এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • মরিচ তোলার দিন, মুহাম্মদ ফজলুল হক

    Fazlul Huque লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৪০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • মরিচ তোলার দিন
    মুহাম্মদ ফজলুল হক

    বেলা একটু পর পর মাথা উঁচু করে চারদিকে তাকাচ্ছে। আলো ক্রমশ কমে আসছে। দিনের শেষ রোদ মাঠের ওপর নরম সোনালি আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। আকাশ পরিষ্কার থাকায় কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। কাজে মগ্ন। রনি, শম্পা, ইয়াছমিন, ঊষা ও পরশ দ্রুত মরিচ তুলছে। হাসিঠাট্টা, প্রতিযোগিতা ও আন্তরিকতা মিলিয়ে মাঠজুড়ে এক অদ্ভুত প্রাণচাঞ্চল্য। মাঠের কাজে সবাই মগ্ন হলেও চারপাশের মগ্নতায় মুগ্ধ বেলা। কি অপরূপ চারপাশ। চোখ তুললেই নদী। তিতাস নদীর কাজল কালো পানি। নদীর পাড়ের জমিতে সবুজের বাড়াবাড়ি। নানা রঙের ফুলের বাহার। আঁকাবাকা মেঠোপথ। বাতাসে বসন্তের গন্ধ শুকে শুকেই একজীবন শেষ করা যায়।

    রনি বলল, দেখি আজ কে বেশি মরিচ তোলে!
    পরশ তার কথা শুনে হেসে বলল, তুই তো দিনশেষে দ্বিতীয় হস। প্রথম হওয়ার আশা বাদ দে রে ভাই!
    ঊষা ঝুড়িতে মরিচ ফেলতে ফেলতে বলল, আজ প্রথম হবে বেলা। ওকে কেউ ধরতে পারবে না।
    বেলা অন্য দিনের মতো নেই। চোখমুখে  অদ্ভুত অস্থিরতা। কাজে মন বসছে না। বারবার দৃষ্টি যাচ্ছে গ্রামমুখী সেই পথের দিকে।
    শম্পা খেয়াল করে বলল, কি হয়েছে বেলা?
    বেলা মৃদু হেসে বলল, কিছু হয়নি রে।
    ঊষা ঠাট্টা করে বলল, কি জানি কার কথা মনে পড়ছে!
    সবাই হেসে ওঠে। বেলাও যোগ দেয় হাসিতে।

    মনটি আজ তার সত্যি ভারী। অদৃশ্য কেউ তাকে টেনে রেখেছে বিষণ্নতার গহ্বরে। মাঠজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির সীমাহীন সৌন্দর্য তার ভেতর অদ্ভুত আলোড়ন তুলেছে। দিগন্ত বিস্তৃত জমির বুক জুড়ে লাল-সবুজ মরিচ রোদের আলোয় ঝিলমিল করছে। পাশেই ধনেপাতার কোমল সবুজ শাখা দুলে দুলে নীরব সুর তোলছে। গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। পরেই সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা লালচে ও সাদা মূলার চারা। বাধাকপি আর ফুলকপি বেড়ে উঠছে। পাতা মেলে মনকাড়া আবেদন জানাচ্ছে। সরষে ফুলের কথা আলাদা করে বলাই যেন অন্যায়। নিজেই আলো ছড়ায়। স্বর্ণাভ, মায়াময় দীপ্তি। চোখে পড়লে মন অবধারিতভাবে থমকে যায়। বেলা তাকিয়ে থাকে বিস্ময়ে।

    মরিচ তুলতে তুলতে জমির ফাঁক দিয়ে লাইন  দিয়ে এগোচ্ছে। হাতের ঝুড়ি ভর্তি হলে দৌড়ে গিয়ে বস্তায় ঢেলে আবার লাইনে নেমে আসে। রনি হঠাৎ বলে উঠল, এই দেখ, আমার ঝুড়ি সবার আগে ভরছে!
    পরশ বলে, তা হবেই। তোমার গাছে মরিচ কম। দু-তিনটে তুললেই ভরে যায়!
    হাসির রোল পড়ে মাঠে।
    বেলা সচেতন হয়ে উঠে। সে নিজের গতি ধরে এগুলেও তার ভেতরে ছন্দ নেই। কিছুদূর এগিয়ে সে আকাশের দিকে তাকায়। এক ঝাঁক বক উড়ে আসছে। সন্ধ্যার আলোয় তাদের সাদা ডানা আরো সাদা মনে হচ্ছে।

    বেলা ভাবতে থাকে, ইস্! যদি পাখি হতে পারতাম!মনের সুখে উড়তে পারতাম। তার কল্পনা হঠাৎ রূপ বদলায়। সে পাখিদের মনের কথা শুনতে শুরু করে। “উড়তে আর ভালো লাগছে না। ডানা ব্যথা করছে। খাবারের জন্য প্রতিদিন দূরে যেতে হয়। কাছে যদি একটা বিল থাকত, তাহলে বাঁচতাম।"
    বেলা হেসে ফেলল, পাখিদের কত কষ্ট!
    ঊষা বলল, কি হলো ? একা একা হাসছ?
    কিছু না রে। ওদের কথা ভাবছিলাম।

    কাজ শেষ। সবাই ক্লান্ত। আনন্দও কম নয়। মরিচতোলা তাদের কাছে শুধু কাজ নয়, যেন উৎসব। বেলা বলল, চল, নদীতে গিয়ে হাত মুখ ধুই?
    তারা দ্রুত চলে যায় পুরাতন তিতাস নদীর কাছে।
    এখানে নদী সরু হয়ে পূর্ব-পশ্চিমে দুই ধারায় ভাগ হয়েছে। পানি কম, স্রোত নেই। প্রাণহীন। তাদের উপস্থিতি এবং কোলাহলে নদী প্রাণ ফিরে পায়।
    রনি পানিতে নেমেই চিৎকার করে উঠল, পানি কিন্তু ঠান্ডা রে!
    পরশ দুষ্টুমি করে এক মুঠো পানি শম্পার গায়ে ছিটিয়ে দিল।
    শম্পা চমকে উঠে বলল, ওই! কি করছিস?
    ঊষা সাথে সাথে এগিয়ে গিয়ে পরশের গায়ে পানি ছুড়ে মারল।
    পরশ বলল, ওহ হো! তুই আমার শত্রু হয়ে গেলি কখন থেকে!
    হাসতে হাসতে সবাই পানিতে ছিটাছিটি করে।
    কেউ কারো কথা শুনছে না। কয়েক মুহূর্ত তাদের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।

    ধীরে ধীরে সবাই পানি থেকে উঠে আসে। কেউ চুল মুছছে। কেউ হাঁসের পালের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ নদীর পানে তাকিয়ে গান গাইছে।

    মরিচভর্তি বস্তা কাঁধে নিয়ে বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়। শম্পা হাঁটতে হাঁটতে বলল, আজ যদি মালিক একটু বেশি ভাগ দিত!
    পরশ বলল, ওসব আশা করে লাভ নেই রে। সাতভাগের একভাগ ছাড়া কিছু দেবে না।
    রনি যোগ করল, তাতেই বা কম কি!
    সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল।

    গ্রামের পথ ধরে তারা এগিয়ে চলে। সন্ধ্যার আবেশ চারপাশে নেমে আসছে। ক্ষেতের কোণের বকের দলও বাড়ি ফিরছে। বকের ডানার শব্দ, বাতাসের গন্ধ, সিগ্ধ পরিবেশ সব মিলিয়ে বেলার মনটা নরম হয়ে ওঠে। সে মনে মনে বলে, পাখিরাও ক্লান্ত, আমরাও ক্লান্ত। অথচ তারা না পায় ভাগ। না পায় বিশ্রামের জায়গা।

    মালিকের বাড়িতে এসে সবাই নিঃশ্বাস ফেলল। রনি দৌড়ে গিয়ে পানি এনে দিল। তখন সুরমা চাচী এসে বললেন, শুধু পানি খেয়ে পেট ফুলাবে না। মুড়ি খাও। শম্পা দৌড়ে গিয়ে তেল আর পেঁয়াজ নিয়ে এল। বলল, মেখে দিচ্ছি। কেউ তাড়াহুড়ো করে গিলে ফেলবি না কিন্তু!
    পরশ হাসল, আজ তোকে খুব উপদেশ দিতে দেখছি। মুড়ি খাওয়ার সময় সবাই মেতে ওঠে গল্প আর হাসিতে। খাওয়া শেষে সুরমা চাচী মরিচ ভাগ করতে আসেন। তিনি ছোট একটি বোল নিয়ে সবার সামনে বসে যত্নসহকারে এক এক করে সবার মরিচ ভাগ করছেন। চাচীর মুখে মমতা। এমন মায়াবতী মানুষ এই গ্রাম কম আছে। চাচী বললেন, এই নাও। সমান  ভাগ করে দিলাম। কেউ কারো দিকে তাকিয়ো না।
    তারপর সবাই বেলার কাছে আসে। বেলা তাদের দলনেতা। রনি বলল, বেলা, তোমারটা নাও।
    বেলা মাথা নেড়ে বলল, আরে ধুর! আমায় কেন দিবে? আমি নিলে তোদের ভাগ কমে যাবে।
    শম্পা প্রায় জোর করেই বলল, আরে না! তুমি আমাদের কাজে নিয়ে আসো, সাহস দাও, কাজ শেখাও। তোমারে না দিলে আমাদের ভাল লাগে না। ঊষা মিষ্টি হেসে বলল, তুমি, না নিলে মনে হবে দলনেতা রাগ করেছে। বেলা অগত্যা সবার নিকট থেকে একটু একটু করে নেয়।

    বাড়ি ফেরার সময় বেলা বলল, কাল সকাল সকাল বের হবো। দুই জমির মরিচ তুলতে হবে। দুপুরের খাবার সাথে নিও। কেউ কিছু বলে না। তারপর রনি বলে, চল চল। ভাবলে হবে না। কাল আবার প্রতিযোগিতায় নামতে হবে? সবাই হেসে ওঠে।

    বেলা আকাশের দিকে তাকায়। দূর থেকে ভেসে আসছে গানের সুর। সে মনে মনে বলে, জীবন কত কষ্টের। তবু কত সুন্দর! তার দলকে দেখে তার মন ভরে ওঠে। কত কষ্ট করে সবাই। অথচ মুখ ফুটে কেউ কিছু বলে না। অভাব অনটন নিত্য হলেও স্পর্শ করতে পারে না কাউকে।

    রাতের বাতাসে তখন ক্ষুধার গন্ধ। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে তারা গল্পে মেতে উঠে। দিনের ক্লান্তি মুছে যায় ফেরার আনন্দে। বেলা হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, পাখির মতো ডানা নেই। জীবন আর ভালোবাসার ডানায় ভর করে তবু উড়ছি আমরা।

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন