পেরু-অ্যামাজন ইন্টারন্যাশনাল বাটারফ্লাই ফার্মে ঢোকবার জন্যে মাথাপিছু দেড় অ্যামেরিকান ডলারের টিকিট কিনতে হয়, যে গাড়িটায় ওরা এসেছে ঢোকবার মুখে সেটা দেখতে পেয়ে কাউন্টারের মেয়েটা টিকিটের দাম নিতে চাইছিল না। ফল্গু জোর করায় অবিশ্যি আর বিশেষ আপত্তি করলো না। ছোট একটা পাহাড়ের ঢালের একটা বাঁকে ফার্মে ঢোকার গেটটা। সেই গেটটা দিয়ে ঢুকলে মনে হয় একেবারে দোতলায় চলে এলাম। যেখানটায় ওরা দাঁড়িয়ে আছে তার নীচেও ফার্মের একটা অংশ।
ভেতরে ঢুকে কিন্তু ওরা হতবাক। ঠিক এমন ধরণের কিছু দেখবে ওরা আগে ভাবেনি। দেখে মনে হয় জঙ্গলেরই একটা অংশ, কিন্তু প্রজাপতিদের ধরে রাখার জন্যে বিরাট একটা জায়গা – শোনা গেলো ছ'শো স্কোয়ার মিটার – জাল দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। এত রং-বেরঙের প্রজাপতি এক জায়গায়, মনের আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে তারা, অজস্র গাছের পাতায় আর ফুলে তাদের রাজত্ব। ছোট ছোট খাল কাটা, তার ওপর আরও ছোট ছোট সাঁকো, ঘাসে-পাতায়-সাঁকোর রেলিঙেও প্রজাপতিদের মেলা, পথ-ভোলা কোন প্রজাপতি ওদেরও চুলে-মুখে-গায়ে – এমন মজার অভিজ্ঞতা ওদের হয়নি কখনো আগে। একটা বিরাট হলে দেখা গেল নানা জাতের প্রজাপতিকে নির্জল করে প্রদর্শনের জন্যে মাউন্ট করে রাখা হয়েছে, প্রতিটির পাশে ছোট ছোট বৈজ্ঞানিক টিপ্পনী।
পাখনায় ঠিক পেঁচার মুখের মতো ছবিওয়ালা একটা প্রজাপতির পাশের টিপ্পনীটা যখন পড়ছে ওরা, তখন পেছন থেকে হঠাৎ পরিষ্কার বাংলা ভাষায় শোনা গেল, কলকাতা থেকে মনে হচ্ছে।
পিছন ফিরে দেখা গেল হাসিমুখে এক ভদ্রলোক ওদের দিকে তাকিয়ে। কলকাতায় এক ধরণের মানুষ দেখা যায় যারা বাংলা বলে একেবারেই বাঙালিদের মতো, কিন্তু চেহারা দেখলেই বোঝা যায় বাঙালি নয়, এই ভদ্রলোকও খানিকটা সেরকম। দেখে মনে হয় বিহার কিংবা উত্তর বা মধ্য প্রদেশের লোক। হেসে বললেন, আমার নাম চিত্রগুপ্ত্ ওয়ার্মা, অনেকক্ষণ ধরে আপনাদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, শব্দটা আসছে কোথা থেকে বুঝতে পারছিলাম না, এই মাউন্টটার পাশে এসেই দেখতে পেলাম।
জানা গেলো ভদ্রলোক কলকাতারই মানুষ, লা-মার্টিনিয়রে স্কুলের পড়াশোনা করেছেন, ট্যুরিজমের ব্যবসা করেন। ট্যুরিস্ট-সিজ্ন্ শুরু হতে এখনো সপ্তা'-তিনেক দেরি, হাতে বিশেষ কাজ না থাকায় নিজের পছন্দের জায়গাগুলোতে একা একাই ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
ট্যুরিস্ট-সিজ্ন্ শুরু হতে তিন সপ্তাহ বাকি, আপনি একা-একাই চলে এসেছেন এতদিন আগে? – ফল্গু জিজ্ঞেস করে ভদ্রলোককে, ওর গলায় বিস্ময় চাপা থাকে না।
এখানে একটা স্ন্যাক বার-কাম-স্যুভেনির শপ আছে, চলুন না, একটু কফি খেতে খেতে গল্প করা যাক, জবাবে বলেন ভদ্রলোক।
স্যুভেনির শপ-এ দেখা গেলো চিত্রগুপ্ত্ ওয়ার্মাকে সবাই চেনে। বোঝা গেলো, স্প্যানিশ এবং পর্তুগিজ, দুটো ভাষাতেই উনি স্বচ্ছন্দ। ভদ্রলোক নিজেই অর্ডার দিলেন, ফল্গুর আপত্তি উড়িয়েই দিলেন একেবারে। টেবিলে ওরা বসার পর কোথা থেকে হঠাৎ একটা মোটাসোটা বেড়াল লাফিয়ে উঠে পড়ল টেবিলটায়। টেবিলে-বসা সবায়েরই মুখের দিকে একে একে তাকাল বেড়ালটা, তারপর চিত্রগুপ্ত্ ওয়ার্মার মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে ডাকল, ম্যাও। চিত্রগুপ্ত্ আঙুল নাড়িয়ে ডাকলেন বেড়ালটাকে, লাফ দিয়ে সে ঢুকে গেল টেবিল আর চেয়ারের মাঝখানের ছোট্ট ফাঁকটা দিয়ে, বসল গিয়ে সোজা চিত্রগুপ্তর কোলে। কফি-টফি আসার পর বেড়ালটাকে টেবিলে তুলে ওর কানের ঠিক নীচে আঙ্গুল দিয়ে আঙুলটা ঘোরাতে ঘোরাতে চিত্রগুপ্ত্ বলতে থাকেন, আমি সাধারণত পেরু-বলিভিয়া-প্যারাগুয়ে-আর্জেন্টিনাই করে বেড়াই, আমার জীবনের যা যা আকর্ষণ, সব এসব জায়গাতেই মেলে। আপনাদের যেখানে ধরলাম, মানে ওই ক্যালিগো ট্যুসার-এর মাউন্টটার পাশে, ওটা থেকে ঠিক দুটো লাইনের পর আমার একটা বিশেষ ভালো-লাগার জায়গা আছে, এখানে এলেই ওই জায়গাটা দেখে আসি একবার। আজ গিয়ে ডবল লাভ হলো, তিন-তিনজন কলকাতার মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল।
লাভ আপনার হলো না আমাদের, সেটা এখনো বোঝা যায়নি, উল্কি বলে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে যেখানে দেখা হলো আপনার, সেই জায়গাটাকে কী বললেন, কিসের পাশে যেন, ক্যালিকো না কী একটা...
ক্যালিকো নয়, নট 'ক' – হেসে ফেলেন চিত্রগুপ্ত্ ওয়ার্মা – ক্যালিকো তো একরকমের সুতির কাপড়ের নাম, সাধারণত সাদা, খুব নরম। ইংরেজরা মসলিনের সঙ্গে এই কাপড়ও দখল করেছিল আমাদের দেশে এসে। যখন বিলেতে নিয়ে যায়, ক্যালিকোই বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল মসলিনের তুলনায়, কারণ দামে অনেক শস্তা, আর মসলিনের মতো প্রায়-স্বচ্ছ না হবার ফলে সাধারণ মানুষের কাজেও লেগেছিল বেশি। কিন্তু আমি বলেছি ক্যালিগো ট্যুসার, 'গ'। 'ক' নয়। আচ্ছা দাঁড়াও – মুড়কিকে দেখিয়ে বলতে থাকেন চিত্রগুপ্ত্ – তোমাদের দুজনকে আমি 'তুমি' সম্বোধনই করবো, তোমরা অনেক ছেলেমানুষ, ক্যালিকোর আর-একটা মানেও বলে দিই তোমাদের।
চোখে-মুখে যথেষ্ট আগ্রহ ওদের তিন জনেরই।
চিত্রগুপ্ত্ বলতে থাকেন, সুতিবস্ত্রের ক্ষেত্রে ক্যালিকো সাধারণত সাদা হলেও জন্তু-জানোয়ারের ক্ষেত্রে কিন্তু অন্যরকম। সে ক্ষেত্রে ক্যালিকো বলতে সাধারণত সাদার ওপর একাধিক রঙের ফুটকি বা ডোরা বোঝায়। আমি যদি কোন বেড়ালের সম্বন্ধে বলি ক্যালিকো ক্যাট, তাহলে বুঝতে হবে নরম সাদা লোমের উপর দু-রঙের – সাধারণত কালো আর কমলা – ফুটকি দেওয়া বেড়াল। কিন্তু দেখো, এই আমার বকবক করার অভ্যেস, বলছিলাম ক্যালিগো ট্যুসার-এর কথা, আর এসে পড়লাম কোথায়!
ক্যালিগো ট্যুসার, বলতে থাকেন চিত্রগুপ্ত্, এক ধরণের প্রজাপতি। পাখনার নীচের দিকটায় পেঁচার চোখের মতো আঁকা থাকে, তার ফলে অনেকেই এদের আউল বাটারফ্লাই বা প্রজাপতি পেঁচা বলে ডাকে।
আমরাও তো নিজেদের মধ্যে তা-ই বলছিলুম, উত্তেজিত হয়ে বলে মুড়কি, ঠিক তখনই আপনি বাংলা শুনে আমাদের সঙ্গে কথা বললেন।
ঠিক, মাউন্ট করা প্রজাপতিটাকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলে তোমরা, একে তো পেঁচার মতো দেখতে পাখনা, তার ওপর সাইজে অমন বড়ো! অতো বড় সাইজ, প্রায় একটা ছোটখাটো পাখিরই মতো, কিন্তু খুব ভাল উড়তে পারে না ওরা। খুব নীচ দিয়ে, মাটি থেকে বড়ো জোর এক-দেড় মিটার ওপর দিয়ে ওড়ে, আর কয়েক মিটার অন্তর অন্তরই বিশ্রাম নিতে হয়। তার ফলে বড়ো-সড়ো পাখি থেকে শুরু করে জঙ্গলের অনেক প্রাণীর পক্ষেই ওদের শিকার করা সহজ। অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, পেঁচা-চোখটা ওদের স্বাভাবিক ক্যামোফ্লাজ, পেঁচা বলে ভুল করে কাছাকাছি আসে না অনেকেই! শুধু চোখই নয়, স্বভাব-টভাবও ওদের রাতের জীবজন্তুর মতোই, সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয়ই হলো ওদের বেড়াবার সময়। ল্যাটিনে ক্যালিগো কথাটার মানে হলো রাত্তির, আর সেই জন্যেই ক্যালিগো ট্যুসার নাম এদের। সমস্ত দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে আছে একুশ-বাইশ প্রজাতির ক্যালিগো প্রজাপতি, দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে কিন্তু নেইই আর।
কিন্তু আপনি যে বলছিলেন যেখানে ক্যালিগো ট্যুসার দেখছিলুম আমরা সেই জায়গাটা আপনার খুব প্রিয়, প্রশ্ন করে মুড়কি, প্রিয় কেন?
প্রিয় কেন সেটা বলব, চল, সেখানেই ফিরে যাই আমরা।
ততক্ষণে ওদের খাওয়াদাওয়াও হয়ে গেছে, মাউন্ট হাউজের দিকে হাঁটতে থাকে ওরা, বেড়ালটাও হাঁটতে থাকে চিত্রগুপ্তর সঙ্গে সঙ্গে। হাঁটতে হাঁটতে কিন্তু প্রজাপতি পেঁচার কথাতেই আবার ফিরে আসেন চিত্রগুপ্ত্ ওয়ার্মা। এবার সরাসরি জিজ্ঞেস করেন ফল্গুকে, কখনো আগে দেখেছেন প্রজাপতি পেঁচা?
না, দেখিনি, আসলে আপনি ইন্টারেস্টিং করে বলছেন তাই, এর আগে কখনও এসব ব্যাপারে ইন্টারেস্টই পাইনি।
প্রজাপতি ভালোবাসেন না?
না না, মৃদু প্রতিবাদ ফল্গুর গলায়, দেখতে তো নিশ্চয়ই ভালোবাসি, কিন্তু আপনার মতো করে, মানে আপনি যেমন এত কিছু জানেন এদের ব্যাপারে...
এন্টোমোলজিতে আপনার কোন আগ্রহ নেই, তাই তো? আপনার ইন্টারেস্ট কিসে?
আমি কলেজে ইংরিজি পড়াই, বলে ফল্গু, আমার আগ্রহ ভাষায়, খানিকটা সাহিত্যেও। তারপর উল্কিকে দেখিয়ে বলে, ও আমার ছাত্রী। তবে আমার ছোট বোন ভাবতে পারেন, এমনকি বন্ধুও।
আর ও? – মুড়কিকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেন চন্দ্রগুপ্ত্।
উল্কিকে দেখিয়ে বলে ফল্গু, ওর বোন। অতএব আমারও।
হাঁটতে হাঁটতে আসছিল ওরা, মাউন্ট হাউজের খুব কাছাকাছি এসেছে যখন, চিত্রগুপ্ত্ বললেন, আপনাদের আমি প্রজাপতি পেঁচার সম্বন্ধে বলছিলুম, আপনারা আগে কেউই এই প্রজাপতি দেখেননি। বলছিলুম, দক্ষিণ আমেরিকায় প্রায় বাইশ-তেইশ প্রজাতির ক্যালিগো প্রজাপতি আছে, কিন্তু এরা বাইরে বেরোয় শুধু রাতের বেলা। এবার মুড়কির দিকে তাকিয়ে হেসে জিজ্ঞেস করেন চিত্রগুপ্ত্, বলতে পার এরা থাকে কোথায়? খায় কী?
এক-দেড় মিটারের বেশি উঁচুতে উড়তে পারে না, মুড়কি জবাব দেয়, তার মানে মাটির কাছাকাছিই থাকে, ছোটখাটো গাছ-টাছে হবে। মাটি থেকেই পোকা-টোকা খুঁটে খায় নিশ্চয়ই।
এবার উল্কির দিকে তাকাতে হেসে ফেলে উল্কি, আমারও ওই একই জবাব, তবে খাদ্যের ব্যাপারে ওর সঙ্গে একমত নই আমি। পোকা-টোকা খুঁটে পাখিরা খেতে পারে নিশ্চয়ই, প্রজাপতির মনে হয় তেমন শক্ত ঠোঁট নেই।
ফল্গুকে জিজ্ঞেস করে চিত্রগুপ্ত্ ওয়ার্মা, ম্যাডাম আন্দাজ করতে পারেন কিছু?
আন্দাজ করতে ক্ষতি কী, চেষ্টা করে দেখি, বলে ফল্গু, পাখিদের যে ক্লে লিক দেখা যায় অ্যামাজন অঞ্চলে, বড় বড় দেয়ালের মতো, তারই নীচের দিকে, মাটি থেকে এক-দেড় মিটার পর্যন্ত আপনার ওই ক্যালিগো ট্যুসারের আস্তানার পক্ষে আদর্শ জায়গা হতে পারে।
আপনি ক্লে লিক-এর কথা জানেন?
সে আর কে না জানে?
তো, ক্লে লিক-এর কথা ভাবলেন কেন?
আপনিই বললেন একুশ-বাইশ প্রজাতির ক্যালিগো প্রজাপতি দক্ষিণ আমেরিকাতেই আছে, কিন্তু এর বাইরে আর কোত্থাও নেই। আর এমন ক্লে লিক-এর কথাও দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে আর কোথাও আছে বলে শুনিনি। অতএব এটাকে এই অঞ্চলের একটা কমন ফ্যাক্টর বলে ধরা যেতে পারে। যে প্রজাপতি মাটি থেকে এক-দেড় মিটারের বেশি ওপরে উঠতে পারে না, সে গাছের কোটরে বা ছোট গাছে থাকবে না, প্রাণ-সংশয় হতে পারে। কিন্তু সে যদি থাকে দক্ষিণ আমেরিকায় তাহলে ক্লে-লিকের নীচের দিকটা অনেক নিরাপদ। দিনের বেলা পেঁচার চোখ প্রদর্শন করে বিশ্রাম নিলে পাখিরা আক্রমণ করতে সাহস পাবে না। তা ছাড়া কাদাই তো ক্লে লিক-এ পাখিদের আসল আকর্ষণ, সেটা খেতেই তারা আসে, প্রজাপতিকে তারা পাত্তাই দেবে না। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পাখিদের ভীড়, তারপর তারা নিজেদের বাসায় ফিরবে, কাজেই সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় প্রজাপতিদের নিরাপদ রাজত্ব চলতেই পারে।
আপনাকে আর একটা খবর জানিয়ে দিই যেটা আমি আগে বলিনি, বলেন চিত্রগুপ্ত্, এই প্রজাপতিদের অন্যতম প্রধান খাদ্য ক্যালসিয়াম।
তাহলে বোধ হয় আমার আন্দাজটা আরও জোরদার হয়। ক্লে-লিক-এর মাটিতে শুনেছি ক্যালসিয়াম ভরপুর, তা ছাড়া
বার্ড-ড্রপিংসেও ক্যালসিয়াম পাওয়া যাবে।
বলছিলেন না, আপনার এন্টোমোলজিতে ইন্টারেস্ট নেই?
আপনার মতো শিক্ষক পেলে ইন্টারেস্ট তৈরি হবে মনে হচ্ছে।
ঠিক আছে, আপনার মতো ছাত্রী পেলে শিক্ষকও খুশি, বলেই যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এমন ভাবে বলে ওঠেন চন্দ্রগুপ্ত্, যে জন্যে আপনাদের টেনে নিয়ে এলুম এই মাউন্ট হাউজে, সেটাই তো ভুলতে বসেছি। চলুন, আমার ফেভারিট জায়গাটা দেখিয়ে আনি আপনাদের।
ক্যালিগো ট্যুসার-এর মাউন্টটা যেখানে সেখান থেকে দুটো লাইন পেরিয়ে আরও অনেক প্রজাপতির মাউন্ট দেখতে দেখতে একটা নীল রঙের প্রজাপতির মাউন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো ওরা। চিত্রগুপ্ত্ জিজ্ঞেস করলেন, কেমন দেখছেন এটা?
শয়ে শয়ে এত সুন্দর প্রজাপতির মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীল প্রজাপতিটাকে তেমন কিছু মনে হল না ওদের, তবুও ভদ্রতা করে ফল্গু বললো, বেশ তো।
খুব কিছু ভালো আপনাদের লাগেনি, লাগবার কথাও নয়, কিন্তু ওটার পাশে যে বিবরণটা লেখা আছে সেটা একবার পড়ে দেখতে অনুরোধ করব।
মুড়কিই পড়তে যায় প্রথম, আর তার পরেই চেঁচিয়ে উঠে বলে, আরে, এ যে আপনারই নাম! তিনজনেই পড়ে তারপর, সেলাস্ট্রাইনা আর্জিওলাস চিত্রগুপ্ত্ ম্যালডোনাডো! পাশেই ব্র্যাকেটে লেখা, হোলি ব্লু বাটারফ্লাই, ম্যালডোনাডো (পেরু) ভ্যারাইটি।
উল্কি বলে, সেলাস্ট্রাইনা আর্জিওলাস নামটা দেখে তো মনে হচ্ছে এটা সায়েন্টিফিক নাম, ল্যাটিন হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু তার সঙ্গে আপনার নাম কেন?
বুঝতে পারলি না, ফল্গু বলে এবার, এই প্রজাপতির আবিষ্কর্তা নিশ্চয়ই চিত্রগুপ্ত ভার্মা, তাই তাঁর নাম যুক্ত হয়েছে সায়েন্টিফিক ল্যাটিন নামটার সঙ্গে। এবার চিত্রগুপ্তর দিকে ফেরে ফল্গু, ঠিক বলেছি স্যর?
ঠিকই বলেছেন, জবাব দেন চিত্রগুপ্ত্, তবে একটু বাড়িয়ে বলেছেন। সেলাস্ট্রাইনা আর্জিওলাস, সাধারণত হোলি ব্লু বাটারফ্লাই নামে জনসাধারণের মধ্যে আমার জন্মের আগের থেকেই পরিচিত। কাজেই এদের আবিষ্কর্তা হবার সুযোগই আমার নেই। মূলত এদের দেখা যায় য়্যোরোপে, বিশেষত ইংল্যাণ্ডে, ইদানিং যদিও ইংল্যাণ্ডে এদের সংখ্যা কমছে। এই প্রজাপতিদের দক্ষিণ আমেরিকায় দেখতে পাওয়া সম্ভব বলে আগে শুনিনি কখনো, কিন্তু বছর তিনেক আগে এই জঙ্গলেই আমি একটা হোলি ব্লু বাটারফ্লাই দেখতে পাই। তারপর আমার জেদ চেপে যায়। দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা হাতে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে ঘুরতে থাকি নানা গাছের ঝোপে ঝোপে, ডিম থেকে মেটামর্ফোসিস পর্যন্ত লক্ষ্য করার সংকল্প নিয়ে...
এই রে, এবার হেসে ফেলেন চিত্রগুপ্ত্, মেটামর্ফোসিস বুঝতে পারলেন তো?
ফল্গু বলে, আমি এন্টোমোলজি পড়িনি ঠিকই, কিন্তু আমি ভাষা আর সাহিত্যের ছাত্রী। রোমান কবি ওভিড-এর ক্ল্যাসিক কাব্য মেটামর্ফোসিস আর কাফ্কার বিখ্যাত উপন্যাসের কথা আমি আপনাকে বলতেই পারি, কিন্তু তার প্রয়োজন হবে না। আমি বুঝতে পারছি আপনি ডিম থেকে ধাপে ধাপে নানা বদলের পর প্রজাপতির পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠার গল্প বলতে চাইছেন।
এগ্জ্যাক্টলি, বলেন চিত্রগুপ্ত্, এই মেটামর্ফোসিস লক্ষ্য করাই আমার একমাত্র কাজ হয়ে উঠল নীল প্রজাপতিটাকে দেখার পর থেকে। আগেই বলেছি, হোলি ব্লু প্রজাপতির সংখ্যা বেশ কিছুদিন ধরেই ইংল্যাণ্ডে কমছে, কিন্তু কিছুদিন আগে একটা আর্টিক্লে পড়েছিলুম দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যাণ্ডের ডরসেট এবং উইল্টশায়ার অঞ্চলে হঠাৎ এদের বৃদ্ধি দেখা গেছে। মাটির খুব কাছাকাছি এক ধরণের সবুজ ঘাসের ঝোপে পাওয়া গেছে এদের ডিম। একটা ইন্টারেস্টিং কথা এখানে বলে রাখি, বলেন চিত্রগুপ্ত্, এই ডিম ফুটে যে লার্ভা বেরোয়, চলতি কথায় শুঁয়ো বলি আমরা যাকে, তার রঙ সবুজ, যে সবুজ ঘাসের মধ্যে দেখা গেছে তাদের, সেই ঘাসের রঙ আশ্চর্য রকম ভাবে ক্যামোফ্লাজও করছে তাদের।
ভদ্রলোকের কথা বলার ভঙ্গীটা এমন চমৎকার নাটকীয় যে মুড়কি-উল্কি-ফল্গু একেবারে ছেলেমানুষরা যেভাবে ঠাকুমা-দিদিমার গল্প শোনে ঠিক সেইভাবেই তন্ময় হয়ে শুনছিল। কখন যে ওদের পেছনে স্ন্যাক-বারের ছেলেটা এসে দাঁড়িয়েছে টেরও পায়নি ওরা।
ছেলেটার গলা শুনে চমকে পেছন ফিরে তাকালো ওরা।
সবুজ রঙের খুব ছোট শুঁয়ো সবুজ ঘাসের ঝোপে ক্যামোফ্লাজ করা, তাহলে ওদের দেখা গেল কীভাবে? – জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা।
ঠিক একটা মুহূর্ত একটু ঢোক গিলে নিলেন ভদ্রলোক, তারপর হেসে বললেন, কামড় খেয়ে।
কামড় খেয়ে? – অবাক প্রশ্ন মুড়কির – কার কামড়? লার্ভার? ওই অত্তটুকু শুঁয়োর?
পিঁপড়ের, বলেন চিত্রগুপ্ত্, লার্ভার পাহারাদার।
পিঁপড়ে? এর মধ্যে পিঁপড়ে এল কোথা থেকে?
সেলাস্ট্রাইনা আর্জিওলাস প্রজাপতির লার্ভার রক্ষক এক ধরণের পিঁপড়ে, এই লার্ভার বেঁচে থাকায় ওদের স্বার্থ আছে।
প্রজাপতির লার্ভার পাহারাদার এক ধরণের পিঁপড়ে? কিন্তু পিঁপড়ের তো নিজেরই খেয়ে নেবার কথা ওদের – বলে উল্কি – একসঙ্গে এক দল পিঁপড়ে আক্রমণ করলে ছোট্ট লার্ভা কি বাঁচতে পারে?
আক্রমণ করলে হয়তো পারবে না, কিন্তু আক্রমণ এই পিঁপড়ে কোনদিনও করবে না। কারণ, এই ডিম আর লার্ভাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে পিঁপড়েরই লাভ। সেলাস্ট্রাইনা আর্জিওলাস শুঁয়োর শরীরে একরকমের গ্ল্যাণ্ড থাকে – হানি গ্ল্যাণ্ড – তার থেকে ক্ষরণ হয় যে মধুর, তা পিঁপড়ের বড়ই প্রিয়। এটা কল্পনা করতে তাই কোনই অসুবিধে নেই যে এই প্রজাপতির ডিম বা লার্ভার পক্ষে ভয়ের যা কিছু, তাকেই আক্রমণ করবে ওদের পাহারাদার পিঁপড়ে। হয়তো ডরসেটের ঘাসের ঝোপে এই ডিম বা লার্ভা আবিষ্কার করেছিলেন যিনি তিনি এই পিঁপড়ের কামড়েই প্রথম জানতে পেরেছিলেন ওই ঘাসের ঝোপে হোলি ব্লু প্রজাপতির নব অভ্যুত্থানের কথা।
যা-ই হোক, বলতে থাকেন চিত্রগুপ্ত্ বর্মা, ডরসেট এবং উইল্টশায়ারের কথা যেহেতু জানাই ছিল আমার, ম্যাগনিফাইং গ্লাস নিয়ে ছোট ছোট ঘাসের ঝোপে হোলি ব্লু-র লার্ভা বা ডিম খুঁজে বেড়াতে থাকলাম আমি। পেলাম না। যখন নিজের চোখের উপরেই সন্দেহ শুরু হল আমার – যে প্রজাপতিটা দেখেছিলাম সেটা কি সত্যিই হোলি ব্লু? – ঠিক সেই সময়েই এক সন্ধ্যেবেলা এক দঙ্গল পিঁপড়ে দেখলাম ক্লে-লীকের কাছাকাছি একটা ঘাসের ঝোপে, অনতিদূরে খুব ছোট একটা গর্ত। কী খেয়াল হলো, গর্তটা একটু খুঁড়লাম। ঠিক যা ভেবেছি তা-ই। এটা পিঁপড়েদের কলোনী। এন্টোমোলজির ছাত্ররা পিঁপড়ের কলোনী পেলে তন্ময় হয়ে দেখে, আমি কিন্তু যা দেখলাম তা আমার পক্ষে চূড়ান্ত উত্তেজনার। ঘাসের মতো কয়েকটা পাতার ওপর ছোট ছোট সবুজ রঙের লার্ভা। পাতাগুলো কোনটাই গোটা নেই আর, লার্ভারা ক্রমাগতই খেয়ে চলেছে তাদের।
জানি তো, উত্তেজিত মুড়কি চেঁচিয়ে ওঠে, পড়েছি তো আমাদের প্রাণীবিজ্ঞানের বইয়ে, ডিম ফুটে লার্ভা যেই বেরোয়, সঙ্গে সঙ্গেই সে খেতে শুরু করে যে পাতায় তার জন্ম সেই পাতাটাকেই। তাতেই জোর পায় সে, আর লার্ভা থেকে পিউপা পর্যন্ত পৌঁছোতে পারে সেই পুষ্টির জোরেই।
ঠিকই বলেছ তুমি, বলেন চিত্রগুপ্ত্, কয়েকটা পিউপাকেও দেখলাম।
তারপর? – মুড়কির প্রশ্ন আবার।
ভেবেছিলাম রোজ একবার করে এসে পিউপার প্রজাপতিতে রূপান্তর দেখে যাব। চিহ্ণ-টিহ্ণ দিয়ে জায়গাটাকে চিনে রাখলাম, যাতে পরে এসে খুঁজে পেতে অসুবিধে না হয়। অনেক আশা নিয়ে পরের দিন এসে যা দেখলাম তাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোন পিঁপড়ের চিহ্ণমাত্রও নেই, কলোনী-টলোনী আর লার্ভা-পিউপা সমেত সবই উধাও! পরে অবিশ্যি মাথা ঠাণ্ডা হলে বুঝলাম, এমনটাই হওয়ার কথা, একই জায়গায় ভাঙা কলোনী নতুন করে আবার পত্তন করবে না পিঁপড়েরা। কে জানে, পালাবার সময় ওই লার্ভা আর পিউপাগুলোকে খেয়েই ফেলেছে, না অন্য কিছু করেছে!
শেষ পর্যন্ত কী করলেন তাহলে? – এবার প্রশ্ন করে উল্কি।
এবার আর কোন চান্স নিইনি আমি। একবার যখন ডিমের সন্ধান পেয়েছি, আবার যে পাব সে বিষয়ে সন্দেহ ছিলো না। এই পেরু-অ্যামাজন বাটারফ্লাই ফার্মের কর্তাদের জানিয়ে রাখলাম যে নতুন এক প্রজাপতির ডিমের সন্ধান পেয়েছি আমি। সেই ডিম সংগ্রহ করে এই ফার্মেই সেগুলোকে ফুটিয়ে প্রজাপতিতে রূপান্তর করাতে চাই। ফার্মের তো প্রবল উৎসাহ। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো, এবার যখন ডিম আবিষ্কার করলাম, ডিম-পাড়া সেই পাতাগুলোকে যত্ন করে একটা বিশেষ ঘেরা জায়গায় রেখে দেওয়া হলো এই ফার্মেই। প্রজাপতি হয়ে মুক্তিও তারা পেল এই ফার্মেই। পেরু-অ্যামাজন ইনটারন্যাশনাল বাটারফ্লাই ফার্মের প্রথম নিজস্ব প্রজাপতি! হোলি ব্লু!
এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে যান চিত্রগুপ্ত্, কিন্তু আমি না হয় নিজের ইন্টারেস্টে অফ্-সিজনেও পড়ে আছি এখানে, আপনারা এই অসময়ে কেন?
ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারের মহিলাকে যা বলেছিলো, প্রায় সেটাই হুবহু বললো ফল্গু শুধুমাত্র ব্রাজিলে আত্মীয় থাকার কথাটা বাদ দিয়ে – পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রোজেক্টে ভলান্টিয়ারিং করার বাসনা, শুনেছি অফ-সিজনে সুযোগ পাবার সম্ভাবনা বেশি, তাছাড়া মাচুপিকচুতেও যাবার ইচ্ছে আছে।