প্রায় রাত দশটা বেজে গেল রিও ব্র্যাঙ্কোতে পৌঁছতে, কাজেই আসিস ব্রাসিলি যাওয়ার কোন প্রশ্নই নেই। দুদিন আগে যে হোটেলটায় রাত কাটিয়েছে ওরা, সোজা চলে গেল সেখানে। হোটেলের মালিক দেখেই চিনেছে ওদের, একটু আশাহত হয়েছে মনে হল এসপিণ্ডোলোকে দেখতে না পেয়ে। বলল, আগের ঘরটাই খালি আছে, সেখানেই ব্যবস্থা করে দিচ্ছি তোমাদের জন্যে। গরম জল দিতে পারব, পাঠিয়ে দিচ্ছি, তোমরা নাওয়া-ধোয়া যা করবে, করে নাও। আর ফ্রিজে ঠাণ্ডা জল আছে, সেটাও দিতে পারব। ব্যস, আর কিছু নয়।
ভোরবেলা আসিস ব্রাসিলি যাবার একটা গাড়ি যোগাড় হল ঐ হোটেলের মালিকেরই চেষ্টায়। গিয়ে জানা গেল সকাল দশটার আগে আসার কোন মানেই হয়নি। আসলে, আসিস ব্রাসিলি পর্যন্ত ব্রাজিল, আক্রে নদীর ওপারে গেলেই পেরু; কাজেই এ পারে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প লাগিয়ে, তবেই ওপার যাওয়া যাবে, আর সেই পাসপোর্ট অফিস দশটার আগে খোলার কোন সম্ভাবনাই নেই।
কী আর করা, অগত্যা ফেরী ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে গল্প করে সময় কাটানো ছাড়া কিছুই আর করার নেই। নদীটা এমন কিছু চওড়া নয় এখানে, খুব স্পষ্ট না হলেও ওপারটা দেখা যায়। আসিস ব্রাসিলি ছোট জায়গা হলে কী হবে, নদীপথে যাওয়ার যাত্রীর অভাব নেই। অনবরতই ছোট ছোট দোতলা লঞ্চগুলো যাচ্ছে আর আসছে, অনেক যাত্রীই বারান্দার মতো ছোট জায়গাটায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খেতে খেতে চলেছে, ভেতরে গিয়ে বসার চেষ্টাও করছে না। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই সময় চলে যায়। এমন সময় হঠাৎ, ওই লোকটা কে, চেনা চেনা লাগছে না! আর লোকটাও যেন ফল্গুর দিকে তাকাল একবার! আস্তে আস্তে উল্কি আর মুড়কিকে ডেকে দেখাতে দেখাতে একেবারে অ্যাবাউট টার্ণ করে লোকটা চলে গেল উল্টো দিকের বারান্দাটায়, তার মানে ও-ও নিশ্চয়ই দেখেছে ফল্গুকে, আর সেটা বুঝতে না দেবার মতলব! মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি রইলই, যদিও ভবিষ্যতের প্ল্যান নিয়ে আলোচনা শুরু করল ওরা।
পাসপোর্ট স্ট্যাম্পিংটা শুধু এ পারে, তার মানে ভিসা দেখবে ওপারের লোকরা, ইমিগ্রেশনের চেকিং-টেকিং যদি থাকে, ওরাই করবে। এত কিছু করে মনে হয়না বেলা বারোটা-একটার আগে ম্যালডোনাডোর দিকে রওনা দিতে পারব আমরা, বুঝলি মুড়কি!
তোর গুগ্ল্ এত কিছু বলেনি, অনেকটাই চেপে গেছে বোঝা যাচ্ছে! এ মন্তব্যটা উল্কির, মুড়কির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে।
দেখ ফল্গুদি, দেরী হচ্ছে বলে আমার গুগ্ল্, যতক্ষণ সব ঠিকঠাক আছে মনে হয়েছিল, ততক্ষণ গুগ্ল্টা আমাদের ছিল, মুড়কির প্রতিবাদ।
হেসে ফেলল ফল্গু, তোরা দুজন কি সব সময়েই এরকম ঝগড়া করিস? শোন্, যেতে যদি দেরিই হয় আমাদের, ওই যে তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লার্স ইন নামের হোটেলটায় আমাদের থাকার কথা, সে হোটেলটা খুঁজে পাব কিনা সেটাই ভাবছি। দেখলি তো রিও ব্র্যাঙ্কো শহরটা – স্টেট ক্যাপিটাল আক্রের – রাত দশটায় কোন খাবার পাওয়া যায় না। প্রফেসর পেরীরা যদি খাবার না দিয়ে দিতেন না খেয়েই কাটাতে হত কালকের রাতটা। ম্যালডোনাডোও তো মাদ্র দ্য দিয়সের ক্যাপিটাল, পৌঁছিয়ে হয়তো দেখব রাস্তায় জনপ্রাণী নেই, বিপদ হবে তখন; স্প্যানিশ পর্তুগীজ কিছুই জানিনা, পৌঁছোব কী করে হোটেলে! হ্যাঁ রে উল্কি, ঐ হোটেলটার ফোন নাম্বার দিয়েছিলাম না তোকে?
হ্যাঁ, দিয়েছিলে তো।
ভালোই হয়েছে কাল ফোনগুলো নিয়ে। ওরা বলেছিল ওরা ইংরিজি বোঝে, ইনাপারি গিয়ে ম্যালডোনাডোর গাড়িতে ওঠার ঠিক আগে ওদের ফোন করে জানিয়ে দিস আমরা এখন বাসে উঠছি, যদি পৌঁছিয়ে অসুবিধে হয় ওদের আর একবার ফোন করে দেব, ওরা যেন নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করে।
দূরত্ব তো কিছুই নয়, তবুও ইমিগ্রেশন থেকে বেরোতে বেরোতে বিকেল প্রায় যায়-যায়। এত যাত্রী, অথচ দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার মাত্র একজন। সেই অফিসারটিকে বাদ দিয়ে প্রায় সবাই-ই পোর্টার জাতীয়। অফিসারটি আবার নিজের পদের গুরুত্ব সম্বন্ধে বড়ই সচেতন। ধীরে-সুস্থে কথা বলেন, স্যুটকেসের ভেতরের পোশাক-টোশাক কোনকিছুই একটু অপরিচিত দেখলেই নানা প্রশ্নে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন!
ইমিগ্রেশন থেকে বেরিয়ে টিকিট-ফিকিট কিনে ম্যালডোনাডোর মিনি বাসে ওঠার সময় সেই লোকটাকে আর একবার দেখতে পেল ফল্গু, অতি দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে। এবার সঙ্গে আর একজন, সে লোকটার শুধু পেছনটাই দেখা গেল, প্যান্ট আর বুশ-শার্ট পরা, মাথায় টাক। হ্যাঁ টাকই, ন্যাড়া মাথা নয়, কারণ পড়ন্ত রোদ্দুর মাথায় পড়ে রীতিমতো রিফ্লেক্ট করছে। বাসের পা-দানিতে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখলো লোকটাকে, নেমে পড়ে ভালো করে যে দেখে নেবে তার উপায় নেই, পেছনের লোকটার প্রেশারে সোজা বাসের ভেতর! লোকগুলোর অভ্যেস ঠিক কলকাতার লোকদেরই মতো!
ম্যালডোনাডোর বাস টার্মিনাসে নেমে হোটেলে যেতে কোনই অসুবিধে হল না, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা মোটর সাইকেল রিকশা। কলকাতায় যে অটো-রিকশাগুলো চলে ঠিক সেরকম নয়, এরকম রিকশায় ফল্গু অনেক ছোটবেলায় একবার চড়েছিল দিল্লীতে, বাবা-মার সঙ্গে; আজকাল অবিশ্যি দিল্লীতেও এগুলো দেখা যায় না, দিল্লীতেও এখন কলকাতার মতোই অটো-রিকশা। রিকশার চালক ওদের দেখেই জিজ্ঞেস করল ইংরিজিতে, তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্লারস ইন তো?
