অলংকরণ: রমিত
টানা কদিনের বিষ্টির পর আজ সকালেই অঝোরে ঝরে পড়া ধারাপাত একটু জিরেন দিয়েছে। এতোদিন ধরে চাদ্দিকে দল বেঁধে উড়ান বিছান করতে থাকা কেলো ভুলো মেঘেরা এখন পজ্জন্যদেবের গুমটি ঘরের বাইরে হত্যে দিয়ে পড়ে আছে, আর থেকে থেকে এতোদিনের ছোটাছুটির ক্লান্তিতে বেজায় হাই তুলে তুলে ঝিমুচ্ছে। এ কদিন খুব উলোট ঝালোট গেছে ওদের শরীরের ওপর দিয়ে। আজ এখানে তো কাল সেই হোথায়। পজ্জন্যর কড়া হুকুম - সব জায়গায় সম বন্টন চাই, কেউ যেন অভিযোগের আঙুল তুলে বলতে না পারে, আমাদের এখানে জল ঝরেনি। তবে এখনও নিশ্চিন্তিতে এক ঠাঁয়ে সবাই মিলে থিতু হয়ে বসে গজালি করার সময় আসেনি। যে কোনো সময়ে ওদিক থেকে হুকুম এলেই ভিস্তির জলভরা বস্তা শরীরে বেঁধে উড়তে উড়তে পৌঁছে যেতে হবে অকুস্থলে ঘাটতি মেটাতে। গতর ঝাঁকিয়ে, তেড়ে জল ঝরিয়ে হাল্কা ফুল্কা হয়ে আবার ফিরে আসবে ঐ গুমটি ঘরের দোড়গোড়ায়। ততদিনে অবশ্য আকাশ পটের রঙ বদলের পালা শুরু হয়ে যাবে।
ইদানিং কৈলাস এপার্টমেন্টে থাকা ভোলুরাম সাতসকালে উঠে একটু চড়তে বেরোচ্ছেন। ধন্যন্তরী বদ্দিঠাকুর নিদেন দিয়ে বলেছেন –” বাপ্ ঠাকুর, একটু হাঁটাহাঁটি না কল্লে, শরীরটা যে বেজায় মুটিয়ে যাবে। আর একবার যদি এই সুযোগে শরীলে শক্করা জমতে শুরু করে, তাহলে তো আর কথাই নেই! শরীল শুধরানোর হ্যাপা বিস্তর বেড়ে যাবে। তাই বলি কি , সারাদিন ঐ ষণ্ডা চেহারার ষণ্ড দুটোর পিঠে চেপ্পে ঘুরুঘুর কল্লে গতরের বোঝা কমবে কী করে বাপঠাকুর? সামনের মাসেই তো আবার সবাই মিলে আমাদের শারদা মায়ের পিত্তিগৃহে গমনের পব্বো আসছে। এতো দূরের পথ চার চারটি কচি কচি ছানা পোনা নিয়ে শারদা মা একা একা যান কি করে আপনাকে এমন নাজুক অবস্থায় ছেড়ে?”
বদ্দিঠাকুরের এসব কথা ভোলুরামের কানে ঢুকেছে বলে মনে হয় না। তিনি নিব্বিকার হয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে থম মেরে বসে বসে ঢুলতে থাকেন। ধন্যন্তরী ঠাকুর আর কি করেন? তাঁর তো আর এক ঠাঁয়ে এতক্ষণ ধরে বসে থাকলে চলে না। তাহলে যে তাঁর পশার লাটে উঠবে! তাছাড়া,এই সময়টা তাঁরও বড্ডো হুটোপুটি, ছুটোছুটির সময়। তাই পেটিকা থেকে এক টুকরো ভুজ্জ পত্র বের করে তাতে খসখস করে গুটিকয় প্রয়োজনীয় বটিকা আর মেদহর সালসা সেবনের বিধান দিয়ে হিজল কাঠের তৈরি ত্রিচক্র যানে উঠে বসেন। এখনি তাঁকে আবার কমলাসনের বাড়িতে ছুটতে হবে যে। তেনার সমস্যা আবার বড়ো জটিল! চার মুখের চার সমস্যা!
বাইরের কথোপকথন এড়িয়ে শারদা এতোক্ষণ ঘরের ভিতরে বসে উ- টিউবে ভিডিও দেখছিল। এসবে বেশ সময় কেটে যায় শারদার। বড়ো ছেলে গনু এখন বাড়িতে নেই,সাম্বৎসরিক তোলা আদায়ে মত্তে কেলি করতে গেছে। শারদা এক মনে বহ্নির রান্নাঘর দেখে একটা নতুন রান্না শিখছিল। সাবেকি পদ– সফরি মৎসের আনারকলি। গনু হয়তো আজকেই ফিরবে বাড়িতে। ছেলেটা খেতেটেতে খুব ভালোবাসে। এ কদিন নিঘ্ঘাত বাতাসা আর কুচো ফল খেয়েই কাটাতে হয়েছে। তবে ইদানিং মত্তে গানুর কদর বেড়েছে, ফলে চেনা খাবারের সাথে সাথে নানা বিচিত্র ভোজ্যের সম্ভারে সেজে উঠছে গানুর খাবারের থালা। এসব অবশ্য উ- টিউবের মাধ্যমেই জেনেছে। বাড়িতে এলে যদি নতুন কায়দার খাবার পাতে তুলে দেওয়া না হয় ,তাহলে মেজাজটাই বিগড়ে যাবে গানুর। তখন তাকে বাগে আনতে বেগ পেতে হবে শারদাকে। এসব কথা ভাবছে,আর উ- টিউব সাচ্ করে করে জম্পেশ একটা জলখাবারের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এমন সময় বাইরে থেকে ভোলুরামের হাঁক কানে আসে। “শারদা, কোথায় গিয়ে সেঁধিয়ে রয়েছো? এতোক্ষণ ডন বোঠক করে বেজায় খিদে পেয়ে গেছে। দাও দেখি একধামা মুড়ি আর কুচানো শসা। ধন্যো এসে তো এসবই খেতে বলে গেল।” উ- টিউব ফেলে শারদা তড়িঘড়ি এক ধামা ফুলকো মুড়ি এনে ভোলুরামের সামনে রাখতেই সদর দরজার সামনে এক শকট এসে থামে। এই সময় কে এলো? মুখ বাড়িয়ে সেদিকে নজর দেয় শারদা। “ও মা! এযে আমার গনু সোনা!”
ছেলে বিস্তর লটবহর সঙ্গে করে ফিরেছে দেখে মায়ের মনে খুশির বান ডাকে। গনুর সহকারী মুষকো ব্যস্ত হাতে সব পোঁটলা পুঁটলি এক এক করে নামিয়ে এনে সামনের চাতালে গুছিয়ে রাখে। পাওনা গণ্ডা বুঝে নেবার ব্যাপারে গনু বড্ডো হিসেবি। সব ঠিকঠাক নামানো হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য গনু পোঁটলা পুঁটলিগুলো গুনতে থাকে - এক, দুই, তিন…. । মোট পঞ্চান্নটা। একমনে মুড়ি চিবুতে চিবুতে ভোলুরাম একগাল হেসে বলে - “পঞ্চাননের পো পঞ্চান্ন পুঁটলি তোলা নে এসেছে। সাবাশ! এই যে আমি একমাস জম্মদিন পালন করে এলুম মত্তে, খালি ঘড়া ঘড়া জল ছাড়া কিছুই তেমন জুটলো না। জলের ধারায় ভিজে জবজবে হয়ে এখন সদ্দি কাশি, হাঁচি নিয়ে ত্রিকালের পরোয়ানার অপেক্ষা কচ্চি।” একথা শেষ করতে না করতেই এক প্রকাণ্ড হাঁচি দেয় ভোলুরাম। সেই নাদে কেঁপে ওঠে কৈলাস এপার্টমেন্টের এ পান্তর থেকে ও পান্তর।
এদিকে টানা ডিউটি করে ক্লান্ত পজ্জন্যদেবের চোখের পাতাদুটো তখন সবে একটু বুজে এসেছে। লগ্ বুকে মাথা রেখে একটু টান হবো হবো করছিল সে। ভোলুরামের হাঁচির বিকট শব্দে তাঁর কাঁচা ঘুম গেল চটকে। খানিকটা বিরক্ত হয়েই মাথার কাছে রাখা বাক্ যন্ত্রখানি হাতে তুলে নিয়ে হেড আপিসে, বস্ বাসব স্যারকে এত্তেলা পাঠায়। পজ্জন্য জানে, এরপরই তাঁর স্যাঙাৎদের নতুনকরে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে।
বাসব স্যার তখন সখা মাতলির সঙ্গে একহাত পাশা খেলবেন বলে মনে মনে ভাবছেন। গুটিগুলোকে শচীর তৈরি রেশমী পুঁটুলি থেকে বের করে সবে গোছাতে শুরু করেছেন,এমন সময় পাশে রাখা বাক্ যন্ত্রখানি সরব হয়ে ওঠে। যন্ত্রখানির দিকে নিতান্তই বিরক্তি নিয়ে তাকাতেই দেখে পজ্জন্যর তলব। “ কী ব্যাপার? হঠাৎ ফোন করেছো কেন?” “ফোন কি আর সাধে করেছি? চতুর্দিক তোলপাড় হয়ে গেল ভোলুরামের হাঁচির শব্দে, আর আপনি শুধোচ্ছেন কী ব্যাপার!” – পজ্জন্যর কথায় খানিকটা উষ্মা ঝরে পড়ে।
ভোলুরামের হাঁচি! এ কি কোনো নতুন সমস্যার আগাম সংকেত? জনার্দন চিন্তায় পড়ে যান। জরুরি সভা তলব করেছেন বদরিকাশ্রমে। তড়িঘড়ি সেখানে উপস্থিত হয়েছেন বাসব, কমলাসন ,পজ্জন্য, বরুন ,দেব জ্যোতিষী বেস্পতি সহ কোর কমিটির সকল সদস্য। জনার্দন বলে– “আজকের এই বিশেষ সভায় ভোলুরাম উপস্থিত থাকলে বেশ হতো, সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। তবে তাঁর হাঁচির ফলেই যখন বিপদের সংকেত মিলেছে তখন তাঁকে হাজির হতে বলাটা কি উচিৎ হবে?” ভোলুরামকে ডাকার কথা বলতেই কমলাসন আৎকে ওঠে – “ না বাপু , তাঁকে আর ডাকাডাকি করে লাভ নেই। সকালেই ধন্যন্তরী বদ্দিঠাকুরের কাছে খবর পেলুম ভোলুর এখন ভাইরাল ইনফেকশন হয়েছে। এই অবস্থায় তাঁকে এই পঞ্চজনের পঞ্চায়েতে ডেকে আনা মোটেই ঠিক হবেনা। কোনো রকমে ঐ ভাইরাস যদি আমাদের শরীরে একবার সেঁধিয়ে যায়, তাহলে কিন্তু জীবন নিয়ে টানাটানি হতে পারে। মত্তের সেই অতিমারির কথা স্মরণে নেই?”
এইসব কথোপকথনের মাঝেই সভাস্থলে এসে উপস্থিত হয় দেবর্ষি। পজ্জন্যকে সেখানে হাজির থাকতে দেখে রীতিমতো চটে উঠে বলে – “বলিহারি আক্কেল তোমার। এবছর এতো নীর বর্ষণ করিয়েছো সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে যে দেবভূমি টালমাটাল। আরে বাপু! তোমার জন্য দেবভূমির বেবাক যদি লোপাট হয়ে যায়, তাহলে তোমার, আমার কি হাল হবে ভেবে দেখেছো?” ভর সভায় দেবর্ষির এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্যে কেবলমাত্র পজ্জন্য নয় সভায় হাজির কোর কমিটির অন্যান্য সদস্যরাও বেশ অসহায় বোধ করে। বেস্পতি ঠাকুর উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে বরিষ্ঠতম। জনার্দন তাঁকেই কিছু বলার জন্য অনুরোধ করে।
বেশ গম্ভীর কন্ঠে বেস্পতি ঠাকুর বলেন – পরিস্থিতি গম্ভীর। তবে এজন্য কেবলমাত্র মঘবন বা তার শাকরেদ পজ্জন্যকে দায়ি করা উচিৎ হবে না। অংশুমান যথেচ্ছভাবে নীর সংগ্রহ করছে জলধি থেকে। মলয় তাকে নিয়ে আসছে এখানে। তার পথ আগলে মাথা উঁচু করে প্রাকারের মতো দাঁড়িয়ে আছে আমাদের সুবিস্তির্ণ শৈলমালা। তাতে আঘাত পেয়ে খান খান হয়ে যাচ্ছে বলাহকেরা। বিপদ তো এখানেই।” বাসব চুপচাপ বসে এসব কথা শুনেছিলো। সে মনে খানিকটা জোর পেয়ে বলে –”এ নিয়ম তো একালের নয়। এ নিয়ম বিধাতারই তৈরি করা। তবে ইদানিং বিকাশের নামে মত্তের লোকজন তাদের মতো করে সবকিছুকেই বদলে দিতে চাইছে, বেনিয়ম তো এখানেই।” কমলাসন নড়ে চড়ে বসে। তারপর বলে, – “আমাদের মধ্যে থেকে শারদা আগামী আশ্বিন মাসে মত্তে যাবে। ওঁর ওপরেই মত্তবাসীদের মগজ ধোলাইয়ের ভার দেওয়া হোক। মত্তবাসী এখন মা মা মন্তরে দশদিক একেবারে ম ম করে রেখেছে। এখন সবাই শারদার জয়গান গাইছে। শারদাই পারবে সবাইকে নতুন ভাবনায় মজাতে।” কোর কমিটির সমবেত সদস্যরা একযোগে শ্লোগান তোলে – সাধু, সাধু । আমরা সবাই এই প্রস্তাবে সহমত।
এমন সময় সভাঘরের বাইরে কৃতাঞ্জলিপুটে এসে হাজির হয় সুরথ। সকলকে একসাথে পেয়ে গদগদ কন্ঠে সে বলে – “উপস্থিত সকলের কাছে আমার একটি প্রার্থনা। শারদা যে কদিন পিত্রালয়ে থাকবে, সেই কদিন মর্ত্যলোকে মঘবনের দৌরাত্ম্য যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে।”
এবারও সকলে একযোগে সম্মতি জানিয়ে বলে ওঠে “তথাস্তু।”
সভাস্থল থেকে একটু তফাতে একটা হিজল গাছের মগডালে এতক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করছিল শঙ্খচিল। সভার রেজোলিউশন জানতেই ডানা ঝাপটে খুশি মনে সে উড়ে যায় কৈলাসের পথে। ভোলুরাম আর শারদাকে খবর দিতে হবে না!