বিষয়টি অত্যন্ত গর্হিত এবং অমানবিক জেনেও সবিনয়ে আপনাদের সামনে একটা ছোট্ট প্রশ্ন রাখছি – কখনো ঢিল দিয়ে পাখি মেরেছেন ? বিষয়টি অন্যায় জেনেও কেন “এক ঢিলে দুই পাখি মারা” – এমন শব্দবন্ধের প্রচলন ? আমি অবশ্য একবার এক ঢিলে তিন পাখি মারার ফন্দি করেছিলাম। এই নিবন্ধে সেই প্রসঙ্গ নিয়েই কয়েকটি কথা বলবো। তবে গোড়াতেই খোলাসা করে বলি পাখি মানে সত্যিই তো আর পাখি নয় । এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বেরিয়ে একাধিক কর্ম সাধনের নাম হলো পাখি মারা। আমিও তেমনি বেরিয়ে পড়েছিলাম এক রবিবাসরীয় সকালে।
গন্তব্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর আগে আমার পাখিদের কথা বলে নিই। শীতের আভাস পাওয়া গেলেই গুটিকয়েক মরশুমী ফুলের গাছ লাগানোর কথা মনে হয়। সেগুলো নার্সারি থেকে কিনে আনাটাই ছিল আমার প্রাথমিক লক্ষ্য। বাকি দুই উদ্দেশ্যর কথা ক্রমশ প্রকাশ্য। জেলা সদরের গায়ে গা লাগিয়ে থাকা আমাদের এই জনপদের বাইরের দৃশ্যপট বিগত এক দশকে বিলকুল বদলে গেছে। এতোটাই বদলেছে যে অনেক সময় পুরনো আবাসিকদের অনেকেই এখন স্মৃতির পাতা হাতড়ে হাতড়ে অতীতের পরিচিত দৃশ্যপটের সঙ্গে এখনকার ছবিগুলোর মিল খোঁজার চেষ্টা করেন। মেলেনা কিছুই মেলেনা।
প্রশ্ন উঠবে বদলের ধরন নিয়ে। একালে এখানেও তেমন কোন জটিলতা নেই। এখন বদলে যাওয়া মানেই হলো আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট বাড়ির জঙ্গল , ঝাঁ চকচকে শপিংমল ও অগণিত সংখ্যক আলোকিত বিচিত্র সম্ভারের বিপণি, বিপুল সংখ্যক বহিরাগত মানুষের আনাগোনা , রাস্তা দাপিয়ে চলা অসংখ্য দুচাকা, চার চাকা যানের ব্যস্ত চলাচল , ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা ফাস্ট ফুডের দোকান ফলে প্রচলিত নাগরিক পরিষেবার অবনমন, এক অতি সরব পরিবেশ ইত্যাদি….। বিশ্বজোড়া এমন প্রবণতাকে এড়িয়ে,অন্য কোনো পথে পথ হাঁটা কি সহজ কথা? আমাদের শহরও সেই নিয়মেই বদলাচ্ছে খুব দ্রুত গতিতে।
বিস্তর দরদাম করে গুটিকয় মরশুমী ফুলের চারা সংগ্রহ করে সাবধানে হেঁটে আবার সেই মোড়ে ফিরি। এ জায়গাটা এখন বেশ ছায়ায় ঢাকা পড়ে গেছে আকাশ ধরে ফেলা হালফিল ফ্ল্যাট বাড়ির দৌলতে। মনে পড়ে , প্রথম যখন এই জমিতে ফ্ল্যাট তৈরির কাজ শুরু হলো তখন ঢাউস সাইজের ফ্লেক্সে বিজ্ঞাপন দেওয়া হতো হাত বাড়ালেই আম পাড়ার সুযোগ পাবেন। সঙ্গে থাকতো দাদু আর নাতির উজ্জ্বল মুখের ছবি। দুজনের মুখেই বিশ্বজয়ের ভূবন ভোলানো হাসি। যেন ওখানে থাকলেই আম খেতে খেতে দুনিয়াদারির হক পাওয়া যাবে। প্রতিদিন যাতায়াতের পথে আমিও ঐ বিজ্ঞাপন দেখতাম এবং হাসতাম। ফলবান আম গাছগুলোর জন্য একধরনের মায়া হতো। জবাইয়ের আগে মাংসের দোকানের সামনে বেঁধে রাখা পাঠাগুলোকে যেমন কাঁঠাল পাতা খেতে দেওয়া হয় , অনেকটা সেরকমই ব্যাপার। কেটে ফেলার আগে বিজ্ঞাপনে ঠাঁই দিয়ে বাড়তি কিছু খদ্দের টেনে আনার স্থূল, হাস্যকর কৌশল আর কি!
সেই গাছগুলো কবেই বিদায় নিয়েছে, মাথা উঁচু করে একঠায় দাঁড়িয়ে থাকা ফ্ল্যাট বাড়ির আগ্রাসনের শিকার হয়ে। ব্যস্ত মোড়ে একটা ছোট্ট চায়ের দোকান। একটু গরম চায়ের জন্য মনটা কেমন যেন উতলে উঠল। দোকানের সামনে পাতা নড়বড়ে চেহারার বেঞ্চে গিয়ে বসবো কিনা ভাবছি । আমার এমন ইতস্তত ভাব দেখে দোকানী আমায় আশ্বস্ত করেন – ভাঙবে না।বসুন। বিশ্বাস করে বসে পড়ে গরম চায়ের গেলাসে চুমুক দিই। হঠাৎ নজরে পড়ে একজোড়া মানবকের ওপর – একটি কিশোর ও একটি কিশোরী। বয়স আনুমানিক সাত এবং দশ বছর। রাস্তার রোড গার্ডের লোহার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দুই ভাইবোন সামনের লম্বা বাড়ির কটা তলা আছে তা গুণছিল এক দুই তিন করে করে। কখনো আগে ভাই , তারপর দিদি, আবার এর উল্টো ক্রমে। কখনো আবার দুজনেই একসাথে।
আমিও গোণা শুরু করলাম। তিনজনেই কিছুটা গোণার পর খেই হারাচ্ছিলাম।
এই করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল আমাদের এক ছাত্রের কথা, এখন এই হাউজিং এস্টেটের আবাসিক। ভাবলাম একবার ঘুরে এলে মন্দ হয়না। দ্বিতীয় পাখির দিকে ঢিল তাক করি। সন্তর্পনে সিগন্যাল দেখে রাস্তা পার হয়ে সেই আলিশান মকানগুলোর প্রধান ফটকের সামনে এসে দাঁড়াতেই ওপার থেকে প্রশ্ন ভেসে এলো – কোথায় যাবেন? বললাম – আমার এক পরিচিত এখানে থাকেন, ভাবছিলাম একবার দেখা করে যাব। সে তো যাবেন বললেই যাওয়ার উপায় নেই স্যার! এটাতো আপনার পরিচিত কারও ফ্ল্যাট বাড়ি নয়, এটা হলো একটা গেটেড সোসাইটি। এখানকার নিয়ম কানুন বিলকুল আলাদা। আর তাছাড়া…….! আমি আর দাঁড়াই না। বুঝতে পারি আমার দ্বিতীয় ঢিলটা ফস্কে গেল। তবে মনের ভেতর সিকিউরিটি পার্সনের শেষ কথাকটি যেন গেঁথে যায়। আজকের নিবন্ধ এই নতুন শোনা এবং শেখা শব্দবন্ধ – গেটেড সোসাইটি নিয়েই।
Gated Society র বাঙলা কি হবে প্রাকারবদ্ধ সমাজ যা হলো এক বিশেষ অর্থনৈতিক শ্রেণির জন্য, বিশেষ স্বাচ্ছন্দ্য যুক্ত এক আবাসিক এলাকা। যেহেতু এমন সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে এক বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে,এক বিশেষ ধরনের উপভোক্তা নাগরিকদের জন্য, সেহেতু এখানে আম জনতার অবাধ গতায়াতের যথেচ্ছ সুযোগ নেই। চারপাশের সমস্ত প্রচল ব্যবস্থাকে এড়িয়ে সেখানে এক বিশেষ শ্রেণির মানুষজনের জন্য বিশেষ সুবিধাযুক্ত এক নয়াধারার যাপন ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা হয়।
মধ্যযুগের ইউরোপে এই ধরনের উঁচু পাঁচিল ঘেরা নগরীর পত্তন করা হয়েছিল আবাসিকদের বিশেষ সুরক্ষা ও স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবে। আমাদের ভারতেও
এমন মধ্যযুগীয় দুর্গ শহরের দেখা মিলবে রাজস্থানে। এমন “শহরের মধ্যে শহর” তৈরির প্রবণতা একেবারে হাল আমলের তেমন কিন্তু মোটেই নয়। ১৯২০ সালের আশেপাশের সময়ে পশ্চিম ইউরোপীয় শহরগুলোতে এমন প্রাকার বেষ্টিত সমাজের উদ্ভব হতে শুরু করে মূলত শহরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দ্রুত গতিতে বেড়ে যাবার ফলে। নাগরিকদের আবাসিক এলাকার বাড়তি নিরাপত্তার কথা ভেবে এমন আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা শুরু হয়। সমাজের সমস্ত স্তরের মানুষজনের মধ্যে অবাধ মেলামেশার সুযোগকে কাটছাঁট করে বিশেষ শ্রেণির মানুষের নিরাপত্তা ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার আয়োজন করা শুরু হলো। ১৯২৮ সালে লন্ডনের প্রান্তিক অবস্থানে জন গলসওয়ার্দি প্রথম আধুনিক গেটেড সোসাইটি স্থাপন করলেন। বহু বিত্তবান অভিজাত মানুষ এই ব্যবস্থা মেনে নিলেন । ফলে পরবর্তীতে এমন সমাজ অন্যত্রও গড়ে তোলার কাজ জোরকদমে শুরু হলো।
ভারতবর্ষে এমন নিরাপদ, নিরিবিলি প্রাকার বেষ্টিত সমাজ গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে অপেক্ষাকৃত অল্প কিছুদিন আগে। এমনিতেই বলা হয় যে ভারতের নগরায়নের প্রক্রিয়া বেশ ধীরগতিতে চলে তার অর্থনীতিতে গ্রামীণ সমাজের প্রাধান্যের কারণে। তবে বিগত কয়েক দশকে এদেশে টার্শিয়ারি সেক্টরে কর্মসংস্থানের সুযোগ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় নাগরিক সমাজে গেটেড সোসাইটিতে বসবাসের তাগিদ বেড়েছে। যৌথ পরিবার ভেঙে তৈরি হওয়া অণু পরিবারের সদস্যদের কাছে গণ্ডি বাঁধা গেটেড সোসাইটিগুলো অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠায় এমন সামাজিক যাপনের প্রতি তরুণ প্রজন্মের নাগরিকদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। নগরীর মূল বাণিজ্যিক এলাকা ছেড়ে নগর প্রান্তিক শহরতলিতে গড়ে উঠছে এমন হাউজিং এস্টেট। নানান ধরনের লোভনীয় পরিষেবা আর প্যাকেজের আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া মোটেই সহজ নয়, বিশেষ করে যখন পকেট ভারী করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যাঙ্কগুলো । ২০২৪ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে ভারতে এই মুহূর্তে ২৬১৭ টি প্রাকার বেষ্টিত সমাজের অস্তিত্ব রয়েছে। এই সংখ্যাটা আগামী দিনে আরও আরও বাড়বে। সবাই তখন হয়তো নিজেদের প্রাচীরের ঘেরাটোপে নিজেদের বন্দি করে রাখতে পছন্দ করবে।
প্রশ্ন হলো কোন বিশেষ আকর্ষণে আজকের নাগরিক সমাজ নিজেদের প্রাকারের অন্তরালে সুরক্ষিত রাখতে চাইছে। আগেই বলেছি এক্ষেত্রেও রয়েছে নির্মাণ সংস্থাগুলোর মধ্যে তীব্র আকচাআকচি। সুযোগ সুবিধার তালিকা দেখে বিভ্রান্ত হতে হয়। সুযোগ সুবিধার তালিকা দেখতে গিয়ে বেশ কয়েকটি নির্মিয়মান গেটেড কমপ্লেক্সের বিজ্ঞাপনের দিকে নজর দিলাম। সবাই আবাসনের পসরা সাজিয়ে হাঁকাহাকি ডাকাডাকির খেলায় মেতে উঠেছে। কী কী সুবিধা মিলবে এহেন প্রাকারিত স্বপ্ন পুরীতে? দেখে নিই।
শরীরচর্চার জন্য জিমনেশিয়াম
ক্লাব হাউস
খেলাধুলার ঢালাও আয়োজন – ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ভলিবল কোর্ট, টেনিস কোর্ট।
ইনডোর গেমস হাউস ফর কিডস্ এন্ড অ্যাডাল্টস্
বিনোদন বা রিক্রিয়েশন এর ব্যবস্থা ।
সুইমিং পুল – পুরুষ ও মহিলাদের জন্য।
চিলড্রেনস পার্ক
জগিং এন্ড ওয়াকিং ট্রাক
প্লে গ্রাউন্ড
গার্ডেন, ওপেন গ্রীন স্পেস….. !
তালিকা আরও আরও দীর্ঘ হতে পারে। তবে আমি এখানেই ইতি টানবো। সুযোগ সুবিধার কথা কইতে কইতে রবিঠাকুরের সেই বিখ্যাত কবিতার প্রসঙ্গ মনে পড়ে গেল যেখানে খাঁচার পাখি আর বনের পাখি মনখুলে আলাপচারিতায় নিজেদের সরব রেখেছে। বনের পাখি মুক্ত জীবন ছেড়ে খাঁচায় ঢোকার কথা ভাবতেই পারেনা। আর খাঁচার পাখি ঐ নিরিবিলি পিঞ্জরাবাসেই সুখী। ইদানিং গেটেড সোসাইটির এমন সব এ্যামিনিটিস এর হাতছানি এড়িয়ে যাওয়া , এক কালের কিনু গোয়ালার গলি অথবা ছিদাম মুদি লেনের এজমালি বাড়িতে কোনো রকমে মাথা গুঁজে থেকে হাউই হয়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়া প্রজন্মের নবীন মানুষজনের পক্ষে এককথায় অসম্ভব। গেটেড সোসাইটির কথা বাদ দিলেও আমরা দেখবো আড়াইজন মানুষ নিয়ে গড়ে ওঠা এই সময়ের সংসারগুলো সবই পাতা হচ্ছে ফ্ল্যাট বাড়ির পরিমিত চৌহদ্দিতে। একদিকে বলা হচ্ছে , আধুনিক ডিজিটাল যুগে,পৃথিবীর পরিধি নাকি সবার হাতের মুঠোয় এসে গেছে, অন্যদিকে আমাদের চিরকালের যাযাবর মনকে এখন সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা ফ্ল্যাট গুহা বাড়িতে বন্দি করে রাখার জন্য সবাই উদগ্রীব। সামাজিক অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কোনো ব্যবস্থা তড়তড়িয়ে বেড়ে ওঠে। এটা হয়তো তারই অনিবার্য প্রতিফল।
বিষয়টি নিয়ে, এমন স্বেচ্ছা বন্দিত্বের জীবন যাপনকে মেনে নেওয়ার তথাকথিত বাধ্যবাধকতা বা সুবিধা অসুবিধা নিয়ে অনেক অনেক কথা বলার আছে। তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার সুযোগ আছে, তবে সেই বিতন্ডায় যাবো না।আজ শেষ করবো আশু বাবুর গল্প দিয়ে।
আশু বাবু , আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়। একজন আপাদমস্তক সাদামাটা ,সরল মানুষ।একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরী করতেন। পুজোপার্বণের সময় মানে লক্ষ্মী পুজো, সরস্বতী পুজোর সময় পাড়ার কয়েকটি বাড়িতে পুজো করতেন। সেই সূত্রেই আমাদের সঙ্গে পরিচয়, পরে হৃদ্যতা। আশুবাবুর স্ত্রী ছবি দেবীকে আমরা কাকিমা বলেই ডাকতাম। ওদের একমাত্র ছেলে অম্লান, পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। লেখাপড়ার ধাপগুলো সহজেই উৎরে যেতেই ডাক পেয়ে গেল এক বিশ্বময় ছড়িয়ে থাকা কোম্পানির চাকরিতে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে ছবি কাকিমা আর আশু কাকু অনেক মিষ্টি নিয়ে একদিন এলেন আমাদের বাড়িতে। সঙ্গে অম্লানও এসেছিলো।
এরই কিছুদিন পরেই শুনলাম আশু কাকুরা এ পাড়া ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে চলে যাবেন। অনেক দিন ধরে এই পাড়ায় ছিলেন ওঁরা। এখন অম্লানের চাকরিসূত্রে এই পুরনো আবাস ছেড়ে যাওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। শত হলেও সামাজিক মান বেড়েছে তো!
ছবি কাকিমারা চলে যাওয়ায় মা খানিকটা মুষড়ে পড়লেন। বাবার আড্ডা মারার এক সঙ্গী কমে গেল। এভাবেই চলছিল। হঠাৎ একদিন সন্ধেবেলায় কাকু আর কাকিমা এসে হাজির। আমরা ভাবলাম বোধহয় দেখা করতে এসেছেন। কাকু বললেন – ওখানে আমাদের মতো লোকের থাকা খুবই মুশকিল। আমরা আৎকে উঠে বললাম – কেন ? এতো দাম দিয়ে কেনা হলো, কতশত আধুনিক ব্যবস্থা,কত আয়েশ আরামের আয়োজন,কত প্রশান্তি,গাছ ,বাগান, ফুল দিয়ে সাজানো এস্টেট! তোমরা চলে এলে?
“সব ঠিক, কিন্তু প্রাণের পরশ নেই। ঢুকতে খাতায় সই করো, বেরোতে হলে জাবদা খাতায় সই করে বের হও , মন খুলে কথা বলার লোক নেই সবাই কেমন পুতুলের মতো। আর তাছাড়া আমার মতো প্রাইভেট ফার্মের এ্যাকাউন্টেন্টকে নিয়ে সামান্য মাথা ব্যাথা নেই ওদের। কেমন একটা অসাম্যের বাতাবরণে দমবন্ধ করে থাকা। এখানে থাকলে কত লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা, কথা বলা । ওখানে সেসবের সুযোগ কোথায়? বাইরের সদা চলমান জীবন থেকে দূরে সরে খাঁচার ভেতর বন্দিদের মতো থাকতে আমরা অভ্যস্ত নই। সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে,একধরনের সচেতন আত্মকেন্দ্রিকতা আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলছিল। তাই চলে এলাম। অম্লান ব্যাপারটা মানতে পারছিল না , তবুও বলে এলাম দিন কয়েকের জন্য আমাদের চেনা এঁদো গলির বাতাসে শ্বাস নিয়ে আসি। আগে ছিল বারো ঘর, এক উঠানের যাপন। আর এখন হয়েছে বারো ঘর,বারো উঠান। এ যেন উল্টো স্রোতে গা ভাসানো। একটা মানুষের জীবনে অত কিছু বৈভবী আয়োজনের কি কোনো প্রয়োজন আছে?”-- আশু কাকু তাঁর দীর্ঘ জবানবন্দি শেষ করে চায়ের পেয়ালায় চুমুক দেন। আমরা সবাই কিছুক্ষণের জন্য মৌনতা পালন করি।
সেদিনের তৃতীয় পাখি ছিল ওখানকার এক বিখ্যাত দোকান থেকে গরম গরম কচুরি আর জিলিপি কিনে আনা বাড়ির সবার জন্য। এই ঢিল অবশ্য ঠিকঠাক লক্ষ্যে লেগেছিল।