আমাদের এই সময়টি অসহিষ্ণুতা, অসৌজন্য, কূপমণ্ডুকতা এবং শ্রদ্ধাহীনতার। নির্মাণ আর সৃষ্টির মিথষ্ক্রিয়ায় যে আলো ফুটে ওঠে, তার যে নির্দিষ্ট কোনও একক পরম সত্য নেই, বহুস্বরের সমূহেই তার বৈচিত্র্য, সম্ভবত, এ সত্য, আমাদের আবহমান অবচেতনায় থাকলেও, ব্যবহারিক চেতনায় বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যায়। তাই এত বেশি এককের প্রতিষ্ঠায় সমূহের প্রতি অভিসম্পাত বর্ষিত হয়। অথবা, অসহিষ্ণু কিছু অস্থির ঝরা পাতার মতো আমরা উড়ে বেড়াই। কিন্তু কবি শঙ্খ ঘোষের কাছে এই অস্থিরতা ছিল না। তাঁর যে অস্থিরতা ছিল, তা এক দার্শনিক অস্থিরতা। মননের সেই অস্থিরতার সন্ধান দুর্ভাগ্যবশত আমরা সন্ধান করিনি। কবি কিন্তু সেই অস্থিরতার ঠিকানাগুলি লিখে গেছেন তাঁর কবিতায়, গদ্যে এবং জার্নালে। আমরা পড়লেও, মেধার সেই নিঃসঙ্গ ও নীরব অভিযাত্রাকে হয়তো আত্তীকরণ করতে পারিনি। কিন্তু কবি আজীবন ধরে সেই নীরবতার মননের সাধনাই করে গেছেন, যা দর্শনের সূক্ষ্ম উপস্থিতিকে আড়াল করেও তাকে করে তুলেছে মহিমান্বিত।
কবির কবিতা ও গদ্যগুলি তাই পাশাপাশিই তাঁর অন্তরের জার্নিকে ফুটিয়ে তুলেছে। কবিতাপ্রয়াসী হিসেবেই শুধু নই, একজন পাঠক হিসেবে মনে হয়, কবিতা ও কবিতা সংক্রান্ত ভাবনাবিশ্বের যে যুগলবন্দি তিনি তৈরি করেছিলেন ধারাবাহিক ভাবেই, তা আমাদের খোলা হাওয়ার বাঁচতে শেখায়। কারণ একপ্রকার ভাবনাগত দৈন্যের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। এ সময় শঙ্খ ও অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের মতো কবিদ্বয় আমাদের জন্য যা রেখে গেছেন, তাই আমাদের আগামীদিনের সহায় হয়ে উঠতে পারে। দুজনকেই আমরা হারিয়েছি খুব অল্প ব্যবধানে। অথচ দুজনেই তাঁদের চলে যাওয়ার কয়েক মাস আগে পর্যন্ত তাঁদের সৃষ্টি ও ভাবনায় আমাদের সমৃদ্ধ করে গেছেন। সেই পাঁচ-এর দশকের শেষ থেকেই শঙ্খ ঘোষ তাঁর গদ্যের মাধ্যমে আমাদের পরিচিত করেছেন রবীন্দ্রভুবনের ব্যাপ্ত পরিসরের সঙ্গে। তার সঙ্গে ফুটে উঠেছে কবিতার অন্তর্জগতের নির্মাণের এবং দর্শনের একপ্রকার অনুসন্ধানের সন্দর্ভ।
গন্ধর্ব, উন্মাদ, তুমি অর্থহীন হাতে উঠে এসে
জলমণ্ডলের ছায়া মাখিয়ে গিয়েছ এই মুখে
তবু আজও বৃষ্টিহারা হয়ে আছে সমস্ত প্রবেশ
আমারও পায়ের কাছে চাপ চাপ রক্ত লেগে আছে।
আমি সর্বনাশ দিয়ে সর্বনাশ বাঁচাতে গিয়েছি
হাত ছুঁতে গিয়ে শুধু আগুন ছুঁয়েছি, আর তুমি
শূন্যের ভিতরে ওই বিষণ্ণ প্রতিভাকণা নিয়ে
আমার মুখের দিকে চেয়ে আছো বিষম পাহাড়ে।
গান কেউ অন্ধকারে নিজে নিজে লেখেনি কখনো
আমাদের সকলেরই বুকে মেঘ পাথর ভেঙেছে
সে শুধু তোমার জন্য, গন্ধর্ব, তোমার হাত ছুঁয়ে
এই শিলাগুল্ম চিরজাগরূক বোধ নিয়ে আসে।
(গান্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ-১)
যে চিরজাগরুক বোধের কথা তিনি বলেছেন তাঁর কবিতায়, তাকে অর্জন করা কঠিন। কিন্তু এ কথাও ঠিক, তাকে অর্জন করার মধ্যেই আসলে সেই অকল্পনীয় অপ্রত্যাশিত গান্ধর্বের স্পর্শ পাওয়া যায় কবিতায়।
জল কি তোমার কোনও ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?
(জল)
একটি অসামান্য কাব্যগ্রন্থ কেউ লিখলেন, কিন্তু তার পরে সেই জার্নি আর যদি না চলে, তাহলে, বুঝতে হবে, সেই কবি আর ভাবনাজগতের মধ্যে ডুব দিতে পারলেন না, আর খনন করতে পারলেন না কিছু। অথবা নিজেকে একপ্রকার নিরাপদের বলয়ের মধ্যে ডুবিয়ে দিলেন। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ যে সে জাতীয় কবি ছিলেন না, তা বলাই বাহুল্য। তাই একইসঙ্গে তিনি যেমন কবিতার দিগন্তকে বারবার উন্মোচন করতে করতে গেছেন, তেমন ভাবেই নিজের কাব্য-ভাবনাকেও পরিবর্তন করতে করতে গেছেন। একইসঙ্গে তাঁর জার্নি চলেছে অন্তর্মুখী এক সংলাপে এবং বাইরের জগতের সঙ্গে দ্বন্দ্বের অনুবাদের ক্ষেত্রেও তিনি তাঁর যে ‘আমি’ তাকে নানা ভাবে প্রকাশ করেছেন। সৃষ্টির সঙ্গেই মিশে গেছে নির্মাণের বৈচিত্র্য। আবার লক্ষণীয় বিষয় হল, তাঁর কবিতা অনেক বেশি সহজ ভাবেই প্রকাশ করেছে সত্যের গূঢ়তম ঐশ্বর্য। তিনি কথা বলেছেন নিজের মনের সঙ্গে এবং সমাজের সঙ্গেও। খাদ্য আন্দোলনের সময় গুলিচালনা এবং কিশোরী হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি লিখেছিলেন
নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে
একটু আগুন দে।
হাতের শিরায় শিখার মতন
মরার আনন্দে।
আবার রণবীর সেনার গণহত্যার পরে তিনি লেখেন
আমার সবটাই আলো আমার সবটাই অন্ধকার
আমার সবটাই জন্ম আর আমার সবটাই মৃত্যু-দ্বার
আমার ধর্মও নেই আমার অধর্ম নেই কোনো
আমার মৃত্যুর কথা যদি কেউ দূর থেকে শোনো
জেনো – এ আমার মাটি এ কাল আমার দেশকাল
জালিয়ানওয়ালাবাগ এবার হয়েছে আরওয়াল!
আসলে, উদাহরণ দিতে বসলে, অসংখ্য উদাহরণ দিতে হয়। বলতে হয় রাধাচূড়া নামক কবিতার কথা। আবার প্রতিবাদের এই কবিতাগুলির পাশে বলতে হয় তাঁর অনবদ্য সব প্রেমের কবিতাগুলিকেও। কখনও কখনও মনে হয়, শঙ্খ ঘোষের প্রেমের কবিতাগুলি একধরনের প্রতিবাদের কবিতাই। প্রতিবাদ বলতে তো কেবলই উচ্চকিত ভাবে প্রতিবাদই বোঝায় না। তিনি তাঁর কবিতা এবং ব্যক্তিজীবনের কঠোর অবস্থানগুলির প্রকাশের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, কীভাবে সংযত ভাবে, সহিষ্ণুতার মাধ্যমে প্রতিবাদ করা যায়। কীভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধা বজায় রেখে মতান্তরে যাওয়া যায়। কীভাবে নীরবতার ভাষাকে জীবনে অবলম্বন করতে হয়। এমনকি কবিতাতেও নীরবতার এই প্রতিধ্বনিগুলিকে ফুটিয়ে তুলতে হয়। এ কারণেই শঙ্খ ঘোষের কবিতা সামগ্রিক ভাবেই আমাদের কাছে একটা শিক্ষা। তিনি যেমন আমাদের উপহার দিয়েছেন এক সত্য বলার আত্মশক্তির কবিতা, তেমন উপহার দিয়েছেন এমন এক প্রেম, যার ইশারা রয়েছে রবীন্দ্রনাথেই। রবীন্দ্রনাথকে কতটা আত্তীকরণ করতে পারলে ‘এ আমির আবরণ’ -এর মতো গদ্য লেখা সম্ভব।
শঙ্খ ঘোষের গদ্য তাঁর কাব্যভাবনার এক প্রতিচ্ছবি। তাঁর গদ্যগুলিকে ভাল করে পড়লে, তাঁর অন্তরের অভিযাত্রাকেই আরও গভীরভাবে পাঠ করতে পারি আমরা। আর সেই পাঠের ফলশ্রুতিতে তখন অনেকটা গভীরে ডুবেই আমরা খুঁজে দেখতে পারি কবি শঙ্খ ঘোষকে। সাহিত্য নিয়ে এক স্বতন্ত্র ধারার গদ্য তিনি বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন। এখন আমরা সাহিত্যিক সন্দর্ভ বলতে শুধুমাত্রই কিছু কঠিন কঠিন যুক্তিবিন্যাসকেই বুঝি না, একজন ব্যক্তিমানুষের পাঠ-অভিজ্ঞতার নিরিখে লেখা এক বিপুল অনুভূতিমালার জগতের কাছেও পৌঁছে যাই। যেন সাহিত্যপাঠ নিজের মনের সঙ্গেই কথা বলা, নিজেকেই বারবার হারানো এবং খুঁজে পাওয়া।
আর ঠিক এ কারণেই শঙ্খ ঘোষের কবিতা ও গদ্য আমাদের বারবার পড়তে হবে আগামী দিনে। সময়ের ধুলো পড়বেই সকলের উপর। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ আমাদের ভাবনার মধ্যে, সত্তার মধ্যে আলোড়ন তৈরি করেন। নীরবেই।
তাঁকে আমার প্রণাম।
খুব ভালো লাগলো।লেখাটা