ঢাকা থেকে আমিরুল বাশার মেসেজ করেছে, আমার দাদা খায়রুল বাশার যাচ্ছেন কলকাতার নন্দনে বাংলাদেশ বই মেলায়, তাঁর একটি প্রকাশন সংস্থা আছে, সাঁকোবাড়ি, আপনি তাঁর সঙ্গে আলাপ করবেন দাদা, খুব খুশি হবেন উনি।
আমিরুলকে মুখোমুখি চেনে না বিমলেশ। তার সঙ্গে আলাপ ফেসবুকে। সেই আলাপ এখন বন্ধুতায় গভীর। আমিরুলের আদি বাড়ি সাতক্ষীরে। থাকে ঢাকায়। একটি পত্রিকার রিপোর্টার। আর থিয়েটার করে। তাদের পরিবারের সকলে থিয়েটার আর সিনেমা পাগল। তার দাদা নাটকও লেখেন, উপন্যাস, গল্প। নিজের প্রকাশন সংস্থা থেকেই তা নিজেই ছাপেন। বিক্রি করেন। তো সেই সাতক্ষীরে ধরেই তাদের আলাপের সূত্রপাত। বিমলেশদের আদি বাড়ি ছিল সাতক্ষীরে সংলগ্ন গ্রাম ধূলিহরে। বিমলেশ সেখানে কাটিয়েছে তার পাঁচ বছর পযর্ন্ত। সে কতকাল আগে। একজন্ম পেরিয়ে যেন বা। বছর কুড়ি আগে একবার সুযোগ হয়েছিল সাতক্ষীরে হয়ে ধূলিহর গমনের। গিয়ে কিছুই খুঁজে পায়নি বিমলেশ। যা পেয়েছিল, তা তার চোখে জল এনেছিল। কতদিন বাদে আবার সত্যিকারের আর একটা লোকের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সে, যার বাড়ি সাতক্ষীরে। কেন যাচ্ছে? কী হবে গিয়ে ? দেশ তো আর তার নেই। সাতক্ষীরেতে তার কী? কী, তা বলতে পারবে না বিমলেশ। সে ষাট পেরোনো বয়সের এক প্রৌঢ়। তার জীবনের পঞ্চান্ন বছর কেটেছে এই শহরে আর পশ্চিমবঙ্গের মফসসলে। গঞ্জে, গ্রামে। সে সবও বাংলা, কিন্তু পশ্চিমের। সাতক্ষীরে বসিরহাট থেকে মাইল কুড়ি। পুবের বাংলা। আলাদা দেশ। আলাদা সব। মুদ্রা থেকে পতাকা। রাজধানী থেকে প্রধানমন্ত্রী, সব। সাতক্ষীরের একটি গলিপথও চেনে না সে। একটি রাস্তার নামও জানে না সে। কটা ইস্কুল, কটা কলেজ, কোন রাস্তা কোন পথে গেছে জানে না। সাতক্ষীরে তার কাছে ভেনিস কিংবা প্যারি শহরের চেয়েও অজ্ঞাত। বরং সেই শহরগুলির অনেকটা চেনে সে। সিনেমায় দেখেছে, বইয়ে পড়েছে, উপন্যাসে সেই সব শহরের বিবরণ পড়েছে। ভেনিসে গেলেই সে গন্ডোলায় চেপে জলপথে শহরটা দেখে বেড়াবে। প্যারিতে ম্যুলা রুজে, পেইন্টিং, কাফে, আড্ডা। কোথায় আঁদ্রে জিদ থাকতেন, জাঁ পল সাঁত্রে, ফ্লবের? পিকাশোর অরিজিনাল পেইন্টিং দেখা যাবে কোথায়? গ্যেরনিকা দেখবে সে। আর আইফেল টাওয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে আনবে। কিন্তু সাতক্ষীরে গেলে কি আনবে সে? সাতক্ষীরে কী জন্য বিখ্যাত তা জানে না সে। লন্ডন শহরের কাছে অ্যাভন নদীর তীরে সেক্সপীয়রের জন্মস্থান দেখতে যাবে। সাতক্ষীরেতে তেমন কিছু কি আছে? কিছুই জানে না সে। কোনো বইয়ে পড়েনি, সিনেমায় দ্যাখেনি, কারোর কাছে শোনেনি। বরিশাল শহরে জীবনানন্দ দাশের বাড়ি, ব্রজমোহন কলেজ, অশ্বিনী দত্তের বাড়ি, কিন্তু সাতক্ষীরেতে তেমন কী আছে যে সে সেই টানে যাবে? কিন্তু টান তার আছে। কিসের টান সেই শহরের প্রতি তা বুঝতে পারে না বিমলেশ। ছেলেবেলা থেকে কত কথা শুনেছে সে সাতক্ষীরে নিয়ে। ঠাকুমা, ঠাকুদ্দা, মা, বাবা, কাকা, কাকি, মেসো, মাসি, মাসতুতো ভাই প্রকাশ......যে কোনো দুজন এক হলেই সাতক্ষীরের কথা বলত। সাতক্ষীরে, কাঁচাগোল্লা সন্দেশ, বেতনা নদী, কপোতাক্ষ নদ, সোনাই নদী, ধূলিহর, বুধাহাটা, বড়দলৈ ঘাট, স্টিমার......। তখন তাঁদের ভিতর মেসো ব্যতীত সকলেই সাতক্ষীরে ছেড়ে আসা মানুষ। মেসো ওপারেই থাকতেন। এপারে বারাসতে মেসোর দুই ছেলে, বড় বাড়ি। আর ওপারে আর দুই ছেলে নিয়ে মেসো আর মাসি। মাঝে মাঝে সাতক্ষীরের খবর নিয়ে আসতেন। কিন্তু কী খবর? পাকিস্তান, আয়ুব খাঁর খবর। উর্দু না শিখলে হবে না, এইসব খবর।
সেই সাতক্ষীরের গল্প এখন মিলিয়ে গেছে। মেসো, মাসি এপারে এসে কষ্ট পেয়ে মারা গেছেন। বাবা, মা, কাকা কাকিরা নেই। বারাসতের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেছে। মাসতুতো ভাইদের সংসার কেমন চলছে জানে না বিমলেশ। ওপার থেকে আসা দুই ভাই খুব কষ্ট করেছে শুনেছিল সে। সাতক্ষীরের কথা তারা বলতে বলতে থেমে গেছে মনে হয়। বিমলেশ রবীন্দ্রসদন চত্বরে বাংলাদেশ বই মেলায় হাজির। সকলেই বাংলাদেশের প্রকাশক। বই সব বাংলাদেশের। “সাঁকোবাড়ি” একটি প্রকাশন সংস্থার নাম। কী সুন্দর নাম! সে বাংলাদেশের কিছু কিছু লেখকের বই পড়েছে। বই তার নেশাও। কিন্তু এই লেখকের নাম সে জানে না। সাতক্ষীরের লেখক, নাট্যকার। সে এতদিন বাদে জানল সাতক্ষীরে একজন লেখকের বাড়ি। হয় তো আরো আছে। এত বছরে সে জানে না। খবরের কাগজে দেখেছে সৌম্য সরকার এবং মুস্তাফিজুর রহমান নামে দুই ক্রিকেটারের বাড়ি সাতক্ষীরে। তাতে আহ্লাদ হয়েছিল বটে, কিন্তু ক্রিকেট নিয়ে তার আগ্রহ খুব নেই। সে ঢুকতেই দেখল সাঁকো বাড়ি। সাঁকো বাড়ির স্টলে এক বিরল কেশ প্রবীণ বসে আছেন। ময়লা রঙ। চোখের চশমার পাওয়ার কম নয়। ইনিই কি তার ফেসবুকের বন্ধু আমিরুল বাশারের অগ্রজ। তারই বয়সী হবেন, কিংবা তার চেয়ে বেশি। সে কুন্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, খায়রুল বাশার মশায় কি আপনি, লেখক খায়রুল বাশার।
ভদ্রলোক চমকে উঠলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আপনি আমাকে চেনেন?
বিমলেশ ভাবল, বলে আমিরুল বাশারের কথা। ফেসবুকের বন্ধু আমিরুল তাকে বলেছে বলেই তার আসা। কিন্তু শেষ মুহুরতে নিজেকে সংবরণ করল সে। না, থাক। সে আন্দাজে বলল, আমি পড়েছিলাম মনে হয় অনেকদিন আগে, তার ভিতরে সাতক্ষীরে ছিল, কপোতাক্ষ নদ ছিল, আপনার লেখা কি?
এক গাল হেসে তিনি বললেন, আমার সব লেখায় তো তাইই থাকে, সাতক্ষীরে নিয়েই লিখি।
বিমলেশ বলল, যেতে যেতে “সাঁকোবাড়ি” দেখে আর খায়রুল বাশারের বই রয়েছে দেখে মনে হলো আপনি হতে পারেন, সাঁকোবাড়ি প্রকাশনের নামটি আমার মনে আছে, কী সুন্দর নাম।
আসুন আসুন, ভিতরে এসে বসুন। খায়রুল বাশার তাকে ভিতরে ডাকেন।
একজন লেখকের এত কাছে বিমলেশ আগে আসেনি। বাংলাদেশের কবি শামসুর রাহমানকে সে একবার কলকাতা বই মেলায় দেখেছিল। আর দেখেছিল তিন চারজন বাংলাদেশের লেখককে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে। তারাও ছিল তার অচেনা। একই ভাষার লেখক, কিন্তু সে জানে না। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ বা ইলিয়াসকে অবশ্য পড়েছে বিমলেশ। এই খায়রুল বাশারকে পড়েনি, কিন্তু মিথ্যে কথা বলে পরিচয় করেছে এখনই।
বিমলেশ বলল, আমাদের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরে।
সাতক্ষীরে! বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছেন খায়রুল, সত্যি, কোথায়?
আপনি তো সাতক্ষীরের মানুষ মনে হয়।
ইয়েস, কিন্তু আপনিও কি?
বিমলেশ বলল, আমাদের বাড়ি ছিল ধুরোল, ধূলিহর।
ধুরোল, কী কান্ড, আমার বউ তো ধুরোলের মেয়ে, আমাদের লাভ ম্যারেজ।
বিমলেশ বলল, আমি ভাবিইনি আপনি আমাদের সাতক্ষীরে থেকে এসেছেন।
খায়রুল বলল, না, তা না, আমি ঢাকায় থাকি, সাতক্ষীরে ছেড়েছি অনেক বছর।
যোগাযোগ নেই?
খায়রুল বললেন, আছে, মা বাবা আর এক ভাই তো সাতক্ষীরে থাকেন, আচ্ছা, আপনারা ধুরোলের মানুষ তো।
অনেক বছর চলে এসেছি। বিমলেশ বলে, আর আমি তো কিছুই জানি না, আমার তখন পাঁচ, কিন্তু মা ঠাকুমার কাছে খুব শুনতাম সাতক্ষীরের কথা।
খায়রুল জিজ্ঞেস করলেন, কী কথা?
বিমলেশ একটি বই নিয়ে পাতা উল্টোতে থাকে, দেখল কপোতাক্ষী কপোতাক্ষী...... উপন্যাসের নায়িকার নাম কপোতাক্ষী। তার ঠাকুমা, মা সেই নদীকে এই নামেই তো ডাকত। বিমলেশ কপোতাক্ষর কথা বলতেই তিনি বিষণ্ণ হয়ে বললেন, নদী নেই, বালি ধু ধু, বেতনাও নেই, মজে মাঠ হয়ে গেছে, খালবিলে পানি নেই মশায়।
তাহলে? বিমলেশ বলে, শুনেছিলাম, কিন্তু এতটা ভাবিনি।
ইয়েস। খায়রুল বাশার বললেন, আমার বইয়ে তা লিখেছি, কিন্তু পানির কথা যে লিখিনি তা নয়, কত পানি, স্টিমার, ঢেউ।
বিমলেশ বলল, ইস, সাতক্ষীরে মানেই তো বেতনা নদী।
নেই, আচ্ছা দাদা, আপনারা তো ধুরোলের লোক, প্রকাশ ঘোষ, ওর বাবার নামটা ভুলে গেছি, আমার ফ্রেন্ড ছিল, জানা আছে?
বিমলেশ বলল, পশুপতি ঘোষ?
আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, সাতদিন ধরে মনে করার চেষ্টা করতিসি, মনেই আসতেসে না, হ্যাঁ দাদা আপনি চেনেন তাদের, কোথায় থাকে জানেন।
বিমলেশ বলল। বিমলেশ নিজেকে লুকোতে পারল না। তার মেসোর কথা বলছে। মায়েরা দুই বোন এক গ্রামের বউ হয়ে এসেছিল কপোতাক্ষর ঘাট সুপুরিঘাটায়। কপোতাক্ষ তাদের নিয়ে এসেছিল তার অন্য এক ঘাট থেকে নৌকো করে। মনু মাসির ছেলে প্রকাশ। মেসোরা খুব বড়লোক ছিল। জমিদারি ছিল। মেসোরা আসেনি এপারে বহুদিন। এল সেই ১৯৮০ নাগাদ, সাতক্ষীরে ছেড়ে ধূলিহর ছেড়ে চলে আসেন সকলে। প্রকাশ আসে আরো বছর তিন বাদে। বিমলেশ জিজ্ঞেস করল, চেনেন নাকি ?
চেনব না কেন, ওই বাড়ি গিয়ে কত ভাত খেইসি, প্রকাশ আমার ক্লাস ফ্রেন্ড, সাতক্ষীরে প্রাণনাথ ইন্সটিটিউশনে পড়েসি, তারপর সাতক্ষীরে কলেজ, প্রকাশ কোথায় থাকে বলেন, কেন যে চলে এল সে, কেন এল সে।
বিমলেশ বলল, বারাসত থাকে, খুব কষ্ট করেছে এপারে এসে।
করতি হবেই তো, ওই বয়সে কেউ আসে দাদা, তখন পঁয়তিরিশ পার, আমরা ঢাকায় নাটকের দল নি গেসি, ওর খুব ভাল ব্যবসা ছিল, অনেকটা জমিতে ফুল চাষ করত, সাপ্লাই দিত ঢাকা, খুলনা, রাজশাহী, অভিনয় করত ভাল, কেন চলে আসতি গেল, খুব বারণ করেসিলাম।
সন্ধ্যা হয়ে এল। মুক্ত মঞ্চে কবিতা পাঠ হচ্ছে। দুই বাংলার কবিরা পড়ছেন। মাইক্রোফোনে কবিতার পংক্তি, তার ভিতরে পদ্মা মেঘনা যমুনা কীর্তনখোলা...। না কপোতাক্ষী নেই। বেতনা নেই। কবিতায় ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী রয়েছে কিন্তু সাতক্ষীরে নেই। আছে শুখা নদী। বালি উড়ছে সমস্ত দিন। খায়রুল বাশার বললেন, সেবার পরপর দুবার হিংসায় এক মুরুব্বি ওর রজনীগন্ধার বাগান নষ্ট করে দিল, গোলাপ বাগান তছনছ করে দিল, ও বলল, ইন্ডিয়ায় চলে যাবে, কতবার বললাম, প্রকাশ যেও না, আমাদের শো সামনে, নতুন নাটক, ম্যাগাজিন করতি হবে প্রকাশ, হিংসেয় আকবর মোল্লা করতিসে এসব, থানায় চল।
তারপর?
থানা কিছু করেনি সত্যি, সে খুব ভয় পেয়ে গেল, বলল, থাকবে না, জমি আকবরের কাছেই কম দামে বেচে চলে এল, ও দাদা তার কথা আমার খুব মনে পড়ে, আপনার মাসির ছেলে, যোগাযোগ করা যাবে ?
আমার কাছে নম্বর নেই, বাড়ী ফিরে দেখছি।
খুব দেখতি ইচ্ছে করে, আমি তারে নিয়ে একটা বই লিখব, আমার বই আপনি পড়েসেন কি না জানিনে, আমি নিজির আনন্দে লিখি, বেতনা আর কপোতাক্ষীর কথা লিখি, এই নে আছি, এইবার নিজির দুঃখ নে লিখব, এই পেত্থম ইন্ডিয়ায় এইসি, মন ভাল নেই প্রকাশ আর পশুপতি জেঠাদের কথা মনে পড়ি যাচ্ছে, তাই।
খায়রুল বাশারের কথার কোনো শেষ নেই। বলে যেতে লাগলেন। তাকে আমন্ত্রণ জানালেন, আসেন নদী নেই, নদীর পানি নেই, কিন্তু আমরা আছি, সব ভাই ঢাকা, খুলনা থেকে চলে আসব সাতক্ষীরে, আমরা আছি দাদা, প্রকাশেরে খুব দেখতি ইচ্ছে করে, তার সেই রজনীগন্ধা বাগানের ধারে বসে কবিতা পড়া, আহা......।
বিমলেশ ফিরে এল। পুরোন ডায়েরিতে মাসতুতো ভাইদের নম্বর ছিল। ল্যাণ্ড লাইন। চেষ্টা করল। ডাজ নট এক্সিস্ট। প্রকাশ বারাসতে থাকে না, ফোনে বলল ছোটমামা। না, কোথায় থাকে কেউ বলতে পারল না। দুঃখে ভেসে গেছে কপোতাক্ষর শেষ স্রোতে। বিমলেশের কানের কাছে সমস্তরাত ধরে খায়রুল বাশারের কন্ঠস্বর ভেসে থাকল। গাঙ আর পানি নেই, কিন্তু সাঁকো বাড়ি আছে। সেই সাঁকো পেরিয়েই বোধহয় সাতক্ষীরে যাওয়ার পথ। আসেন দাদা, সাঁকোটা বাঁধসি গাঙের উপর। গাঙটা ধরে রেখেছে খায়রুল বাশার তার বুকের ভিতর। বুকের নদীতে সাঁকো। তারপরে সাতক্ষীরে। তারপরে সেই বাড়ি। ফুলের বাগান।
(এইটি গল্প হতে পারে আবার নাও পারে, কেন না এর চরিত্রগুলি সত্য। ঘটনা অনেকটাই সত্য। সংবাদই গল্প করে তোলার প্রয়াস ছাড়া এই রচনা আর কিছুই নয়। )