এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  গপ্পো  শনিবারবেলা

  • মুড়কিদিদির রামায়ণ

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২০ বার পঠিত
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩


    কবন্ধ মানে জানিস? – জিজ্ঞেস করে মুড়কি, শুনেছিস কথাটা?

    মুড়কিদিদিকে নকল করে ইদানিং অনেক কথারই সোজাসুজি উত্তর দিচ্ছে না উচ্ছে। ঠোঁটটা উলটিয়ে মাথাটা ধীরে ধীরে নেড়ে বুঝিয়ে দেয় কথাটা জানেনা ও।

    মুড়কি অবিশ্যি আন্দাজ করেইছিল কথাটা ও জানবে না। তাই আজ রোববার সকালে জলখাবারের লুচির ময়দা মাখা হচ্ছিল যখন, তখনই সেখান থেকে একটুখানি মাখা-ময়দা সরিয়ে রেখেছে সে। আর সেই ময়দা দিয়ে তৈরি করেছে একটা মানুষ-পুতুল। সেই পুতুলটা বইয়ের আলমারি থেকে নামিয়ে, উচ্ছে কিছু বোঝবার আগেই এক টানে পুতুলটার মুণ্ডুটা ধর থেকে আলাদা করে দেয় মুড়কি, ধড়টাকে দেখিয়ে বলে, এই হল কবন্ধ।

    মুণ্ডু ছাড়া ময়দার পুতুলকে কবন্ধ বলে? – একটা ফাজলামির হাসি উচ্ছের মুখে।

    মুণ্ডু ছাড়া পুতুল হলে সেটা পুতুল-কবন্ধ, আর সত্যিকারের মানুষ হলে মানুষ-কবন্ধ, রাক্ষস হলে রাক্ষস-কবন্ধ। এইরকম। হ্যাঁ, এইরকমই, সীরিয়স মুখ করে বলে মুড়কি।

    তাহলে তুমি কোন্‌ কবন্ধের গল্প বলবে?

    গল্পটা শোন, তাহলেই বুঝতে পারবি, বলল মুড়কি। রামায়ণের গল্প যখন আমাকে শোনালি তুই প্রথম, তুই যে বললি রাম-লক্ষ্মণ বনে যাবার পর সীতাকে চুরি করে নিয়ে গেল রাবণ, আর বাঁদরদের রাজার সাহায্যে সাগর পেরিয়ে রাবণকে মেরে সীতাকে ফিরিয়ে আনল রাম-লক্ষ্মণ, তখন আমি বলেছিলুম সীতাকে ফিরিয়ে আনার পিছনের গল্পটা তোকে বলব, মনে আছে? তখনই বলেছিলুম সম্পাতির গল্প, মনে আছে তোর?

    আছে তো, বলে উচ্ছে, সম্পাতি না বলে দিলে সাগর পেরোনোই তো হত না।

    ঠিক, বলে মুড়কি, কিন্তু সম্পাতিকেই বা পাওয়া গেল কোথায়?

    সে তো বিন্ধ্য পাহাড়ে, একা একা সম্পাতি থাকতো সেখানে।

    বিন্ধ্য পাহাড়ে, ঠিক বলেছিস, বলে মুড়কি, কিন্তু একা একা বিন্ধ্য পাহাড়ে কেন? কোথা থেকে সেখানে এল সম্পাতি?

    সে তো তুমি বললেই আগের দিনের গল্পটায়। ওই যে সূর্য রেগেমেগে পুড়িয়ে দিল সম্পাতির ডানা, আর সম্পাতি বমি করতে করতে ধপাস করে পড়লো বিন্ধ্য পাহাড়ে।

    ভেরি গূড, বলে মুড়কি, তার মানে, আগের দিন যেটা বলেছিলুম সেটা হল তার আগের গল্পটার পিছনের গল্প, ঠিক?

    ঠিক।

    কিন্তু, এবার বল্‌ তো, সীতাকে যে রাবণ নিয়ে যাচ্ছিল লঙ্কায়, এ কথাটা সম্পাতি বলেছিল কাকে? রাম-লক্ষ্মণকে?

    রাম-লক্ষ্মণকে কোথায় পাবে? বলেছিল তো বাঁদরদের, যাদের দলে ছিল হনুমান আর জাম্ববান – বলে উচ্ছে।

    কিন্তু বাঁদররাই বা সীতার খোঁজ করবে কেন?

    বাঃ, বাঁদরদের যে রাজা, যার নাম সুগ্রীব, সে-ই তো পাঠিয়েছিল বাঁদরদের। তার সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব হয়েছিল না?

    বন্ধুত্বটা হল কীভাবে? সুগ্রীবকে কোথায় পেল রাম?

    তোমাকে নিয়ে আর পারা যাবে না মুড়কি দিদি, বলে উচ্ছে, তুমিই তো বলেছিলে সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে রাম যখন জঙ্গল পাহাড় নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রামের সঙ্গে তখনই প্রথম আলাপ হয়েছিল সুগ্রীবের।

    হ্যাঁ, সেটাই বলেছিলুম তোকে। এবার আর একটু খুঁটিয়ে বলি। মানে, এই আলাপ হওয়ার পেছনের গল্পটা। যে বন থেকে চুরি হয়েছিল সীতা, মানে, যে বনে তখন থাকত রাম সীতা আর লক্ষ্মণ, সেই বনের নাম দণ্ডকারণ্য। এই দণ্ডকারণ্যে পঞ্চবটী নামে এক জায়গায় নিজেদের জন্যে একটা কুটির, মানে, একটা কুঁড়েঘর, বানিয়ে সেখানে থাকত তারা।

    এবার আসি রাবণের কথায়, বলতে থাকে মুড়কি। রাবণের অনেক ভাইবোন ঘুরে বেড়ায় নানান জায়গায়। তাদের কাছ থেকেই রাবণ খবর পেল কোথায় থাকে রাম-লক্ষ্মণ-সীতা। মারীচ নামে একজন যাদুকর রাক্ষসও থাকত ওই দণ্ডকারণ্যেই। মারীচের বাড়িতে পৌঁছে গেল রাবণ। মারীচকে বুঝিয়ে-বাজিয়ে রাজি করালো ম্যাজিকের জোরে নিজেকে একটা সোনার হরিণ বানিয়ে ফেলে রামসীতার কুটিরের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াতে। সোনার হরিণ দেখে লোভ সামলাতে পারবে না সীতা, ঠিক বেরিয়ে আসবে, আর সেই সুযোগে রাবণ পালাবে সীতাকে চুরি করে।

    যে কথা সেই কাজ। সোনার হরিণ ঘোরাঘুরি করতে লাগল কুটিরের কাছাকাছি। দেখে তো সীতা অবাক, ওই হরিণটা তার চাই-ই চাই, সে পুষবে। রামকে ধরে পড়ল সীতা, হরিণটা তাকে ধরে দিতেই হবে।

    রাম ধরতে পারল? খুব উত্তেজিত উচ্ছে।

    পারল না। দৌড়িয়ে পালাল হরিণ, পিছু পিছু রামও। এত জোরে দৌড়িয়েছে, কিছুক্ষণ পর ওদের আর দেখাই যাচ্ছে না। যে পথ দিয়ে গেছে ওরা, সীতা ভয় পেয়ে সেই পথের দিকে তাকিয়েই আছে তাকিয়েই আছে, এমন সময় দূর থেকে শোনা গেল রামের গলা, বাঁচাও বাঁচাও!

    আরো উত্তেজিত উচ্ছে, কেন, কী হয়েছে?

    এই প্রশ্নটাই তো সীতারও, কী হয়েছে! সে লক্ষ্মণকে বললো, দৌড়িয়ে যাও, দেখ কী হয়েছে।

    মুশকিল হল লক্ষ্মণের। বেরিয়ে যাবার আগে রাম তাকে বলে গেছে, কোন অবস্থাতেই সে যেন সীতাকে একা ফেলে রেখে না বেরোয়, আর সীতাকে নিয়ে তো দৌড়োনো যাবে না। সীতা কিন্তু নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়েই তীরের ফলা দিয়ে মাটিতে গোল একটা দাগ দিয়ে সীতাকে সে বলল, এই দাগের বাইরে বেরোবে না, যতক্ষণ না আমরা ফিরে আসি – আর বলেই দৌড়িয়ে বেরিয়ে গেল লক্ষ্মণ।

    লক্ষ্মণ পারল রামকে বাঁচাতে?– উদ্বিগ্ন উচ্ছে জিজ্ঞেস করে।

    বাঁচাবে কী? – হেসে জবাব দেয় মুড়কি, ওটা তো সত্যি-সত্যিই রামের গলা ছিল না, ম্যাজিশিয়ান মারীচ রামের গলা নকল করে ঠকিয়েছিল সীতাকে। কিন্তু এ দিকে মুনি-ঋষিদের মতো সাজগোজ করে কাছাকাছিই ঘোরাঘুরি করছিল রাবণ। এই সুযোগে সীতার কুটিরের বাইরে এসে সে হাঁক পাড়ল, মা কিছু ভিক্ষে দাও।

    সীতা প্রথমে ভিক্ষে দিতে বেরোতে রাজি ছিল না, লক্ষ্মণ দাগ কেটে বারবার বারণ করে গেছে দাগের বাইরে বেরোতে। কিন্তু মুনি-ঋষি-ব্রাহ্মণ-টাহ্মণরা আবার খুব যে রাগী হয় সেও তো সবাই জানে, কে জানে কী অভিশাপ দিয়ে দেবে! শেষ পর্যন্ত তাই যেই না ভিক্ষে দিতে বেরিয়েছে সীতা, রাবণ তাকে টেনে-হিঁচড়ে রথে তুলে এক্কেবারে হাওয়া।

    ফিরে এসে সীতাকে দেখতে না পেয়ে রাম-লক্ষ্মণ খুঁজতে বেরোলো সীতাকে। পথে যাকে পায় তাকেই জিজ্ঞেস করে, সীতাকে দেখেছ তোমরা কেউ?

    কেউ জবাব দেয় না, কেউ না। রাবণ যখন নিয়ে যাচ্ছিল সীতাকে তার রথে চড়িয়ে আকাশ দিয়ে, ততক্ষণে তো সে মুনি-ঋষির সাজ বদলিয়ে আবার হয়ে গিয়েছে রাক্ষস, ভয়ঙ্কর চেহারার
    রাবণ-রাক্ষস। দশটা মুণ্ডু, কুড়িটা হাত। যারা তাকে সীতাকে নিয়ে যেতে দেখেনি তারা তো
    দেখেইনি, কিন্তু যারা দেখেছে তারাও ভয়ে-ভয়ে চুপ করেই রইল। অনেকটা যাবার পর দেখা বিরাট এক পাখির সঙ্গে, তার সারা গায়ে-মুখে রক্ত। রক্ত দেখে রাম ভাবলো এই পাখিই নিশ্চয়ই খেয়ে নিয়েছে সীতাকে, সে ধনুকে তীর লাগিয়ে মারতে গেল তাকে।

    পাখি বলল, রাম, দাঁড়াও। তোমরা আমাকে চেন না, আমার নাম জটায়ু। আমি তোমাদের বাবা রাজা দশরথের প্রিয় বন্ধু।

    জটায়ু? সেই সম্পাতির ভাই জটায়ু? – প্রশ্ন করে উচ্ছে।

    হ্যাঁ, সেই সম্পাতির ভাই জটায়ু, বলে মুড়কি, সে বললো রাম-লক্ষ্মণকে, তোমাদের দেখবার জন্যেই আমি বেঁচে আছি এখনো। সীতাকে চুরি করে নিয়ে গেছে রাবণ। আমি এখানে বসে একদিন দেখতে পাই আকাশ দিয়ে উড়ে যাচ্ছে রাবণের রথ, হাতে তার সীতার চুলের মুঠি, সীতা কাঁদতে কাঁদতে বলতে বলতে যাচ্ছে, সবাই শুনে রাখ, আমার নাম সীতা, আমি অযোধ্যার রাজা দশরথের ছেলে রামচন্দ্রের বউ, এই রাক্ষস রাবণ আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

    লক্ষ্মণ জিজ্ঞেস করল জটায়ুকে, আপনি কী করলেন তখন?

    জটায়ু বললো, আমি উড়ে গিয়ে ঠোঁটে করে নামিয়ে আনলাম রাবণের রথ, তারপর তার সঙ্গে শুরু হল আমার যুদ্ধ। রাবণ অস্ত্র দিয়ে আমার ডানা কেটে দিল, তারপর আবার সীতাকে রথে তুলে উড়ে গেল – বলেই মরে গেল জটায়ু – মরার আগে শেষ কথা বললো সে, রাবণের রথ উড়ে গেছে দক্ষিণ দিকে।

    এবার উচ্ছেকে জিজ্ঞেস করে মুড়কি, দক্ষিণ দিক জানিস তো?

    হ্যাঁ, বাবা আমায় শিখিয়ে দিয়েছে, জবাব দেয় উচ্ছে, বলে একটা খাতা আর পেনসিল টেনে নেয় সে। ভোরবেলা যে দিকে সূর্য ওঠে, তার নাম পূর্ব দিক। সেই পূর্ব দিকে মুখ করে যদি দাঁড়াই, আমার ডান হাতটা যেদিকে – বাবা বলেছে ডান মানেই দক্ষিণ – তাহলে সেটাই দক্ষিণ দিক। এই বলে পূর্ব আর দক্ষিণ দিকে একটা করে দাগ দেয় উচ্ছে। তারপর পশ্চিম দিকে দাগ দিতে দিতে বলে, এবার আবার ডান দিকে ঘুরলে পশ্চিম, আর তারও ডানদিকে উত্তর। মুড়কি তো দেখে খুবই চমৎকৃত, সে বলে, তুই কি খেয়াল করেছিস পূর্বের ঠিক উল্টোদিকে পশ্চিম আর দক্ষিণের উল্টোদিকে উত্তর?

    খাতায় চোখ রেখে আড়চোখে মুড়কির দিকে তাকায় উচ্ছে, কিছুই বলে না, শুধু মুখ দিয়ে একটা আওয়াজ বের করে, হুঁহুঁ!

    যাই হোক, মুড়কি বলতে থাকে গল্প। বলে, রাম বলল তার মানে আমাদের যেতে হবে দক্ষিণে, কিন্তু দক্ষিণে তো যাবার পথই নেই, বিশাল খাড়া পাহাড়। তাহলে আমরা এখন পশ্চিমেই যাই, সেখান থেকে বাঁদিকে যখন পথ পাব, তখনই দক্ষিণ ধরব। শেষ পর্যন্ত পথ একটা পাওয়া গেল গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।

    সেই গভীর জঙ্গলে খানিকটা যেতেই হঠাৎ ধুপধাপ ধুপধাপ ভয়ঙ্কর একটা শব্দ। জঙ্গলে যেন ধুন্ধুমার কাণ্ড, পাখিরা সব ডানা ঝটপট করতে করতে ভয়ার্ত ডাক দিতে দিতে উড়ে যাচ্ছে,
    ছোট-বড় সব জন্তুই প্রাণ নিয়ে পালাচ্ছে যেন। কিছুক্ষণ পরেই বোঝা গেল আসল কারণটা। কোন একটা কিছু – জানোয়ারই হবে একটা – খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে রাম-লক্ষণের দিকে। জানোয়ারটার মাথা-গলা কিছু নেই, মস্ত পেটের মাঝখানে একটা ভীষণ দেখতে চোখ, জ্বলজ্বল করে আগুনের ভাঁটির মতো জ্বলছে যেন সেটা। আর আছে দুখানা হাত; দারুণ লম্বা হাত, এত লম্বা যে তুই যদি সেই হাতের আঙুলগুলোর সামনে বসে কনুইটা দেখতে চাস, দেখতেই পাবি না, কনুইটা এত দূরে হবে আঙুলগুলোর থেকে। সেই জানোয়ারটা রাম-লক্ষ্মণের কাছে পৌঁছোবার আগেই দূর থেকে দুহাতে ধরে ফেলেছে দুজনকে।

    জানোয়ার জিজ্ঞেস করলো, কে তোমরা? তোমরা কি শিকার করতে এসেছ? যে জঙ্গলে আমি থাকি সে জঙ্গলে শিকার করতে পারবে না আর কেউ।

    জানোয়ারের কথার কোন জবাব না দিয়ে লক্ষ্মণ রামকে বলল, দাদা, কোন কথা নয়, এর বাঁ-হাতটা আমি কাটছি, ডান হাতটা কাটো তুমি। তারপর ওর আর কিছু করবার থাকবে না।

    যেই কথা সেই কাজ। কাটা হাত দুখানা ধপাস করে পড়ল মাটিতে। আর্তনাদ করে গড়াতে গড়াতে জানোয়ারটা এসে পড়ল একেবারে রাম-লক্ষ্মণের পায়ের কাছে, তোমরা কে? তোমরা কি
    রাম-লক্ষ্মণ?

    তুমি কী করে জানলে?

    সেরকমই তো কথা ছিল।

    কথা ছিল? কী কথা? কার সঙ্গে? – জিজ্ঞেস করে রাম।

    তাহলে আমার পুরো কাহিনীটাই শোন, বলে জানোয়ার। আমি মানুষ নই, জানোয়ারও নই। আমার নাম দনু।

    ভালো করে দনুকে দেখে লক্ষ্মণ বলে, তুমি তো কবন্ধ দেখছি, মাথাটা ঘাড় থেকে কেটে নেওয়া হয়েছে। পেটের ওপর চোখ, এরকম আগে কারো দেখিনি। তুমি কি রাক্ষস?

    সুন্দর দেখতে রাক্ষসকে কেউ রাক্ষস বলে না, জবাব দেয় দনু, আমি একজন দানব, মায়ের
    নাম শ্রী।

    তুমি বুঝি খুব সুন্দর দেখতে? – লক্ষ্মণের গলায় মজাটা বুঝতে অসুবিধে হয়না দনুর।

    ছিলাম। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে আমার মতো সুন্দর এমনকি কোন দেবতাও ছিল না। ভেবে দেখলাম, এমন সুন্দরের চিরকাল বেঁচে থাকা উচিত, তাই আমি ব্রহ্মার দেখা পাবার জন্যে তপস্যা শুরু করলাম। ব্রহ্মা বললেন, ঠিক আছে, যদি কোন দিন রাম-লক্ষ্মণ তোমার হাত দুটো কেটে নেন তাহলেই তুমি মরবে, না হলে নয়। আমি ভাবলাম, কোথাকার রাম-লক্ষ্মণ, আমাকে মারবার আগে নিজেরাই মরে কিনা নেই ঠিক, তারা আবার আমাকে মারবে! আমি তখন নিশ্চিন্ত মনে ভয়ঙ্কর দেখতে একটা রাক্ষস সেজে জঙ্গলের মুনি-ঋষিদের ঘরে ঘরে গিয়ে অত্যাচার শুরু করলাম। স্থূলশিরা নামে একজন ঋষি একবার অনেক ফল-টল রেখে দিয়েছিলেন ঘরে, সব আমি কেড়ে খেয়ে নিয়েছি, তিনি রেগেমেগে আমাকে শাপ দিলেন। বললেন, তোর রূপের গর্ব! যাঃ, এখন থেকে তোকে বিচ্ছিরি দেখতে হয়ে যাবে। দেবতাদের রাজা ইন্দ্ররও আমার ওপর রাগ ছিল, সে মেঘের ভেতর থেকে বাজ টেনে এনে ছুঁড়ল আমার ওপর, ঘাড়ের ওপর থেকে আমার মাথাটা, আর হাঁটুর নীচ থেকে পুরো পা দুটো, পেটের মধ্যে ঢুকে গেল আমার। আমি বললাম, আমি এখন দেখব কী করে? ইন্দ্র আমার পেটের ওপর একটা চোখ বসিয়ে দিল। বললাম, খাব কী করে? সে বলল, কেন, তোর মাথা তো পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছি, খেতে কী অসুবিধে? ও, হাত চাই, তাই না? বলে বিরাট দুখানা হাত লাগিয়ে দিল আমার কাঁধ থেকে। বলল, অনেক দূর দূর থেকেও জীবজন্তু ধরে খেতে পারবি। যাঃ!

    এবার গলাটা ধরে এসেছে দনু কবন্ধর, সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমাকে তোমরা পুড়িয়ে দাও, তাহলে আমি আবার সুন্দর চেহারা ফিরে পাব, তারপর স্বর্গে চলে যাব। তোমরা তো এই ভয়ঙ্কর জঙ্গলে এমনি এমনি আসনি, নিশ্চয়ই তোমাদের কোন বিপদ হয়েছে। আমার যদি ক্ষমতা থাকে, স্বর্গে যাবার আগে তোমাদের আমি সাহায্য করব।

    রাম-লক্ষ্মণ তখন বিরাট একটা গর্ত খুঁড়ে টেনে-হিঁচড়ে দনুকে ফেলল সেই গর্তে, তারপর দিল আগুন লাগিয়ে। গলগল করে বেরোতে শুরু করল ধোঁয়া। কিছুক্ষণ পর সেই ধোঁয়ার সঙ্গে উঠে এল খুব সুন্দর-দেখতে একজন, পরম রূপবানই বলা চলে, নতুন চেহারার দনু। দনু হাত জোড় করে বলল, তোমাদের কী বিপদ?

    সব শুনে সে বলল, এই দণ্ডকারণ্য বনে কেউ তোমাদের সাহায্য করতে পারবে না। তোমাদের যেতে হবে ঋষ্যমূক পাহাড়ে।

    ঋষ্যমূকে যাব কী করে? জিজ্ঞেস করে রাম।

    আমার কি অতকিছু বলার সময় আছে এখন? দেখছ তো এই ধোঁয়া। আ্রর কিছুক্ষণের মধ্যেই স্বর্গে যাবার রথ এসে যাবে আমার জন্যে। আমি আর দেরি করতে চাইনা।

    শুনে লক্ষ্মণ অত্যন্ত বিরক্ত। সে বলল, ব্রহ্মার বরটা মনে আছে তোমার? ব্রহ্মা বলেছিলেন, যদি কোন দিন রাম-লক্ষ্মণ তোমার হাত দুটো কেটে নেন তাহলেই তুমি মরবে, না হলে নয়। আমরা সেই রাম-লক্ষ্মণ। একবার যদি ব্রহ্মার কাছে নালিশ করি, স্বর্গে যাওয়া পণ্ড হয়ে যাবে তোমার, সে কথা কি জান?

    ভয়ে ভয়ে দনু বলে, না না, সে কথা আমি বলছিনা।

    তবে বলছটা কী?– লক্ষ্মণ গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করে।

    বলছি, ঋষ্যমূক পাহাড়ের রাস্তাটা তোমাদের বুঝিয়ে দেব আমি। সেখানে গিয়ে সুগ্রীব নামে এক বাঁদরের সঙ্গে দেখা হবে তোমাদের। সেই সুগ্রীবের সঙ্গে যদি বন্ধুত্ব করতে পার তোমরা, তাহলে সুগ্রীব আর তার চেলারা তোমাদের অনেক সাহায্য করবে।



    চলবে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • ধারাবাহিক | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন