উপন্যাস-নামক সাহিত্যমাধ্যমটি এতই বৈচিত্র্যময়, যে তাকে নির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞায় আঁটিয়ে ফেলা নিতান্তই দুষ্কর। যদি ভাবা যায়, যেকোনো উপন্যাসই আসলে একটি কাহিনী ও তার কথনশৈলীর পারস্পরিক টানাপোড়েন বা আন্তঃক্রিয়ার ফলশ্রুতি, তাহলে একটি স্পেক্ট্রাম বা পরিসরের কথা মাথায় আসতে পারে। সেই পরিসরের একদিকে রয়েছে নিটোল কাহিনী-নির্ভরতা, আর অন্যদিকে, তথাকথিত আঙ্গিক-সর্বস্বতা। এখন, বিশুদ্ধ কাহিনী-নির্ভর বা বিশুদ্ধ আঙ্গিক-সর্বস্ব উপন্যাস বলে বাস্তবে কিছু হয় কি না, আমি জানি না। হয়তো, উপন্যাস-পরিসরের এই দুটি প্রান্তসীমা, আসলে দুটি তাত্ত্বিক অবস্থান-মাত্র। পাঠক-হিসেবে, আমার কেবল এটুকুই মনে হয়, যেকোন সৎ-উপন্যাসই, এই দুই প্রান্তসীমার মধ্যবর্তী কোনো না কোনো বিন্দুতে অবস্থান করে—কেউ কেউ ঝুঁকে থাকে কাহিনীর দিকে, কারোর আবার পক্ষপাত শৈলী বা আঙ্গিকের প্রতি। এবং, আমি এ-ও মনে করি যে, একটি উপন্যাসের গুণমান নির্ধারিত হয় কাহিনী আর আঙ্গিকের সঠিক ভারসাম্যরক্ষায়। কিন্তু, কতটা কাহিনী আর কতটা শৈলীর সংমিশ্রণে এই ভারসাম্যটি যথাযথভাবে রক্ষা করা যাবে, সে-ব্যাপারে কোনো নির্দিষ্ট ফতোয়া, স্বাভাবিকভাবেই, জারি করা সম্ভব নয়। প্রশ্নটা আসলে একজন ঔপন্যাসিকের উদ্দেশ্য ও তাঁর কবজির জোরের।
এই কথাগুলো মাথায় এল, রাজর্ষি দাশভৌমিকের সদ্য-প্রকাশিত উপন্যাস ‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’ পড়তে গিয়ে। এবং, সাম্প্রতিককালে পড়া দেশি-বিদেশি উপন্যাসগুলির মধ্যে, এটি আমার অন্যতম প্রিয় হয়ে রইল। অথবা, আরেকটু সংকীর্ণভাবে ভাবলে, এত ভালো বাংলা উপন্যাস আমি অনেকদিন পড়িনি। রাজর্ষি জানেন, কীভাবে একটি কাহিনী বুনতে হয়, এবং সেই বয়নের ভাঁজে-ভাঁজে, কুশলী জাদুকরের মতো, লুকিয়ে রাখতে হয় আঙ্গিকের অন্তর্ঘাত। ফলে, কাহিনীর সম্মোহনে আবিষ্ট হতে-হতেও, পাঠকের চোখে পড়ে, তার সূক্ষ্ম কারুকাজ, যেন পুরোন এক মন্দিরের দেওয়ালে, শ্যাওলার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেওয়া যক্ষিণীর সুডৌল বুক বা দ্বারপালের পেশল শরীরের আভাস।
‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’ একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস। সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে, বাংলার প্রাক-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পর্যায়ে, যখন পর্তুগীজ ও মগরা এদেশের জলজঙ্গল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, এ-আখ্যান সেই সময়ের। আখ্যান অবিশ্যি একটি নয়, বরং, তিন-চারটি কাহিনীসূত্র, সমান্তরালভাবে, প্রসারিত হয়েছে। ফলে, এই উপন্যাসে, সেই-অর্থে কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই। একাধিক স্বর, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ ও বাচনভঙ্গীর সহাবস্থানে, কাহিনীশরীরে একধরণের অসমানতা ফুটে ওঠে, যা কতকটা স্ফটিকের মতো, বহুকৌণিক।
