এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  নববর্ষ ২০১৪

  • রাতের অন্যান্য পাখি

    শৌভ চট্টোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ইস্পেশাল | নববর্ষ ২০১৪ | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ | ৯৬৬ বার পঠিত
  • লোকটা আচমকা রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছিলো। ও তারপর, উদভ্রান্তের মতো হাত নেড়ে ইশারা করতে থাকে। সময়মতো গাড়ি না থামালে, সন্দেহ নেই, বড়োসড়ো একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো। নিজেই নিজের তৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে যাই। অ্যাশফল্টের ওপর চাকার তীব্র ঘর্ষণের শব্দ অনেকক্ষণ অবধি কানে লেগে থাকে। লক্ষ করি, রাস্তার আলোগুলির চারিদিকে কুয়াশার এক অস্পষ্ট বলয়। আর, হেডলাইটের হলুদ সুড়ঙ্গ ঘিরে জলকণা উড়ছে।

    দুটি অ্যাম্বুলেন্স, একের পর এক, উল্টোদিক থেকে এসে বাঁ-দিকে বেঁকে যায়। লোকটিকে ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসতে দেখি। বিরক্ত হয়ে দু-একবার হর্ণ বাজাই। রাত যথেষ্ট হয়েছে, ও বাড়ি ফেরার তাড়া ছিলো তার ওপর।

    গাড়ির নিকটে এসে, লোকটি ইশারায় জানলার কাচ নামাতে বলে। তার দীর্ঘ ও প্রশস্ত চেহারার ছায়া পড়ে গাড়ির ভেতর। অন্ধকার তাতে খানিকটা বেড়ে যায়। অনুমান করি, একদা সে যথার্থই সুপুরুষ ও বলশালী ছিলো। এখন, বয়সের ভারে, ঈষৎ স্ফীত ও শিথিল। আমি জিজ্ঞাসা করি, “কী ব্যাপার? হ্যাঁ? এইভাবে কেউ—আশ্চর্য! কোথায় যাবেন কোথায়?”

    লোকটি জানলার মধ্যে দিয়ে অর্ধেক শরীর গলিয়ে দ্যায়। ও চামড়ার জ্যাকেটের আড়াল থেকে একটি পিস্তল বের করে আমার কপালে ঠেকায়। রূঢ়স্বরে বলে, “সরো। সরে বসো।”

    ঘটনার এইরূপ আকস্মিকতায় আমি পূর্ণতঃ বিহ্বল হয়ে পড়ি। মুখ দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় না। রগের কাছে পিস্তলের শীতল ও ধাতব স্পর্শে আমার বোধবুদ্ধি ক্রমশ যেন লোপ পেতে থাকে।

    “কী হল? কী বললাম? কথা কানে যাচ্ছে না? সরে বসো।” লোকটি পুনরায় বলে।

    আমি তার দিকে তাকাই। দেখি, কাঁচাপাকা চুল বেশ ছোটো করে ছাঁটা। মসৃণ, কামানো মুখ ও দামী পোশাক-আশাক দেখে তাকে তস্কর নয়, বরং ডাক্তার কিংবা পদস্থ আমলা বলে মনে হওয়াই স্বাভাবিক। আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারি না। লোকটি দরজা খুলে আমাকে নামতে ইশারা করে। বিনা বাক্যব্যয়ে, গাড়ি থেকে নেমে অন্যদিকের দরজা দিয়ে ড্রাইভারের পাশের সীটে গিয়ে বসি। লোকটি গাড়িতে স্টার্ট দ্যায়।

    কিছুক্ষণ এভাবেই কাটে। সময়ের হিসেব ছিল না। আমি কাচের মধ্যে দিয়ে সটান সামনের দিকে তাকিয়ে থাকি। শুনতে পাই, লোকটি মৃদুস্বরে শিস দিচ্ছে। ঘাড় ঘোরাতে সাহস হয় না। জানলার কাচ নামানো থাকায়, কনকনে ঠান্ডা হাওয়ার প্রকোপে নাক-মুখ প্রায় অসাড় হয়ে আসে। ভয়ে ও বিস্ময়ে আমি এতোটাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম যে বাইরের দৃশ্যাবলী কিছুই আর মস্তিষ্কে রেখাপাত করছিল না। ফলে, গাড়ি ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে, তা অনেকক্ষণ অবধি ঠাহর করতে পারি নি। এখন, পথনির্দেশিকা ও অন্যান্য চিহ্ন দেখে বুঝি যে আমরা প্রায় শহরের উপকন্ঠে এসে উপস্থিত হয়েছি। বাড়িগুলি এখানে আলগা ও ঈষৎ ব্যবধানে ছড়ানো। সামনে বাগান ইত্যাদি রয়েছে।

    রাস্তার ধারে কয়েকটি দোকান চোখে পড়ে। এখন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যাও নগণ্য। দু-একটি গাড়ি পাশ দিয়ে চলে যায়। তাদের কাচ তোলা থাকায় আরোহীদের কাউকেই ভালো দেখতে পাই না। সোডিয়াম ভেপারের কমলা আলোর নিচে সবকিছুই অত্যন্ত ম্লান ও বিষন্ন বলে মনে হয়।

    আরো খানিক দূর এগোনোর পর গতি শ্লথ হয়ে আসে। রাস্তা এইখানে দু’দিকে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁদিকের রাস্তাটি চলে গেছে বিমানবন্দরের দিকে, আর ডানদিকে কিছুদূর এগোলেই শহরের সীমানা। তারপর, দেড়শো কিলোমিটারের মধ্যে, আর কোনো বড়ো জনপদ নেই। আমাদের গাড়ি, শেষমুহূর্তে একটি মারাত্মক বাঁক নিয়ে, সেদিকেই ঘুরে যায়। তীক্ষ্ণ এক শব্দ হয় তার।

    একসময়ে, বিক্ষিপ্ত চাষের জমি ও বড়ো বড়ো ভেড়ি ছাড়া এই অঞ্চলে আর কিছুই ছিলো না। এখন, চারপাশে শহরের সুস্থির বিস্তার পরিলক্ষিত হয়। দেখি, নির্মীয়মাণ অতিকায় অট্টালিকা আর বৃহৎ যন্ত্রসমূহ অন্ধকারে, আলোয় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রয়েছে। ও তাদের ছায়া পড়েছে উঁচু-নিচু মাটির ওপর। এইক্ষণে, গাড়ি থেমে যায়। অল্প ঝাঁকুনি অনুভব করি।

    লোকটি সীটে হেলান দিয়ে বসে। ও গলা খাঁকরায়। বলে, “সিগারেট?”

    আমি দু’দিকে মাথা নাড়ি।

    লোকটি পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায়। কড়া তামাকের গন্ধে হাওয়া ক্রমশ ভারি হয়ে ওঠে।

    “ওরা খেতে দ্যায় না। বলে, বারণ। শালা, বারণ! একসময় তিন প্যাকেট খেতাম। রেগুলার। দিনে। বুঝলে, ইয়াং ম্যান, দিনে তিন প্যাকেট! কখনো কখনো চার।”

    চুপ করে থাকি। দূরে একটি আলো কিছুক্ষণের জন্য নিভে গিয়ে জ্বলে ওঠে ফের।

    “কী হলো? ভয় করছে? হ্যাঁ? কী, ভয় করছে না?” সে পুনরায় পকেট থেকে পিস্তলটি বের করে। ও হাতে নিয়ে নাচায়। কালো ধাতবপৃষ্ঠ থেকে একধরণের ভোঁতা, ঘষঘষে ঔজ্জ্বল্য বিচ্ছুরিত হয়। ওইদিকে তাকাই।

    “বেরেটা। নাইনটি টু এফ এস। নাইন মিলিমিটার ক্যালিবার। চমৎকার জিনিস। হ্যাঁ? এদেশে পাওয়া যায় না চট করে।” লোকটি সপ্রশংস দৃষ্টিতে পিস্তলটি নিরীক্ষণ করে। ও সমর্থনের প্রত্যাশায় আমার দিকে তাকায়। আমি জানলা দিয়ে বাইরে দেখি।

    আশেপাশে কোথাও জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। দূর থেকে চাপা ও গমগমে একপ্রকার শব্দ ভেসে আসে। দু-একটি ট্রাক দ্রুতবেগে পাশ দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। আড়চোখে ঘড়ি দেখি। মধ্যরাত পেরিয়ে গিয়েছে, বেশ কিছুক্ষণ হলো।

    “কোথায় বাড়ি? এখানেই?”

    আমি অন্য একটি শহরের নাম বলি।

    “এখানে কদ্দিন?”

    “দু-বছর। ওই আড়াই। চাকরি নিয়ে—”

    সিগারেটের অবশিষ্ট অংশটুকু জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে লোকটি পিস্তল হাতবদল করে। অন্যহাত স্টিয়ারিঙের ওপর আলগোছে রাখা। চওড়া কবজির ওপর ঘড়ির ধাতব ব্যান্ড ঝকঝক করছে।

    “নামো।”

    একটি শীতল অনুভূতি প্রথমে হৃৎপিন্ড ও পরে তলপেট হয়ে ধীরে ধীরে পা বেয়ে নেমে যেতে থাকে। শরীর প্রায় অবশ হয়ে এসেছিলো। কোনোক্রমে গাড়ি থেকে নামি।

    “এদিকে এসেছো কখনো? আগে?”

    আমরা রাস্তার সংলগ্ন ঢালু অংশ বেয়ে নিচে নেমে আসি। লোকটা পেছনে। ও আমাকে অনুসরণ করছিলো। এবড়ো-খেবড়ো জমি, শক্ত মাটির ডেলা, পাথর আর কাদা বাঁচিয়ে হাঁটতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই হোঁচট খাই।
    গলা শুকিয়ে গিয়েছিলো। তার ওপর কফ জড়িয়ে বিশ্রী আওয়াজ বেরোয়। কেশে নিয়ে পুনরায় বলি, “হ্যাঁ। বেশ কয়েকবার। মানে নামিনি। ওই, রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়ে যা—”

    “এদিক দিয়ে? কোথায়? এপাশে তো—”

    আমি জানাই যে আমার এক বন্ধু থাকে, পাশের একটি ছোটো লোকালয়ে। মানে, গঞ্জ যাকে বলে। ও সেখানে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার।

    “ডাক্তার?” লোকটি জিজ্ঞেস করে। আমি বুঝতে পারি, সে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার গলার স্বর কিছুটা অন্যরকম। এই টের পাই। ও ঘুরে পেছনে দেখি।

    লোকটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তাকে খানিকটা অন্যমনস্ক বলেও মনে হয়।

    “সরকারি চাকরি—” আমি বলি।

    লোকটি আমার দিকে দু কদম এগিয়ে আসে। পেছোতে গিয়ে নরম ও ঠান্ডা কোনো বস্তুর ওপর পা পড়ে পিছলে যায়। দ্রুত সামলে নিই।

    সিগারেট ধরানোর সময়ে, লক্ষ করি, ওর হাত অল্প কাঁপছে। পিস্তলটি সম্ভবতঃ জিনসের পকেটে রাখা। সামান্য ফুলে আছে। আমার দিকে সে প্যাকেট বাড়িয়ে দ্যায়। আমিও, আর কোনো আপত্তি না করে, একটি সিগারেট টেনে নিই। সে কোনো মন্তব্য করে না।

    অনেকক্ষণ পর ধোঁয়া পেটে গেলে দ্রুত ভারহীন বোধ করি। ঈষৎ গা গোলায়। মনে পড়ে, রাত্রে কিছুই খাওয়া হয়নি। মুখের ভেতর এক বিস্বাদ তিক্ততা অনুভূত হয়।

    “এখানে মেরে ফেলে রেখে গেলে কেউ জানতেও পারবে না।” লোকটা স্থির দৃষ্টিতে আমাকে নিরীক্ষণ করে। ও ধীরে ধীরে তার মুখ বিকৃত হয়ে আসে, “কী হল? কী দেখছো? হ্যাঁ? গাড়ি থামিয়ে ভাবলে খুব উপকার করেছো? উদ্ধার করছো আমাকে? হ্যাঁ? শালা! মেরে পুঁতে রেখে দেবো।” পা দিয়ে সে মাটিতে লাথি মারে। খানিকটা ধুলো ওড়ে তার ফলে।

    আমি চোখ সরিয়ে নিই। ও অন্যদিকে তাকাই। অল্প দূরে, বিশাল এক গর্তের কিনারায়, একটি মাটি খোঁড়ার যন্ত্র কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার পাশে ঢালাই মেশিন, লোহার বড়ো বড়ো রড। এই জনহীন প্রান্তরে, আর অস্পষ্ট আলোয়, তাদের দানবিক ও অপার্থিব বলে ভ্রম হয়।

    মাথার ভেতর দপদপ করছিলো। আমি জোরে জোরে শ্বাস নিই। রাস্তা থেকে আমরা অনেকটা সরে এসেছি। ও দূরে হেডলাইটের আলো চোখে পড়ে। অন্যদিকে বড়ো বড়ো স্তম্ভ, অসমাপ্ত দেয়াল। লোহার বিমের ওপর দু-একটি হ্যালোজেন জ্বলছে। লোকজন আছে কি না, তা ঠাহর করার চেষ্টা করি। লোকটা ইতস্তত পায়চারি করতে থাকে।

    “ওদেরকে যেন কী বলে? যারা অন্য জায়গা থেকে আসে? কিছুদিনের জন্য?” হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে সে আমার কাছে জানতে চায়।

    আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করে, “কী বলে যেন?”

    “যাযাবর?” আমি অনিশ্চিতভাবে বলি।

    “না, না। প্রতি বছর। আবার ফিরে যায়।”

    “পরিযায়ী?”

    “হ্যাঁ। ঠিক। প-রি-যা-য়ী।” লোকটা কেটে কেটে উচ্চারণ করে। তাকে দৃশ্যতঃ নিশ্চিন্ত দেখায়।

    “এদিকে এসো। এই যে—” লোকটা গর্তের ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। আমি এগিয়ে যাই।

    “এইখানে”, হাওয়ায় দীর্ঘ এক অধিবৃত্ত এঁকে সে বলে, “আগে বিরাট জলাজমি ছিলো। দীঘি নয়। আরো বড়ো। বিল বলে বোধহয়। তাই না? না কি ঝিল? মানে, এদিক থেকে ওদিকের পাড় দ্যাখা যায় না। এ রকম।”
    এ-কথা আমার অজানা নয়। শহরের অনেকের মুখেই শুনেছি, অনেকবার। যদিও, উপস্থিত তা প্রকাশ করা সমীচীন হবে না, এই ভেবে চুপ করে থাকি।

    “অনেক পাখি আসতো। শীতকালে। পরিযায়ী। বালিহাঁস, সারস। ঝাঁক বেঁধে। এই বছর পাঁচেক আগেও।” লোকটা জ্যাকেট থেকে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে ফ্যালে।

    “একবার দুটোকে মেরেছিলাম। এয়ারগান দিয়ে। এতো নরম আর পলকা। হাতে নিলে বোঝা যায়। কীভাবে যে অত দূর থেকে উড়ে আসে। হাজার হাজার মাইল।”

    “চৌম্বকক্ষেত্রের ব্যাপার আছে। মানে, ওদের শরীরে—” আমি বলার চেষ্টা করি। কিন্তু লোকটা আমার কথায় কান দ্যায় না। বলে, “এখন কোথায় যাবে কে জানে! সব তো বুজিয়ে ফেলেছে।”

    তার চোখমুখ চিন্তায় ঘন হয়ে আসে। ও বিভ্রান্ত হয়ে চারিদিকে তাকায়, “এতো লোক। রাস্তাঘাট, বাড়ি। কোথায় যাবে? জায়গা কই?”

    আমি পা দিয়ে মাটিতে আঁকিবুকি কাটি। অস্পষ্ট চিহ্নগুলি একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছিলো। লোকটি গর্তের মধ্যে ঝুঁকে কিছু দেখার চেষ্টা করে।

    “সাবধানে—” আমি বলে উঠি। লোকটিকে এখন আর ততোটা বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছিল না।

    সে ফিরে তাকায়। ও কিনারা থেকে সরে আসে।

    “কী?”

    “না—”

    তৃতীয় সিগারেটটি ধরানোর সময়ে, দেশলাইয়ের আলোয় তার মুখের ভাঁজ, কপালের রেখাগুলি, অধিক কমনীয় বলে মনে হয়। আমার শীত করছিলো। জ্যাকেটের চেন গলা অবধি টেনে দিই।

    “ভয় করছে?”

    আমি নিচের দিকে তাকাই। জুতোর ফাঁক দিয়ে কাদা ঢুকে মোজা ভিজে গিয়েছিলো। অস্বস্তি অনুভব করি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে পা টনটন করতে থাকে।

    “ধরো, তোমাকে তিনমিনিট সময় দিলাম। মানে গুলি খাওয়ার আগে, তোমার হাতে তিনমিনিট আছে। ভেবে বলতে পারবে, কী কী করতে চাও? মানে, কী কী করা বাকি রয়ে গেল?”

    উত্তর দিই না। খুব নিচু দিয়ে একটা প্লেন উড়ে যায়। সম্ভবতঃ, বিদেশ থেকে আসছে। এইসময়ে, রাতের দিকে, অনেক বিদেশি বিমান শহরে এসে নামে। আমি কখনো বিদেশে যাইনি।

    “কী হলো? উত্তর দাও।” লোকটা ফের পিস্তল বের করে।

    “জানি না।”

    লোকটা চুলে হাত বোলায়। কিছুক্ষণ পর বলে, “আমিও জানি না। মুশকিল খুব এভাবে বলা। হ্যাঁ?”

    সে আকাশের দিকে তাকায়। একটাও তারা দ্যাখা যাচ্ছে না। ধোঁয়াটে এক আস্তরণে চারিদিক ক্রমশ ঢেকে যেতে থাকে।

    “যাও।”

    “হ্যাঁ?” আমি প্রথমটায় বুঝতে পারিনি।

    “চলে যাও।” বাঁদিকের পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে আমার দিকে ছুঁড়ে দ্যায়।

    “আপনি?”

    “যাও।” লোকটি চেঁচিয়ে ওঠে। ও অধৈর্য হয়। আমি আর কোনো কথা না বলে গাড়ির দিকে হাঁটতে থাকি। বেশ খানিকটা যাওয়ার পর ঘুরে দেখি, লোকটা আবার গর্তের কিনারায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সে এদিকে তাকায় না।

    আরো একটি প্লেন মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। গমগমে শব্দ হয় তার।

    প্রায় গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, এমন সময়ে পেছন থেকে লোকটির গলা কানে আসে। ফিরে দেখি, এদিকেই হেঁটে আসছে। ও ইশারায় আমাকে অপেক্ষা করতে বলে। ওপর থেকে তার চেহারার প্রকৃত বিশালত্ব আন্দাজ করা যায় না। তাকে ছোটো, এমনকী, যথেষ্ট অসহায় বলে মনে হয়। তার হাঁটার ভঙ্গীতে ক্লান্তির ছাপ ফুটে ওঠে। আমি ঢালু জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকি।

    “আমাকে দেখলে চিনতে পারবে? পরে?” ফেরার পথে লোকটি জিজ্ঞাসা করে।

    আমি গাড়ি চালাচ্ছিলাম। ও চুপ করে থাকি।

    “মনে থাকবে নিশ্চয়ই।” লোকটা মুখ থেকে অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে হাসে। অল্প কাশি হয়। সে বুকের ওপর আড়াআড়ি হাত রাখে। ও ধীরে ধীরে সামলে নেয়।

    একটি কুকুর হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে এসে পড়েছিল। হর্ণ দিতে ছিটকে সরে যায়। আমি আড়চোখে বাঁ-দিকে তাকাই। দেখি, চোখ বন্ধ। ও ঠোঁটের কোণে অল্প হাসি লেগে আছে।

    “ইটস নট ইজি, ইয়াং ম্যান। নট সো ইজি।”

    “কী?”

    ও কোনো উত্তর দেয় না।

    আমরা পুনরায় লোকালয়ে ফিরে আসি। লোকটি আমাকে রাস্তা দেখিয়ে দিতে থাকে। শহরের পথঘাট ও বিভিন্ন গলিঘুঁজি যে তার নখদর্পণে, এ-কথা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

    যেখানে সে আমাকে গাড়ি থামাতে বলে, সেই অঞ্চলে আমি এর আগে কখনো আসিনি। বাড়িঘরের আদল ও রাস্তাঘাটের দুধারে কেয়ারি করা বাগিচা ইত্যাদি দেখে যথেষ্ট সম্ভ্রান্ত এলাকা বলে মনে হয়। আমি বলি, “এখানে?”

    লোকটা গাড়ি থেকে নামে। ও আমাকে বুঝিয়ে দ্যায় কীভাবে মূল রাস্তায় ফিরে যেতে হবে।

    আমি গাড়ি চালু করি। লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর বাঁদিকের একটি গলির মধ্যে ঢুকে যায়।

    উল্টোদিকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলে ওঠে। ও জ্বলতেই থাকে।

     

     

    “তারপর?” হারুণ ব্যগ্রভাবে আমাকে জিজ্ঞেস করে।

    “এই—” আমি বলি।

    হারুণের চোখেমুখে আলগা হতাশার ছায়া পড়ে। এ আমার অচেনা নয়। তথাপি, আমি চুপ করে থাকি। কী বলবো ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দিই।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ | ৯৬৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • sumeru | ***:*** | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:০৫87484
  • জাস্ট কুন্দেরার মত ঈশ্বর সাধনা করে যাচ্ছে ছেলেটা, কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না। ব্যস, এই-
  • শিবাংশু | ***:*** | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ১০:২৪87485
  • তাকাচ্ছে তো...
  • Souva | ***:*** | ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ১০:৩৪87486
  • :) শবসাধনা উইথ কারণবারি!
  • sinfaut | ***:*** | ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:১২87488
  • নিজের লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করে আবার বাংলাতে অনুবাদ করেছে। :P
  • i | ***:*** | ১৮ এপ্রিল ২০১৪ ১১:৪০87487
  • বসন্তের জানলা দিয়ে পড়েছিলাম বছর দুই আগে আর এই লেখাটি পড়লাম। খুব বেশি তো পড়া হয় না।
    সুভাষ ঘোষালের একটি লেখা পড়েছিলাম-প্রতিক্ষণের ১০টি গল্প সংকলনের মুখবন্ধে-সেইখানে যতদূর মনে পড়ে নৈঃশব্দের সামর্থ্য বলে একটি বাক্যবন্ধ ছিল-শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের এই দুটি লেখাই কিছুটা সেই কথা মনে পড়ায়।
  • . | ***:*** | ২০ এপ্রিল ২০১৪ ১২:৩২87489
  • সে তো বেকেট করত বলে শুনেছি। ইংরিজি, ফ্রেন্চ, ইংরিজি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন