এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • টোপান-১

    পাগলা গণেশ লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৭ জুলাই ২০২৪ | ৪৩৯ বার পঠিত
  • | |
    মৃদু স্নিগ্ধ মনোরম মিউজিকের সাথে হালকা আওয়াজে বাজছে।

    রাত্রি এসে যেথায় মেশে দিনের পারাবারে
    তোমায় আমায় দেখা হল সেই মোহানার ধারে ॥
    সেইখানেতে সাদায় কালোয় মিলে গেছে আঁধার আলোয়--
    সেইখানেতে ঢেউ ছুটেছে এ পারে ওই পারে ॥
    নিতলনীল নীরব-মাঝে বাজল গভীর বাণী,
    নিকষেতে উঠল ফুটে সোনার রেখাখানি।
    মুখের পানে তাকাতে যাই, দেখি-দেখি দেখতে না পাই--
    স্বপন-সাথে জড়িয়ে জাগা, কাঁদি আকুল ধারে ॥

    হায়াত বিছানায় উঠে বসল। আস্তে আস্তে মেঝেয় নেমে গিয়ে দ্রুত ৩০ টা পুশ আপ দিল। ঘুম কেটে বেশ চনমনে লাগছে এবার। হিটারের সুইচটা হাত বাড়িয়ে বন্ধ করে দিল। ও আজ চারদিন হল এই ঘরটাতে এসেছে। বেশ সুন্দর ঘরটা। দক্ষিণদুয়ারী দোতলা বাংলো। চারিদিকে বাগান। বাগানে নানারকম ফুলের কেয়ারী, গাছের সারি। দেশবিদেশের নানা ফুল ফুটে রয়েছে। ঘরের ঠিক সামনেই ডানদিকেই গোলাপী-সাদা টিউলিপ ফুলের বাগান, আর বাঁদিকে বেগুনী-সাদা অ্যাস্টার্স ফুল। বাগানের চারিদিক উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। সে জানালার সামনে থেকে সরে গোয়ে ঘরের দেওয়ালে এক জায়গায় চাপ দিল। দেয়ালটা স্লাইড করে ঢুকে গেল দেয়ালের মধ্যে। একটা খুপরি মতো জায়গা, সেখান থেকে তোয়ালে নীল আর জামা-কাপড়। একটা সাদা শার্ট, নীল লিনেনের প্যান্ট, ইলেক্ট্রিক ব্লু রঙের টাই ও প্যান্টের সাথে ম্যাচিং নীল রঙের কোট। তোয়ালেটা ঘাড়ে ফেলে বাকি সব বিছানায় রেখে বাথরুমে চলে গেল। বাথরুমের দরজাটা এমনভাবে দেয়ালের সাথে মিশে আছে যে দেখে বোঝার উপায় নেই ওটা দরজা। মনে হয় যেন ওটা দেয়ালেরই অংশ। ভেতরে গিয়ে হায়াত দরজাটা বন্ধ করে দিল। গরম জলের শাওয়ারটা চালু করল। বেশ ভালো করে স্নান করল অনেকক্ষন ধরে। বেরিয়ে এসে মাথা মুছতে মুছতে একটা সুইচ টিপল। একজন মেয়ে খাবার নিয়ে এল। বয়স ত্রিশের উপরে, চল্লিশেরই বেশি কাছে, গায়ের রং ফ্যাকাশে, মুখের চামড়ায় অকাল বার্ধ্যকের ছাপ, পরনে সালোয়ার-কামিজ, হাতে একগোছা করে কাঁচের চুড়ি, পায়ে একজোড়া নুপুর, চোখে রাত্রি জাগরণের ছাপ। খাবারটা নিয়ে এসে সে টেবিলের উপর রাখল। একটা ওটসের প্যাকেট, তাতে লেখা 'হান্ড্রেড পার্সেন্ট অর্গানিক'; দুধের প্যাকেট একটি, তাতে লেখা 'ফ্রেশ ফরম ফার্ম'; একটা বোল আর চামচ। মেয়েটি ওটস বোলে ঢেলে তাতে দুধ দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল। ততক্ষণে হায়াত জামাকাপড় পরে তৈরি। এসে টেবিলে বসেই খেতে আরম্ভ করল। খুব জোরে খিদে পেয়েছে আজ তার। গোগ্রাসে কয়েক চামচ খাবার পর তার সম্বিৎ ফিরল, পাশে মিনু যে দাঁড়িয়ে আছে। লজ্জা পেয়ে হায়াত নিজের খাওয়া সংযত করল। ও মুখ না তুলেই জিজ্ঞেস করল, "মিনু, তোমার ছেলে কেমন আছে এখন? "
    মিনু-কেমন আর থাকবে বলুন? ওই আছে আর কি!"
    ধরা, হতাশ, ক্লান্ত গলা।
    মিনুর আসল নাম মৃন্ময়ী। থাকে শহরের একদম প্রান্তের এক বস্তিতে। স্বামী রাজমিস্ত্রি। খুব যে স্বচ্ছল তা নয় তবে বেশ সুখের সংসারই ছিল ওর। কিন্তু বছরখানেক আগে ওদের একমাত্র ছেলে পারভেজের লিউকোমিয়া ধরা পড়ে। তখন ওর বয়স মাত্র চার। একদিন খেলতে খেলতে অজ্ঞান হয়ে যায়। পাড়ার ছেলেরা ধরাধরি করে ঘরে দিয়ে যায়। এর মাস দুয়েক আগেই থুথুর সাথে সামান্য রক্ত উঠেছিল, ওজনও কমে যাচ্ছিল। কিন্তু ওরা কেউ গা করেনি। ভেবেছিল ছোট ছেলে ঠিকমত খাওয়াদাওয়া করছে না, তাই হয়তো এরকম হচ্ছে। গুরুত্ব দিয়েই কি করত? রোজগার যা হয়, তাতে চলে মোটামুটি যায়, কিন্তু নিয়মিত চেকআপ বা ফোঁড়া-ফুসকুড়িতেও ডাক্তারের কাছে ছুটে যাওয়ার মতো সামর্থ্য তো নেই!জ্বর হলে খুব জোর পাড়ার হাতুড়ি ডাক্তারের কাছে এক পুরিয়া-দু পুরিয়া ওষুধ, তাতেই ভালো হয়ে যায়। জ্বর-সর্দি-মাথাব্যথা, তার জন্য আবার ওষুধ!কিন্তু পারভেজের অবস্থা আস্তে আস্তে আরো খারাপ হতে থাকে। পাড়ার হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার এক নামকরা জেনারেল ফিজিসিয়ানকে রেফার করে দেয়। জেনারেল ফিজিসিয়ানও দেখে শুনে মাথা নাড়ে। সে আবার একজন অঙ্কোলজিস্টকে রেফার করে। সেখানে গিয়ে ডাক্তারের মুখে ক্যানসারের কথা শুনে দুজনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ক্যান্সার!প্রাথমিক ধাক্কাটা কাটিয়ে উঠে জিজ্ঞেস করে, "ডাক্তারবাবু চিকিৎসা কী আছে? আমাদের খোকন ভালো হয়ে যাবে তো? "যদিও জানে এর চিকিৎসা নেই, তবু মা-বাপের মন!

    ডাক্তার বলল, "দেখুন আমি অপনাদিকে মিথ্যা আশ্বাস দিতে চাই না। এ রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। শুধু সিম্পটমগুলো কমানোর জন্য কিছু ওষুধ দিচ্ছি সেগুলো খাওয়ান। কেমো করাতে পারেন। তাতে বিলম্বিত হতে পারে, কিন্তু সারবে না। "মিনু পাথর হয়ে গেল। রাজেশ কিছুক্ষণ পরে বলল, "ডাক্তারবাবু কত খরচ হবে? "ডাক্তার বলল, "তা ধরে রাখতে পারেন ওষুধ মাসে হাজার পঞ্চাশেক টাকার, কেমোর প্রতি সেশন ত্রিশ হাজারের মতো। সবমিলিয়ে মাসে দেড় থেকে দুলাখ টাকা। "রাজেশ মিনুর মুখের দিকে তাকাল। সেখানে দুচোখে দৃষ্টিহীন দৃষ্টি। রাজেশ তাকিয়ে থাকতে পারে না, মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ডাক্তারকে বলে, "কোনোভাবে কম করা যায় না? "
    ডাক্তার-"দেখুন আমি আপনাদের পরিস্থিতি দেখেই বলেছি। জেনেরিক ওষুধের দাম ধরে বলেছি বলে এত কম। নাহলে কোনো নামি কোম্পানির ওষুধ হলে তো দশ-বিশগুন বেশি দাম হত। কিছু ওষুধ তো পঞ্চাশগুন বেশি দাম। "দুজনে উঠে পড়ে। যন্ত্রচালিতের মতো বাড়ি ফিরে আসে। পারভেজ জিজ্ঞাসা করে, "মা আমার কী হয়েছে? "মিনু এতক্ষণ চুপ ছিল, কিন্তু এবার আর থাকতে পারে না, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। রাজেশও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তারও চোখে জল। পারভেজের যখন জন্ম হয় চারবছর আগে, তখন ওদের টানাটানির সংসারে খুশির লহর বয়ে গিয়েছিল। ওদের ভাব-ভালোবাসার বিয়ে।

    মিনুর বাড়ি নিশানগঞ্জের মোটামুটি একটা ভদ্রস্থ পাড়ায়। বাবা দুঁদে ব্যবসায়ী। নিশানগঞ্জ বাজার বেশ বড় একটা হার্ডওয়্যারের দোকান আছে। প্রায় তিনপুরুষের ব্যবসা। মা গৃহবধূ। বেশ অভিজাত পরিবার। বাপের খুব আদরের মিনু। ওরা দু বোন, মৃন্ময়ী আর মীনাক্ষী।

    যখন ও ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, একদিন টিউশন পড়ে ফিরছে, রাত তখন প্রায় আটটা। ওর সাথে আছে ওর বান্ধবী মিতা। আরো বন্ধুরা ছিল সাথে, কিন্তু মাঝরাস্তায় যে যার আলাদা আলাদা পথে চলে গেছে। এখন শুধু ওরা দুজন। অবশ্য ওদের দুজনকে যেতে হবে আর দুশো মিটার মতো। কিন্তু আসার পথে দুচারজন লোফার ধরণের ছেলে প্রায়ই বসে আড্ডা দেয়, টিটকিরি মারে। মিতা একটু মুখরা, সে উত্তর দিতে চায়। কিন্তু মিনু তাকে কিছু বলতে দেয় না। বলে, "কী দরকার ওদের সাথে লেগে? নোংরা জানোয়ার সব!এখন কী করতে কী করে বসবে তার ঠিক নেই!চল আমরা যাই। "

    দুচারদিন পর। সেদিন টিউশনে পড়া না হওয়ায় স্যার মিতাকে খুব বকেছিলেন। তাই মিটার মাথাটা বেশ গরম হয়েই ছিল। জায়গাটায় আসতেই ছেলেগুলো টিটকিরি দিয়ে উঠল, "ওরে পাখি এসে গেছে। যাবে নাকি মামনি? "মিতা আর মিনুর কথা শুনলে ন। সোজা গিয়ে লদের সামনে দাঁড়িয়ে পা থেকে জুতো খুলে সামনের জনের গালে সপাটে এক জুতো মারল। আর যায় কোথা? ছেলেটি রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে মিতার চুল ধরল। মিতা যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠল। ছেলেটা দাঁতে দাঁত পিষে বলল, "হারামজাদী মাগী, বিরাট সাহস তো তোর!আজ চল, তোর সাহস আমি বড় করছি। ওই মাগীটাকেও ধর তো!নিয়ে চলে ওদিকের মাঠে, আজ দেখে নেব। "

    ওরা ধরে নিয়েই যাচ্ছিল। এমন সময় সেই রাস্তা দিয়ে কাজ শেষে ফিরছিল রাজেশ। ওর সঙ্গে আরও জনাদশেক ছেলে। ওরা একসাথে কাজ করে। এত দেরি করে ও সাধারণত ফেরে না, আজ একটা বাড়ির ছাদ ঢালাই হচ্ছিল, তাই কাজ শেষ করতে এতটা দেরি হয়ে গেল। তাও হত না, কিন্তু মাঝপথে সিমেন্ট ফুরিয়ে গিয়েছিল। যেখানে কাজ হচ্ছিল সেখান থেকে দোকান অনেকটা দূরে, তাই মাল নিয়ে আসতে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছিল।

    সে এবং তার সঙ্গে থাকা ছেলেরা দূর থেকেই ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছিল। ছুটে এসে ওদিকে "কী হয়েছে? " জিজ্ঞাসা করাতে ওরা বলল, "নিজের চরকায় তেল দে, সবজায়গায় মাথা গলানোর দরকার নেই। "শুনে রাজেশ ও তার সাথে থাকা ছেলেরা ওদের পিটতে আরম্ভ করে। খুব একচোট মারধর করার পর মিতা আর মিনুকে নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছে দেয়। সাথে থাকা দুটো ছেলেকে বলে, "গাড়ি ডেকে ওদের ডাক্তারখানা নিয়ে যা। "সবকিছু শুনে মিতা এবং মিনুর বাবা-মা ওদের আর সে রাতে না খেয়ে আস্তে দেয়নি। খাবার শেষে মিনুর বাবা রাজেশকে একধারে নিয়ে যায়।
    -"বাবা তুমি যা করেছ আজ, তার ঋণ আমি কোনোদিন শোধ করতে পারব না। তাই আমি ঋণ মেটানোর চেষ্টাও করব না। তা তোমার অপমান হবে। আমি কিছু তোমাকে দিচ্ছি, এটা নিতে হবে বাবা। "
    বলে পাঁচশ টাকার একটা তাড়া তাকে দিতে যায়।
    রাজেশ তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে বলে, "কী করছেন আপনি!আমি এ টাকা নিতে পারব না। এ হারাম!"
    মিনুর বাবা তারপরেও জোরাজুরি করেন। কিন্তু রাজেশ কিছুতেই সে টাকা নেয়নি।
    তখন মিনুর বাবা বলেন, "বাবা আমার তো ছেলে নেই, দুটি মাত্র মেয়ে। কিন্তু যদি ছেলে থাকত, সেও নিশ্চয় এমনই করত। তুমি তো কিছু নিলে না, আমি তোমাকে আমার ছেলে বলেই মানছি। তুমিও আমাকে বাবা বলেই জেনো। "
    -"আচ্ছা, তাই হবে। "বলে হেসেছিল রাজেশ।

    এরপর অবাড়িতে তার অবাধ আনাগোনা শুরু হয়। মিনুর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। মাঝে মধ্যে মিনু, তার বোন মীনাক্ষী ও রাজেশ সন্ধ্যেবেলা বেড়াতে যায়। কোনোদিন ফুচকা খায়, কোনোদিন আইসক্রিম, কোনোদিন সিনেমা দেখে। বেশ ভালোই কাটছিল।

    ব্যাপারটা প্রথম চোখে পড়ে মীনাক্ষীর। একদিন সে মিনুকে ছেলে ধরে। "তুই সত্যি করে বল। তোদের মধ্যে কী চলছে? "
    মিনুর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু সে মুখে বলে, "কই, কিছু না তো!কীসের কথা বলছিল তুই!"
    -"দেখ দিদি, সত্যি কথা বল। আমি কিন্তু বোকা নই, আর কানাও নই। "
    মিনু ততক্ষণে সামলে উঠেছে। সে বেশ ঝাঁঝিয়েই বলল, "বিরাট পাকা হয়েছিস তো!চড়িয়ে গাল ফাটিয়ে দেব জানিস!জানোয়ার কোথাকার!"

    মীনাক্ষী আর কিছু বলল না। কিন্তু তার চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। সে একদৌড়ে বেরিয়ে চলে যায় ঘর থেকে। মিনু লাফিয়ে উঠেছিল ধরার জন্য, কিন্তু ততক্ষণে সে নাগালের বাইরে চলে গেছে।

    মীনাক্ষী সোজা মায়ের কাছে গিয়ে সব বলে দিল। মিনু দুরুদুরু বুকে বসে আছে, এই বুঝি মা এল। সেও তৈরি হয়। মা যদি জিগ্যেস করে কী বলবে। কিন্তু মা বা মীনাক্ষী কেউ এসে না। দুপুরে মা স্বাভাবিকভাবেই বলল, "কিরে চান করবি না? "
    মিনু বলল, "যাচ্ছি। "
    স্নান করে, খেয়েদেয়ে সে নিজের রুমে চলে যায়। বিকেলবেলা টিউশনে যাবার জন্য ঘর থেকে বেরোচ্ছিল। মা বলল, "আজ টিউশন যেতে হবে না। "
    মিনু কিছু বলল না। বলার নেই কিছু। সে ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে। সারা সন্ধ্যা সে নিজের রুমে বসেই কাটাল। রাতে খাবার সময় তার ডাক পড়ল। বাবা টেবিলে বসে, মোবাইলের পর্দায় চোখ। মীনাক্ষী তার ঘরে পড়ছে। মা খাবার বের করছে। মিনু রান্নাঘরে চলে গেল মাকে সাহায্য করতে। মা কিছু বলল না। ভাত-তরকারির থালা, বাটি সব হাতে দিল। মিনু নিয়ে গিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখল। বাবা ডাকলেন, "মীনাক্ষী খাবি আয়। "
    মীনাক্ষী বেরিয়ে, বেসিনে হাত ধুয়ে টেবিলে বসল। যে যার থালায় ভাত বের করে খেতে আরম্ভ করল। বাবা নুন চাইলেন। মীনাক্ষীর হাতের কাছে নুনের পাত্রটা ছিল। সে বাড়িয়ে দিল। বাবা ভাতের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলেন, "তোমার সিক্সথ সেমের ফাইনাল এক্সাম কবে? "মিনু শুনল, কিন্তু বুঝতে পারল না। একমুহূর্ত পরে বাবা আবার জিগ্যেস করলেন, "কী বলছি যে? তোমার সিক্সথ সেমের ফাইনাল এক্সাম কবে? "মিনু বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, "বাবা আমাকে বলছ? "
    বাবা-"হুম, আর কে সিক্সথ সেমে পড়ে? "
    মিনু-"এখনো কিছু বলেনি; তবে এপ্রিলের মাঝামাঝি শুরু হবে বোধহয়!"
    বাবা আর কিছু বললেন না। সবাই খেয়ে নিজের নিজের রুমে চলে গেল। অন্যদিন খাওয়ার পর বসে ঘন্টাখানেক গল্প হয়; আজ কিছু হল না। মিনু অন্যদিন গল্প করতে করতেই মাকে এঁটো থালা-বাসন মাজতে সাহায্য করে। আজ সেও নিজের রুমে চলে এসেছে। সে বেশ কিছুক্ষণ থালা'বাটি, হাঁড়ির টুং টাং শব্দ শুনতে পেল। মা বাসন মাজছেন।

    এর দুচারদিন পর থেকেই পাত্রপক্ষ আসতে আরম্ভ করল। মিনুর বাইরে যাওয়া বন্ধ। ঘরে বসে শুধু পড়া, টিভি দেখা নাহয় মোবাইল ঘাঁটা। মিনু রাজেশকে ফোন করতে পারে না। হোয়াটসঅ্যাপ বা এসএমএসে বলে, "কী হবে? "
    রাজেশ বলে, "চিন্তা কোরো না, আমি ব্যবস্থা করছি। "
    এর মধ্যে মিনুর বিয়ে ঠিক হয়ে যায়, আগস্টের সতের তারিখ। মিনু উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকে। সে নিজের ঘরেই প্রায় গৃহবন্দী। তাকে ঘর থেকে বেরোতে দেওয়া হয় না, খাবার ঘরেই দেওয়া হয়, ফোনে রিচার্জও শেষ আজ দুমাস, কামরার সাথেই অ্যাটাচ বাথরুম, তাই রুমের বাইরেও যাওয়ার অনুমতি বা অজুহাত কোনোটাই নেই। ঘরে কেউ তার সাথে কথা বলে না। সে প্রায় তখন তার পাগল পাগল অবস্থা। সেই সময় একদিন প্রায় রাত আড়াইটার সময় তার ঘরের দরজায় খুঁত করে শব্দ হল। সেদিন সে প্রায় রাত দুটো পর্যন্ত কেঁদেছে, সেইমাত্র ঘুমটা এসেছে, শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখে সামনে বিছানার পাশে রাজেশ দাঁড়িয়ে। প্রথিম সে তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। তারপর যখন বুঝতে পারল যে সে আসলেই রাজেশকে দেখছে, সে স্থান-কাল ভুলে প্রায় চিৎকার করে রাজেশকে জড়িয়ে ধরল। একটু পরে স্বাভাবিক হয়ে রাজেশকে জিগ্যেস করল, "কোথায় ছিলে এতদিন? আমি চিন্তায় মরে যাই!তা তুমি এলে কী করে!"
    রাজেশ-"সে অনেক কথা, পরে ভালো করে বলব। এখন জামাকাপড় যা আছে সব গুছিয়ে নাও। তারপর আমার সাথে চলো। "মিনু তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে তার ব্যাগে ভরে নিল। তারপর সদর দরজা পেরিয়ে সোজা রেলস্টেশন। সেখান থেকে সোজা আক্রোপোলিস। এরকম বড় শহরে পৌঁছে যেতে পারলে আর কোনো চিন্তা নেই। এত লোকের ভিড়ে কেউ খুঁজে পাবে না তাদের। তবু সাবধানের মার নেই, তাই প্রায় তিনমাস তারা অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বেরোয়নি। শুধু রাজেশ সকাল সাড়ে আটটার সময় বাজার করতে যেত একবার। ওইসময় লোকের ভিড় থাকে সবচেয়ে বেশি, যদি কেউ তাদের খুঁজতে এসেও থাকে, খুঁজে পাবে না।

    ওই তিনমাস খুব সুখের ছিল। দুজনে মিলে ঘরের সব কাজ করত। মিনু রান্না করতে জানত না। তাই সে চাল ধুয়ে দিত, তরিতরকারি কুটে দিত, রাজেশ রান্না করত। রাজেশ রান্না করেও খুব ভালো।

    বাকি সময় ওরা গল্প করে কাটিয়ে দিত। ওদের ঘর কেমন হবে, তাতে আসবাব কেমন হবে, বিছানার চাদর, জানালার পর্দা, এমনকি বাথরুমের ফ্ল্যাশ ট্যাংক অব্দি। ওই সময়েই রাজেশ বলেছিল সেই রাতের কথা।

    যেদিন মিনুর রিচার্জ শেষ হয়, রাজেশ সেদিনই ওকে মেসেজ করেছিল, "তুমি তৈরি থাকবে, আমি আজকে রাতে যাব, দুটোর সময়। "
    কিন্তু মিনু জানতে পারেনি। রাজেশ রিচার্জ করতে গিয়ে জানতে পেরেছিল, ওই নাম্বারটাই গিভ আপ করে দেওয়া হয়েছে। সে নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু কোনোভাবেই সফল হয় না। মিতাকেও বলে; কিন্তু মিটার সাথেও মিনুর যোগাযোগ বন্ধ। তাই সেও কোনো সাহায্য করতে পারেনি। একদিন মিতা মিনুদের ঘরেও গিয়েছিল, কিন্তু মিনুর মা "মিনু নেই" বলে প্রায় দরজা থেকেই তাড়িয়ে দিয়েছিল। অনেক চেষ্টা করেও যখন রাজেশ কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি, তখন দিশেহারা হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, রাত্রে দেয়াল বেয়ে উঠে সিঁড়ি দিয়ে মিনুদের ঘরে ঢুকবে। সেদিন রাত্রেই সে মিনুদের ঘরের চারপাশ ঘুরে দেখে। ঘরের পিছন দিকে একটা নারকেল গাছ দেখে তাতে উঠে পড়ে। গাছটার প্রায় ডগায় পৌঁছে গেছে, এমন সময় একঝাঁক পিঁপড়ে এসে তাকে একেবারে ছেবে ধরে। সে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিল কামড় সহ্য করেও, কিন্তু মিনিট খানেক চুপ করে বসে থাকার পরেও কামড়ের যন্ত্রণা না কমে বাড়তে থাকে। তার সাথে আগের কামড়ের জ্বালা, সে আর সহ্য করতে না পেরে শেখ থেকেই ঝাঁপ দেয়। মাটিতে পড়ার সাথে 'মটাক' করে একটা আওয়াজ হয়, প্রায় সেকেন্ড দশেক পরে সে টের পায় তার পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। যন্ত্রনায় তার মনে হল আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করে। কিন্তু ধরা পড়ে যাবার ভয়ে সে দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা সহ্য করে। ওই যন্ত্রণা নিয়েই সে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাড়ি ফিরে যায়। ভালো করে সাবান মেখে স্নান করে গায়ের জ্বালা একটু কমতে সে শুয়ে পড়ে। ভাবে, "পায়ের ব্যবস্থা সকালে করা যাবে। "

    সকালে একটু বেলাতেই ঘুম ভাঙ্গে। তার ঘরের দরজা দিয়ে রোদ আসছে। সবাই কাজে চলে গেছে এতক্ষণ নিশ্চয়। ও তাড়াতাড়ি উঠতে যায়। কিন্তু যন্ত্রনায় কঁকিয়ে ওঠে। আবার বিছানায় কাছাড় খেয়ে পড়ে। ওর মোমে পড়ে কালকের ঘটনাটা। পায়ের যন্ত্রণাটা একটু সহনীয় হতে ও ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। সে পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখে সেটা ফুলে রাবণ, তিনগুণ হয়ে গেছে। এই পা নিয়ে কী করে বাইরে বেরোবে? একে তো নাড়ানোয় যাচ্ছে না!তার উপরে সারা গায়ে পিঁপড়ের কামড়ের দাগ। গোটা গায়ে ফুলে চাকা চাকা হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা আর কিছুদিনের মধ্যেই মিনুর বিয়ে!তার মধ্যে কি পা সারবে?

    সে কোনোমতে উঠে দাঁড়াল। যন্ত্রণায় চোখে জল চলে আসছে। মনে হচ্ছে বসে পড়ে, কিন্তু খুব চেষ্টা করে বাইরে আসতে পারল। ভেবেছিল হেঁটেই চলে যাবে, কিন্তু তাতে লোকের চোখে পড়বে বেশি, জিগ্যেস করবে কী হয়েছে? পাঁচকান হয়ে যাবে, শেষে মিনুর বাবার কানেও পৌঁছাবে কথাটা, তখন দুয়ে দুয়ে চার করে নিতে কোনো অসুবিধাই হবে না। কাল রাতে পড়ার সময় যে আওয়াজটা হয়েছিল, সেটা না শোনার কোনো কারণ নেই। ও ভয়ে দৌড়ে পালিয়ে এসেছিল বলে বাঁচোয়া। হয়তো মিনুর বাবা উঠে এসে বাইরেটা দেখেওছিলেন!

    রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে রইল রাজেশ। কোনো সাইকেল বা মোটরসাইকেল গেলেই দাঁড় করাবে। ও ভাবতে লাগল, "দিন দশ-পনেরর মধ্যে সেরে না উঠলে আর হল না। হাড় না ভেঙে যায়। তাহলে হয়েছে। "

    এমন সময় রমেন যাচ্ছিল বাইক নিয়ে। রাজেশ হাত দেখাল, রমেন দাঁড়িয়েই বলল, "আরে, রাজেশদা যে? কতদিন দেখা নেই? আর তুমি এমন সময় এখানে, কাজে যাওনি? "
    রাজেশ-"না রে, পা টাই মোচড় লেগে গেছে কাল। তাই যেতে পারিনি। আমাকে একটু হারুণ চাচার ঘরে ছেড়ে দিতে পারবি? "
    রমেন-"সে ছেড়ে দিচ্ছি, কিন্তু মোচড় লাগল কী করে? "
    বলে রমেন বাইকে অ্যাক্সিলেরেটরে মোচড় দেয়।
    রাজেশ-"ওই দেওয়াল মাজছিলাম একটা। জলখাবার বেলায় নামতে গেছি, ঝাঁপ দিয়েছিলাম। ব্যাস, গেছে মুচড়ে। কালকে আর কাজটাই হল না। কালকের মাজুরিটাও গেল। গোলমাল করলে অর্ধেকটা হয়তো দিত। কিন্তু কে চেঁচামেচি করবে বল তো? "
    রমেন-"তুমি না একদম ম্যাদামারা লোক!চেঁচামেচির ভয়ে কেউ মজুরি ছাড়ে? "
    রাজেশ-"কপালে না থাকলে কি কেউ পায় রে? "
    রমেন-"তা বলে চেষ্টা করব না? "
    হারুণের ঘরের সামনে এসে রমেন গাড়ি থামায়। রাজেশ একটু সময় নিয়ে নামল।
    রমেন-"চলো আমি তোমার সাথে যাচ্ছি। তোমার তো বেশ জোরেই লেগেছে সেট। হাড়ও ভেঙে গিয়ে থাকতে পারে, এক্স-রে করিয়ে নেবে একটা। "
    রাজেশ-"আচ্ছা। "
    রমেন রাজেশের মোচড় দেওয়া পায়ের দিকের হাতটা নিজের গলার পাশ দিয়ে ঘাড়ে তুলে নেয়। অন্য হাতে কোমরটা জড়িয়ে ধরে। রাজেশ ওর কাঁধে ভর দিয়ে হারুণের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। রাজেশ ডাকল, "হারুণ চাচা, ও হারুণ চাচা। "
    কোনো উত্তর নেই। এবারে রমেন ডাকে, "হারুন চাচা কি ঘরে নেই নাকি গো? "
    একজন স্ত্রী কণ্ঠে উত্তর দেয়, "আমার শ্বশুর ঘরে নেই। কেন কি দরকার নাকি? "
    রাজেশ-"দরকার বলতে আমি গাঁট বসাতে এসেছি। "
    স্ত্রীলোক-"এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন। বোধহয় সামনের চা দোকানে আছেন। "
    রাজেশ-"আচ্ছা ঠিক আছে। "

    হারুণ এখানের একজন খেটে খাওয়া চাষী। থাকে অ্যাক্রোপোলিসের লাগোয়া একটা গ্রামে। খেটে খায়। তবে ও একটা বিদ্যা জানে। কারো হাড় ডিসলোকেট হলে ও খুব ভালো বসাতে পারে। তার সাথে ব্যাথা এবং যন্ত্রণা কমানোর জন্য একটা ভেষজ মলম বানিয়ে দেয় নিজের থেকে, তাতে নাকি পেনকিলারের থেকেও ভালো কাজ হয়। তাই অনেক দূর দূর থেকে অনেক লোক ওর কাছে প্রায়ই আসে হাড় বসাতে।

    ওরা আবার বাইকে চড়ে বসে। বাইক উল্টোমুখে গিয়ে কিছুটা দূরে একটা ছোট চা দোকানের সামনে দাঁড়াল। রমেনই ডাকল, "হারুণ চাচা আছো নাকি ভেতরে? "
    ভেতর থেকে একজন জিজ্ঞাসা করল, "কে? "
    রমেন-"আমি রমেন। এই আমার একটা বন্ধু এসেছে, ওর পায়ের গাঁট সরে গেছে। "
    বৃদ্ধ-"ভেতরে নিয়ে আয়। "
    রমেন রাজেশকে নামতে সাহায্য করল। ধরে ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। চৌকাঠে একবার ঠোক্কর খেল রাজেশ। রমেন তাকে ধরে নিল। ও ভিতরে গেলে হারুন ওকে বেঞ্চিটায় বসতে বলল। ও বসতে হারুণ ওর পায়ের কাছে উবু হয়ে বসে পা টা ধরল। ধরে আস্তে আস্তে আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে দেখতে লাগল। পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, তার উপরে এরকম অসহ্য যন্ত্রণা। রাজেশ দাঁতে দাঁত টিপে রইল। এমন সময় 'খটাস' করে একটা শব্দ হল, সাথে সাথেই রাজেশ "ও মাগো" বলে প্রায় লাফিয়ে উঠল। হারুণ মিটিমিটি হেসে বলল, "হয়ে গেছে। এবারে একটু হেঁটে দেখ তো? "
    "আর হাঁটা!"রাজেশের মনে হচ্ছে যেন পাটা থেকে আগুনের ঝলকা বেরোচ্ছে। একটু পরে যন্ত্রণাটা একটু কমল। রাজেশ হারুণের কথামতো হাঁটার জন্য উঠল। কিন্তু আগের যন্ত্রণার কথা ভেবে, চোখ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে রেখে পা টা মাটিতে ঠেকাল। কিন্তু আশ্চর্য যেরকম ভেবেছিল তার সিকিভাগও ব্যাথা হচ্ছে না তো? যন্ত্রণাও প্রায় নেই বললেই চলে। হারুণ বলল, "চিন্তা নেই, দুচারদিনেই সেরে যাবে। "
    রাজেশের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল।
    রমেন জিজ্ঞাসা করল, "হাড়-টাড় ভাঙেনি তো? "
    হারুণ বলল, "মনে তো হয় না। তবু যদি সন্দেহ হয়, একবার এক্স-রে করিয়ে নিস। "

    দুচারদিন পর ব্যাথাটা প্রায় নেই হয়ে গেছে। ও এক্স-রেও করে দেখে নিয়েছে। হাড় ভাঙেনি। ওর কাজে যাওয়া বন্ধ। তাতে অবশ্য খুব অসুবিধা হচ্ছে না। ওর নেশা-ভাঙ নেই। তাই খাওয়া আর থাকা বাবদ যা খরচ তা ছাড়া প্রায় সবই জমে যায়। ওর সাতকুলে কেউ নেই। তাই বাড়িতে টাকা পাঠানোর কন ব্যাপারও নেই। ও যে ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে লোকটা খুব ভালো। তাছাড়া ও ঠিকাদারের কোনো কাজে না করে না। এমনিতেই ও খুব ভালো মিস্ত্রি, দেওয়াল গাঁথার কাজ ছাড়াও, দেওয়ালে নকশা করা, প্লাস্টার অফ প্যারিসের কাজ সবই করে। মাঝে মধ্যে এমন হয়, কোনো কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, কিন্তু কোনো উৎসবের জন্য অন্যেরা কাজ করেনি, আবার এদিকে ক্লায়েন্ট পার্টি তাগাদা দিচ্ছে, তখন ঠিকাদারের এক কথায় ও নিজের দলের ছেলেদের নিয়ে ঠিকাদারকে উদ্ধার করে দিয়েছে।

    ওর দলে জনা তিরিশেক ছেলে আছে। সবাই ওকে খুব মানে। কিন্তু এমনি কি? ও তাদের সবার প্রয়োজনের খোঁজ রাখে। বলার আগেই তাদের পাশে দাঁড়ায়। তাই ওরাও কখনো না বলতে পারে না।

    ঠিকাদার ওকে অন্য দলগুলোর থেকে একটু বেশিই মজুরি দিত। যেখানে অন্য দলগুলোর মাথাপিছু মজুরি পনের ক্যারাব, ওকে প্রায় সতের ক্যারাব দিত। রাজেশের কাছে অ্যাকাউন্টে এখন হাজার চারেক ক্যারাব আছে। তাই যদি দু বছরও বসে খেতে হয়, চিন্তা নেই। তাতো একটা শর্ত জুড়তে হয়। যদি কোনো বড় অসুখ না হয়!

    পরের দিন রাজেশ রাত দুটোর সময় ঘর থেকে বেরোল। খুব সাবধানে গিয়ে সে পৌঁছাল সেই নারকেল গাছের কাছে। এবারেও পিঁপড়ের কামড়ের জন্য তৈরি হয়েই এসেছিল। ভেবেছিল তাড়াতাড়ি গাছে উঠে পাতা ধরে সোজা লাফিয়ে পড়বে ছাদে। সে প্রায় মাথায় উঠে গেছে, ভাবছে এই বুঝি পিঁপড়ে কামড়াল!কিন্তু আশ্চর্য!একটাও পিঁপড়ে কামড়াল না। সে আরো উপরে উঠল, এবারে সে বুঝল। গাছে ডগার দুচারটা বাদে কোনো পাতা নেই। সেদিন মিনুর বাবা নিশ্চয় আওয়াজটা শুনেছিলেন। বিচক্ষণ মানুষ, দুয়ে দুয়ে চার করে নিয়েছেন। তার ফলেই এই ব্যবস্থা। রাজেশ হতাশ হয়ে বসে পড়ল গাছের ডগাতেই। কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবল, কী করা যায়? শেষে মরিয়া হয়ে ঠিক করল, ঝাঁপ দিবে। মরলে মরবে, সে তো এমনিতেও হবে।

    সে একটু পিছিয়ে নীচু হয়ে বসল, তারপর হঠাৎ একটা লাফ দিল। কয়েক মিলিসেকেন্ড শূন্যে থাকার পর ও টের পেল ওর ডান হাতটা পিলারের একটা বেরিয়ে থাকা রড ধরে আছে। আর সঙ্গে সঙ্গেই ও ধাক্কা খেল কার্নিশে। ওর বাকি শরীরটা শূন্যে ঝুলছে। যদি একবার হাত ছাড়ে, একদম তিনতলা থেকে নীচে গিয়ে পড়বে। না মরলেও, হাড় একটাও আস্ত থাকবে না। সে কোনোমতে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে সামনের একটা রড ধরল। বাঁ পায়ের পাতাটা তুলে দিল কার্নিশের উপরে, তারপর হাঁটুটা। তারপর শরীরটা সামনে পিছনে একটু ঝাঁকিয়ে বাঁ হাতটা বাড়িয়ে ভিতরের দিকের একটা রড ধরল। শরীরটাকে টেনে তুলল ছাদের উপর। তারপর চিৎ হকয়ে শুয়ে দম নীল খানিকক্ষণ। একটু পড়ে আস্তে আস্তে উঠে বসল। তারপর উঠে তাড়াতাড়ি ছুটে গেল চাঁদের দরজার দিকে। গিয়েই মাথা হাত দিয়ে বসে পড়ল। ছাদের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। কিছুক্ষণ পর সে উঠে দাঁড়িয়ে চারিদিক দেখতে লাগল। কিন্তু না, কোথাও নামার কোনো পথ নেই। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ সে দেখল, ছাদের একধারে করোগেটেড টিনের একটা শেড আছে। সেটা সিঁড়ির উপরে যে ছাউনিটা আছে, সেটার উপর পর্যন্ত বিস্তৃত। সে চটপট গিয়ে সেটার উপর উঠে গেল। সেখানেই চুপচাপ শুয়ে রইল।

    একটু বেলায় সে দরজা খোলার আওয়াজ ঘুম পেল। ও উঠে একটু উঁকি মারল। মিনুর মা, হাতে আচারের বয়াম, বড়ি। শুকাতে দিয়েই চলে গেলেন। ঘন্টা খানেক পরে সে ফিসফিস আওয়াজে উঁকি মেরে দেখল, মীনাক্ষী। কার সাথে ফোনে কথা বলছে। একটু পড়ে সেও চলে গেল।

    প্রায় ঘন্টা তিনেক বাদে আবার গলার আওয়াজ পেল। দেখল, মিনুর মা আর মীনাক্ষী। একগাদা কাপড় নিয়ে এসেছে। প্রায় আধঘন্টা ধরে সেগুলো মেলল। তার সাথে কে রাঙা মামী নাকি বাপের বাড়ি থেকে একটা জি.এম. গোরু এনেছে, সেটা নাকি পঞ্চাশ কেজি দুধ দেয়, হাতির মতো বড় এসব গল্প হচ্ছিল। রাজেশ কান পেতে রইল, মিনুর ব্যাপারে কোনো কথা হচ্ছে নাকি। কিন্তু না, কেউ ও ব্যাপারে একটা কথাও বলল না।

    আবার প্রায় একঘন্টা পরে প্রথমে মীনাক্ষী এবং তারপরে তার মা এলেন। স্নান করে কাপড় মেলতে এসেছেন। কাপড় মেলে চলে গেলেন। তারও প্রায় ঘন্টাখানেক পরে রাজেশ নামল। গ্রীষ্মের দুপুর, তার উপরে টিনের শেড, সে পুরো ভাজা হয়ে গেছে। সারা গা ঘামে ভিজে সপসপ করছে। তারপর কাল রাতের পর থেকে আর খাওয়া নেই। এমনকি একফোঁটা জল পর্যন্ত খায়নি। সে কাল দেখেছিল ছাদে একটা ট্যাপ আছে। সে নেমে ট্যাপ থেকে প্রাণভরে জল খেল। তাতে তেষ্টা তো মিটলই, খিদেটাও কমে গেল। সে দেখল চাঁদের দরজা খোলা। সবাই নিশ্চয় ঘুমাচ্ছে। তার মনে হল, একবার নিচে গকয়ে দেখবে কি? কিন্তু সে যদি মিনুকে নিয়ে ঘরের বাইরে যেতেও পারে, তবু লোকের চকক্ষে পড়ে যাওয়ার ভয় আছে। আর লোক মিনুকে তার সাথে দেখলেই সন্দেহ করবে। তাই সে আবার গিয়ে ছাউনির উপরে উঠল।

    তার মনে হল, ছাদের দরজা তো রাত্রে বন্ধ করে দেয়!কিছুক্ষণ ভাবার পর সে নীচে নেমে গেল। সিঁড়ি দিয়ে একটু নেমে দেখে নিল নীচের অবস্থা, বুঝল কেউ জেগে নেই। সব ঘরের দরজা বন্ধ। সে উঠে এসে দরজার শিকলের গোড়াটাকে একবার ডানদিকে একবার বাঁদিকে মোচড় দিতে লাগল। খানিকক্ষণে সেটার অবস্থা এমন দাঁড়াল, যে সেটা ধরে টানলেই ভেঙে যাবে। সে আবার ছাউনির উপরে উঠে গেল। এখন কেউ ওটাতে হাত দিলেই ভেঙে যাবে। রাত্রে লাগাতে গিয়ে যখন দেখবে ভেঙে গেল, ওরা বাগাতেও পারবে না, রাত্রে মিস্ত্রীকেও ডাকবে না। যদি ডাকেও, সে সকালের আগে আসবে না। ও নিশ্চিন্ত মনে শুয়ে রইল।

    সব ঠিকঠাকই যাচ্ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার পরে ওকে খুব পেচ্ছাব পেল। ও নামতে যাবে, এমন সময় ছাদে এসে ঢুকল মীনাক্ষী। ও তাড়াতাড়ি গিয়ে লুকাল। এখন ও কতক্ষণ থাকবে তার ঠিক আছে? একবার মনে হল এখানে বসেই করে ফেলি। কিন্তু তাতে ধারাজল নীচে গিয়ে পড়বে। বৃষ্টি নেই, বাদলা নেই, জল পড়লে সন্দেহ হবে। বহুকষ্টে ও চেপে বসে রইল। প্রায় ঘন্টাখানেক পর মীনাক্ষী নেমে গেল। ততক্ষণে রাজেশের অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। প্যান্টে হয়ে যায় আর কী? তাড়াতাড়ি নেমে ট্যাপের গোড়ায় বসে পেচ্ছাব করে আবার এসে উঠল আস্তানায়।

    মাঝে নীচে গিয়ে ও এর একবার জল খেয়ে এসেছিল খুব খিদে পেয়েছিল বলে। তারপর বসে শুধু কান পেতে রইল, কখন দরজা বন্ধ করে? কিন্তু আজ কেউ দরজা বন্ধ করতে এল না। র

    রাত বেশ গভীর হলে যখন চারিদিক শুনশান হয়ে এল, তখন সে নেমে আস্তে আস্তে নীচে নেমে এল।

    তারপর বাকি সব তো জানা।

    মিনু এবারে জিগ্যেস করল, "তুমি যে এত কান্ড করলে, তোমাকে কেউ দেখেনি? "
    রাজেশ বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, "একজন দেখেছিল। "
    মিনু-"কে? "
    রাজেশ-"পরে একদিন বলব। "
    মিনু-"না, আজকেই বলো। "
    রাজেশ-"এই তো বাচ্চা ছেলের মতো জেদ করো!"
    মিনু-"আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলবে কিন্তু!"
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | |
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন