বাংলা সিনেমার কথা ভাবলেই, ইদানীং, প্রেমেন্দ্র মিত্রের "বিকৃত ক্ষুধার ফাঁদে" গল্পের সেই বিগতযৌবনা বেশ্যার (সম্ভবতঃ, তার নাম ছিল বেগুন, স্মৃতি যদি নিতান্তই বিশ্বাসঘাতকতা না করে) কথা মনে পড়ে যায়, যে, নিজের হতশ্রীকে গোপন করার উদ্দেশ্যে, উগ্র রঙ মেখে পথের ধারে দাঁড়িয়েছিল, যদিও সেই প্রসাধন, তার সৌন্দর্যের অভাবকে ঢাকাচাপা দেওয়ার পরিবর্তে, আরো বেশি করে বিজ্ঞাপিতই করছিল বরং। অনেক রাত অবধি, তবুও কোনো খদ্দের না পাওয়ায়, অবশেষে, কতকটা অনন্যোপায় হয়েই, সে এক ভয়ানক কুৎসিতদর্শন মানুষকে ঘরে নিয়ে যেতে সম্মত হয়। সেদিন, পয়সার নিতান্তই প্রয়োজন ছিল তার। এই উপমাটিকে যথোচিত সম্প্রসারিত করলে, শুধু যে সেই অসহায় বেশ্যাটির সঙ্গে বর্তমান বাংলা সিনেমার মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে তা নয়, বরং, সেই পূতিগন্ধময় অন্ধকার রাস্তাটির সঙ্গে বাঙালির ক্ষয়িষ্ণু সিনেমাবোধ, এবং ভয়ানক-দর্শন খরিদ্দারটির সঙ্গে বাঙালি দর্শকের মিলও আবিষ্কার করা সম্ভব।
বিগত এক দশকের বাংলা ছবি (মানে, কাগজের ভাষায়, তথাকথিত "মননশীল" বাংলা ছবি) দেখলে একটা কথা খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, বাংলা সিনেমার সাথে আন্তর্জাতিক সিনেমার সম্পর্ক, যা সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক একদা স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছিলেন, এখন প্রায় পূর্ণতঃ ছিন্ন হয়েছে। বাংলা সিনেমা, অধুনা, তার নির্মাণে ও মেজাজে, পরিপূর্ণ মধ্যবিত্ততার একটি পঙ্কিল আবর্তে পাক খেতে খেতে, একমনে, নিজেই নিজেকে ক্রমাগত ধ্বংস করে চলেছে। বিশ্বসিনেমার ভাষা যতই বদলে যাক না কেন, যতই জটিল হয়ে উঠুক না কেন তার অন্তর্গত আখ্যানের বুনন, বা সেই আখ্যানের সঙ্গে বহির্বাস্তবের লেনদেন ও টানাপোড়েন, বাংলা ছবি, তবুও, দৃশ্যের মাধ্যমে একটি নিটোল, নাটকীয় অথচ অন্তঃসারশূন্য গপ্প বলাকেই তার পবিত্র কর্তব্য ঠাউরে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে ব্যস্ত থাকবে। এমনকী, ছবির ভাষা নিয়ে মাথা ঘামানো ছেড়ে, শুধু যদি এটুকুই প্রত্যাশা করি যে সেই গল্প, আদতে, মধ্যবিত্তের কোন গূঢ় আস্তিত্বিক সংকট বা জটিল স্ববিরোধকে দর্শকের সামনে উপস্থাপিত করবে, তাহলেও আশাভঙ্গের শিকার হতে হয়। কেননা, মধ্যবিত্তের হাঁচি-কাশি-টিকটিকি-প্রেম-অপ্রেম-আমাশার গল্পকে, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে, সভ্যতার সংকট হিসেবে উপস্থাপিত করাই, এখন তার নতুন দস্তুর। এবং এই অন্তঃসারশূন্যতাকে আড়াল করার জন্যে রয়েছে আরোপিত কেতা, যা, বস্তুতপক্ষে, ষাট-সত্তরের দশকের আভাঁ-গার্দ ছবির থেকে ধার করা, পরবর্তীতে মিউজিক ভিডিওর জমানায় ব্যবহৃত হতে-হতে বাসি মাংসে পরিণত হওয়া, ক্যামেরা বা সম্পাদনার কৌশলমাত্র। বিশ্বসিনেমার কথা বাদ দিলেও, কেবল যদি হিন্দি বা মারাঠী সমান্তরাল ছবির কথাই ধরি, তাহলেও বোঝা যায়, বাংলা সিনেমা ঠিক কোন গর্তে গিয়ে মুখ লুকিয়েছে।
ব্যতিক্রম কি নেই? রয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে, গত দেড়দশকে নির্মিত ছবির মধ্যে থেকে, কেবল চারটি ছবির কথা স্মরণ করতে পারছি, যা আমার বেশ ভাল লেগেছিল—‘স্থানীয় সংবাদ’, ‘বাকিটা ব্যক্তিগত’, ‘ফড়িং’ এবং ‘আসা-যাওয়ার মাঝে’। তাও, এর মধ্যে, প্রথম তিনটি ছবির ক্ষেত্রে ভাল লাগাটা আংশিক, যদিও শেষ ছবিটির ক্ষেত্রে আমার মুগ্ধতা ছিল সর্বাঙ্গীন। সম্প্রতি, এই ভাল-লাগা ছবির তালিকায়, অন্ততঃ প্রথম তিনটি ছবির সঙ্গে একসারিতে, একটি নতুন নাম যুক্ত হয়েছে—কৌশিক গাঙ্গুলির ‘সিনেমাওয়ালা’।
যেসব দর্শক দেশি-বিদেশি ছবি দেখেন, তাঁদের কাছে ‘সিনেমাওয়ালা’ ছবির গল্প বোধহয় খুব অচেনা ঠেকবে না। বিশেষতঃ, যাঁরা তোরনাতোরের ‘সিনেমা পারাদিসো’ দেখেছেন, বা চাই মিং লিয়াঙের ‘গুডবাই ড্রাগন ইন’, তাঁরা জানেন, সিনেমা ও সিনেমাহল সম্পর্কিত নস্ট্যালজিয়ার বিষয়বস্তুটি সিনেমায় ততটা নতুন নয়। এই ছবিগুলির মতই (যদিও প্রত্যেকটি ছবির সামাজিক-অর্থনৈতিক পটভূমিকা ও বাস্তবতা স্বভাবতই ভিন্ন), ‘সিনেমাওয়ালা’-ও, ডিজিটাল মাধ্যম ও মাল্টিপ্লেক্সের যৌথ আগ্রাসনে খতম হয়ে যাওয়া সেলুলয়েড জমানা এবং একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমাহলের প্রতি কৌশিক গাঙ্গুলির নিজস্ব, ব্যক্তিগত শ্রদ্ধার্ঘ্য, এ-কথা তিনি নিজেও নানান জায়গায় বলেছেন। এবং সিনেমা-ইতিহাসের এই পটপরিবর্তনকে কৌশিকবাবু যুক্ত করতে চেয়েছেন, বা সংস্থাপিত করতে চেয়েছেন, একটি ক্ষয়িষ্ণু মূল্যবোধের আবহে, যেখানে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমাহলের মালিক প্রণবেন্দু দাসের সঙ্গে তার ছেলে প্রকাশের লড়াই, দুই প্রজন্মের মধ্যবর্তী দূরত্বকে ছাপিয়ে, দুটি বিরোধী মতাদর্শের সংঘাত হিসেবেই প্রতিভাত হয়। বিন্যাসের এই স্তরটি, একদিকে যেমন কাহিনি-কাঠামোর ওপর খড়-মাটি চাপানোর জন্যে পরিচালকের কাছে অপরিহার্য ছিল, বিশেষ করে বাঙালি-দর্শকের অভিরুচির কথা মাথায় রেখে, তেমনি অন্যদিকে, এই স্তরটির উপস্থিতিই, ছবিটিকে উপদেশাত্মক (ইংরিজিতে যাকে ডাইড্যাকটিক বলে) ও সীমাবদ্ধ করে ফেলেছে, এ-কথা স্বীকার করা ভাল। প্রথমতঃ, ডিজিটাল সিনেমার যুগে সেলুলয়েডের ক্রম-অবলুপ্তি শুধুমাত্র ডিভিডি-বাটপাড়ি (যা, প্রকাশের মূল ব্যবসা) দিয়ে ব্যাখ্যা করাটা শিশুসুলভ, আর দ্বিতীয়তঃ, এই অবলুপ্তির আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষিতগুলিকে এড়িয়ে নীতিবাগীশতার বুলি কপচানোটাও খুব একটা কাজের কথা নয়। আমি পারিবারিক কাহিনির এই স্তরটিকে অবজ্ঞা করছি না, শুধু এটুকুই বলছি যে, এই স্তরে যদি আরো কিছু উপাদান সংযোজিত হত, তাহলে এই ছবিটি প্রায়-এপিক হলেও হতে পারত।
এ তো গেল খারাপ লাগার জায়গা (আরো দু-একটা জায়গা আছে, সে-আলোচনায় একটু পরে আসব)। এসব সত্ত্বেও, ছবিটি আমার কেন ভাল লাগল, এবার সে-বিষয়ে কিছু কথা বলি। প্রথমতঃ, এই ছবির ধীর-মন্থর গতি আমাকে মুগ্ধ করেছে। বাংলা সিনেমায় এমন লম্বা লম্বা শটের প্রয়োগ চট করে চোখে পড়ে না। বর্তমানে, বিশ্বসিনেমায় স্লো-মুভির বাড়বাড়ন্ত, বিশেষ করে আপিচাটপং ভীরাসেথাকুল বা লাভ দিয়াজের কাজ, অথবা নুরি বিলগে চেলান ও বেলা তারের ছবি, অন্ততঃ একজন বাঙালি পরিচালককে, কিছুটা হলেও প্রভাবিত করেছে, এমন ভাবনা আমাকে সান্ত্বনা দেয়। আর, আমার এও মনে হয়েছে যে, বর্তমান ব্যস্তসমস্ত জীবনের বিপরীতে, বিগতযুগের নাড়ির ধাতটিকে ধরার জন্যে, এই ধীরলয়টি একেবারে মোক্ষম ও যথোপযুক্ত ছিল। সিনেমা-জুড়ে, প্রণবেন্দুর বাঁধা সাইকেল রিকশা আর প্রকাশের মোটরবাইক ব্যবহারের মোটিফও এই গতির বৈপরীত্যকেই ক্রমাগত আভাষিত করে চলে। দ্বিতীয়তঃ, এই ছবিতে ঘটনা খুবই সামান্য—অন্ততঃ, ছবির প্রথমার্ধে, প্রায় কিছুই ঘটে না। এমনকী, যেসব জায়গায় ঘটনা নাটকীয় হয়ে উঠলেও উঠতে পারত, সেখানেও, সম্ভাব্য সমস্ত ঘনঘটাকে সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে, পরিচালক যেভাবে তাঁর নিস্পৃহ ও অনুত্তেজিত কথনের ভঙ্গিমাটি বজায় রাখেন, তাতে তাঁকে কুর্নিশ না-জানিয়ে উপায় থাকে না। উদাহরণ—প্রকাশের মা, প্রকাশের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর জন্য উপহারস্বরূপ যে-গয়নাটি দেন, প্রকাশ নির্বিবাদে, স্ত্রীকে এ-বিষয়ে বিন্দুবিসর্গ না জানিয়ে, নিজের ব্যবসার স্বার্থে সেটি বিক্রি করে দেয়। এই ঘটনাটি, অন্যত্র, উচ্চকিত কোন্দল ও তৎপ্রসূত অতিনাটকীয় বিড়ম্বনায় পরিণত হতে পারত, কিন্তু কৌশিকবাবু এতই ভ্রূক্ষেপহীন ঔদাসীন্যে তা বিবৃত করেন যে, ঘটনাটির অভিঘাত দর্শকের কাছে দ্বিগুণ হয়ে ধরা দেয়, এবং, একই সঙ্গে, প্রকাশের স্বভাবের নির্মম ও নির্লজ্জ পাটোয়ারি দিকটিও এক ধাক্কায় সামনে চলে আসে। এই প্রসঙ্গে, এও বিশেষ লক্ষ্যণীয় যে, গপ্প-কেন্দ্রিক বাংলা সিনেমার সম্পূর্ণ উলটোপথে হেঁটে কৌশিকবাবু তাঁর কাহিনির কিছু কিছু জায়গাকে পুরোপুরি দর্শকের চিন্তাভাবনার ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন, এবং অনাবশ্যক ব্যাখ্যানের ধারকাছ মাড়াননি। যেমন, অতীতে কখনো প্রণবেন্দু ও তাঁর স্ত্রীর বিচ্ছেদ হয়েছিল, ছবি থেকে এইটুকুই শুধু আমরা অনুমান করতে পারি, এবং এ-ইঙ্গিতও পাই যে, তার পেছনে, সিনেমা ও নিজের সিনেমাহল নিয়ে প্রণবেন্দুর অত্যধিক মাতামাতিই দায়ী। কিন্তু, এর চেয়ে বিশদ কোনো ব্যাখ্যা, অনাবশ্যক ফ্ল্যাশব্যাক মারফত, কৌশিক তাঁর দর্শকের জন্যে বরাদ্দ করেননি। এই ধরণের ইঙ্গিতময় ওপেন-এন্ডেড বিন্যাস, হেমিংওয়ে বা রেমণ্ড কার্ভারের লেখার মতই, পাঠক-দর্শকের জন্যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা ছেড়ে রাখে। এবং বাকিটুকু, মায় প্রকাশের সঙ্গে তার বাবার বিক্ষুব্ধ সম্পর্কের পেছনে এই ঘটনার অবদান অবধি, দর্শকের, তার নিজের মত করে, অনুমান করে নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে। এই স্বাদ, বাংলা সিনেমায়, খুব সুলভ নয়। অবিশ্যি, কাহিনিবিন্যাসে অতিমাত্রায় ন্যূনবাদী (মানে, মিনিমালিস্ট) হতে গিয়ে, দু-একটি জায়গায় কাহিনির যুক্তিক্রম খানিকটা হলেও ব্যাহত হয়েছে হয়তো-বা। যেমন, সিনেমার প্রতি প্রণবেন্দুর প্রেম ঠিক কবে থেকে ও কীভাবে, সে-বিষয়ে আলোকপাত না-করায়, তার সমস্ত নস্ট্যালজিয়া, বিষাদ ও মর্ষকাম, নিখাদ বস্তুনিষ্ঠ হওয়ার পরিবর্তে, প্রায় বায়বীয় হয়েই রয়ে যায়।
ভাল লাগার আরেকটি বড় কারণ এই যে, এ-ছবির নির্মাণ প্রায় মেদহীন, এবং অনর্থক চালিয়াতির পীড়া থেকে মুক্ত। একটি মধ্য অথবা নিম্নমানের ছবিকে মহান শিল্প হিসেবে প্রতিপন্ন করার আন্তরিক তাগিদে, বাঙালি পরিচালককূল যেসব প্রচলিত পন্থার আশ্রয়গ্রহণ করেন—যেমন, দু-একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত, অদ্ভুত ও অপ্রাসঙ্গিক ক্যামেরার অ্যাঙ্গল, বিবেচনাহীন স্বপ্নদৃশ্য, আঠালো সংলাপ, মেদুর নিসর্গদৃশ্য, আপাত-স্মার্ট কিন্তু আদতে অসার সম্পাদনাকৌশল—সেগুলি কৌশিকবাবু যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। কয়েকটি মোটিফ ঘুরেফিরে এসেছে, যার মধ্যে সাইকেল রিকশা বনাম বাইকের কথা আগেই বলেছি। এছাড়া, সাইকেল রিকশার পেছনে ঝোলানো সিডি/ডিভিডির দৃশ্যটিও খুবই আগ্রহোদ্দীপক। এবং এই বৃত্তের, ও বৃত্তাকার গতির, মোটিফও বেশ অনেকবারই ফিরে এসেছে ছবিতে—কখনো চাকার ঘূর্ণনে, কখনো-বা নাগরদোলার। এর মধ্যে, একটি সময়বৃত্তের পূর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত প্রছন্ন রয়েছে, এমন অনুমান করা হয়তো খুব অসঙ্গত হবে না। একদিকে যেমন প্রণবেন্দুর চরিত্রটি, পারিবারিক গণ্ডীতে, ক্রমশ তার প্যাট্রিয়ার্কাল কর্ণধারের ভূমিকা থেকে চ্যূত হয়, এবং ছেলের ঔদ্ধত্যের সামনে অসহায় ও দাঁতনখহীন হয়ে পড়ে, তেমনি অন্যদিকে, বাবা হতে-চলা প্রকাশ নিজেই ধীরে ধীরে হয়ে উঠতে থাকে আরেক পেট্রিয়ার্ক। সেলুলয়েড-যুগের অবসান ও ডিজিটাল-যুগের সূত্রপাতের সমান্তরালে, এই পারিবারিক পালাবদলটিও আসলে চক্রবৎ পরিবর্তনশীল সময়েরই দ্যোতনা বহন করে যার ইঙ্গিত লুকিয়ে থাকে এই অনুচ্চকিত প্রতীকসমষ্টির ভেতর।
চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রে কৌশিকবাবুর মুন্সিয়ানা, আমার কাছে, প্রায় প্রত্যাশার অতীত। এই ছবিতে, কোনো চরিত্রই ঠিক সহজ শাদা-কালোর বিভাজনে আবদ্ধ নয়, বরং একটি বহুকৌণিক পরকলা দিয়ে তাদের খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা রয়েছে। প্রণবেন্দুর চরিত্রে পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও হরি-র চরিত্রে অরুণ গুহঠাকুরতার অভিনয় অসামান্য বললেও কম বলা হয়। এমনকী, প্রকাশের স্ত্রী-র ভূমিকায় সোহিনী সরকারও চমৎকার। কিন্তু, প্রকাশের চরিত্রে পরমব্রত-র অভিনয়, বরাবরের মতই, একঘেয়ে এবং অনর্থক ম্যানারিজম-আক্রান্ত। সম্ভবতঃ, সংলাপ বলার ক্ষেত্রেও পরমব্রত-র কিছু শিক্ষা ও অনুশীলনের প্রয়োজন রয়েছে।
ব্যক্তিগতভাবে, আমার মনে হয়েছে, ছবির দ্বিতীয়ার্ধে কৌশিক গাঙ্গুলি একটু অনর্থক তাড়াহুড়ো করেছেন, হয়তো দ্রুত গুটিয়ে আনতে চেয়েছেন ন্যারেটিভের বিস্রস্ত সুতোগুলি। এর ফলে, ছবির মন্থর চালটি, যা শুরুতে আমাকে মুগ্ধ করেছিল, শেষ অবধি আর বজায় থাকেনি। যদিও, ছবির শেষ দৃশ্যটি, খানিকটা অনুমেয় হলেও (তোরনাতোরের ছবির দ্বারা অনুপ্রাণিতও হয়তো), অত্যন্ত কুশলতায় ও ন্যূনতম নাটকীয়তায় চিত্রায়িত, এবং, প্রয়োগগতভাবে মর্মস্পর্শী।
জেমস জয়েস তাঁর ‘আ পোর্ট্রেইট অফ দি আর্টিস্ট অ্যাজ আ ইয়াং ম্যান’ উপন্যাসে, তাঁরই প্রতিভূ স্টিফেন ডিডালাসের মুখ দিয়ে একটি নিজস্ব নন্দনতত্ত্বের প্রস্তাবনা করেন। তিনি বলেন, সৎ শিল্প আসলে জঙ্গম নয়, তা স্থবির। পাঠক বা দর্শককে তা কোনো নির্দিষ্ট অনুভূতির দিকে চালিত করে না, বরং সমস্ত অনুভূতির উর্দ্ধে যে স্থির শান্তি, তার সন্ধান দেয়। এবং, তিনি এও বলেন যে, শিল্পের সৌন্দর্য আসলে লুকিয়ে রয়েছে তার ছন্দে, যে-ছন্দ আসলে সংহতির নামান্তর—অংশের সাথে অংশের, অংশের সাথে সমগ্রের, এবং সমগ্রের সাথে অংশের সংহতি। কৌশিক গাঙ্গুলির এই ছবিটি, সেই অর্থে, একটি সংহত নির্মাণ। এ-ছবি কোনো মহৎ বা কালজয়ী শিল্পকর্ম হয়তো নয়, কিন্তু সাম্প্রতিককালের আর-পাঁচটা বাংলা ছবির সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে, এই ছবিটিকে আমি বেশ খানিকটা এগিয়ে রাখব। এবং, সর্বোপরি, বাংলা ছবির এই ঊষর দিনগুলিতেও, দু-একটি ভাল কথা উচ্চারণের সুযোগ করে দেওয়ায়, কৌশিকবাবুর প্রতি, একজন দর্শক ও সিনেমাপ্রেমী হিসেবে, আমার কৃতজ্ঞতা রইল।