এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ধর্মঠাকুর: নিম্নবর্গের মানুষের আশ্রয় ও ন্যায়ের প্রতীক __ এস. আজাদ

    S Azad লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | ১১১ বার পঠিত
  • ধর্মঠাকুর বাংলার এক অতি প্রাচীন ও স্বতন্ত্র লোকদেবতা, যিনি ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মের মূলধারার বাইরে এক নিজস্ব সত্তা নিয়ে টিকে আছেন। তিনি শুধুমাত্র একজন দেবতা নন, বরং ছিলেন সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের আশ্রয়, ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং সামাজিক শৃঙ্খলার এক রক্ষাকর্তা। তিনি প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে গ্রাম্য দেবতা (গ্রামদেবতা) হিসেবে পূজিত হন। তাকে সাধারণত ধর্মরাজ নামে ডাকা হয়,কোথাও কোথাও শুধু ধর্ম। তার উপাসনা বাংলার প্রান্তিক সমাজের বিশ্বাস, সংগ্রাম এবং আত্মপ্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরে। ধর্মঠাকুরের কোনো নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। সাধারণত সিঁদুর মাখানো একটি আকারবিহীন পাথরের খণ্ড হিসেবে তাঁকে পূজা করা হয়। এই পাথরের খণ্ডটি গাছতলা বা উন্মুক্ত স্থানে 'ধর্মঠাকুরের থান' বা 'ধর্মরাজতলা'-এ রাখা হয়, আবার কখনো মন্দিরেও পূজা করা হয়। ধর্মঠাকুরের উৎস নিয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন তিনি মূলত অনার্য দেবতা এবং কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রাচীন জাদুমন্ত্র ও বিশ্বাস থেকে এর উৎপত্তি। পরে আর্য হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব মিশ্রিত হয়ে তাঁর পূজা বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং সুকুমার সেনের মতো গবেষকরাও তাঁর অনার্য উৎসের কথা বলেছেন। সময়ের সাথে সাথে ধর্মঠাকুরকে সূর্যদেবতা সূর্য, বরুণ, বিষ্ণু, যম, এমনকি শিব এবং বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গেও যুক্ত করা হয়েছে। সাধারণত বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা তিথিতে অথবা ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন তাঁর বিশেষ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। ধর্মঠাকুরের বাহন হলো ঘোড়া। পোড়ামাটির বা কাঠের তৈরি ঘোড়া মানত হিসেবে তাঁর কাছে উৎসর্গ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে হাতিও তাঁর বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মধ্যযুগে ধর্মঠাকুরের মহিমা প্রচারের জন্য বহু মঙ্গলকাব্য রচিত হয়, যার মধ্যে ধর্মমঙ্গল একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এই কাব্যগুলিতে রাঢ় অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এবং ডোম পুরুষ ও নারীদের বীরত্বপূর্ণ কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে। ধর্মপুরাণ নামক অন্য ধরনের সাহিত্যও তাঁর পূজা পদ্ধতি ও মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে বিবরণ দেয়।

    ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বাইরে অবস্থান ও নিম্নবর্গের আশ্রয় ধর্মঠাকুরের পূজা মূলত ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় কাঠামোর বাইরে বিকশিত হয়েছিল। বাংলার বর্ণপ্রথা প্রভাবিত সমাজে, যেখানে ব্রাহ্মণেরা ধর্মীয় আচারের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন, সেখানে বহু প্রান্তিক ও নিম্নবর্ণের মানুষের জন্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কঠোর রীতিনীতি এবং আভিজাত্য ছিল অগম্য। এই শূন্যস্থান পূরণ করেন ধর্মঠাকুর।

    অব্রাহ্মণ পুরোহিত ও অনুসারী: ধর্মঠাকুরের পূজায় ডোম, বাগদি, হাড়ি-র মতো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষেরাই প্রধানত পুরোহিতের ভূমিকা পালন করত। এই বিষয়টি প্রমাণ করে যে, ধর্মঠাকুরের উপাসনা ছিল মূলত নিম্নবর্ণের মানুষের দ্বারা পরিচালিত এবং তাদের জন্যই নিবেদিত। এটি তাদের ধর্মীয় আত্মপ্রকাশের একটি শক্তিশালী মাধ্যম ছিল, যেখানে তারা নিজেদের সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে স্বাধীনভাবে চর্চা করতে পারত।

    সমান্তরাল ধর্মীয় ধারা: ধর্মঠাকুরের উপাসনা ছিল সমাজের মূলধারার বাইরে এক সমান্তরাল ধর্মীয় ধারা, যা ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিকল্প হিসেবে কাজ করত। এর মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচিতি এবং সামাজিক মর্যাদা খুঁজে পেত।

    ন্যায় ও সত্যের প্রতীক: সামাজিক শৃঙ্খলার রক্ষাকর্তা ধর্মঠাকুর কেবল একজন লোকদেবতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন ন্যায়বিচার, সত্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার মূর্ত প্রতীক। গ্রামীণ সমাজে, যেখানে বিচার ব্যবস্থা ততটা সুসংগঠিত ছিল না, সেখানে ধর্মঠাকুরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

    সালিশি ও বিচারের উৎস: গ্রামের বিবাদ, পারিবারিক কলহ বা সামাজিক অন্যায় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ধর্মঠাকুরের দোহাই দেওয়া হতো। মানুষ বিশ্বাস করত, ধর্মঠাকুর অসত্যকে সহ্য করেন না এবং অন্যায়কারীর শাস্তি নিশ্চিত করেন। তাই তার নামে শপথ নেওয়া বা তার কাছে বিচারের প্রার্থনা করা ছিল প্রচলিত প্রথা।

    ধর্মীয় ভয় ও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ: ধর্মঠাকুরের প্রতি মানুষের ভক্তি ও ভয় ছিল সামাজিক নিয়ন্ত্রণের একটি শক্তিশালী উপাদান। অন্যায় কাজ করতে গেলে ধর্মঠাকুরের শাস্তির ভয়ে অনেকে বিরত থাকত। তিনি ছিলেন গ্রামীণ সমাজের অলিখিত বিচারক, যিনি সত্য ও মিথ্যাকে পৃথক করতেন এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করতেন।

    ধর্মের অর্থ: 'ধর্ম' শব্দটির মধ্যেই রয়েছে নৈতিকতা, ন্যায় ও শৃঙ্খলার ধারণা। ধর্মঠাকুর এই 'ধর্ম'-এরই রক্ষক ছিলেন, যা সাধারণ মানুষের কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল।

    গাজন উৎসব: গ্রামীণ সংস্কৃতির মিলনমেলা ধর্মঠাকুরের পূজা কেন্দ্র করে যে ধর্মমেলা বা গাজন উৎসব আয়োজিত হতো, তা ছিল প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতির এক বিশাল অংশ এবং সামাজিক মেলামেশার কেন্দ্রবিন্দু। শিবের গাজনের মতো হলেও এই উৎসবে ঘোড়ার ব্যবহার আবশ্যিক, যা শিবের গাজনে দেখা যায় না। গাজনের সন্ন্যাসীদের 'ভক্ত' বা 'ভক্তিয়া' বলা হয়, যারা কিছু বিশেষ আচার পালন করেন। এই উৎসবে খুলি নাচও প্রচলিত আছে, যা অনার্য সংস্কৃতির অংশ বলে মনে করা হয়।

    সামাজিক সংহতি ও ঐক্য: গাজন উৎসবে গ্রামের সকল স্তরের মানুষ, বিশেষ করে নিম্নবর্গের মানুষেরা একত্রিত হতো। এটি ছিল সামাজিক ভেদাভেদ ভুলে একত্রিত হওয়ার একটি সুযোগ, যা সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি ও ঐক্য গড়ে তুলত।

    লোকায়ত আচার ও পরিবেশনা: গাজনে সন্ন্যাসীরা বিভিন্ন ধরনের লোকাচার, নৃত্য, গান এবং বিশেষ পরিবেশনার মাধ্যমে ধর্মঠাকুরের মহিমা প্রচার করত। এই উৎসব ছিল কেবল ধর্মীয় আচার নয়, এটি ছিল গ্রামীণ লোকনৃত্য, লোকসংগীত এবং লোকনাট্যের এক বিশাল আয়োজন, যা মানুষকে বিনোদন জোগাত এবং তাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখত।

    কৃষিভিত্তিক সমাজের উদযাপন: অনেক গবেষক মনে করেন, ধর্মঠাকুরের পূজা এবং গাজন উৎসবের সঙ্গে কৃষিভিত্তিক সমাজের উৎপাদন, উর্বরতা এবং বর্ষা কামনার সম্পর্ক ছিল। এটি ফসল ফলানোর সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানকে প্রতীকায়িত করত।

    ধর্মঠাকুরের উপাসনা প্রাচীন বাংলার নিম্নবর্গের মানুষের জন্য ছিল শুধু একটি ধর্মীয় প্রথা নয়, বরং এটি ছিল তাদের সামাজিক আত্মমর্যাদা, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক শক্তিশালী মাধ্যম। তার পূজা বাংলার লোকধর্মের গভীরতা ও বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে, যেখানে মূলধারার ধর্মীয় কাঠামো থেকে ভিন্ন এক নিজস্ব বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। যদিও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ও স্থান ভেদে পূজার উপাচার রীতিনীতি ও পদ্ধতিগত কিছু অদলবদল চোখে পরে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খারাপ-ভাল প্রতিক্রিয়া দিন