অভিষেকেই স্বতন্ত্র উপন্যাসশিল্পী
পুরুষোত্তম সিংহ
সময়ের নিরন্তর চলমানতা থেকে কিছু খড়কুটোকে আখ্যানে সাজিয়ে দিয়েছেন বনমালী মাল। সংস্কার, লোকায়ত জীবন, জনপদ, বাস্তব-অবাস্তব, বানানো বাস্তব, অর্ধ বাস্তব নিয়ে এক দ্বন্দ্বময় বাস্তবের জন্ম দেন বনমালী মাল ‘কালগর্ভ’ (২০২৪) আখ্যানে। সময়ের অসমান্তরাল বিন্যাসের মধ্যে অন্তর্বিশ্বের যাবতীয় সারাৎসার বিন্দুকে বিবিধ সমীক্ষণে নির্মাণের প্রয়াস আখ্যানকে বহুমাত্রিক সত্যে উত্তীর্ণ করেছে। বনমালী মাল ইচ্ছাকৃতই প্রবাহিত বাস্তবতাকে ভেঙে ফেলেন। বলা ভালো নির্মম বাস্তবতার পাঠকে স্বেচ্ছায় ধ্বসিয়ে দেন। অথচ লক্ষ্য কিন্তু জটিল বাস্তবতার নিপুণ পাঠ। বাস্তব-অবাস্তব, লোকায়ত বাস্তব-মিথের বাস্তব, বানানো বাস্তব, অর্ধ বাস্তব নিয়ে শান্তনু ভট্টাচার্য, শতদল মিত্র, বনমালী মালের পথচলা। হীরেনের দাম্পত্য জীবনের সমস্যা থেকে তারির সন্তানহীনতা, সুপুরুষা-কুপুরুষার দ্বন্দ্ব, আলো-অন্ধকারের পথচলা, রাজনীতির আলোআঁধারি রহস্য, জনপদের ঝিমন্ত চেহারা, লোভ-আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে জীবনের অলিগলির যে চিত্রনাট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে তা দ্বন্দ্বমধুর সত্যে ভরপুর। অদৃশ্য বাস্তবকে বনমালী মাল নানা নিরীক্ষণে ভাসিয়েছেন। সময়ের দ্বৈত স্বরূপকে সে যেমন বিচক্ষণ বানে চিহ্নিত করেন তেমনি সময় সরণিতে মিশে থাকা অজস্র দৃশ্যকে পথের আনাচে কানাচে রেখে যান। লোকায়ত বাংলা, কুসংস্কারের বাংলা, আকাঙ্ক্ষার বাংলা, রাজনীতির বাংলাকে এক সরণিতে নিয়ে এসে শুধু সময়কেই রোমন্থন করেন না সময়ের বুকে মিছরির ছুরি চালিয়ে দেখান সময়ের রসাভাস এইভাবেও নির্মিত হতে পারে।
হীরেন-তারির সন্তানহীনতা, সন্তান কামনা, সন্তান কামনায় লোকায়ত সংস্কারকে গ্রহণ ও সেই গ্রহণের ফাঁক দিয়ে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, জনপদের চালচিত্র, জনপদের সুখ-দুঃখ, বিবিধ বিভঙ্গের নিত্য নৈমিত্তিক চাপান উতোর, সময়ের অলস বেলার মন্থন ও জীবনচরিতের আলগা খামখেয়ালি বিন্যাসকে সঙ্গী করে সময়ের প্রবাহমানতা আখ্যানের গতি নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। জনপদের অন্তর্লোকের অধিগঠন, আকাঙ্ক্ষা পরায়ণ জীবনের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, সত্য-মিথ্যা, জনশ্রুতি, লোকবিশ্বাস, যাপনের ছকের মধ্যে আলো-অন্ধকার, উড়ো সংবাদ মিলে প্রস্ফুটিত কাননের পুষ্পসজ্জা আখ্যানে সুঘ্রাণ ছড়ায়। মঙ্গলকাব্যের ঈশ্বর পাটনি বাস্তবের ঈশ্বরী হয়ে জনপদের জীবনচরিত কীভাবে রচিত হতে থাকে তার তত্ত্বতালাশ যে সদর্থক ভূমিকা গ্রহণ করে তা আখ্যানে দিগন্তবিস্তারী মায়া ছড়ায়। একটা জনপদ জনজোয়ারে ভাসে, তীব্র আবেগে গল্প গড়ে, গল্পের ভিতর জীবনের ফল্গুধারাকে ভ্রাম্যমাণ গতিতে প্রবাহিত করে চলে। কেউ কেউ কথক ঠাকুরের মতো জীবনের দীক্ষিত পুরোহিত হয়ে ওঠে। ঈশ্বরী জীবনকে দেখে, বোঝে, জনপদের নির্ভরযোগ্য ছাতা হয়ে ওঠে—
“ঈশ্বরীর কাছে লোক পুষে রাখার মতো কিছু নেই, সবাই যেন জীবনের পাঠ নিতেই বসে। যারা তার কাছে বসে—তাদের স্বভাব কেউ চেনে না। একে-অপরেও না। যে চিনতে চায়, সে নিজেকে ভেবে ভেবে নিজের স্বভাবের মতো করে চিনতে চায়। তারা ঈশ্বরীর কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়—কিছু না-পাওয়ার মতো শূন্য হয়ে কিছু সময় পর উবে যায়—এক-একদিন তারা সন্ধ্যার মিছিলে ঘোরে। মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে চেনাতে চায়।” (কালগর্ভ, দু-টি উপন্যাস, আপনপাঠ, প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০২৪, পৃ. ৫২)
কখনো আশাভরসার নির্ভরযোগ্য স্বপ্নভূমি হয়ে ওঠে। হীরেনের চেতনায় ঈশ্বরীর জীবনসেতু, স্বপ্নে জীবনের সম্পাদ্য বুঝে নেওয়ার মধ্য দিয়ে এ আখ্যান যেমন জনপদের অন্তর্লোকের তেমনি হীরেন, ঈশ্বরীর। ‘কালগর্ভ’ আখ্যান জনপদের ভিতরের গভীর ব্যঞ্জনাকে রূপায়িত করেছে। অথচ বয়নশিল্প ভিন্ন। চরিত্রের বিকাশ অপেক্ষা জনপদের অজস্র সত্য চরিত্রকে ধাক্কা দিয়ে চলে। বহমান জীবনের মধ্যে অজস্র প্রকোষ্ঠকে ছিন্নভিন্ন করে জীবনের বহুবিধ পাঠকে কুণ্ডলীকৃত করে জীবনের আয়ুধকে তীব্র মায়ায় ছুঁয়েছে এ আখ্যান।
‘জাতক’ও (২০২৪) জনপদের আখ্যান। জনপদের অভাবী জীবনের আখ্যান। জলসংকট, মানুষের ত্রাহিত্রাহিরব, বিশ্বাস-সংস্কার-বাস্তবতার দ্বন্দ্ব নিয়ে জীবনের আর্তরবকে ক্ষতবিক্ষত করে দেখার জরুরি প্রয়াস। বুদ্ধদেব জানার খেয়ালি মানসিকতা, বিকৃত ভাবনা অথচ জীবন সম্পর্কে সংগঠিত ধারণার মধ্যে মনস্তত্ত্বের গভীর দ্বন্দ্ব যেমন লুকিয়ে থাকে তেমনি অভাবী জীবনের গভীর তলদেশের সংবাদ বহন করে চলে। অন্নচিন্তার পাশাপাশি জলচিন্তা শুষ্কদেশের মানুষকে গভীর সংকটে ফেলে দেয়। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুরের শুষ্কদেশের মানুষের আর্তরব, করুণ মুখচ্ছবি বাংলা আখ্যানে নানাভাবে এসেছে। সৈকত রক্ষিতের ‘ঢেঁকিকল’ উপন্যাসে দেখি জল সংকটের কথা। অমর মিত্রের প্রথম পর্বের উপন্যাসে (‘নদী বসত’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘নদীর ভিতর মানুষ’) নদীর প্লাবতার কথা যেমন আছে তেমনি রুক্ষতার কথাও আছে। নদী শুকিয়ে বালি হয়ে আছে, তপ্ত বালিতে চাষ হয় না। অমর মিত্র সুকৌশলে নদীভূমিকে জমি হিসেবে ব্যবহার করে আখ্যান সাজিয়েছেন। আবার ‘ধ্রুবপুত্র’ উপন্যাসেও খরাকে পটভূমি করে মেঘের সন্ধানে হেঁটেছেন। বনমালী মালও জল সংকট, শুষ্কভূমি, মানুষের আর্তরবকে সূক্ষ্মভাবে এঁকেছেন। বনমালীর প্রধান গুণ প্রবল অভাবের মধ্যেও প্রবল যন্ত্রণার মধ্যেও শুভবোধ, কল্যাণচিন্তার বীজ বুনে যাবার গোপন প্রয়াস। সংস্কারের পৃথিবীতে, অভাবের পৃথিবীতে, লোকায়ত ভাবমণ্ডলের পৃথিবীতে তিনি গোপনচারিণী হয়ে স্বপ্নভূমির বীজ বুনে যান। বুধু সম্পর্কে বয়ানে পাই—
“যারা জীবন ভালোবাসে, জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত মেনে নিতে পারে, তারা তো মন্ত্রে মানে না। তারা মুরারীকে দেখতে দেখতে চোখের জল হয়ে গেল। তাদের কাছে গোটা কাহিনিটার সর হয়ে থেকে গেল শুধু জল আর শীতলতার আদর। ভাবতে ভাবতে ততদিনে তারা গোড়ায় পৌঁছে গেছে, বুঝে গেছে, লোকটা আসলে জলের আপনজন। তাই সেদিন দগদগে আগুন তার কিছুই করতে পারেনি।” (জাতক, তদেব, পৃ. ৮৮)
‘জাতক’ আসলে জলের আখ্যান। জলজীবন কামনার আখ্যান। উত্তর বাংলায় কৃষির জন্য জল কামনায় ‘হুদুম দ্যাও’ উৎসবের কথা বাংলা আখ্যানে নানাভাবে এসেছে। দেবেশ রায়, জীবন সরকার, বিপুল দাস, দেবজ্যোতি রায়ের আখ্যানে কৃষির সঙ্গে যুক্ত সেই সংস্কার নানাভাবে উঁকি দিতে দেখি। আবার জলজীবনের কথা ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়, হরিশংকর জলদাস, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় নানা বিচ্ছুরণে দেখি। ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়ের ‘চর পূর্ণিমা’, ‘সমুদ্র দুয়ার’, ‘বন্দর’ উপন্যাসে জল জীবিকা ও জল সংলগ্ন মানুষের সুখ দুঃখের কথা নানামাত্রায় আছে। বনমালী মালের ‘জাতক’ আখ্যানে জল প্রার্থনা, জলের জন্য আর্তনাদ, জলের নিমিত্তে ভুক্তভোগী জীবনের করুণ চিত্র আছে। বুদ্ধদেব জানা ওরফে বুধু হয়ে গেছে জলফকির। অথচ পুকুরে মৃত হয়েছে স্ত্রী আরতি। সংস্কার, লোকাচারের ভুবনে দ্বন্দ্বময় জীবনের ক্ষতবিক্ষত চিত্রনাট্য বনমালী মাল নানা বিরোধাভাসে চিহ্নিত করেছেন। অমর মিত্রের লক্ষ্য যেখানে প্রাচীন ভারত, ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায় যেখানে জলের শস্যকে সামনে রেখে জীবনের হালহকিকত গড়তে ব্যস্ত, সৈকত রক্ষিত, সাধন চট্টোপাধ্যায়, সুকান্তি দত্ত যেখানে সমস্যার কথা ব্যক্ত করতে উদগ্রীব সেখানে বনমালী মাল বদলে যাওয়া মানচিত্র ও সময়ের বিবর্তনে আধুনিক পৃথিবীর গল্প গড়তে অগ্রসর। জলের পাইপ লাইন, মাছ চাষের ভেড়ি, নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্ব, নবীনের অস্থিরতা, নতুন কিছু করার মোহ, প্রবীণের আঁকড়ে ধরা জেদ, ছদ্ম দ্রোহের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত জীবনচেতনার গল্প উঠে আসে। সংস্কার, বিশ্বাস, বংশলতিকা, মুরারী-বুধু-সুশীল-গোরাদের জীবনচেতনার পৃথক অভিসার, জীবনভাবনার দোদুল্যমান সমীক্ষায় সমষ্টি-ব্যক্তির ধারাপাত যেমন বর্ণিত হয় তেমনি পরিবর্তিত সময় কাঠামোয় সংস্কার-বিশ্বাসের দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে আধুনিক পৃথিবীর ভাষ্য উঁকি দিতে দেখি। বাস্তব-অবাস্তব, ঢেউ খেলানো বাস্তব, অদৃশ্য বাস্তব, ছায়া বাস্তব ও মানুষের অবয়ব নিয়ে আখ্যান যেমন জলকীর্তন, জল পদাবলি গেয়ে চলে তেমনি জীবনতৃষ্ণার নানাবিধ প্রকোষ্ঠকে ব্যক্ত করে। মানুষ হারিয়ে যায় ছায়ার অবয়বে—
“বুধু এখন একা একটা ছায়া শুধু। কালো কুচ্ছিত যে-কোনো একটা অবয়ব। সেই কালোয় মানুষ নেই। মায়া নেই। কোনো জাদু কিংবা বিদ্যা—কিছুতেই সেই ছায়ায় আলো ঝরে না। এমনকী সুশীলের ছায়ার দিকে তাকানোর চোখও নেই তার।” (তদেব, পৃ. ১১০)
এখানে মানুষ হারিয়ে যায়। গাছ পাথরে মিশে যায়। অদৃশ্যলোকে বিচরণ করে জীবিতের উপর প্রভাব ফেলে। জীবিত মানুষ মৃত মানুষকে ঘিরে কাহিনি গড়ে। অমর মিত্রের ‘নিসর্গের শোকগাথা’ আখ্যানে মৃতরাই কাহিনি রচনা করে চলেছে। ‘নিরুদ্দিষ্টের উপাখ্যান’ আখ্যানে মৃত ছায়া জীবিতের পিছনে পিছনে ঘুরে চলেছে। রবিশংকর বলের ‘দোজখনামা’ আখ্যানে উপমহাদেশের দুই কিংবদন্তি মান্টো-গালিব কবর থেকে দেশ-কাল-সমাজ নিয়ে কাহিনি গড়ে তুলেছে। শুভংকর গুহের ‘বিয়োর’ আখ্যানে কিরিটি সাপুড়ে বৃদ্ধ হতে হতে যেন অদৃশ্যলোকে মিশে যাচ্ছে। ভারতীয় মিথের পরম্পরা, রূপকথা, লোকগাথার নানাবিধ স্কেচকে সংযুক্ত করে বনমালী মাল বুদ্ধদেব জানাকে সাজিয়েছেন। পীযূষ ভট্টাচার্যের ‘জলের বর্গক্ষেত্র’, ‘ভবনদীর ঘাট’ গল্পে দেখা যাবে জলের লীলাখেলা, জলকে নিয়ে ভারতীয় সভ্যতার মিথ পুরাণ, লোকায়ত পরিসরের বহুমাত্রিক দ্বন্দ্বচরিতের খেলা। সেসবের মধ্য দিয়ে ভারতীয় আখ্যান কেমন হতে পারে তার নিদর্শন মেলে। বনমালী মাল জলকে সামনে রেখে প্রাচীন সভ্যতার ও আধুনিক সভ্যতার সহজিয়া স্রোতকে এক সূত্রে গেঁথেছেন। বুদ্ধদেব জানা ওরফে বুধু তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নায়ক হতে গিয়েও হয়নি। বনমালী মাল খুব সচেতনভাবেই সেই বিন্যাস প্রক্রিয়া বজায় রেখেছেন। বুদ্ধদেব দুইকালের প্রতিনিধি। সে সময় চরিতের ধারকবাহক। ভারতীয় সভ্যতার মিথ-রূপকথা-লোককথার আধুনিক সংস্করণ কোন পথে যেতে পারে তার আশ্চর্য আলেখ্য আঙ্কিত হয়েছে ‘জাতক’ আখ্যানে। বনমালী মাল খুব সচেতনভাবেই বাংলা উপন্যাসে পা রেখেছেন। নির্জনতার আড়াল দিয়ে সাহিত্যের প্রচলিত ফর্মকে ডিঙিয়ে নিজস্ব পথ অন্বেষণ এই তরুণকে বাংলা বাজারে পৃথক করে তুলেছে। এখন দেখার ভবিষ্যতে সেই যাত্রাপথ কোনদিকে যায়।
দু-টি উপন্যাস। বনমালী মাল। আপনপাঠ। প্রথম প্রকাশ, ডিসেম্বর ২০২৪। মূল্য ২২০।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।