ক্ষীণকায় বইটির নাম ‘সৌম্য যেভাবে আকাশ দেখেছিল’। লেখক মণিশংকর বিশ্বাস। প্রচ্ছদ বেশ গতানুগতিক ধরনের আকাশি নীল। তার ওপর, ছোটো একটু আয়তাকার নকশা—লতাপাতার, সুচারু আলপনার মতো। এরপর, পাতা ওলটাই।
আকাশ দেখার, বাস্তবিকই, নানান তরিকা রয়েছে। জানলার মধ্যে দিয়ে দেখা আকাশের নাচার গেরস্তপনা, বাড়ির ছাদ কিংবা গাছের মাথার ওপর ঝুঁকে-থাকা আলগা নশ্বরতাটুকু, পুকুরের জলে প্রতিফলিত তার অলীক চেহারা—এসমস্তই এক-একরকমের দেখা, এবং তার ফলে, আকাশের এক-একরকম হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত। কিন্তু, দেখার বিভিন্নতার আড়ালে এই সত্যটুকু সর্বদাই প্রচ্ছন্ন রয়ে যায় যে, আকাশ বলে সত্যিই আসলে কিছু নেই—এক আদি-অন্তহীন শূন্যতা বই, তা আর কিছু নয়। এবং এই শূন্যতাই, আমাদের মানুষি মরপৃথিবীর সঙ্গে, তার পারিপার্শ্বিক মহাজগতের এক ও একমাত্র যোগসূত্র।
আকাশের নানা রঙ। শিল্পী গোলাম মহম্মদ জোয়ারদার। ক্যানভাসে অ্যাক্রিলিক
সৌম্য-র আকাশ দেখার ভঙ্গিমায়, অতএব, আমরা লক্ষ করি এই শূন্যতার ছায়া। আমাদের দৈনন্দিন যাপনের ভেতরেও চোখে পড়ে তার অনপনেয় আদলটুকু। সৌম্য অন্যমনস্ক হয়, এবং ভাবে—
“বাকি সবই তো প্রতীক
শুধু তোমার ওই পোষমানা ঈগলখানি সত্যি—
তার রাজকীয় ওড়াটুকু, আহা,
আমাকে পুলকিত করে
আমি প্রণত হই মনে মনে তার কাছে প্রার্থনা করি
আমাকেও তুলে নাও
অতর্কিতে
এই অতিকায় প্রতীকময় সরোবরের ঊর্ধ্বে
তোমার ডানার পাশে।”(সৌম্য যেভাবে আকাশ দেখেছিল)
“প্রতীকময় সরোবর” কথাটি, এক্ষেত্রে, বিশেষ ভাবে লক্ষ্যণীয় বলে মনে হয়। সরোবরে প্রতিফলিত গাছ, পাখি, আকাশ—এসবই আসলে বাস্তবের প্রতিচ্ছায়া মাত্র, অর্থাৎ বাস্তবের এক প্রতীকী উপস্থাপনা। কিন্তু, যাকে আমরা প্রথাগত অর্থে বাস্তব বলে জানি, তা-ও যদি আসলে প্রতীকমাত্র হয়? জলের ওপর আকাশের ছায়াটি যে অলীক তাতে কোনো সন্দেহই নেই, অথচ, আকাশ যে নিজেই একটা বিভ্রম, এক অনির্বচনীয় না-থাকাই শুধু, সে-কথা আমরা সবসময়ে মনে রাখি কি? প্লাতো-সহ ভাববাদী দার্শনিকরা, প্রাচ্যে এবং পাশ্চাত্যে, এ-নিয়ে অনেক ভেবেছেন এবং ভাবিয়েছেন। কিন্তু তবুও, বাস্তবের এই কুহককে অস্বীকার করা, বা তাকে অতিক্রম করা, খুব একটা সহজ কাজ নয়। আমরা শুধু অন্ধকারে হাতড়াই, আর ভাবি, কোনো অতিবাস্তব ইগলকে আকাশে চক্কর মারতে দেখেছিল সৌম্য? সে কি তবে মুহূর্তের জন্য, আমাদের চেতনায় ছোঁ-মেরে, আবার উধাও হয়ে যায় আকাশের নীল পর্দার ওইপাশে?
বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা কবিতার দুই দিকপাল—বিনয় মজুমদারও উৎপলকুমার বসুকে। লেখক যে একদা বিনয়-ঘনিষ্ঠ এবং ঠাকুরনগরের বাসিন্দা ছিলেন, সে-কথা আমি জানি। তবু, এই উৎসর্গপত্রটিকে আর-একটু খুঁটিয়ে দেখলে, এবং তাকে বইয়ের কবিতাগুলির সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে চাইলে, দুইয়ের মধ্যে এক প্রচ্ছন্ন সম্পর্ক আবিষ্কার করাও একেবারে অসম্ভব নয়। বিনয় ও উৎপল দুজনের কবিতাই, আমাদের দিনানুদিনের আটপৌরে যাপনও এক মহাজাগতিক সচেতনতার পারস্পরিক টানাপোড়েনে নির্মিত বলে মনে হয় আমার। এবং, সেই টানাপোড়েনের নকশাকে, নিজের মতো করে ছুঁতে চাওয়ার চেষ্টা এই বইয়ের কবিতাগুলির মধ্যেও আবিষ্কার করি। যদি, ‘স্কুলবাস’-নামক কবিতাটির কথাই ধরি—
“আজ ভোরে উঠে দেখি একদল নীলকণ্ঠ ফুল
স্কুলে যাবে বলে প্রস্তুত হয়েছে
ওরাও আমাকে দেখছে সবিস্ময়ে!
ওদেরই কয়েকজন সমস্বরে জানাল,
আজ থেকে উত্তরায়ণ শুরু
এই সময়টায় স্কুলে যেতে সাড়ে সাত লাখ কিলোমিটার
অতিরিক্ত দূরে যেতে হয়।
স্কুলবাস আসতে আজকাল না-কি
পুরো আড়াই মিনিট লেট করে।
এসব কথার ভিতরই কলকল করতে করতে সব বাসে উঠে পড়ে
এদিকে ওদেরই ভাইবোন
কুর্চি ফুলগুলি একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠে, বাস মিস করে
তৈরি হচ্ছে পরের বাসের জন্য।”
লক্ষ করুন, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ও উত্তরায়ণ-হেতু তার সামান্য হেরফের, আলোর গতিবেগ, ফুল-ফোটার মতো স্বাভাবিক কিন্তু অলৌকিক সৌন্দর্যময় ঘটনা, নীল-সাদা পোশাকে স্কুলবালিকাদের প্রভাতী কলরব—এইসব কিছুই কী আশ্চর্য নৈপুণ্যে বুনে দেওয়া হল এই ছোটো কবিতাটির শরীরে। প্রাকৃতিক ও বৈজ্ঞানিক সত্যের নিক্তিতে মানুষের জীবনকে, তার সৌন্দর্য বেদনা, প্রেম ও অপ্রেমকে ছুঁতে চাওয়ার এই কৌশল আমরা বিনয়ের কবিতায় লক্ষ করে বিস্মিত হয়েছি (“জেনেছি নিকটবর্তী এবং উজ্জ্বলতম তারাগুলি প্রকৃত প্রস্তাবে/সব গ্রহ, তারা নয়, তাপহীন আলোহীন গ্রহ” ইত্যাদি)। আবার, উৎপলকুমার বসুর কবিতায়—“বাড়ি ফিরে দেখি, বারান্দায়, টবের গাছে, ছোটো এক/শাদা ফুল ফুটে আছে”— এই অমোঘ উচ্চারণে আমরা দেখেছি, একটি নামহীন ফুলের ফুটে ওঠার সঙ্গে কীভাবে একাকার হয়ে যাচ্ছে একটি শিশুর জন্ম, কিংবা একটি কবিতার সূচনা মুহূর্তও। যেন, এক বিস্ময় বিমুগ্ধ পিতৃত্বের উদ্যাপনই এই কবিতার বিভাব। আর সেই মুগ্ধ বিস্ময়ের ছায়াপাত, মণিশংকরের কবি তাতেও ঘটেছে বলে মনে হয় আমার। বস্তুত, বিনয় ও উৎপলের কাব্যচেতনার স্বাভাবিক সংশ্লেষ, মণিশংকর বিশ্বাসের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য, এবং জোরের জায়গাও।
এই বইয়ের প্রায় সমস্ত কবিতার মধ্যেই, এক শান্ত, বিষাদখিন্ন ও নির্লিপ্ত দেখার ভঙ্গিমা রয়েছে। সমস্তরকম অতিনাটকীয়তা, তথাকথিত মোচড় ও চমক পরিহার করে, কবি বেছে নিয়েছেন এক মৃদু, অনুচ্চকিত ও প্রায়-নিরলংকার উচ্চারণ। খুব স্বাভাবিক ঢঙে, অত্বর চলনে, কবিতাগুলো গড়িয়ে যায় একলাইন থেকে পরের লাইনে। তার মধ্যেও, আচমকা, হীরকখণ্ডের মতো ঝকঝক করে ওঠে আশ্চর্য কোনো চিত্রকল্প, কিংবা উপমা—
“মনে হয় তুমি এক আশ্চর্য কাহিনি—
যার গল্প আমার একটুও মনে নেই
মনে আছে শুধু গল্পের মোচড়খানি
যেন কুমারী স্তনের অতিনাটকীয়তা—
শেষ লাইনের পরে এক বিস্ময়চিহ্ন!” (বিস্ময়চিহ্ন)
অথবা,
“দুপুর থেকেই একটানা এলোমেলো খেলে যাচ্ছে কোনো এক ব্যথা—
বারান্দায় শুকোতে দেওয়া কাপড়গুলির মতো।
রাস্তা দিয়ে দেখি অল্পবয়সী মেয়েরা, আরো বেশি হাওয়ায় উড়ছে—
পাশের বাড়ির ছাদের উপর গ্রীষ্ম-বেগুনের মতো উজ্জ্বল ত্বকের
মেয়েটি এসে শুকনো কাপড় তোলে।
তাকে চুলখোলা শনিবার মনে হয়—“ (বিরোধ)
এই আশ্চর্য ও অপ্রত্যাশিত উপমা-ব্যবহার, কখনও বা, উৎপলকুমারের কথা মনে পড়ায়। ‘স্তন’ কবিতাটি তো, প্রত্যক্ষভাবেই, বেপরোয়া উপমা-চিত্রকল্পের প্রয়োগে এবং শ্লেষ-বঙ্কিম উচ্চারণে, উৎপলকুমারের প্রতি এক সার্থক শ্রদ্ধার্ঘ্য—
“সভ্যতার চাকা এবং সভ্যতার কথায় উৎপল বসুর
ঢিলে পাজামার অধিক উৎপল যেন হুবহু টোকা”
দু-একটা কবিতা, যেমন ‘অঙ্কোলজিস্ট’, কিছুটা কৃত্রিম ও বানিয়ে-তোলা বলে মনে হয়। কিন্তু, তেমন কবিতার সংখ্যা হাতে-গোনা।
সব মিলিয়ে, এই মৃদুভাষ ও ক্ষীণায়তন, কিন্তু বিস্তারে উচ্চাশী বইটির প্রতি ক্রমশ মমত্ব জন্মায়। উলটেপালটে পড়ি, ভাঁজ করে রাখি কখনও, আবার হাতে তুলে নিই। একধরনের আত্মীয়তা তৈরি হয় কবিতাগুলির সঙ্গে। একটি সার্থক কবিতার বইয়ের কাছে, এর বেশি আর কী-ই বা চাইতে পারি আমরা?
কী বলি, শৌভ আমার প্রিয় কবিও বটে! তাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবার ভাষা নেই!
কবি ও আলোচক কে ধন্যবাদ।