেকে বাঙালি মানিল না। শুধু মুসলমানরাই কী রূপে বাঙালি হইয়া উঠিল! রাজা সোয়াস্তি পান না। রাজা বাল্যস্মৃতি খুঁড়িয়া দেখিলেন। জমিদার-মহাজন কিংবা জমিদার-কৃষাণের কোনো বিরোধের ছায়া নাই অথচ কী এমন ঘটিল! প্রজারা পরিজনসহ পশ্চিমে গেল। ইতিহাস জানাইল- একদা মধুপুরের মুসলমান প্রজা হঠাৎ হিন্দু প্রতিবেশীদের বিরোধী হইয়া উঠিল। কিন্তু এই প্রবল জাতিদ্বেষের সুনির্দিষ্ট কোনো সূত্র জানাইল না। ইতিহাস জাতির সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আর সম্মিলিত সংগ্রামের কথা বলিল। জানাইল আচমকা মানুষ আমূলভাবে ভিটা হইতে উৎখাত হইল। হাজার বছরের শান্তি সহাবস্থান রুষ্ঠ হইয়া উঠিল। কিন্তু এমন ঘটিল কী প্রকারে? সেই ব্যাপারে নীরব রহিল। পরদিন রাজা দোলা-চৌদোলা দিয়া পাইক পাঠাইয়া দিলেন। পাইক গিয়া গৃহস্থ কিশোর আর যুবককে নিয়া আসিল।
রাজসভায় আসিয়া যুবক আর কিশোর কাঁপিয়া কুঁপিয়া অস্থির। রাজা বলিলেন—সেদিন রাতে কে কী বলিয়াছিলে বলো তো?
কেহ কিচ্ছু কয় না। শেষে রাজা বলিলেন- সত্য কথা যদি না বলো তো বড়ই সাজা হইবে। তখন কিশোর বলিল- আমি কেবল নাম বলিয়া ছিলাম। যুবক বলিল- আমি ইতিহাসের বৃত্তের কথা বলিয়া ছিলাম।
রাজা যুবককে জিজ্ঞাসা করিলেন- তোমার নাম?
খাগড়া।
দেশ?
এই মধুপুর।
পরিচয়?
জন্ম অনাথ। ভবঘুরে।
বৃত্তের কথা কেন বলিলে?
ইতিহাস সম্পূর্ণ উল্টাইয়া গেল যে!
মধুপুরের মুসলমান বাঙালি হইল। মধুপুরের হিন্দু বাঙালিত্ব হারাইয়া শুধুই হিন্দু হইয়া গেল। মানুষে মানুষে ব্যবধানের ইতিহাস রচিত হইল। হায়! রাজা কিছুই জানিতে পারিল না। একপক্ষ দুইপক্ষ করিয়া না জানি কত পক্ষকাল ধরিয়া এই ভেদ সৃষ্টি হইল। আধিপত্যের নানা প্রয়াসে হিন্দু-মুসলমানের ব্যবধান রচিত হইল। পিতৃপুরুষ সেই কবে রাজ্য কাটিয়া দুই ভাগে বাঁটোয়ারা করিয়া দিল। সমাধান মিলিল না। সোনার পিঞ্জরে শুকপাখি বুঝি আর ডাকিল না।
আধিপত্য রাক্ষসের নিঃশ্বাসে গরম হলকা। রাজার বক্ষ জ্বলিল। দাসী-বাঁদীরা রাজবক্ষে চন্দনের প্রলেপ লেপিয়া দিল। রাজা শীতল মিঠাপানীয় পান করিলেন। বক্ষ জুড়াইল না। রাজার বুকে খিল, পিঠে খিল। রাজা তবু টের পাইলেন না। রাজগৃহে ঐতিহাসিক রাক্ষসের পুনঃপ্রবেশ ঘটিল। রাজপুরীর লক্ষ্মীরানি গেল, রাজপুরী আঁধার হইল। এক রাত্রে হাতীশালে হাতী মরিল, ঘোড়াশালে ঘোড়া মরিল। গোহালে গরু মরিল। রাজগৃহ ছমছম করিতেছে। রাক্ষসীরানির হাতে সোনার কাঁকন ঝমঝম করিতেছে। গায়ের রোমে কাঁটা, চোখের পলক ভাঁটা। রাজা মহাফাঁপরে পড়িলেন।
রাজার বুঝিতে দেরী হইয়া গেল। দেরীতে হইলেও অন্তত সত্য বুঝিয়া পাইলেন। ভৌগোলিক বিভাজনে জাতি-ধর্ম-ভাষার বিবাদ মিটিল না। রাজার মনে দুঃখ জাগিল। প্রজাদের মধ্যকার ভিন্নতা আর বৈচিত্র্যকে মান্যতার ও শ্রদ্ধার শিক্ষা দিতে হইত। এই কথা কেন পিতৃপুরুষের ভাবনায় বিশেষ স্থান পাইল না? সহনশীলতা আর উদারতা প্রতিষ্ঠা পাইল না। তাই বিভেদ-বিবাদের উৎস বন্ধ হইল না। পরের রাত্রে রাজার ঘরেই- কাঁই মাঁই। চমকাইয়া রাজা তলোয়ার নিয়া উঠিলেন। দেখিলেন পৃথিবী উল্টাইল। চোখের সামনে রাক্ষসীরানি রাজপুত্রকে খাইতে লাগিল।
রাজা চোখের জলে ভাসিয়া গেলেন, মুছিতে পারিলেন না। রাজার শরীর থরথর কাঁপে, রাজা বসিতে পারিলেন না। রাক্ষসী খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। রাজা তলোয়ার উঁচাইয়া ধরিলেন। রাক্ষসী ছাদে বসিয়া রাজপুত্রের হাড় চুষিতে লাগিল। রাজপুরীর চূড়া ভাঙিয়া পড়িল। রাজার বুক কাঁপিয়া উঠিল। গাছ পাথর মুচড়াইয়া, নদীর জল উছলাইয়া রাক্ষসের ঝাঁক মধুপুরে ছুটিয়া আসিল। ক্ষীরপুরের রাজা রাজদূতের হাতে মধুপুরের জন্য শোকবার্তা পাঠাইলেন।
এদিকে উলু-খাগড়া অবস্থা বেগতিক দেখিয়া ছাদে লুকাইল। দেখিল রাক্ষসীরানি তখন রাজপুত্রকে মুড়মুড় করিয়া চিবাইয়া খায়। খাগড়া পিছন হইতে রাক্ষসীর মাথায় এক চাঁটি মারিল। রাক্ষসী ‘আঁই আঁই’ করিয়া ঘুরিয়া পড়িয়া এক সোনার ডেলা উগরাইয়া পালাইয়া গেল।
উলু-খাগড়া রাজপুরী ছাড়িল। ভবঘুরে খগড়া উলুর হাতে সোনার ডেলা তুলিয়া দিল। তারপর উলুকে বিদায় জানাইয়া দুই চোখ যেদিকে যায় হাঁটিতে লাগিল। উলু নদীর ধারে বাঁশবনে সোনার ডেলা পুঁতিয়া রাখিয়া ঘরে ফিরিয়া গেল। এই সোনা দিয়া একদিন মায়ের জন্য পঁইচে আর বাজু বানাইয়া দিবে। উলু ঘরে ফিরিয়া দেখিল মা নাই। প্রতিবেশী কাঠুরে নামায পড়া শেষ করিয়া মুনাজাতের জন্য দুই হাত তুলিল। কাঠুরে বউ উলুকে দেখিয়া কূলো মূলো ফেলিয়া ডুকরিয়া কাঁদিয়া উঠিল- রাক্ষস তোর মা-কেও গিলিয়া নিল। মা-হারা উলু কাঁদিতে কাঁদিতে বহুপথ হাঁটিল। পথের শেষ নাই। রৌদ্র ঝাঁ ঝাঁ, দিকদিশা খাঁ খাঁ। পথের মাঝে খাগড়াকে পাইয়া উলু চোখ মুছিতে মুছিতে সব বলিল।
রাজা রোজ মন্ত্রী রাখেন। রাক্ষস সেই মন্ত্রী খাইয়া যায় আর একঘর প্রজা খায়। ঘরে ঘরে মানুষের হাড়, পথে পথে হাড়ের জাঙ্গাল! রাক্ষসে দেশ ছাইয়া গিয়াছে। রক্ষা নাই আর। রাজ্যে হুলস্থুল পড়িয়া গেল। যখন সকলে শুনিল রাক্ষসী রানি হইয়াছে, সোনার বরণ রাজপুত্রকে খাইয়াছে, জীবন্ত মানুষ দলে দলে মধুপুর রাজ্য ছাড়িয়া গেল।
প্রজাদের কেহ গেল দুধসাগর দরিয়ার দিকে। কুলবৈদ্য গাছের শিকড় দুধে ভিজাইয়াছিল, নক্ষত্রাদির অবস্থান বুঝিয়া ভাগ্যগণনা করিতেছিল রাজজ্যোতিষী। দুই জনই আছাড়ি পাছাড়ি খাইয়া নৌকায় উঠিল। ইলিশ মাছের ঝোল-ভাত পাতে রাখিয়া গৃহস্থ, রৌদ্রে শুকাইতে দেয়া কুল ফেলিয়া খুকি, ডাংগুলি খেলা ভুলিয়া খোকা নৌকায় উঠিল। দরিয়ায় সপ্ত ডিঙা শুধু ভাসিল। আগাইল না। নদীবক্ষ শুকাইয়া শাঁই শাঁই করিয়া ধূলার ঘূর্ণি উঠিল। কেহ গেল ক্ষীরপুরের দিকে। স্বর্ণরেণু ফেলিয়া স্বর্ণকার, তপ্ত হাপর ফেলিয়া লৌহকার পথে নামিল। কৃষাণ আমনের সোনালি ধানক্ষেত মাড়াইড়া চলিল। তাল-তমালের গহীন বন ছাড়াইয়া কাঠুরে ছুটিল। কেহই ক্ষীরপুরে পৌঁছাইতে পারিল না। এক পা আগে বাড়াইলে ক্ষীরপুরের সীমানা সাত দিনের পথ দূরে সরিয়া যায়।
দীঘল দীঘল পা ফেলিয়া রাক্ষসেরা ক্ষীরপুর পৌঁছাইল। হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ, সাঁত শঁত্তুর খাঁউ। রাক্ষসের নিঃশ্বাসে ক্ষীরপুরের রাজার মাথায় টনক, বুকে চমক। পৃথিবী বুঝি আর থাকে না। নিশাচর রাক্ষসেরা ক্ষীরপুরেও রাজ্য উজাড় দিতে গেল। পুষ্পসৌরভ, মকরন্দের মিষ্টবাস উধাও হইল। শ্বেতপাথরের রাজমহল কাঁপিয়া উঠিল। ক্ষীরপুরের রাজা বোকা হইয়া রহিলেন।
মধুপুর রাক্ষসে ছাইয়া গেল। ধাইয়া ধাইয়া রাক্ষস ক্ষীরপুর ঘিরিল। রাত যেতে-না-যেতে মধুপুরের রাজার সিংহাসন কাঁপিয়া উঠিল। দিন যেতে-না-যেতে ক্ষীরপুরের রাজার রাজ্য গেল, রাজপাট গেল। সকল হারাইয়া, খোয়াইয়া দুই রাজা বনবাসে গেলেন।
মার্জাররূপী গল্প নিঃশব্দে লঘু পদে হাঁটিয়া, লেজ গুটাইয়া চাহিয়া চাহিয়া বিরান রাজ্য দেখিল। গল্প কোন দিকে যাইবে তাহা ভাবিয়া পাইল না। ইতিহাসের উল্টা দিকে যাওয়া যায় না। গল্প বুঝিতে পারিল না কী করিবে। সে কি তবে ঠাকুমার ঝুলিতে ফিরিয়া যাইবে? উত্তররূপকথার লিপিকারের হাতে সেই আখ্যানের সিদ্ধান্ত সঁপিয়া গল্প সামান্য আগাইয়া গেল।
নদীর ধারে বাঁশের বনে হাওয়া খেলিল। উলু-খাগড়া পরিশ্রান্ত হইয়া অশ্বত্থের তলায় বসিল। ক্লান্তিতে তন্দ্রায় ঢুলিয়া পড়িল। সেই অশ্বত্থের ডালে বেঙ্গমা-বেঙ্গমী পাখির বাসা। বেঙ্গমা-বেঙ্গমী বলিল- বাঁশ গাছের তলায় পোঁতা সোনার ডেলায় শান্তিকাটি আর সৌহার্দ্যকাটি আছে। সোনার ডেলা ভাঙিয়া উহাদের মুক্ত করিলে রাক্ষসেরা মরিবে। সুদিন ফিরিবে।
সেই গুপ্তকথা কেহ জানিতে পারিল না। উলু-খাগড়ার ঘুম ভাঙিল। বেঙ্গমী বলিল- আহা! এমন দয়ালু কে? দুই ফোঁটা রক্ত দিয়া আমার বাছাদের চোখ ফুটায়?
শুনিয়া উলু-খাগড়া বলিল- গাছের ওপর কে কথা কয়? আমরা রক্ত দিতে পারি।
বেঙ্গমা নামিয়া আসিল। উলু-খাগড়া নিজেদের আঙুল চিরিয়া দুই ফোঁটা রক্ত দিল। শোঁ শোঁ করিয়া বেঙ্গমা উড়িয়া গেল। একটু পরে দুই বেঙ্গমাছানা নামিয়া আসিল। বলিল- তোমরা আমাদের চোখ ফুটাইয়াছ? তোমাদের জন্য কী করিব বলো?
উলু-খাগড়া কহিল- বেঁচে থাকো ছানারা। কিছু করিতে হইবে না।
-তোমরা কোথাও যাইবে? আমরা উড়াইয়া লইয়া যাইব। যাইবে কোথায়? চলো! রাখিয়া আসি।
উলু বলিল- আমাদের দেশ নাই। খাগড়া বলিল- আমাদের বাড়ি নাই।
দেখিতে দেখিতে ডাঙা জাঙ্গাল, নদ নদী, পাহাড় পর্বত, মেঘ আকাশ, চন্দ্র সূর্য, গ্রহ নক্ষত্র সকল ছাড়াইয়া উলু-খাগড়া বেঙ্গমাছানাদের পিঠে শূন্যে উড়িল।
...
('অপরজন' পত্রিকায় প্রকাশিত)
আমার গল্প , আমাদের গল্প। খুব ভালো লাগলো।
এই উপমহাদেশে আমাদের হাহাকারগুলো গল্প হয়ে যায়। অনেক ধন্যবাদ শিবাংশু।
পড়ে বহুত কষ্ট হল। কি আর বলব।
সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে 'লিখিলাম'। পাঠের জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ।
যে গল্পের শুরু আছে, শেষের কোনো ইঙ্গিত আজো নেই। উলু খাগড়া রক্ত দেয় আর যাদের চক্ষু খোলে তারা গৃহহীন।
গল্পটি খুব ভালো লেগেছে।