ইংরেজিতে ব্যবহৃত ফোবিয়া শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ Phobos থেকে,যার সাধারণ অর্থ হলো ভয়। ভয়ের বিপরীতে কি ভালোবাসা শব্দটির অবস্থান? হয়তো হবে। কিন্তু এই দুই অতি পরিচিত শব্দ অর্থগতভাবে অভিধানের দুই মেরুতে অবস্থান করলেও তাদের মধ্যে কিন্তু কার্যকারণ সূত্রে গভীর সম্প্রীতি রয়েছে। কী! ভাবছেন তো? আদা আর কাঁচকলা কোথায়, কীভাবে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়? ভাবুন, ভাবুন। সবাই মন দিয়ে ভাবুন। আমি বরং ততক্ষণে গঙ্গাধরের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। কী একটা জরুরি সমস্যায় পড়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে। নিশ্চয়ই মোবাইল ফোনে কথা বলে সমস্যা মেটার নয়। আমারও মন একটু ঘুরে আসতে চাইছে।
গঙ্গাধর চৌবে। আমার স্কুল বেলার সাথী। গঙ্গাধররা কয়েক পুরুষ ধরে উন্নয়নের গুঁতো খেয়ে শশব্যস্ত হয়ে বেড়ে ওঠা আমাদের এই মফস্বল শহরে বাস করে। গঙ্গাধরের ঠাকুরদার বাবা সৌভাগ্যের সন্ধানে উত্তরপ্রদেশের জৌনপুর থেকে এসেছিলেন কলকাত্তায়। তখন অবশ্য এই তল্লাটের চেহারা বিলকুল আলাদা ছিল। সেই থেকেই ওঁরা এখানে।
যাইহোক, টুকটুক করে হেঁটে গঙ্গার বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম। ও যেন আমার অপেক্ষায়ই ছিল। আমি পৌঁছতেই খুব স্বস্তিতে আমাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে বসাল। সত্যি বলতে কি,আমি একটু অবাকই হলাম, কেননা ওঁর বাড়িতে তো আমি প্রথম যাচ্ছিনা! দু দণ্ড পার হতে না হতেই কৌশল্যা, মানে গঙ্গাধরের ধরম পত্নী,এক গেলাস ঘোলের শরবত এনে হাজির করলো। গেলাসে আলতো চুমুক চড়িয়ে বলি– কিরে! এতো জরুরি তলব কেন? সমস্যা কী?
এরপর, হিন্দি বাঙলা ইংরেজি মিলিয়ে মিশিয়ে ও এবং ওর পরিবারের সদস্যরা যা বললো তার মর্মার্থ হলো –
বেশ কয়েক বছর পর গঙ্গাধর সপরিবারে ওঁর দেশের বাড়িতে যাবে বলে ঠিক করেছে। ওখানে ওঁর মা এবং অন্যান্য ভাইয়েরা আছে। গঙ্গাধর আর কৌশল্যা ভাবী একপায়ে খাড়া যাবার জন্য, কিন্তু ওঁদের দুই ছেলেমেয়ে , লালন আর শালিনী, একদম বেঁকে বসেছে। কেন? ওদের বক্তব্য, জৌনপুর থেকে অনেক দূরে ওদের গ্রাম। সেখানে এখনো ইলেক্ট্রিসিটি নাকি পৌঁছয় নি, ফলে ওরা ওদের মোবাইল ফোনে চার্জ দিতে পারবে না। বোকার মতো থাকতে হবে ওদের। গোটা বিশ্বের থেকে ওরা বিলকুল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।
“We can't live without our mobs. Leave us here. We will manage everything in our own way. You need not to worry at all.”
ছেলেমেয়েকে বলে বোঝাতে না পেরে গঙ্গাধর অনন্যোপায় হয়ে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে সালিশি করার জন্য । সবার কথা শুনে আমার মনে হলো এতো সেই ভালোবাসা আর ভয়ের যুগলবন্দি। এই সময়ের তরুণ প্রজন্মের কাছে মোবাইল ফোনের কোনো বিকল্প নেই। এইটি ওদের নয়নের মণি। এই ফোন ওদের নাগালের বাইরে চলে যাবে, একথা ওরা ভাবতেই পারেনা। তাই একে নিয়ে একটা ভয় বা ফোবিয়া অহর্নিশ ঘিরে থাকে ওদের। আধুনিক শব্দ ভাণ্ডারে তাই ঠাঁই পেয়েছে নতুন এক শব্দবন্ধ নোমোফোবিয়া (Nomophobia ) বা মোবাইল হারানোর আতঙ্ক। আমাদের আজকের আলোচনা এই নতুন ফোবিয়াকে নিয়েই ।
নোমোফোবিয়া শব্দটির প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। ২০০৮ সালে বৃটেনের গবেষণা সংস্থার Gov You এর সৌজন্যে ইংরেজি ‘no mobile phobia’ শব্দবন্ধটিকে কেটে ছেঁটে এই শব্দটিকে তৈরি করা হয়েছে হাতের মুঠোয় সচল মোবাইল ফোন না থাকার ভয় এবং উদ্বেগকে বোঝাবার জন্য।
হালফিল সময়ে খবর কাগজ খুললেই দেখা যায় মোবাইল ফোন না থাকার ফলে অথবা অতি ব্যবহারের আসক্তি থেকে ছেলে মেয়েদের দূরে সরে থাকার জন্য বকাঝকা করা হলেই, কি ভাবে তারা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে কোনো রকম চিন্তা না করেই। ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর ক্রমশই আমাদের নির্ভরতা বাড়ছে। জীবন হয়ে উঠেছে অ্যাপস নির্ভর। আর সেই অবকাশে আমাদের, বিশেষ করে অল্পবয়সীদের, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শয়নে স্বপনে জাগরণে আজ মুঠো বন্দি এই উপকরণটি হয়ে উঠেছে সর্বক্ষণের সঙ্গী। আর এই কারণেই মোবাইল ফোনকে ঘিরে বাড়ছে তীব্র আসক্তি।
এই ফোবিয়ার বিষয়টিকে ইতোমধ্যেই তুলনা করা হয়েছে ভয়ঙ্কর ড্রাগ আসক্তির সঙ্গে। মনোবিদ তথা মনোচিকিৎসকদের মতে, লাগামছাড়া ভাবে মোবাইল ফোনের ব্যবহার, ব্যবহারকারীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর উদ্বেগজনকভাবে ছাপ ফেলছে যার থেকে বের হয়ে আসার কোনো উপায় এই মুহূর্তে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনোচিকিৎসকদের মতে, মোবাইল ফোনের সঙ্গে ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন করার ফলে নোমোফোবিয়ার দাপট বাড়ছে দ্রুত গতিতে। পড়াশোনার সুবিধা হবে বলে বিভিন্ন সরকারের তরফ থেকে ছাত্রছাত্রীদের মোবাইল ফোন দেবার ব্যবস্থা করা হলো। দুদিন এই বাটন, সেই বাটন খট্ খট্ করে একটু ধাতস্থ হতেই শুরু হলো বিশ্ব দর্শনের পর্ব। বইপত্র সব আড়ালে চলে গেল, কেবল টিকে রইলো প্রবল মোবাইল আসক্তি বা নোমোফোবিয়া। মনোচিকিৎসকদের মতে, হাতের মুঠোয় ফোনটিকে পেয়ে আমরা সবাই ভাবতে শুরু করেছি যে এর জোরে আমরা দুনিয়াটাকে কব্জা করে ফেলেছি। এই কপট দুনিয়াদারির ভাবনা থেকেই আমাদের মধ্যে বাসা বাঁধতে শুরু করেছে নিরাপত্তাহীনতা, অপরিমেয় উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগ, আত্মমূল্যায়নের অক্ষমতা, মানসিক বিভ্রান্তি ও দোদুল্যমানতা, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকার অসামর্থ্য, আবেগকে সম্বরণ করতে না পারার মতো জটিল মানসিক সমস্যার। বিষয়টি এতোটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে পশ্চিমা দেশগুলোতে নোমোফোবিয়াকে এক গভীর অসুখ বলে চিহ্নিত করা শুরু হয়েছে। দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে, আমাদের দেশেও মোবাইল ফোনের আসক্তি বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে
নোমোফোবিয়া আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা।
ছোট শিশুর কাছ থেকে মা একটু আড়াল হলে সে যেমন উদ্বেগাকুল হয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দেয়, মোবাইল ফোন ছাড়া এখন অনেকের তেমনই অবস্থা। হাতের মুঠোয় ধরা মোবাইল ফোন নাড়াচাড়া করা ছাড়া এই জীবন যেন অচল।
বছর কয়েক আগে বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী মাননীয়া আশা ভোঁসলে জী একটি অনুষ্ঠানে যোগদান করতে গিয়েছিলেন সম্ভবত গুয়াহাটিতে। অনুষ্ঠানের পর্ব সাঙ্গ করে বিকেলের দিকের বিমানেই মুম্বাই ফিরে যাবেন বলে বিমান বন্দরে এসে হাজির। এই একই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আরও যেসব নামীদামী শিল্পীরা গিয়েছিলেন তাঁরাও ঐ বিমানেই ফিরবেন মুম্বাইতে। বিমান বন্দরে পরস্পর দেখা হয়ে যায় সবার সঙ্গে। আশা জী মনে মনে ভাবলেন - যাক্ সময়টা ভালো কাটবে সবার সঙ্গে গল্পগুজব করে। কিন্তু হা হতোস্মি! আশা জী হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল, অথচ অন্য সবাই ব্যস্ত মোবাইল ফোনের সঙ্গে নীরব কথালাপে। আশা জীর মতো ব্যক্তিত্বকেও সেদিন আশাহত হতে হলো সহযাত্রীদের নোমোফোবিক মানসিকতার জন্য। এমন অভিজ্ঞতা আমাদের সকলেরই।
ছোট্ট কিছু পরিসংখ্যান পেশ করি। মার্কিন গবেষকদের সমীক্ষায় উঠে এসেছে কিছু চিন্তনীয় তথ্য। গবেষকেরা জানিয়েছেন যে,
●পরিণত বয়সের ৬৬ শতাংশ মানুষ এই মুহূর্তে নোমোফোবিক।
●প্রতি ৩ জনের মধ্যে ২ জন শোবার সময় মাথার পাশে মোবাইল ফোন রেখে শোন।
●প্রতি ৫ জনের মধ্যে ১ জন পায়ে জুতো না পড়েই নিঃসংকোচে বাইরে বেরিয়ে যেতে পারেন কিন্তু সঙ্গে মোবাইল ফোন না নিয়ে এক পা ও বাইরে যাবেন না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষজনের ওপর এই সমীক্ষা করা হলেও অন্য অনেক দেশের অবস্থার খুব বেশি হেরফের হবে বলে মনে হয় না। সম্প্রতি বৃটিশ যুক্তরাজ্যের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে হাইস্কুল ও কলেজ পড়ুয়াদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহার করার আসক্তির মাত্রা সর্বাধিক । সমীক্ষা সূত্রে জানা গেছে যে -
●যুক্তরাজ্যের ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ তরুণ প্রজন্মের মানুষ মোবাইল ফোন ছাড়া হলেই গভীর উদ্বেগের শিকার হন।
●২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে মোবাইল ফোন ছাড়া তাদের এক বিচ্ছিন্ন জীবন যাপন করতে হবে। ফোন না থাকলে তাঁদের গভীর বিপন্নতা বোধ গ্রাস করে।
●৫৫ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন যে মোবাইল ফোন ছাড়া থাকতে হলে তাঁরা নিজেদের অসহায়, অবলম্বনহীন মনে করেন।
●বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার আশঙ্কা পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে অধিকতর কার্যকর হয় । সমীক্ষা বলছে ৫২ শতাংশ মহিলা মনে করেন যে মোবাইল ছাড়া তাঁরা তাঁদের পরিবারের সদস্য ও প্রিয়জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। এই ভাবনা তাঁদের কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। অন্যদিকে একই আশঙ্কায় ভূক্তভোগী পুরুষের সংখ্যা ৪৮ শতাংশ।
বছর কয়েক আগের এই সমীক্ষা স্পষ্টতই প্রমাণ করে যে নতুন প্রযুক্তি কীভাবে আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাপন প্রক্রিয়ায় গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। মানুষ নতুন নতুন প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁর জীবন যাপনকে আরও সহজ সুবিধাজনক করে তুলতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু তা করতে গিয়ে সে নিজেই প্রযুক্তির জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে যাবে,এটাও নিশ্চয়ই অভিপ্রেত নয়। দুর্ভাগ্য , ঠিক তেমনি ঘটছে বহমান সময়ে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য আজ এই ডিজিটাল দুনিয়ায় বিপন্ন। একের পর এক সমীক্ষায় এমন তথ্যই উঠে আসছে।
গবেষক Caglar Yildirim তাঁর গবেষণার মধ্য দিয়ে এ কালের স্মার্টফোন বিচ্ছিন্ন মানুষের মানসিক বিভ্রান্তির ক্ষেত্রকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। গবেষণার প্রয়োজনে তিনি একটি প্রশ্নমালা তৈরি করে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। Caglar Yildirim এর মতে একজন মানুষ ফোন ব্যবহার করতে না পারলে বা তেমন আশঙ্কায় আশঙ্কিত হন এই ভেবে যে মোবাইল ফোন না থাকলে –
●তিনি অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না, নিঃসঙ্গ হয়ে যাবেন।
● তিনি নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে করেন,
●তিনি মোবাইল ফোন থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে অপারগ হন, ফলে তিনি অন্যদের থেকে পিছিয়ে যাবেন,
●তিনি নিজেকে একজন বঞ্চিত মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন।
আসলে একালে মোবাইল ফোন ক্রমশই আমাদের ব্যক্তিমানুষের প্রতিরূপ হয়ে উঠেছে। মোবাইল ফোনের আড়ালে চলে যাচ্ছে আমাদের সমস্ত একান্ত অনুভব, অনুভূতি। বয়স্ক মানুষদের মধ্যেও মোবাইল ফোনকে ঘিরে এক আশ্চর্য বোধ কাজ করছে – “দেখো, আমিও এখন ডিজিটালাইজড।” এই বোধ আমাদের আত্মপরিচয়ের স্বাতন্ত্র্যকে একটু একটু করে কোণঠাসা করে ফেলছে, একই ধরনের যান্ত্রিক অভ্যাসের অনুবর্তী হয়ে পড়ছি আমরা সবাই।
আপনি কি নোমোফোবিক?
একালে সকলেই মোবাইল ফোন ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়েছি কখনও হয়তো প্রয়োজনে, আবার কখনও সমাজ পরিসরে নিতান্তই ভেসে থাকার তাগিদে। অনেক অর্থহীন কথা আর ঘটনার জালে জড়িয়ে পড়ছে আমাদের মন ও শরীর। মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে এমন অনেক কাণ্ডকারখানার বৃত্তান্ত যা জনপরিসরে প্রকাশ করার কথা ভাবাই যেতো না মাত্র কিছুকাল আগেও। মোবাইল ফোনের সূত্রে এই সব করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে অনেকেই জ্ঞানত বা অজ্ঞানত নোমোফোবিক হয়ে পড়ছি।
মনোচিকিৎসকদের মতে মোবাইল থেকে দূরে থাকার আশঙ্কায় আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঠিক কোন কোন সিম্পটম বা লক্ষণ দেখা দিলে আমরা বুঝতে পারবো যে মানুষটি নোমোফোবিক । আসুন এক নজরে দেখে নিই। এগুলো জানা হয়তো খুব জরুরি কেননা আমাদের ঘরে ঘরে এখন এমন আতঙ্কিত মানুষজনের বসবাস। চিকিৎসকদের মতে এই ফোবিয়ায় আক্রান্ত মানুষের –
●শ্বাসপ্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিতে পরিবর্তন নজরে পড়বে। কখনও তার গতি বা হার অনেকটাই বেড়ে যাবে , আবার কখনও হয়তো নেমে আসবে একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক শ্বাস গতির নিচে।
●প্রাথমিক পর্যায়ে দুই হাতে কাঁপুনি দেখা দেয়। যত নোমোফোবিয়ার প্রকোপ বাড়বে ততই কম্পনের প্রভাব সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।
●শরীরে খুব বেশি পরিমাণে ঘাম হবে।
●সাধারণ সংবেদন অনেকটাই কমে যায়।সে ঠিক করতে পারে না ফোন নিয়ে তার আহলে কী করা উচিত। বিচারবুদ্ধির ওপর প্রভাব পড়ার ফলে তার যথাযথ সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা লোপ পায়।
●শরীরে ট্যাকিকার্ডিয়াক সমস্যা দেখা দেয় অর্থাৎ হৃদস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়।
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সবসময় মন গভীর উদ্বেগ ও উৎকন্ঠায় ভরে থাকে বলে আচরণগত গভীর সমস্যা দেখা দেয়।
বাড়ির কিশোর কিশোরীদের মধ্যেও নোমোফোবিয়ার আতঙ্ক ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। মুশকিল হলো এইসব আচরণগত সমস্যা অনেক সময়ই অভিভাবকদের নজর এড়িয়ে যায়। বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। আজকাল ছোটদের জীবনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি করে ডিজিটালাইজড হয়ে উঠেছে। সমস্ত পরিষেবা একালে অ্যাপস নির্ভর। এরফলে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে মোবাইল ফোনের সঙ্গে সময় কাটানো। ফল নোমোফোবিক হয়ে ওঠা। সমীক্ষা সূত্রে জানা গেছে যে খুব সামান্য সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য মোবাইল ব্যবহার করে। সমস্যা গহীন। এখন হয়তো সমস্যার চূড়াটুকুই শুধুমাত্র আমাদের নজরে পড়েছে। সমস্যার জট আরও জটিল হয়ে ওঠার আগে সমাধানের সম্ভাব্য উপায়গুলো জেনে নিই আমরা।
মোহমুক্তির উপায়?
সমস্যা ক্রমবর্ধমান। মনোস্বাস্থ্যবিদরা তাই আমাদের মোবাইল মোহ থেকে নিজেদের মুক্ত করার জন্য কয়েকটি উপায়ের কথা জানিয়েছেন। নোমোফোবিয়া থেকে মুক্তি পেতে হলে সবার প্রথমে যা করতে হবে তা হলো এই সমস্যা আদৌ আমাদের মনে বাসা বেঁধেছে কিনা তা যাচাই করে নিতে হবে। এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলেই পরবর্তীতে কতগুলো নতুন জীবন শৈলীর শিক্ষা মেনে চলতে হবে। এই উপায়গুলো হলো –
ডিজিটাল ডিটক্স
দিনের মধ্যে কখন মোবাইল ফোনের সঙ্গে সময় কাটাবো এবং কতটা সময় মোবাইল থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবো তা আগাম নির্দিষ্ট করে নিতে হবে। ধীরে ধীরে মোবাইল ফ্রি সময়ের সবার ক্ষেত্রে এই সময়টা এক হবে তা হয়তো নয়। তবে উত্তরোত্তর এই ফ্রি টাইমের দৈর্ঘ্য বাড়াতে হবে।
নিজের সঙ্গে থাকা
শুনতে একটু অদ্ভুত লাগলেও বাস্তবে এটাই নির্মম সত্যি যে যত সময় আমরা মোবাইলে মন মজিয়ে রাখি তত সময় আমরা আর আমায় থাকিনা। ভার্চুয়াল জগত ছেড়ে নিজের কাজের জগতে প্রবেশ করতে হবে যেখানে মোবাইল ফোনের ব্যবহার জরুরি নয়।
ব্যবহারের সীমানা
কোনো কোনো কাজের সময় মোবাইল দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। যেমন খাবার সময়,কারও সঙ্গে আলাপকালে এবং অবশ্যই বিশ্রাম নেবার সময়।
সামনাসামনি কথা বলার অভ্যাস
পরিবার পরিজনদের সঙ্গে, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মুখোমুখি কথা বলুন। এরফলে ভার্চুয়াল জগতের হাতছানি কমবে।
সামাজিক অনুষ্ঠানে মোবাইল বর্জন
কোনো সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গেলে মোবাইল সঙ্গে নেবেন না।
এগুলো কোনো নির্দেশিকা নয় । গবেষকেরা জানিয়েছেন সমস্যা আরও বেড়ে যাবার আগে কিছু বিধিনিষেধের মধ্যে ঢুকে পড়াই হবে এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে মুক্ত করার সবথেকে জোরালোতম উপায়। নিজের ভালো আমরা সকলেই চাই। খালি কখনও কখনও চোখ বুজে সমস্যাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করি। নোমোফোবিকরা কেউই গ্রহান্তরের জীব নয়, তাঁরা সকলেই রক্ত মাংসের মানুষ। তাই মোবাইল ফোনের থেকে তাঁদের দূরে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব হয়তো আমাদেরই। মনে রাখবেন হাত থেকে মোবাইল ফোন সরে গেলে আমরা কেউই শক্তিহীন হয়ে যাবনা। একথা ঠিক যে কালের নিয়মেই আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মোবাইল ফোন অনেকটাই প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে কিন্তু অপরিহার্য নয়। বিশিষ্ট নেশামুক্তি চিকিৎসক ও থেরাপিস্ট Paul Hokemeyer বলেছেন – “আমাদের যে সমস্ত মানুষের সঙ্গে বা বন্ধুদের সঙ্গে আজ আর তেমন যোগাযোগ নেই তাঁদের সঙ্গে আমরা যেমন নির্লিপ্ত আচরণ করি , মোবাইলের সঙ্গে ও তেমনটাই করা হোক। ভুলে যাওয়া বন্ধুদের মতো মোবাইলকেও আমরা একসময় ভুলে যাব, ঠিক সেভাবেই যেভাবে তাঁদের অনেককেই ভুলে গেছি।”