১. উপকথা
শহর থেকে অল্প দূরেই যে একটি চমৎকার হ্রদ রয়েছে, এ আমি অনেকদিন অবধি জানতাম না। হারুণের মুখে প্রথম যখন এর কথা শুনি, তখন থেকেই জায়গাটির প্রতি আমার এক অদম্য আকর্ষণ জন্মায়। ও সেখানে না-যাওয়া অবধি য্যানো কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছিলাম না।
তখন বসন্তকাল। যদিও শহরে তা নামমাত্র। কাজের চাপ তেমন না থাকায় আমরা প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই (রোববার বাদে) সদর স্ট্রিটের এই ছোটো পানশালায় জমায়েত হই। আমরা বলতে আমি, হারুণ, অরূপ আর মাস্টার। পানশালাটির নাম ‘সলিটেয়ার’। ও সেখানকার ওয়েটাররাও আমাদের চিনে ফেলেছিলো। ঘন্টাদুয়েক গল্পগুজব করে আমরা যে যার বাড়ি ফিরতাম।
তো এখানেই একদিন হারুণ হ্রদটির কথা আমাকে বলে। সে এও জানায় যে, শহর থেকে ওই হ্রদের দূরত্ব মাত্রই মাইল কুড়ি। কিন্তু নিকটে হলেও, ঘন সবুজ গাছপালায় ঘেরা, অনুচ্চ টিলাবেষ্টিত অধিত্যকাটির সৌন্দর্য না কি প্রায় অপার্থিব। সে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
তার এই কথায় বাকি সবাই সায় দ্যায়। আমি বলি যে, তাদের সৌভাগ্যে আমি ঈর্ষান্বিত। আগে জানলে আমিও নিশ্চয় এতদিনে হ্রদটি দেখে আসতুম।
মাস্টার তখন একটু ইতস্তত করে। ও বলে, “না, আমার অবিশ্যি এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। আসলে যতবারই প্ল্যান করেছি...”
অরূপ মাথা চুলকোয়, “জায়গাটার কথা বাবার মুখে এতবার শুনেছি। যাইনি যদিও...”
হারুণ বলে, বহুকাল আগে গাড়িতে করে যাওয়ার সময়ে দূর থেকে সে না কি একঝলক দেখেছিলো। কিন্তু তারপর আর...
তাদের এই নির্বোধ আচরণে আমি যারপরনাই বিস্মিত হই। বলি, “কী আশ্চর্য! হাতের কাছে এমন একটা জায়গা থাকতেও তোমরা যাওনি কোনোদিন?”
হারুণ নিচু স্বরে বলে, “আসলে নানারকম গল্প আছে হ্রদটা নিয়ে। কুসংস্কারই বলা যায়।”
“কী রকম?” আমি জানতে চাই।
“ওখানে গেলে না কি মানুষ পালটে যায়। অন্যরকম হয়ে যায়।”
“আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের আর চিনতে পারে না।”
“সবসময়ে একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। কিছুই ভালো লাগে না।”
ইত্যাদি।
স্পষ্ট বুঝতে পারি যে এসবই আসলে নিছক গালগল্প, আর কিছু নয়। অন্যরাও সে-কথা নির্দ্বিধায় মেনে নেয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে হ্রদটি দ্যাখার কোনো উৎসাহ লক্ষ করি না। আমি বলি যে, প্রয়োজনে আমি একাই সেখানে যাবো। ও সারাদিন একান্তে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করবো। অন্যরা তা শুনে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
২. মুনিয়া
এর কিছুকাল আগের ঘটনা।
মুনিয়ার সাথে আমার প্রেম হয়ে গিয়েছিলো।
মুনিয়া আমারই অফিসে চাকরি করে। একদিন, অফিস থেকে ফেরার সময়ে আমি একটি ট্যাক্সি ধরি। তখন অল্প-অল্প বৃষ্টি পড়ছে। সন্ধ্যের আকাশ ক্রমশ ঘন মেঘে লাল হয়ে আসে। দেখি, মুনিয়া দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাওয়ার বিরুদ্ধে সে মরীয়াভাবে তার ছাতাটি খোলার চেষ্টা করছিলো। আমি তাকে ট্যাক্সিতে উঠে আসতে বলি। সে আমার পাশে এসে বসে। ও তার সুগন্ধে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবে বলে মনে হয়। আমি তাকে জানাই যে, সন্ধ্যের পর এইসব অঞ্চল বিশেষ বিপজ্জনক। তস্করের ভয় আছে। তাই, এই সময়ে, তার একা-একা যাতায়াত না করাই সমীচীন। সে আমার দিকে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকায়।
সন্ধ্যাটি ক্রমশ দ্রব হয়ে ওঠে। আমি বলি, “মাঝেমধ্যে এরকম হয়। মনে হয় এই ঘটনাগুলো, সবই, আগে কখনো ঘটে গিয়েছে। শুনেছি, মানুষের স্নায়ুর বিলম্বিত ক্রিয়াই না কি এইসব ঘটনার জন্যে দায়ী।” মুনিয়া হাসে। তাকে আরো বলি যে, আমার বন্ধু অরূপের লেখা একটি গল্পে অনুরূপ দৃশ্যের বর্ণনা আমি পড়েছি। সেই গল্পের নায়ক তুমুল বৃষ্টির মধ্যে, ভিজতে-ভিজতে, নায়িকাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলো। হয়তো সেইজন্যেই, আজ, এই সন্ধ্যাটি এত পরিচিত ও প্রীতিপ্রদ বলে মনে হচ্ছে। মুনিয়া জিজ্ঞেস করে, “তারপর?” আমি চুপ করে থাকি। মুনিয়া আমাকে তার বাড়িতে কিছুক্ষণ বসতে ও এককাপ কফি খেয়ে যেতে অনুরোধ করে। এরকম যে ঘটবে, তা আমি আগেই অনুমান করেছিলাম। অতএব, ধীরে ধীরে বলি, “আজ থাক। পরে কোনোদিন।”
গাড়ির হেডলাইট মুনিয়াকে ছুঁয়ে ঘুরে যায়। মুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসে।
এর পরের রোববার আমি মুনিয়ার বাড়িতে যাই। ও তারপর, প্রত্যেক রোববার আমি মুনিয়ার বাড়িতে যেতে শুরু করি। মুনিয়ার বানানো কফি আমার অত্যন্ত সুস্বাদু লাগে। মুনিয়াকে আমি প্রায় ভালোবেসে ফেলি।
মুনিয়া যে ঘরে শোয়, তার দেয়ালে তেলরঙে আঁকা একটি নিসর্গচিত্র টাঙানো রয়েছে। ও তা বিকেলের ম্লান হলুদ আলোয় রহস্যজনকভাবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। যদিও, ছবিটির বিষয়বস্তু আমি ভালো বুঝতে পারি না। দেখি, সমুদ্রের তীরবর্তী উঁচু জমিতে এক কৃষক হালসমেত চাষের কাজে ব্যাপৃত। তার পরণে অদ্ভুত পোষাক, যা মধ্যযুগীয় বলে মনে হয়। একটু দূরে এক মেষপালক আকাশের দিকে তাকিয়ে য্যানো কিছু দ্যাখার চেষ্টা করছে। আর তারও পেছনে, ইস্পাতের মতো ধূসর-নীল সমুদ্রের জল। স্থির। ও তাতে দু-একটি পালতোলা জাহাজ। নিকটবর্তী জাহাজটির নিচে একটি ডুবন্ত মানুষের উপস্থিতি আমাকে চিন্তায় ফেলে দ্যায়। আর পটজুড়ে ওই চাপা হলুদ আলো, যার কথা আগেই বলেছি।
আমি মুনিয়ার কাছে ছবিটির বিষয়ে আরো জানতে চাই। এও জিজ্ঞাসা করি যে, মেষপালকটি আকাশের দিকে তাকিয়ে কী দেখছে। মুনিয়া বিছানায় চিত হয়ে শুয়েছিলো। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে চুপ করে থাকে। আমি তার ইঙ্গিত অনুমান করে তার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ি।
এইভাবে আমাদের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে।
এইসময়েই আমি হ্রদটির কথা জানতে পারি।
পরের রোববার যথারীতি মুনিয়ার বাড়িতে যাই। মুনিয়া একটা গাঢ় সবুজ রঙের ভেলভেটের গাউন পরেছিলো। ও টোকা দেওয়া মাত্রই দরজা খুলে দ্যায়।
আজ তার চুলগুলি উঁচু করে বাঁধা। তার গ্রীবা বাঁকানো ধাতুর মতো ফুটে ওঠে। সে সহজভাবে আমার হাত ধরে। ও আমরা সোফায় গিয়ে বসি।
আমার অন্যমনস্কতা মুনিয়ার চোখ এড়ায় না। সে স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি একটু অস্বস্তিবোধ করি। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটে। অবশেষে, হ্রদটির কথা সবিস্তারে খুলে বলা ছাড়া আর উপায় থাকে না। এমনকী, আমি তাকে একসাথে সেখানে যাওয়ার প্রস্তাবও দিই।
মুনিয়া সহজেই আমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যায়। যথেষ্ট উৎসাহ ছিলো তার। এইরূপ সাবলীল আত্মবিশ্বাস ও বেপরোয়া ভাব আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করে। ঠিক হয়, আগামী রোববার আমরা হ্রদটি দেখতে যাবো। ও সারাদিন সেখানেই কাটাবো।
পরের দিনগুলো দ্রুত কেটে যায়।
৩. হ্রদ
আমরা একটি গাড়ি ভাড়া করি। শহর থেকে হ্রদের দূরত্ব বেশি নয়। কিন্তু ড্রাইভার বলে যে, পৌঁছতে অন্ততপক্ষে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা সময় লাগবে। কেননা রাস্তার যা অবস্থা, তাতে খুব দ্রুত গাড়ি চালানো সম্ভব নয়। আমরা একটি ছোটো ব্যাগে স্যান্ডউইচ, আলুভাজা ও ঠান্ডা পানীয় ভরে নিই। হ্রদের তীরে বসে মধ্যাহ্নভোজন করবো, এই ছিলো আমাদের মনোগত অভিপ্রায়।
গাড়ি চলতে শুরু করলে ড্রাইভারকে কাচ তুলে দিতে বলি। বাতানুকূল যন্ত্রের ক্রিয়ায় শরীর ক্রমশ শীতল হয়ে আসে।
মুনিয়া বলে, “আজ এক আশ্চর্য দিন।”
আমি বলি, “অবশেষে আমরা হ্রদটি দেখতে চলেছি।”
মুনিয়া আমার হাত ধরে থাকে।
এইভাবে, পরিচিত রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, সংগ্রহশালা, তথ্যকেন্দ্র ইত্যাদি অতিক্রম করি। আস্তে আস্তে, শহর ফুরিয়ে আসে।