সময়, যেকোন আখ্যানেই, একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কিন্তু ঐতিহাসিক উপন্যাসে, সময় নিজেই যেন একটা চরিত্র হয়ে ওঠে। ফলে, আগ্রহ থাকে, লেখক তাঁর আখ্যানশরীরে কীভাবে সময়কে ব্যবহার করছেন, তা দেখার। রাজর্ষির আখ্যানে, সময়ের প্রবাহ সর্বদা সরলরৈখিক নয়। মাঝেমধ্যেই দেখি, একটি অধ্যায় থেকে পরবর্তী অধ্যায়ের মধ্যে, লুকিয়ে রয়েছে সময়ের চোরা ফাটল বা চ্যুতি। যেমন, উপন্যাসের প্রথমার্ধে, টিবাও-ভিষকু-ক্রিশ্চিয়ানোকে কেন্দ্র করে বোনা কাহিনীসূত্র আর নগেন পাড়ুই বা শ্যামল-ওফেলিয়ার কাহিনীসূত্রের মধ্যে কয়েক-বছরের ফাঁক রয়েছে, যার ফলে কাহিনী এগোয় তাঁতের মাকুর মতো, আগুপিছু, কাহিনী ও সময়ের স্তরগুলিকে বুনতে-বুনতে। শুধু তাই নয়, এই আলাদা ও সমান্তরাল কাহিনীগুলি, নিজেরাও, একটানা সোজাপথ ধরে এগোয় না। বরং, সময়ের ছোটো-ছোটো সোঁতা আর ঝোরাগুলোকে লঘুপায়ে লাফিয়ে ডিঙিয়ে যেতে থাকে। ব্যাপারটা শুনতে বা ভাবতে যত সোজা বলে মনে হয়, আদতে তা নয়। লেখকের দক্ষতা ও নৈপুণ্যকে, এ-বাবদে, সাধুবাদ না-জানিয়ে উপায় থাকে না।
ঐতিহাসিক উপন্যাসে, সময়ের আরেকটি ব্যঞ্জনা প্রায়শই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই যে আমি, একবিংশ শতাব্দীর বর্তমানে বসে, পাঁচশো বছর আগের একটি সময়কালকে অবলোকন করছি, এতে করে, যেন একটা সময়, অন্য এক কালপর্বের ভেতর অনুপ্রবিষ্ট হল, যেন তাদের মধ্যে একটা আদান-প্রদান বা সংলাপের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। আমার বিশ্বাস, যদি লেখক খেলুড়ে হন, এবং যদি তাঁর দম থাকে, তাহলে তিনি চাইবেন, এই পারস্পরিক সংলাপটিকে মান্যতা দিতে, তাকেও আখ্যানের অংশ করে তুলতে। এই ঘটনাটি ঘটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই, বাংলায়, ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রসঙ্গ উঠলে, শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বদলে আমার প্রথমেই মনে পড়ে অমিয়ভূষণ মজুমদারের কথা। আর কী আশ্চর্য, ‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’ পড়তে বসে, আমি কেবলই ভাবতে থাকি 'মধু সাধুখাঁ'-নামক সেই অত্যাশ্চর্য নভেলেটটির কথা, হয়তো বা কালপর্বের সাদৃশ্যহেতু, হয়তো-বা নদীনালা-খালবিল-জল-নৌকার অনুষঙ্গে, অথবা আরো গভীর ও গূঢ় কোনো আত্মীয়তার ইঙ্গিতে। রাজর্ষি-র উপন্যাসের একজায়গায়, পর্তুগীজ পাদ্রী ডোম আর মুসলমান ক্রীতদাস আবদুলের একটি সংক্ষিপ্ত কথোপকথন রয়েছে, যার নীরব শ্রোতা ও দর্শক নগেন। এই অংশটি পড়তে গিয়ে, আমার স্মরণে আসে, খ্রীষ্টধর্ম নিয়ে, মধু সাধুখাঁ-র সঙ্গে ফিরিঙ্গি বলাই ওরফে রালফ ফিচের আলোচনার অংশটি। এই দুটি অংশের কাহিনীগত সাদৃশ্য বা বৈপরীত্য যা-ই হোক না কেন, আদতে তারা, সমকালীন পাঠকের জন্যে পেতে রাখা চোরাগোপ্তা সময়-ফাঁদ, যাতে পা দেওয়া-মাত্র পাঠক বুঝতে পারবেন ইতিহাসের ভাঁজে-ভাঁজে কী বিপুল বক্রাঘাত বা আয়রনি লুকিয়ে রয়েছে। রাজর্ষি তাঁর উপন্যাসটিকে "সমকালীন রূপকথা" বলে অভিহিত করেছেন। আমরা এখানে "সমকালীন" শব্দটির একটি অন্যতর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, যা লেখকের উদ্দেশ্যের থেকে আলাদা, কিন্তু খুব একটা বেমানান হয়তো নয়। "রূপকথা"-র প্রসঙ্গেও আসব, তবে একটু পরে।
রসগ্রাহী পাঠকমাত্রেই জানেন, ঐতিহাসিক উপন্যাসকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে গেলে, তথ্যের খুঁটিনাটি ও সত্যতা-সম্পর্কে লেখককে কতখানি নিষ্ঠাবান হতে হয়। আমি আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতে যতটুকু বুঝি, রাজর্ষি এই কাজে সম্পূর্ণ সফল। সপ্তদশ শতকের বাংলা, বিশেষ করে, সমতটের বাকলা-বাখরগঞ্জ থেকে, সন্দ্বীপ ও চট্টগ্রাম হয়ে, আরাকান বা রাখান-দেশ অবধি বিস্তৃত ভূখণ্ডের ভুগোল ও ইতিহাস, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে এই উপন্যাসে। শুধু তা-ই নয়, সামাজিক আচার-ব্যবহার, খাদ্যাভ্যাস, বাচনভঙ্গী, এমনকী নৌবিদ্যার খুঁটিনাটি বর্ণনাতেও, লেখকের মনোযোগ ও যত্নের ছাপ সুস্পষ্ট। অথচ, তথ্যের এমত প্রাচুর্য কখনও বাহুল্য হয়ে ওঠেনি। বরং, পটভূমির বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে, গল্পের চরিত্রগুলিকেও আরো বেশি রক্তমাংসের বলে মনে হয়েছে।
আর চরিত্রও তো বড় কম নয়, এবং তাদের বৈচিত্র্যও! বাঙালি-পর্তুগীজ-মগ-মোগল, হিন্দু-মুসলমান-ক্রিশ্চান-বৌদ্ধ, পাদ্রী-লুটেরা-নবাব-ক্রীতদাস—কে নেই এই আখ্যানের চৌহদ্দিতে! কিন্তু প্রায় সমস্ত চরিত্রই—বাংলার হিন্দু যুবক শ্যামল, তার আধা-ফিরিঙ্গি প্রেমিকা ওফেলিয়া, ভাগ্যান্বেষী নগেন পাড়ুই, সন্দ্বীপের পর্তুগীজ শাসক সেবাস্তিয়াও গোনসালভেস টিবাও—অত্যন্ত সূক্ষ্ম আঁচড়ে চিত্রিত ও রূপায়িত। যদিও চরিত্রগুলিকে রক্তমাংসের বললে, আলোচকের ওপর, সামান্য মিথ্যাচারের দায় অর্শায়। কেননা, মানুষী চরিত্রগুলির পাশাপাশি, বেশ কিছু আধি-দৈবিক বা আধি-ভৌতিক চরিত্রও ঘোরাফেরা করে এখানে। তাদের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে, পাঠকের পড়ার মজাটিকে নষ্ট করতে চাই না। তবে, উপন্যাসটি পড়ার সময়ে, যদি কারোর মনে পড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথা, এমনকী মার্কেজের কথাও, আমি তাঁকে দোষ দেব না। বরং রাজর্ষি, কী অনায়াস দক্ষতায়, ঐতিহাসিক বাস্তবের সঙ্গে পরাবাস্তবকে মিলিয়ে দিতে পেরেছেন, সে-কথা ভেবে আমি যারপরনাই আনন্দিত হব। উপন্যাসটিকে "রূপকথা" বলে অভিহিত করার তাৎপর্য, এইবার, বোধহয় খানিকটা পরিষ্কার হল। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাক, আরাকানের জঙ্গলে মাংসভূক পিঁপড়ের আক্রমণের ঘটনাটিকে, 'একশো বছরের নিঃসঙ্গতা'-র প্রতি লেখকের প্রচ্ছন্ন শ্রদ্ধার্ঘ্য বলেই মনে হয়েছে আমার।
উপন্যাসটি পড়ার পর, একটি ছোট প্রশ্নের উত্তর পাইনি বলে, মনটা খানিকটা খচখচ করছে। ওফেলিয়ার মা সর্বাণী যখন তিনমাসের গর্ভবতী, সেই সময়ে ওফেলিয়ার বাবা নিরুদ্দেশ হয়। ওফেলিয়ার জন্মের আগে, বা অব্যবহিত পরেই, তার মা ধূমাঘাট ছেড়ে সেগ্রামে এসে বাসা বাঁধে। যেহেতু সর্বাণী খ্রীষ্টান হয়নি, এবং সেগ্রামে খ্রীষ্টধর্মের অনুপ্রবেশের কোনো সূত্র উপন্যাসে পাওয়া যাচ্ছে না, অতএব অনুমান করা যায়, ওফেলিয়ার ব্যাপ্টিজমও হয়নি। তাহলে, ওফেলিয়া নামকরণের রহস্যটি কী? সর্বাণীর নিজের পক্ষে এমন নামকরণ করা সম্ভব নয়, কোনো খ্রীষ্টান পাদ্রীর পক্ষে সম্ভব হলেও হতে পারত। কিন্তু, লেখক এ-ব্যাপারে নীরব। কাহিনীর খুঁত বলতে শুধু এটুকুই। তবে, কে না জানে, সামান্য একটু খুঁত না-থাকলে, কোনো সৌন্দর্যই পরিপূর্ণতা পায় না!
এই উপন্যাসের কাহিনী যেমন একমুখী ও সরলরৈখিক নয়, তেমনি এর কোনো নির্দিষ্ট উপসংহারও নেই। মনে হতে পারে, উপন্যাসটি যেন আচমকা শেষ হয়ে গেল, কোনো সুস্পষ্ট পরিণতি ছাড়াই। আবার, একটু ঘুরিয়ে ভাবলে মনে হবে, আসলে বুঝি এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। ইতিহাস এক আদি-অন্তহীন প্রবাহমাত্র। শ্যামল-ওফেলিয়া-নগেন-টিবাও-খামেঙ—এরা সবাই সেই ইতিহাসের প্রবাহে ভেসে আসা চরিত্র। এই প্রবাহের যতটুকু আমাদের চোখে পড়ে, তার আগে-পরে আরো বহু ঘটনা রয়েছে, চরিত্র রয়েছে। চরিত্র ও ঘটনার সেই মহামিছিলের খানিকটা, একটা স্থিরচিত্রের মতো, লেখক আমাদের সামনে তুলে ধরলেন। বাকিটুকু কল্পনা করে নেওয়ার দায়, হয়তো-বা পাঠকের।
আর বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। উপন্যাসটি সবরকম পাঠকের কাছে আদৃত হোক, এটুকুই চাওয়ার।
‘পাইয়া ফিরিঙ্গ ডর’
রাজর্ষি দাশভৌমিক
সৃষ্টিসুখ, ২৫০ টাকা