এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আগুনে সামনে দাঁড়িয়ে মানুষকে চেনা যায় অয়ন মুখোপাধ্যায়

    Ayan Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১৪০ বার পঠিত
  • আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষকে চেনা যায়

    অয়ন মুখোপাধ্যায় 

    গতকাল রাতটা শুধু বাংলাদেশে নয়—এই উপমহাদেশের বিবেকের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে। আগুনে পোড়া একটি শরীর, ফাঁসিতে ঝোলানো এক শ্রমিক, আর উল্লাসে ভিডিও তোলা কিছু মানুষ—এই দৃশ্য কোনও “ঘটনা” নয়, এটা এক ভয়াবহ বার্তা। বার্তাটা খুব পরিষ্কার: মানুষকে আর মানুষ হিসেবে দেখা হচ্ছে না, দেখা হচ্ছে পরিচয়ে, পদবিতে, সংখ্যায়।

    দিপু চন্দ্র দাস—একজন কাপড় কারখানার কর্মী। তার কোনও অপরাধ ছিল না, কোনও আদালত ছিল না, ছিল না কোনও মানবিক প্রশ্ন। ছিল শুধু হিংসা, আগুন আর উল্লাস। আর সেই উল্লাসের ভিড় আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল—মৌলবাদ যখন রাষ্ট্র, সমাজ আর রাজনীতির প্রশ্রয় পায়, তখন মানুষ পুড়ে যায়, আর পশুত্ব উৎসব করে।

    একই সময়ে, অন্য এক ভূগোলে—বিহারের এক কাপড় বিক্রেতা, মুহাম্মদ আথার হুসেইন। সাইকেলের টায়ার খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সাহায্য চেয়েছিলেন। উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন জ্বলন্ত কাঠের ঘর, কাটা কান, ভাঙা আঙুল, শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া লোহার রড। দুই দেশে, দুই ধর্মের মানুষ—কিন্তু একই পরিণতি। কারণ মৌলবাদ কখনও ধর্ম চেনে না, সে শুধু শত্রু খোঁজে।

    এই দুই মানুষের মৃত্যু আমাদের বলে দেয়—আজ বিপদ সংখ্যালঘু হওয়ার নয়, আজ বিপদ মানুষ হওয়ার।

    বাংলাদেশের ইতিহাস আমাদের অন্য কথা শিখিয়েছে। এই দেশ জন্ম নিয়েছিল ভাষা, সংস্কৃতি, স্বতন্ত্রতা আর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার লড়াই থেকে। পাকিস্তানি সামরিক আগ্রাসন আর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যে জনগণ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল, সেই জনগণের শ্বাস আজ রুদ্ধ করা হচ্ছে সংগঠিত ইসলামিক মৌলবাদ দিয়ে। জামায়াতি রাজনীতি, ধর্মকে হাতিয়ার করে মানুষের উপর ঘৃণা চাপিয়ে দিচ্ছে—হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, মুক্তচিন্তার মানুষ, শিল্পী, সাংবাদিক, শ্রমজীবী নাগরিক—কেউই আজ নিরাপদ নয়।

    এটা কোনও “সংখ্যালঘু সমস্যা” নয়। এটা গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ। এটা মানবিকতার উপর আক্রমণ। আজ যে আগুন দিপু চন্দ্র দাসকে পোড়াল, কাল সেই আগুন প্রশ্ন করবে না—তুমি কে, কোন ধর্মের, কোন দলের।

    এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব বাংলাদেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের। চুপ থাকা আর নিরপেক্ষ থাকা এখন আর আলাদা নয়—চুপ থাকা মানে অপরাধের পাশে দাঁড়ানো। শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, ছাত্র, শ্রমিক—সবাইকে বলতে হবে: এই হিংসা আমাদের নাম নিয়ে হচ্ছে না।

    আর আমাদের দেশ, বিশেষ করে পড়শি বাংলার নাগরিকদেরও এই প্রতিবাদে সামিল হতে হবে। কারণ সীমান্ত দিয়ে ঘৃণা থামে না। মৌলবাদ এক দেশের সমস্যা নয়—এটা মানবতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ব্যাধি।

    প্রতিবাদ মানে ভাঙচুর নয়। প্রতিবাদ মানে আরও স্পষ্ট করে মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক চাপ, আন্তর্জাতিক নজরদারি, সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ—এই সবকিছু দিয়েই মৌলবাদকে কোণঠাসা করতে হবে। ঘৃণার রাজনীতিকে তার সামাজিক বৈধতা কেড়ে নিতে হবে।

    আজ পৃথিবীর সব দেশে যারা মানুষের বিরুদ্ধে মানুষের ঘৃণার বিরোধিতা করে, তারা সংখ্যায় কম—কিন্তু ইতিহাস বলে, সংখ্যাই শেষ কথা নয়। শেষ কথা বলে সাহস।

    এই সময় নিজেদের সবটুকু ক্ষমতা দিয়ে প্রতিবাদ করুন। লিখুন, বলুন, রাস্তায় নামুন, প্রশ্ন তুলুন। কারণ আজ যদি আমরা নীরব থাকি, আগামীকাল আগুনটা আমাদের দরজায় আসবে—আর তখন বলার মতো কেউ থাকবে না।

    মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার লড়াইটাই এখন সবচেয়ে বড় রাজনীতি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন