রন মেয়েটিকে দুশো টাকা দিতে রাজি হয়। ও দুজনে একটি ট্যাক্সি করে আউট্রাম ঘাটে যায় হাওয়া খেতে। যেতে যেতে রন মেয়েটির নাম জিজ্ঞাসা করলে মেয়েটি বলে, "নন্দিনী।" রন খেয়াল করে, মেয়েটির মুখের মধ্যে বাস্তবিক নন্দিনীর আদল রয়েছে।
স্মৃতি অবলুপ্ত। পেশী সঙ্কুচিত হয়। লাফানোর ঠিক আগের মুহূর্ত।
নদীর ধারে সিঁড়িতে বসে নন্দিনী "দিল চিজ ক্যায়া হ্যায় আপ মেরি জান লিজিয়ে" ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ গান গেয়ে শোনায়। রন অভিভ¨ত হয়ে যায়।
এরপর স্মৃতি থেকে সে নন্দিনীকে বাসুদেব দাশগুপ্তের লেখা "বমনরহস্য" গল্পটি (রন্ধনশালা, ১৯৭৫) শোনায়। গল্পটি এইভাবে শুরু হয়েছিল --
"আকাশে বিমান উড়ল গর্জন করে। চারিদিকে আওয়াজে কাঁপিয়ে ল্যাজের কাছ থেকে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বিমান উঁচুতে উঠল আরো। অল্পক্ষণের মধ্যেই সু¤কুমারের বাড়িটাকে একটা ছোটবেলার খেলনার মতো মনে হয়। জানলা দিয়ে আমরা কয়জনা তাকিয়ে রইলুম নিচে।"
ও গল্পের শেষ অংশটি ছিল এইরূপ--
"শরীরের সমস্ত নালী-প্রণালী যেন পাক দিয়ে ওঠে। চোখের সামনে সমস্ত দোকানঘর বোঁ বোঁ করে ঘুরতে থাকে। সব আলো অন্ধকার হয়ে নেমে আসে চকিতে। শেষবারের মতো সামলাবার চেষ্টা করি নিজেকে। কিন্তু পারি না। বিয়ে-বাড়িতে যা খেয়েছিলাম সব গলগল করে বেরিয়ে আসতে থাকে। ওয়াক, ওয়াক শব্দ তুলে আমি বমি করে যাই। বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবনভোর ধরে খেয়ে যাওয়া যাবতীয় মাংসের টুকরো আমি বমি করে উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নি:শ্বাস যেন আটকে আসে। আমি বমি করি।"
রন লক্ষ্য করে, নন্দিনীর স্মৃতিশক্তি ভালো। ও পরেরদিন সে তাকে বাসুদেবের অন্যান্য গল্প, এমন কি অবনী ধর ও সুবিমল মিশ্রের কিছু গল্প শোনাবে, এইরূপ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
পরের দিন ।। দেয়ালে নখের আঁচড়, গ্র্রাফিত্তি
পরের দিন, অর্থাৎ ২৫শে আগস্ট, কলকাতার বিভিন্ন ছোটবড়ো লাইব্রেরিতে আচমকাই আগুন লেগে যায়। এ ধরণের অন্তর্ঘাতমূলক কাজকর্ম কে বা কারা করেছিল, আর তাদের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল, এ নিয়ে ধোঁয়াশা কাটে না। কাগজে এ ব্যাপারে বিস্তর লেখালিখি হয়। ও বর্তমান সাহিত্যের অবক্ষয়ী চেতনা এবং ক্রমহ্রাসমান পাঠকসংখ্যাকে এই নাশকতার জন্যে পরোক্ষে দায়ী করা হয়।
বিকেলে নন্দিনীর সঙ্গে দেখা করতে রন কার্জন পার্কে গিয়েছিল। কিন্তু নন্দিনী তাকে চিনতে পারেনি। গতরাতের কোনো স্ম«তিই ছিল না তার। তবুও তারা আউটÊ¡ম ঘাটে যায়। ও সেখানে রন একটি নৌকো ভাড়া করে। মাঝনদীতে গিয়ে আচমকাই বড়ো ঢেউয়ের ধাক্কায় নৌকোটি দুলে উঠলে গলুইয়ের কিনারায় বসে থাকা নন্দিনী জলে পড়ে যায়। রন পাশেই বসেছিল। তখন জোয়ার সমাগতপ্রায়। তাই মাঝি ঝুঁকি নেয়নি। নৌকোটি নিরাপদে ঘাটে ফিরিয়ে আনে।
সেদিন সারা সন্ধ্যে ও এমন কি অনেক রাত পর্যন্ত রন অপেক্ষা করেছিল। ভেবেছিল পুলিশ আসবে।
কিন্তু পুলিশ আসেনি।
অবশেষে, ভোরের দিকে, সে ঘুমিয়ে পড়ে।
তখনো আকাশ ধোঁয়াটে। ও খবরে বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল।