সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। একরাশ উদ্বেগে মুখ ভার হয়ে আছে আসগরেরও। অবশ্য এমন হাল শুধু তাঁর একার নয় , নদীর ধারে থাকা সব মানুষজনের। কাল তখন অনেক রাত, সারাদিনের খাটাখাটনির পর বিছানায় শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে একদম কাদা। আসগর শুয়ে পড়লেও নূরজাহানের শুতে শুতে আরও অনেকটাই দেরি হয়। এঁটো বাসনপত্র তুলে, জায়গা মতো রেখে খাবার জায়গাটা নিকিয়ে নেওয়া। এরপর আঁচঘরের শিকল তুলে, সদর দরজায় ডাসা দিয়ে তবে ছুটি। সরকারি খরচে তৈরি বাড়ি। এসব ক্ষেত্রে নিজেদের ইচ্ছামত সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নেওয়া যায়না। ওদের নকশা মোতাবেক আয়োজন করতে হয়। খেপে খেপে টাকা বরাদ্দ করে পঞ্চায়েত থেকে, তাতেও হাজার বাহানা। ঘরের আলো নিভিয়ে বিছানায় শুতে ওঠে নূরজাহান। পাশে শুয়ে থাকা মেয়ে নাসরিনের গায়ে আলতো করে হাত বুলিয়ে আদর করে। তারপর চোখ বুজে আসে সারাদিনের ক্লান্তিতে। পাশের ঘর থেকে আসগরের নাক ডাকার শব্দ শোনা যায়। লোকটা আর বদলালো না।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায় আসগরের। বাইরের হৈচৈ শব্দ কানে আসে। ভেসে আসে মাইকে কিছু একটা ঘোষণার আওয়াজ। বিপদের আঁচ পেয়েই বিছানার ওপর খাড়া হয়ে উঠে বসে সে। কথাগুলো এখন অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে – “আকিবপুর পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে জানানো যাচ্ছে পাশের রাজ্যের বাঁধ থেকে বিপুল পরিমাণ জল ছাড়ার ফলে গোটা জেলায় ও পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আগামী কাল সকালের আগেই গোটা এলাকা ভয়ঙ্কর বন্যায় প্লাবিত হতে পারে এমনই আশঙ্কা করছেন প্রশাসন। আপনারা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে স্থানীয় রিলিফ সেন্টারে চলে যান। অযথা দেরি করবেন না।”
আলো জ্বালাতে গিয়ে আসগর টের পায় বিজলি চলে গেছে। অন্ধকার হাতড়ে নিজের ঘর ছেড়ে পাশের ঘরে গিয়ে সে নূরজাহানকে ডেকে তোলে। ধড়ফড়িয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে নূরজাহান। এরমধ্যেই হ্যারিকেন ধরিয়ে ফেলেছে আসগর। বাইরে পলায়নপর ভয়ার্ত মানুষের ভেসে আসা কন্ঠস্বর তাকে আরও বিহ্বল করে তোলে। নসরিন সবটা বুঝতে পারে না। তবে আগাম বিপর্যয়ের বিষয়টা বেশ টের পায়। হ্যারিকেনের ম্লান আলোয় সবকিছু ঠিকঠাক গুছিয়ে নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। তাও দ্রুত গতিতে যথাসম্ভব গুছিয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে যাবার তোরজোড় করে ওরা । নসরিনও হাত লাগায়। এমন সময় দরজায় টোকা মারার শব্দ শোনা যায়। জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতেই আসগর জবাব দেয় –
কে? দরজায় ধাক্কা দাও কে ?
আমিগো আমি, সোলেমান। বেবাক গুছাইয়া নিছো? পানি আসতেছে,খবর পাইছো নি ?
হ ,হ । পাইছি। অগো কথা শুইন্যাই তো টের পাইলাম। তোমাগো গোছান্ হৈছে? হইলে চলো, একলগে যাই। আমি আমার ভ্যানডারে আনছি । মালপত্র তুইলা দাও। হালাগো আর কাম নাই। ক্ষোভে গজগজ করতে থাকে সোলেমান।
হাতে হাতে লটবহর সোলেমানের ভ্যানে তুলে দিয়ে ওরা হাঁটতে থাকে রিলিফ সেন্টারের দিকে। অন্ধকারেই টের পায় বহু আশঙ্কায় মুহ্যমান একদল মানুষের মিছিল চলেছে।
এও এক যাযাবর জীবন মানুষের। প্রকৃতির রোষ বাড়ার ফলে মানুষের থিতু জীবনের চেনা সুরটাই কেটে যাবার জোগাড় হয়
বারংবার । কখনো ঝড় তুফান, কখনো ভূকম্পন, আবার কখনও বা বন্যা – বারবার ঘুরেফিরে ঘটেই চলেছে ক্লান্তিহীনভাবে।
নদীর হানাদারিতে বন্যা এসে দুয়ারে কড়া নাড়ে। ওঠে ভাঙনের কল্লোল। অথচ নদীর সঙ্গে মানুষের সহবাস তো একালের চর্চার বিষয় নয়, আবহমানকালের। তিরতির করে সোহাগী মেয়ের মতো মানুষের গা ঘেঁষে বয়ে চলা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মন্টানা প্রদেশের ছোট্ট রো নদী ( দৈর্ঘ্য মাত্র ৬১ মিটার বা ২০১ ফুট) থেকে শুরু করে শুষ্ক মরুভূমির হাজারো বিধিনিষেধ এড়িয়ে আপন পৌরুষের গরিমায় বয়ে চলা নীল নদ ( দৈর্ঘ্য ৪১৩২ মাইল বা ৬৬৫০ কিলোমিটার) সবাই যে শরীরে জল বয়ে নিয়ে চলেছে ব্যস্ত ভিস্তিওয়ালাদের মতো। ঐ জলের টানেই তো আমাদের তাদের কাছে যাওয়া, তাদের বুকে নাও ভাসিয়ে দূরগামী হওয়া। অবশ্য মানুষের খবরদারির অন্ত নেই। নিজেরা যা ইচ্ছে তাই করে পার পেয়ে গেলেও নদীর উছলে ওঠা সইতে পারিনা। দুরন্ত ছাত্রকে শায়েস্তা করতে গিয়ে যেমন হাজারো বিধিনিষেধের ফাঁদে তাকে জড়িয়ে ফেলেন ততোধিক দুরন্ত গুরুমশাই, তেমনি নদীকে বশ মানাতে গিয়ে কংক্রিটের বাঁধনে বেঁধে দেওয়া হয়। নদী যে তাতে আরও ক্ষেপে ওঠে তা বুঝলেও না বোঝার ভাণ করে থাকি আমরা।
এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনায় যাবার আগে খুব সহজ করে, একেবারে স্কুল পাঠ্য বইয়ের মতো করে, নদী সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে। নদী কাকে বলে? নদী হলো প্রবহমান প্রাকৃতিক জলধারা যার একটি নিজস্ব চলার পথ বা খাত আছে। খাতের চরিত্র বা প্রকৃতি নির্ভর করে নদীর সামর্থ্যের ওপরে। নদীর সামর্থ্যের বিষয়টি আবার একান্তভাবে নির্ভর করে জলের জোগানের ওপর। প্রশ্ন হলো নদী জল পায় কোথা থেকে? এর উত্তরও খুব সহজ, পৃথিবীর অধিকাংশ নদী যে জল বহন করে তা আসে বৃষ্টিধারা থেকে। উত্তর ভারতের প্রধান নদীগুলোকে বাদ দিলে, দক্ষিণাপথের মালভূমির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট বড়ো সমস্ত নদীই সম্পূর্ণভাবে বৃষ্টির জলের ওপর নির্ভর করে।
আর এক শ্রেণির নদী রয়েছে যারা পার্বত্য হিমবাহের বরফগলা জলে পুষ্ট। ভারতের প্রাণ ধারা গঙ্গা এই শ্রেণির নদী।*
নদীতে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় কীভাবে সে কথা বলার আগে নদী জলের বাড়া কমা সম্পর্কে আরও একটি জরুরি কথা সেরে নিই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে পৃথিবীর নিরক্ষীয় অঞ্চলের নদীগুলোতে বছরভর জলের জোগান প্রায় একই রকম থাকে। ক্রান্তীয় মৌসুমী অঞ্চলের নদীগুলোতে গ্রীষ্মের পর বর্ষা ঋতুতে জলের জোগান অনেকটাই বেড়ে যায় ফলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ক্রান্তীয় মরু অঞ্চলের নদীগুলোতে জলের জোগান পরিমিত। নদীগুলো একান্তই মরশুমী। নাতি শীতোষ্ণ অঞ্চলের নদীগুলোতেও গ্রীষ্মকালীন জলবৃদ্ধি হয়। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলের দেশগুলোতে আবার শীতকালেই বৃষ্টি হয়, তাই ঐ সময়ে জলের জোগান বেড়ে গিয়ে কখনও কখনও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এছাড়াও নদী এঁকেবেঁকে চলতে ভালোবাসে। কখনো ডাইনে কখনো বাঁয়ে। প্লাবন ভূমিতে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। এরফলে নদী খাত ক্রমশই অগভীর হয়ে বন্যার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়।
গত বছরের শেষ দিক থেকে শুরু করে এই নিবন্ধটি লেখার সময় পর্যন্ত পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষেরা প্রবল বন্যার সম্মুখীন হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের পাশাপাশি আমাদের রাজ্যকেও খুব সম্প্রতি বন্যায় বানভাসি হতে দেখলাম আমরা। কলকাতার কিছু অঞ্চলে গোড়ালি অবধি জল উঠলেই মেইন স্ট্রিম মিডিয়া বিপুল হৈচৈ শুরু করে দেয়, ব্যবস্থাপনার মুণ্ডুপাত করে, অথচ এই বন্যায় বানভাসি গ্রামীণ এলাকার মানুষের দুঃসহ দুর্গতি তাঁদের নজর এড়িয়ে যায়। দুবাইয়ের ভয়ঙ্কর বন্যার কথা এখনও স্মৃতিতে সজীব। সেখানে নদীর দাপাদাপি ছিলনা, ছিল আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি। আসলে বিশ্ব উষ্ণায়নের অব্যবহিত ফলাফল হিসেবে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন এমনসব বন্যার অন্যতম কারণ। জলবায়ুর চরিত্র যে বিলকুল বদলে গেছে তা বোধহয় বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
পৃথিবীর এমন কোনো মহাদেশ বাকি নেই যেখানে এই এক বছরে বন্যার পদচিহ্ন পড়েনি। আলোচনাটাকে একটু ছোট পরিসরে মেলে ধরে গোটা পরিস্থিতিকে বোঝার চেষ্টা করি । দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মানুষ জন মরশুমী মৌসুমী বৃষ্টিপাতের ওপর নির্ভরশীল। অথচ পরিবর্তিত আবহিক বিরূপতার দরুণ মৌসুমী বৃষ্টিপাতের চরিত্র একদম বদলে গেছে। একটা দীর্ঘ খরা পরিস্থিতির পর যখন বৃষ্টি নামলো তখন তার আর থামার নাম নেই। পরিস্থিতি এতোটাই উদ্বেগের যে থর মরুভূমির দেশ রাজস্থান এবার অভূতপূর্ব বন্যায় বানভাসি। রাজস্থানের পশ্চিম প্রান্তীয় জেলাগুলোও এবার বন্যাগ্রস্ত হয়েছে ।বন্যা হলেই নদী ছাপিয়ে জল ঢুকে পড়ে জনপদের ভেতরে , ভেসে যায় চাষের খেত। ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে মানুষ পাড়ি দিতে বাধ্য হয় অন্য আশ্রয়ের খোঁজে। এমন অবস্থা সৃষ্টি হলে আঙুল তুলবো কার দিকে ? সব পার্থিব প্রাকৃতিক শৃঙ্খলাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিশৃঙ্খল করে নিজেরাই নিজেদের বিপন্ন করছি প্রতিনিয়ত। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ , সিকিম,কেরাল , নেপাল - কত নাম করবো! সব জায়গাতেই হাহাকারের এক বেদনার্ত সুরের অনুরণন।
এখানেই শেষ নয়।একটু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলে দেখবো প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, থেকে শুরু করে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের ইয়েমেন,কাতার, বাহরিন সর্বত্রই বন্যা কবলিত হয়েছে মানুষ। একালের দুনিয়ায় উন্নয়নের বিস্ময়কর উদাহরণ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া চিন দেশের বন্যার দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। এও এক আশ্চর্য দ্বৈধতা– যতবেশি উন্নয়ন, তত প্রবল বন্যা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সাম্প্রতিক বন্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যতই উন্নয়নের ঠাট বাট দেখাও না কেন , প্রকৃতির রোষ ঠেকানোর ক্ষমতা মানুষের নেই।
সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে যে, কেবলমাত্র বন্যার কারণে সারা দুনিয়ার প্রায় ২৪ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হয়ে প্রব্রজনে বাধ্য হয়েছে। একথা মাথায় রাখতে হবে যে এই সমস্ত বন্যা পীড়িত মানুষের প্রায় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই হলো সমাজের একেবারে নিম্ন আয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। বন্যা সহ অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিপর্যয়ের পৌনঃপুনিকতা যেভাবে বাড়ছে তাতে আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যাটা ২০০ মিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে বলে অনুমান করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের এই সংঘাত কোন্ পরিণতির দিকে আমাদের মানবজাতিকে নিয়ে যাবে তা অনুমান করা এখনই সম্ভব নয়। তবে ফলাফল যে স্বস্তিদায়ক হবেনা তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
অতি বৃষ্টিপাতের কারণে পার্বত্য অঞ্চলে বন্যা হলে তার পরিণতি নদীর বাস্তুতন্ত্রের ওপর গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। নেপালের সাম্প্রতিক বন্যার কথাই ধরা যাক। হড়পা বানের কারণে বিস্তির্ণ অঞ্চল জুড়ে ধস নেমেছে। এই অবস্কর নদীখাতে জমা হবার ফলে নদীখাত আরও অগভীর হয়ে পড়ায় কমেছে জলধারণের ক্ষমতা। এই সমস্ত উপাদান আমাদের রাজ্যের উত্তর প্রান্তের নদী খাতগুলোতে জমা হওয়ায় এগুলোও বন্যা কবলিত হয়েছে। উত্তর ভারতের বিস্তির্ণ অঞ্চল জুড়ে কৃষি জমির সম্প্রসারণ, অপরিকল্পিতভাবে শহর ও নগরবসতির বিকাশ, উন্নয়নের নামে যথেচ্ছভাবে গাছপালা কেটে ফেলার ফলে বেড়েছে ভূমিক্ষয় । সমস্ত উপাদান জমা হচ্ছে নদীখাতে।নদী গতিহীন হয়ে দ্রুত হারাচ্ছে প্রবহমানতা, কমছে জলকে নির্দিষ্ট খাতে ধরে রাখার ক্ষমতা – পরিণতি কুলপ্লাবি বন্যা। বিপর্যস্ত জনজীবন। এ এক সহজ হিসাব। স্বার্থান্বেষী মানুষের মদতে চলছে অবাধে নদী লুন্ঠন যজ্ঞ । কেরালায় ওয়েনাড়ে নদী লুট করে তৈরি করা হয়েছিল বসতি, রিসর্ট, হোটেল। প্রবল বর্ষণের ফলে হড়পা বান ভাসিয়ে নিয়ে গেল সব। এতো কাণ্ডের পর নদী দখল নিয়েছে তার হারিয়ে যাওয়া চলার পথটিকে। এভাবেই প্রতিনিয়ত চলছে নদী হনন পর্ব। নানান ছল ছুতোয়। এরপরেও নদী হানা দিলে দোষ কোথায় তার!! ড্রেজিং করে নদী খাতের চরিত্র স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা যায় খানিকটা তবে তা এতোটাই ব্যয়বহুল যে সাধারণ রাষ্ট্রের পক্ষে তার ভার বহন করা সম্ভব নয়। সেই কাজেও চাই সুষ্ঠু পরিকল্পনা, নদী সচেতনতা।
নদীর সঙ্গে জুড়ে গেছে রাজনীতি, জল দখলের রাজনীতি। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ভারতে বহুমুখী নদী পরিকল্পনার নামে যথেচ্ছভাবে নদীগুলোকে কংক্রিটের শিকলে বেঁধে ফেলা হয়েছে। চলার পথের এমন বাধা নদী মানবে কেন? ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রকল্প রূপায়ণের একেবারে শুরুতে প্রশ্ন তুলেছিলেন নদী বিশেষজ্ঞরা, দিয়েছিলেন বিকল্প ভাবনা, সমান্তরাল দিশা। কিন্তু সে কথা মানা হয়নি। কি দেখছি আমরা? মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া জেলায় নদী ভাঙনের কবলে পড়েছেন অগণিত পরিবারের সদস্যরা। ভাঙনের গ্রাসে রাতারাতি লোপাট হয়ে গেছে তিলতিল করে গড়ে তোলা তাঁদের বসতভিটা, চাষের জমি,ফলের বাগান, স্কুল, মাদ্রাসা থেকে শুরু করে প্রশাসনিক ভবন। এই বিপর্যয়ের দায় কে নেবে? ভাঙন নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে প্রশাসনের তরফে কিছু আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বটে, মেলে কিছু খয়রাতি সাহায্য, কিন্তু এসব করে সমস্যার যথার্থ সমাধান হয়না। অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয় মাত্র।
ইদানিং ম্যান মেড বন্যার কথা বলা হচ্ছে । এই শব্দবন্ধ কেউ উচ্চারণ করলে শুরু হয় বিপুল রসিকতা। সাধারণ ভাবে অতি বৃষ্টির কারণে বন্যা হয় বা সেই সম্ভাবনার সৃষ্টি হয় -এমন কথা মেনে নিয়েও বলা যায় যে ফ্লাড পলিটিক্সও কখনো কখনো এর পেছনে সক্রিয় থাকে। সাধারণ মানুষজনকে দুর্গতিগ্রস্ত করে তোলার পেছনে এক ধরনের স্যাডিজিম মানসিকতা হয়তো কাজ করে– তোমার দুখ, আমার সুখ। আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে নিকট ভবিষ্যতেই প্রবহমান পেয় জলের দখলদারি নিয়ে পারস্পরিক অসহযোগিতা, হানাহানি আরও বেড়ে যাবে। মনে রাখবেন পৃথিবীর বিপুল পরিমাণ জল ভাণ্ডারের ৯৯ শতাংশেরও বেশি অব্যবহার্য সামুদ্রিক নোনা জল,ওই জলে প্রাণিকুলের প্রয়োজন মেটেনা। ফলে ক্রমশ বেড়ে চলেছে নদীকেন্দ্রিক রাজনীতির পারদ। খুব সম্প্রতি বাংলাদেশ ভারতের দিকে আঙ্গুল তুলে অভিযোগ করেছে তাঁদের দেশে ভারতের ছাড়া নদীর জলে বন্যা হয়েছে। ভারত সরকার যথারীতি খারিজ করে দিয়েছে এই দাবি, কিন্তু একটা খিঁচ থেকেই যাচ্ছে সম্পর্কের ব্যাপারে। তবে ম্যান মেড বন্যার বিষয়টির মধ্যে কোনো সারবত্তা নেই এমনটাও নয়।
বন্যা, নদী জলের ভাগ দখলদারি নিয়ে পারস্পরিক অসহযোগিতা ও সংঘাতের বিষয়টি ক্রমশই হাইড্রো ইম্পিরিয়ালিজিমের হাত ধরে হাইড্রো ক্যাপিটালিজমের পথ ধরেছে। প্রাকৃতিক জল শক্তির বিকাশ যে প্রকৃতপক্ষে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থারই অঙ্গ তা বোধহয় বোঝবার সময় হয়েছে। ঊনিশ ও বিংশ শতাব্দীর ফ্রান্সে এই ধারণার জন্ম যা নদীর জলের মতোই ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য উপনিবেশগুলোতে। নিজেদের স্বার্থেই ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো একেএকে উপনিবেশগুলোর দীর্ঘ সময় ধরে প্রচলিত রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং বাস্তুতান্ত্রিক যাপনের সমস্ত ক্ষেত্রগুলোকে ধংস করে ফেলেছে। নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থেই প্রাক্ বৃটিশ যুগের ভারতীয় কৃষি কাঠামোকে ভেঙেচুরে এক পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থার পত্তন করেছে। প্রথাগত ঋতুচক্রের সুবিধাকে নস্যাৎ করে পত্তন করেছে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দীর্ঘমেয়াদি অর্থকরী বাজারি ফসলের চাষ। এজন্য নদীর জলের ওপর স্থাপিত হয়েছে একছত্র পুঁজিবাদী নিয়ন্ত্রণ। এখন কর্তার ইচ্ছায় চলে নদী জলের জোগান। কখন ছাড়বে আর কখন ধরবে তা তাঁরাই ঠিক করে। বন্যার প্রসাদ পায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
এককালে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এমন আগ্রাসনের হাত ধরেছে, আর আজ তাঁদের জায়গা নিয়েছে ধনী পুঁজিপতি থেকে শুরু করে কর্পোরেট সংস্থাগুলো। শ্বেত কয়লার ব্যবহার বাড়ানোর নামে সমস্ত সম্ভাব্য নদী উৎসগুলোর দখল নিতে চাইছে তাঁরা। এঁরাই ঠিক করছে নদীর জলের ভাগ কে পাবে, কখন পাবে, কতটা পাবে? সব। সরকারি সংস্থার আচরণের মধ্যেও প্রকাশ পাচ্ছে এমনই পুঁজিবাদী মানসিকতা। সুতরাং বন্যা এখন ম্যানমেড তামাশা। এই প্রসঙ্গে বৃদ্ধ ফকির চাঁদের কথা মনে পড়লো। বানভাসি হয়ে সেই বাস্তুহারা মানুষটি এসেছিলেন কাজের খোঁজে। কথায় কথায় তিনি বলেছিলেন ,
নদীর বন্যা মোদের জন্য পলির পশরা নিয়ে আসে। বন্যার পানি নেমে গেলে লাগে ফসল চাষের ধুম। ফসলের ভারে উপচে পড়ে গোলা”। আর এখন? জানা গেল খানাকুলের বানভাসি কৃষিজমি এখন চার ফুট বালির তলায়। সেই বালির দখলদারি কব্জা করতে চলছে নেতাদের সুললিত শাসানি।
হায় আমার দেশ!
জলের রাজনীতির রাশ এখন নিয়ন্ত্রক সংস্থার হাতে। তাই প্রচণ্ড তাপে কৃষি জমি ফুটিফাটা হলেও প্রয়োজনীয় জল মেলেনা, অথচ ভরা বর্ষায় কিউসেকের পর কিউসেক জল ছেড়ে দিয়ে ভাটির মানুষকে বিব্রত করা হয়। নর্মদা নদীর ওপর সর্দার সরোবর প্রকল্প রূপায়ণের সময় সাধারণ মানুষ কোমর কষে প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন, কিন্তু পুঁজির অপার শক্তির কাছে হার মানতে হয়েছিল তাঁদের। বাঁধের পেছনে জল ধরে রাখতে গিয়ে প্লাবিত করা হয়েছিল বিস্তির্ণ অঞ্চলকে, ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল অগণিত সংখ্যক মানুষকে। হারিয়ে গিয়েছে তাঁদের কষ্টার্জিত জীবনের সমস্ত আয়োজন। এদেশে জল থৈ থৈ ভরা বর্ষায় কিউসেকের জলে বানভাসি হতে হয় মানুষদের। এটাই এখন নির্ভেজাল প্রহসন।এমন বিয়োগান্তক ঘটনা বারবার ঘুরেফিরে ঘটেই চলেছে এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে সেখানে। সাধারণ মানুষের কান্না শোনার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নেই। আক্ষেপ সেখানেই।