ড্রাইভার ভুল বলেনি। ভূপ্রকৃতি এখন জটিল হয়ে উঠছে। রাস্তার জায়গায় জায়গায় পিচ উঠে গিয়ে গভীর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে, এই লক্ষ করি। খুব ধুলো ওড়ে। মুনিয়া জানায়, এই অঞ্চলের মাটি মূলতঃ ল্যাটেরাইট জাতীয়। তাই এর রঙ লাল। আমরা হ্রদ ও তার সন্নিহিত ভূপ্রকৃতির বিষয়ে আলোচনা করি। আমি য্যানো চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই সেই জায়গাটি। কাকচক্ষু জল, সবুজ ঘাসে ঢাকা তটভূমি ও তাকে ঘিরে প্রাচীন বৃক্ষের সারি, ছায়ায় বিশ্রামরত মুনিয়া, পাখির ডাক, বুনোফুলের গন্ধ—সব মিলিয়ে এক অনুপম নিসর্গের ছবি আমার কল্পনায় ভেসে ওঠে। আমি মুনিয়ার কাছে এইসব বর্ণনা করি। এমনকি, হ্রদের বিষয়ে প্রচলিত উপকথাগুলিও এখন বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। সময় কোথা দিয়ে যে কেটে যায়, বুঝতে পারি না।
ড্রাইভার একটি বাঁকের মুখে এসে গাড়ি থামায়। ও বলে, সামনের ঢাল বেয়ে কিছুদূর নামলেই না কি আমরা হ্রদের তীরে পৌঁছে যাবো। যদিও, সেই অংশটি আমাদের হেঁটেই পার হতে হবে, কেননা এর পর আর গাড়ি যায় না। বস্তুতঃ, হ্রদে যাওয়ার যে রাস্তা, তা নিতান্তই শুঁড়িপথ। ড্রাইভার আরো বলে যে, সে গাড়িতেই অপেক্ষা করবে। আমরা য্যানো অন্ধকার হবার আগেই ফিরে আসি। মুনিয়া ও আমি কেবল খাবারের ব্যাগটি সঙ্গে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ি।
খুবই নিস্তব্ধ এই অঞ্চল। ঢাল বেয়ে নামার সময়ে পায়ের নিচে শুকনো পাতা ও ডাল ভাঙার আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ ছিলো না। মুনিয়া দুবার পড়ে যেতে যেতে সামলে নেয়। তার গোড়ালিতে চোট লেগেছিলো। আমারও, পাথরে ঘষা লেগে, হাত ছড়ে যায়। আমরা কেউই বিশেষ কথা বলি না। রোদ না থাকায় খানিকটা স্বস্তি অনুভূত হয়। এইভাবে, প্রায় পনেরো মিনিট চলার পর আমরা হ্রদের নিকটে এসে উপস্থিত হই।
আমাদের কল্পনা মোটামুটি মিলে গিয়েছিলো। হ্রদের তীর সত্যই সবুজ ঘাসে ঢাকা। তবে আশেপাশে বড় গাছ বিশেষ চোখে পড়ে না। হ্রদের তীরে পৌঁছনোর আগেই বৃষ্টি আসে। আমরা সামান্য ভিজে যাই।
শুকনো জায়গা দেখে বসি। মুনিয়া ব্যাগ থেকে খাবার বের করে। আমি মুনিয়ার কাঁধে হাত রাখি। অল্প অল্প ঘাম হতে থাকে।
খাওয়ার পর মুনিয়া জানায় যে, সে একটু বিশ্রাম নেবে। তা ছাড়া, পায়ের যন্ত্রণাহেতু তার পক্ষে হাঁটাহাঁটি করাও অসুবিধাজনক। অন্যদিকে, আমার বিশেষ কিছুই করার ছিলো না। তাই আশপাশটা একটু ঘুরে দেখবো, এই মনস্থ করি। ও সেই মতো হ্রদের তীর ঘেঁষে হাঁটতে থাকি।
হ্রদটা যথেষ্ট বড় এবং উপবৃত্তাকার। চারিদিকের জমি ঢালু হয়ে ওপরে উঠে গ্যাছে। বেশিরভাগই ঘাস আর নিচু ঝোপঝাড়ে ঢাকা। লক্ষ করি, ঝোপের মধ্যে লালরঙের একপ্রকার থোকা থোকা ফল হয়েছে। অনেকটা কুলের মতো দেখতে। একটা কামড়াতেই তীব্র বিস্বাদে জিভ অসাড় হয়ে আসে। থু থু করে ফেলে দিই।
ঘাসের মধ্যে কাদা ও অন্যান্য আবর্জনা খেয়াল করে হাঁটি। দেখি, মাঝখানে খানিকটা অংশ য্যানো আগুনে ঝলসানো। আশেপাশে ছেঁড়া কাগজ, টিনের কৌটো, খালি বোতল ইত্যাদি পড়ে আছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি।
একটা অস্বস্তি শুরু হয়। রুমাল বের করে ঘাম মুছি। ঘড়িতে দেখি, সবে একঘন্টা হয়েছে আমরা এখানে এসেছি। আমি পোড়া জায়গাটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসি।
আলগা মাটির স্তূপ নিকটেই। ও তার চারিদিকে অসংখ্য বিষাক্ত পিঁপড়ে থিকথিক করছে। য্যানো, একটি নৃশংস লাল রুমাল মাটিতে বিছানো। বৃষ্টির জলে তাদের নিশ্চিন্ত বসবাস বিপর্যস্ত হয়েছে বলে মনে হয়। আমি কাছ থেকে নিরীক্ষণ করি। শিহরণ জাগে।
একটি ব্যাঙ সেইদিকে দু-এক কদম এগিয়ে থেমে যায়। বিপদের আঁচ পেয়ে দ্রুত সরে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি তাকে বাধা দিই। ও একটি শুকনো কাঠি দিয়ে বারবার পিঁপড়ের ঢিবির দিকে ঠেলে দিতে থাকি। ব্যাঙটি মরীয়া হয়ে ওঠে। আমি এতে মজা পেয়ে যাই।
শিকারের স্বাদ পেয়ে পিঁপড়েরা ক্রমশ তাকে ঘিরে ধরছিলো। শরীরের নরম অংশগুলি, যথা চোখের কোণ, মণি, জিভ ইত্যাদি, ছিলো তাদের আক্রমণের প্রাথমিক লক্ষ্য। গ্রন্থিময় শরীর বিষের প্রকোপে এইভাবে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। একসময়ে, ব্যাঙটিকে আর দেখতে পাই না। বরং, একটি কদাকার লাল মন্ড দু-একবার গড়িয়ে থেমে যায়। ও তখনো তিরতির করে কাঁপছিলো। আমি উঠে দাঁড়াই।
এইসময়ে, বমনের উদ্রেক হয়। তীব্র অম্লের ঝাঁঝে আমার নাকমুখ বন্ধ হয়ে আসে।
বমি করার পর অত্যধিক শিথিল ও দুর্বল লাগে। কোনোক্রমে হ্রদের তীরে গিয়ে মুখেচোখে জল দিই। দেখি, জলের রং ঘোলাটে। তদুপরি, হালকা সবুজ রঙের শ্যাওলার আস্তরণ পড়েছে। গা ঘিনঘিন করে ওঠে।
আমি হ্রদের তীরেই বসে পড়ি। জুতো ও পোষাক কাদায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।
এইভাবে অনেকক্ষণ কেটে যায়। সময়ের হিসেব থাকে না।
এখন, আস্তে আস্তে মেঘ সরে যাচ্ছে। বুঝতে পারি, বিকেলের দিকে চাপা হলুদ আলোয় ম্লান হয়ে উঠবে চারদিক। প্যাকেট থেকে শেষ সিগারেটটা বের করে ধরাই। পেছনে তাকিয়ে মুনিয়াকে আর দেখতে পাই না। এমনকি, বারংবার ডাকা সত্ত্বেও কোনো সাড়া মেলে না। দারুণ জলময় স্তব্ধতায় সম্পূর্ণ গ্রস্ত হই। মনে হয়, আশেপাশে আমি আর ওই পিঁপড়েরা ছাড়া অন্য কেউ য্যানো জীবিত নেই। ছিলো না কোনোদিন। শহরে ফেরার তাগিদ অনুভব করি।
আরেকবার, শেষবারের মতো, হ্রদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। হাওয়া মৃদুমন্দ। জল অল্প অল্প কাঁপছে। নিজের ছায়া স্পষ্ট দেখতে পাই না। ভেঙে ভেঙে যায়।
এই ভ্রমণ, ও সংশ্লিষ্ট গোটা ব্যাপারটাই একটা বাজে রসিকতা বলে মনে হতে থাকে।
চিত্রঃ মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায়