নির্মলা মিশ্র বাংলায় অনেক গান করেননি। কিন্তু শুনেছি ওড়িয়া সংগীতে, বিশেষতঃ ছবির গানে, ওনার একচ্ছত্র রাজ্যপাট। শুনে খুবই ভাল লাগে। এ কথা তো ঠিক বাংলায় সুরেলা গায়িকার অভাব কোনদিনই হয়নি। এখনকার কথা হচ্ছে না। আমি আমাদের মতন আধবুড়োদের শোনা গানের কথা বলছি। সন্ধ্যার সাম্রাজ্যের পাশে প্রতিমা, আরতীরা নিজের রেপের্টয়ার তৈরি করতে পেরেছিলেন। এনারা সকলেই অসম্ভব সুরেলা কন্ঠের অধিকারী। সন্ধ্যা এবং আরতী দুজনেই গলায় নাটক আনতে পারতেন অনায়াসে। প্রতিমার সেদিকে খামতি থাকলেও, স্রেফ সুরের প্রয়োগে ঘায়েল করতে পারতেন যে কোন মানুষকে। সঙ্গেই ছিলেন মাধুরী চট্টোপাধ্যায়, আলপনা বন্দোপাধ্যায়, সবিতা চৌধুরীরা। এর পরেও বম্বে থেকে লতা মঙ্গেশকর ও আশা ভোঁসলে মাঝে মাঝে এসে অনন্য সুরের ফুল ফুটিয়ে গেছেন। হয়ত এই ল্যান্ডস্কেপে নির্মলা মিশ্র আলাদা জায়গা করতে পারলেন না। তাছাড়া সময়েরও একটা ব্যাপার আছে। নির্মলা যখন এসেছেন তখন সন্ধ্যা, প্রতিমারা মধ্যগগনে। আরতী আর নির্মলা সমসাময়িক। আর নির্মলার জমি তৈরি করতে করতেউ পরের প্রজন্মের হৈমন্তী শুক্লা, অরূন্ধতী হোমচৌধুরীরা এসে পড়েছেন।
অথচ নির্মলার প্রস্তুতি ছিল চষা। গানের ঘরের মেয়ে। গান সঙ্গে বড় হয়েছেন। বাবা পন্ডিত মোহিনীমোহন মিশ্রর খ্যাতি ছিল ধ্রুপদী গাইয়ে হিসেবে, আর তার থেকেও বেশি গানের শিক্ষক হিসেবে। দাদারাও গানের জগতের। অতি অল্প বয়সে নচিকেতা ঘোষের সুরে গান করে কমার্শিয়াল গানে আসেন। নচিকেতা ঘোষের সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছিল। ডাকাবুকো ও ঠোঁটকাটা ছিলেন। সুর, তালে দখল ছিল অসামান্য। দমও ছিল ভাল। গলায় পরিমিত নাটক ছিল। আমি নির্মলার জীবনী লিখতে বসিনি। তাঁর গায়কীর মূল্যায়নও আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বহু গানে নির্মলা যে সাধারণ থেকে দীক্ষিত শ্রোতাদের আনন্দ দিয়েছেন, এ লেখায় তার স্মরণ করিয়ে দেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। জনপ্রিয়তায় 'ও তোতাপাখিরে' বা 'এমন একটা ঝিনুক খুঁজে পেলাম না'র সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে এরকম গান নির্মলা আর গাননি। কিন্তু শুধু জনপ্রিয় সৃষ্টিই তো শিল্পীর একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে না। এখানে নির্মলার অল্পশ্রুত চারটে গানের উল্লেখ করব, যা ব্যক্তিগতভাবে আমার সবচেয়ে প্রিয়। চার দিকপাল সুরকারের চারটে গানের ধরণ আলাদা, তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা।
১৯৭০ সালে রেকর্ড করেছিলেন হিমাংশু দত্তর সুরে 'নিশীথে চলে হিমেলবায়'। আজকের দিনে হলে বলা হত 'রিমেক'। তখন এই শব্দটা গানের ক্ষেত্রে তৈরি হয়নি। অবশ্য এটাকে রিমেক বলা যাবে না, কারণ যন্ত্রানুষঙ্গ বদলেছিল। 'কভার' বলা যায়।
মূল গান গেয়েছিলেন সাবিত্রী ঘোষ, ১৯৩৬ সালে। হিমাংশু দত্তর সুরে, মমতা মিত্রর কথায়। গানটির ইতিহাস উল্লেখের দাবী রাখে। হিমাংশু দত্তর গানে চাঁদ ও চামেলীর অনুষঙ্গ ফিরে ফিরে আসে। এই অনুষঙ্গে একটি ব্যর্থ প্রেমের ইতিহাস বিধৃত আছে বলে মনে করা হয়। চাঁদ হলে্ন হিমাংশু। কুমিল্লা থেকে কলকাতায় এসে যখন সংগীতজগতে প্রতিষ্ঠা পাবার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন গ্রাসাচ্ছাদনের জন্যে তাঁকে গানের টিউশন করতে হত। চামেলী ছিলেন তাঁর এক ছাত্রী। চাঁদ-চামেলীর প্রেম হয়, কিন্তু পরিণতি সুখের হয়নি। চামেলীর অন্যত্র বিবাহ হয়। তিনি হিমাংশু দত্তর গাওয়া গান ছেড়ে দেন। হিমাংশু দত্ত প্রেমে ব্যর্থতার কিছুদিন পরে মারা যান। সাবিত্রী ঘোষই সেই চামেলী। এবং 'নিশীথে চলে হিমেল বায়' হিমাংশু দত্ত সুরে সাবিত্রী ঘোষের প্রথম রেকর্ড। হিমাংশু দত্ত অধিকাংশ গানের গীতিকার তাঁর কুমিল্লার সুহৃদ অজয় ভট্টাচার্য, এবং পরে শৈলেন রায় ও বিনয় মুখোপাধ্যায়। বিনয় মুখোপাধ্যায় পরে 'যাযাবর' ছদ্মনামে সাহিত্যকর্মে খ্যাতি পেয়েছিলেন। মমতা মিত্র কেবলমাত্র দুটো গান লিখেছিলেন হিমাংশু দত্তর জন্যে। তার একটি এই গান।
ইমন-শংকরায় বাঁধা গানটা সহজ গান নয়। তার ওপর এ গানের ওপর ছিল ইতিহাসের ভার। কিন্তু কী অসাধারণ গেয়েছিলেন নির্মলা। গানটাকে প্রায় নিজের করে নিয়েছিলেন।
সলিল চৌধুরীর গান গাওয়াও সহজ নয়। প্রায় সব বড় গাইয়েই কোন না কোন সময়ে থমকেছেন। ১৯৬৩ সালে নির্মলা মিশ্র সলিলের সুরে দুটি গান গেয়েছিলেন। সাধারণতঃ সলিল চৌধুরী গান নিজেই লিখতেন। অন্য কবির কবিতায় সুর করেছেন, সে আলাদা কথা - যেমন সুকান্ত ভট্টাচার্য বা বিমল ঘোষ বা মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু অন্য গীতিকার সলিলের গানে কথা লিখছেন, এমন ঘটনা দুর্লভ। সে দিক দিয়ে নির্মলা মিশ্রর গান দুখানি ব্যতিক্রম। গান দুখানি লিখেছিলেন পুলক বন্দোপাধ্যায়। যে গানটার কথা আমি এখানে বলব, সেটা 'এ মন মোর জানিনা'। গানের শুরুর লাইনগুলো দীর্ঘ -
এ মন মোর জানিনা কোথা যে হারাল, ঠিকানা না দিয়ে শরমে কাঁদিয়ে
নয়নে নয়ন রেখে কতই খুঁজেছি, বৃথাই গেয়েছি বীণারে সাধিয়ে।
প্রতিটি লাইন আটচল্লিশ মাত্রার। এবং সঙ্গে সলিল চৌধুরীর সিগনেচার সুরের চড়াই-উৎরাই। আটচল্লিশ মাত্রার লাইন গাইতে গেলে দম নেওয়ার কায়দাটাও গোলমেলে। নির্মলা সেটা করে দেখান সহজেই।
১৯৬৯ সালে 'আঁধার সূর্য' ছবির জন্যে রবীন চট্টোপাধ্যায় নির্মলা মিশ্রকে দিয়ে গাওয়ালেন 'রিমিঝিমি রিমিঝিমি শ্রাবণের সুর বাজে'। ছায়ানট আর মল্লারের মিশ্রণে অসাধারণ কম্পোজিশন করেছিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়। নির্মলা গেয়েছিলেন দাপটে। পিতৃসূত্রে হয়ত নির্মলা এ ধরণের গানে নিজের জায়গা খুঁজে পেতেন। এ গান যে কেন আরও বেশ শোনা হয়না, বোঝা মুশকিল। এই কম্পোজিশন এবং গায়ন বাংলা ছবিতে রাগাশ্রয়ী যে সব বিখ্যাত গান হয়েছে, তার যে কোন গানের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসতে পারে।
শেষ যে গানটার উল্লেখ করব, সেটা ব্যক্তিগতভাবে আমার নির্মলা আবিষ্কারে বিশেষ জায়গা নিয়েছে। নির্মলা মিশ্রর গান প্রথম বিশেষভাবে ভাল লাগে যখন স্কুলে পড়ি - 'এ মন মোর জানিনা' শুনে। 'আমায় বাঁশের বাঁশি দাও বাজাতে' গানে নির্মলা মিশ্রকে পুনরাবিষ্কার করি বছর পঁচিশ আগে। ১৯৭৪ সালে নচিকেতা ঘোষের সুরে রেকর্ড করেছিলেন। ততদিনে নির্মলার গলা কিছুটা ভারী হয়েছে। ফলে লোকায়ত মেজাজের এই গানে এক দারুণ মাধুর্য এসেছে। আর সুরের অভিনবত্বের সঙ্গে যোগ হয়েছে নচিকেতা ঘোষের কম্পোজিশনে তালের মজা। গানটা শুনলে বুঝবেন নির্মলা গাইতে গাইতে কেমন সেই তালের মজাটা নিচ্ছেন। একই সঙ্গে গানের লোকায়ত মেজাজের সঙ্গে গলার মোচড় আনছেন এক এক জায়গায়, যা একান্তভাবে লোকসংগীতের ডিভাইস।
এই চারটে গান বেছেছিলাম কারণ আমার প্রিয় নির্মলা মিশ্রর গান হিসেবে এই চারটে একদম অপরে থাকবে। কিন্তু এখন লিখতে গিয়ে দেখছি চারটেই বাংলা আধুনিক গান হলেও - আঙ্গিকে চারটে চার ধরণের। আধুনিক গানের শিল্পী হিসেবে নির্মলা মিশ্রর যে কীরকম তৈয়ারী ছিল, হয়ত এই চারটে উদাহরণ থেকে বোঝা যাবে।