কেমন করে বুঝলেন? – মুড়কির প্রশ্ন।
এরকম চেহারার ট্যুরিস্টরা বাসেই আসে, আর এসে এই হোটেলের কথাই বলে।
বুঝলে ফল্গুদি, তুমি যা ভেবেছিলে তাই, এই সাজ-পোশাক আর পিঠের ব্যাগের মহিমাই আলাদা, বাংলায় মন্তব্য উল্কির।
একেবারে রিও ব্র্যাঙ্কোর মতো না হলেও রাস্তা মোটামুটি নির্জন, মিনিট পনেরোর মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেল ওরা। সবুজ কাঠের বেড়া দেওয়া হোটেলটা দেখেই ওরা মুগ্ধ। কাঠের একতলা বাড়ি, সামনে খুব কেয়ারি করা না হলেও একটা বাগান। বাগানের একদিকে সাইকেল-স্ট্যাণ্ডটা বাইরে থেকেই দেখা যাচ্ছে, যতগুলো সাইকেল দাঁড়িয়ে, সেটা দেখলেই হোটেলের আবাসিকদের সম্বন্ধে ধারণা হয়ে যায়।
রিসেপশনের ভদ্রলোক বললেন তোমাদের একটা ফোর-বেডেড ডর্মিটরী দিয়ে দিচ্ছি। সিঙ্গল মেয়ে যদি এসে পড়ে কেউ, তাকে ঢুকিয়ে দেব, নাহলে তোমরা তিনজনেই থাকবে। বাথরূমে গরম জল পাবে, তোমরা ফ্রেশ হতে হতে আমি তোমাদের জন্যে কিছু খাবারের ব্যবস্থা করছি, ঘরে বসেই খেতে হবে। আমাদের হোটেলে রেস্টোর্যান্ট নেই। মাছ খাও তো তোমরা?
ফোর-বেডেড ডর্মিটরী শুনে যে বড়সড়ো ঘরটার কথা কল্পনা করেছিলো ওরা, ঢুকে দেখলো ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়। টু-টিয়ার বেড দুটো, ওপর-নীচ করে শোয়ার ব্যবস্থা, অনেক ইয়ুথ-হোস্টেলে যেরকম হয়। ঘরটা ঝকঝকে পরিষ্কার, মৃদু একটা সুন্দর গন্ধ। কোণের দিকে একটা টেবিল, চারটে চেয়ার তার সঙ্গে। একদিকের দেয়ালে বিভিন্ন উচ্চতায় অজস্র হুক লাগানো, তার কোন কোনটার থেকে হ্যাঙ্গার ঝুলছে। বোঝা গেল জামা-কাপড় রাখার ব্যবস্থা এটাই। একটা দেয়াল আলমারি গোছের আছে, লাগেজগুলো ডাম্প করতে হবে সেখানেই। যেটা দেখে মুড়কি একেবারে মোহিত সেটা হচ্ছে প্রতিটি বেডের মাথার দিকে লাগানো একটা করে চতুষ্কোণ কাঠের পাটাতন, যেগুলো বেড-সাইড টেবিলের কাজ করবে, নীচেরটা যদি ডান দিকের মাথার পাশে হয় তো ওপরেরটা বাঁ দিকে। আর তার প্রত্যেকটাতেই একটা করে চকচকে ম্যাগাজিন-গোছের; কভারে যে ছবিটা সেটা পেরুর জাতীয় পাখি, অ্যাণ্ডিয়ান কক-অব-দ্য-রকের। তুলে নিয়ে বোঝা গেল এগুলো পেরুর ট্যুরিস্ট গাইড। প্রথমেই নিজের পিঠ থেকে ব্যাগটা খুলে ওপরের একটা বেডে রেখে মুড়কি বলল, এই বেডটা আমার।
ঘন্টাখানেক পরে ঐ রিসেপশনের ভদ্রলোক নিজেই একটা বড়সড়ো ট্রে নিয়ে ওদের ঘরে ঢুকলেন। একেবারে পাক্কা ওয়েটারের মতো টেবিলে প্লেট, যাবতীয় চামচ, ন্যাপকিন-ট্যাপকিন ইত্যাদি সাজিয়ে খাবারটা রাখলেন পাশে। ফ্রায়েড রাইসের মতো দেখতে ভাতের একটা বড় বোল আর অনেকগুলো মাছ। ভদ্রলোক বললেন তোমরা খেতে শুরু কর, তোমাদের খুবই খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই। বলেই, একটা চেয়ার একটু দূরে টেনে নিয়ে নিজে বসলেন তাতে। এক টুকরো মাছ কেটে উল্কি মুখে পুড়ে খেতে শুরু করতেই জিজ্ঞেস করলেন, কেমন লাগছে?
দারুণ, উল্কি বলে, কী মাছ এটা?
এই রে, বিপদে ফেললে, কী মাছ, সেটা তো জানিনা; অ্যামাজনের মাছ নয়, সমুদ্রের। আমি রান্নার ব্যাপারে অতশত খবর রাখিনা। জানতে চাও তো জিজ্ঞেস-টিজ্ঞেস করে কাল বলে দেব। এই ডিশটা দেখেছি আমার এখানে যে ট্যুরিস্টরা আসে তাদের খুব পছন্দ, সবাই এসে এটারই খোঁজ করে। তাই আমি এটাই নিয়ে এলাম তোমাদের জন্যে, ডিশটার নাম সেবিচে, লাইম জ্যুসে ম্যারিনেট করে তৈরি করে।
ভদ্রলোক বললেন, গেস্টরা চেক-ইন করার সময়েই কতকগুলো ইনফর্মেশনের আদান-প্রদান করি, তোমাদের দেখে মনে হল খুবই টায়ার্ড হয়ে এসেছ তোমরা, তাই তাড়াতাড়ি তোমাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে গিয়ে সব কথা হয়নি তখন। তোমরা খাও, আমি কথা বলি। এক নম্বর, এখানকার ট্যারিফ; বারো ডলার পার পার্সন পার টোয়েন্টি ফোর আওয়ার্স, কিন্তু অ্যামেরিকান ডলারেই দিতে হবে সেটা। সকালে ব্রেকফাস্ট কমপ্লিমেন্টারী, আমাদের বাগানে স্প্রেডটা লাগানো হবে সকাল আটটা থেকে। খুব খারাপ ব্রেকফাস্ট দিই না আমরা, প্রায় সব রকম টেস্টের লোকের জন্যেই কিছু-না-কিছু থাকে। আমি অ্যাডভাইস করব, যতটা পার খেয়ে নেবে, ব্রাঞ্চের মতো। ঠিক ঠিক খেলে স্বচ্ছন্দে লাঞ্চটা স্কিপ করতে পার। কতদিন থাকার প্ল্যান তোমাদের?
ফল্গু বলল, এখনই সেটা বলতে পারছি না; আমরা এসেছি প্রধানত দুটো ইন্টারেস্টে। পেরু অ্যামাজন রেনফরেস্ট প্রজেক্টে থেকে জঙ্গলের অভিজ্ঞতা পেতে চাই একটু; সেটা একটা, আর একটা হলো মাচুপিকচু নিয়ে একটু রিসার্চ করব। এগুলো করতে কতদিন সময় লাগবে, সেটা তো এখনই বলা যাবে না। তার জন্যে কতদিন এখানে থাকব, কতদিন কাস্কোতে, মাচুপিকচুতে কতদিন, আর কতদিনই বা জঙ্গলে কে জানে! আর তাছাড়া যেটুকু খোঁজ নিয়ে আমরা এসেছি, তাতে তো মনে হচ্ছে যেখানেই যাই ম্যালডোনাডোতে ফিরে আসতে হবে বারবার, তাই না?
হ্যাঁ, সেটা ঠিকই, আর তা ছাড়া রেনফরেস্ট প্রজেক্টে যদি কাজ করতে চাও, বিশেষ করে ভলান্টিয়ারিং প্রজেক্টে, তাহলে তো ম্যালডোনাডোই হেডকোয়ার্টার: ট্রেনিং হবে এখানে; জঙ্গলের বাইরের জগতের সঙ্গে যখনই যোগাযোগ করতে হবে, সবই ভায়া ম্যালডোনাডো। তবে তার জন্যে তো আর এক টানা থাকার দরকার নেই, প্রয়োজন মতো থাকলেই হলো। ঠিক আছে, তোমরা খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়, খাওয়া হয়ে গেলে প্লেট-টেটগুলো দরজার বাইরে রেখে দিও, গুড নাইট।
গুড নাইট বলে চেয়ার থেকে উঠে পড়েও আবার ফিরে এলেন ভদ্রলোক, ও হ্যাঁ, আমাদের এখানে লণ্ড্রী সার্ভিস আছে, তবে আমি সাজেস্ট করবো একটা ব্লক এগোলেই লণ্ড্রোম্যাট পেয়ে যাবে একটা, সেলফ সার্ভিস, অনেক সস্তায় কাজ হয়ে যাবে।