কিছুদিন আগে পর্যন্তও ‘নতুন যুগের’ কর্পোরেট সংস্থাগুলি ছিল উদারতাপন্থার ধ্বজাধারী। সিলিকন ভ্যালির তরফে একের পর এক রেনবো মার্চেন্ডাইস, #MeToo ওয়ার্কশপ, বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব অঙ্গীকার — প্রগতিশীলতার হদ্দমুদ্দ যাকে বলে। নারী অধিকার, জাতিগত সমতা, LGBTQ+ অন্তর্ভুক্তি — এসব বুলির ছড়াছড়ি ছিল কর্পোরেট পলিসিতে।
কিন্তু ট্রাম্পের উত্থান আর সাম্প্রতিক ‘কালচার ওয়ার’-এর মধ্যেই সুর কেমন পাল্টে গেলো। ডিইআই (ডাইভার্সিটি, ইকুইটি, ইনক্লুশন) টিম গুটিয়ে নেওয়া হচ্ছে, গর্ভপাত সংক্রান্ত সুবিধা আংশিক/ সম্পূর্ণ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে, জলবায়ু প্রতিশ্রুতিও আর্থিক চাপের অজুহাতে স্থগিত। নিউ ইয়র্ক টাইমস (2024)-এর ভাষায়, কর্পোরেট উদারতা যেন হঠাৎই ফিকে হয়ে গেল। প্রশ্ন জাগে — হঠাৎ এই বিপরীতমুখী সিদ্ধান্তের নেপথ্যে কি সত্যিই বিশ্বাসের বদল, নাকি কেবলই হিসেবের খাতায় মুনাফার রাস্তা বদল?
কেন কর্পোরেট দুনিয়া এমন নিজেদের এমন উদার ভাবমূর্তি মেলে ধরেছিল, তা বোঝার জন্য একবার পেছনে তাকাতে হবে। সম্ভবত সবচেয়ে জোরালো ব্যাখ্যা হল — তখন উদারপন্থা ছিল লাভজনক। গ্লোবাল, শিক্ষিত, শহুরে মধ্যবিত্ত এবং পেশাদারদের মন জয় করতে ‘প্রগতিশীল’ ভাবমূর্তি কাজে লেগেছিল। থমাস ফ্রাঙ্ক তার "Listen, Liberal" (2016) বইতে যাকে বলেছিলেন “প্রফেশনাল ক্লাস”, তারাই ছিল এই কর্পোরেট সংস্কৃতির আসল লক্ষ্য। সুতরাং বৈচিত্র্য আর অন্তর্ভুক্তি আদতে নীতি নয়, ছিল একটি কৌশলী পণ্যায়ন।
একই সঙ্গে, এই উদারতাবাদী-ছোঁয়া কোম্পানিগুলির মানবসম্পদ বিভাগ শ্রমিক আন্দোলন বা কোনো ইউনিয়ন গঠনের বিরুদ্ধে একরকম ঢাল হিসেবে ব্যবহার করত। সংস্থার যদি ওয়েবসাইট যদি বৈচিত্র্য তুলে ধরে বা প্রাইড প্যারেডে স্পনসর করার অঙ্গীকার করে, তখন স্বল্পবেতনে শ্রমচুরি, অতিরিক্ত কাজের বোঝা - এইজাতীয় কর্মচারী শোষণের প্রসঙ্গ অনেকটাই ঢাকাচাপা পড়ে যায়। এই ‘উদারতার’ আলোক-ছটা আসলে কর্পোরেটের রক্ষাকবচ।
পরিবেশ-সচেতনতা? সেটাও ছিল পণ্য বিক্রির কৌশলেই। গ্রাহকরা বিশ্বাস করতে চায় যে তাদের উবার রাইড কার্বন-নিউট্রাল, বা অ্যামাজন প্যাকেটের পেছনে পবিবেশবন্ধব সবুজ-ছাপ আছে। যদি এইভাবে কনজিউমারিজমের অপরাধবোধ মিটিয়ে ফেলা যায়, এর চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে?
তারপর এল ট্রাম্প-যুগ। এই রাজনৈতিক ও সামাজিক দক্ষিণপন্থী উত্থান, যা ‘ওক ক্যাপিটালিজম’-কে সহজ টার্গেটে পরিণত করল। হঠাৎই ডিইআই হয়ে উঠল শেয়ারহোল্ডার আর রাজনীতিকদের নিশানা। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ (2023) বলছে, রাজনৈতিক মেরুকরণের চাপে অনেক সংস্থাই তাদের উদার ভাবমূর্তিকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে — কারণ হিসেবের অঙ্ক পাল্টে গিয়েছে।
অর্থনৈতিক বাস্তবতাও বদলেছে। সুদের হার বেড়েছে, কোভিডের বাড়তি নগদ তলানিতে, স্টার্টআপের ভ্যালুয়েশন পড়ে যাচ্ছে — ফলে কর্পোরেট ‘মূল্যবোধ’ রক্ষার খরচ আর বহন করা যাচ্ছে না। কিছু কর্পোরেট তো বুঝেই গিয়েছিলো, যদি রক্ষণশীল শাসকদের খুশি রাখতে হয়, তাহলে উদার ভঙ্গি ছাড়তেই হবে।
তবে কী পুরোটাই প্রতারণা ছিল?
একদম বিশ্বাসঘাতকতা বললে হয়তো পুরো সত্যি বলা হবে না। কর্পোরেট মানসিকতা সর্বদা মুনাফার নিয়মে চলে — সূর্যের দিকে বাড়তে থাকা গাছের মতো। যতক্ষণ উদারপন্থা থেকে মুনাফা আসছিল, ততক্ষণ তারা উদারপন্থার কথা বলেছে। যখন সেটাই ব্যয়বহুল হয়ে গেল, তখন আবার রঙ পাল্টাল।
নয়া-পুঁজিবাদ আসলে উদারপন্থাকে শুধু দখল করেনি — সেটাকে পণ্যে পরিণত করেছে। আর যখনই আর্থিক সমীকরণ পাল্টেছে, তখনই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।
অনেকে একে বিশ্বাসঘাতকতা মনে করতে পারেন, কিন্তু সত্যি বলতে গেলে সেক্ষেত্রে এটা মেনে নিতে হয় কর্পোরেট নীতির মূলে আদর্শ ছিল — কিন্তু তা তো আর নয়, ছিল কেবল হিসেবি বাজার-পরিচালনা। সেই অঙ্ক বদলেই নতুন কৌশল।
সামনের দিনে কর্পোরেট সংস্কৃতি কিসের দিকে যাবে? যেদিকে বাজারের হাওয়া বইবে। যদি রক্ষণশীল সংস্কৃতির মধ্যেই মুনাফা থাকে, তবে সেটাকেই পলিশ করে বিক্রি করবে। আবার প্রগতিশীল হাওয়া ফিরলে নতুন করে রংচঙে লোগো, ডিইআই কনসালট্যান্ট সব ফিরিয়ে আনবে।
নয়া-পুঁজিবাদের আসল চিন্তা একটাই — মুনাফা। বাকি সব মুখোশ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।