এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • অন্য দেশের পাখি - ২৫,২৬

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৪০৪ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • ছবি: রমিত
    ২৫


    তাকিলেতে রওনা হবার আগের সন্ধ্যেতে কামিলার সঙ্গে ব্যবস্থা অনুযায়ী ট্যুরিস্ট ইনফর্মেশন সেন্টারে যখন পৌঁছল ওরা তখন শ্যাভেজ অপেক্ষা করছিলেন মাঝি আর তার সঙ্গীকে নিয়ে। পুনু থেকে টেলিফোনে শ্যাভেজের সঙ্গে কথা বলবার সময় ফল্গু ওঁকে অনুরোধ করেছিল, যে নৌকোয় প্রথম রাতে ওরা গিয়েছিল প্রজেক্টে, যেখান থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল মুড়কি, সেই নৌকোর মাঝিদেরও যেন উনি সঙ্গে করে আনেন। অনেকটা জার্ণি হয়েছে, সবায়ের জন্যেই একটু ধোয়াধুয়ি এবং খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন কামিলা। পনের মিনিটের মধ্যে তৈরি হয়ে নিয়ে ফল্গু বলল, একটু নিরালায় একটা ফোন করতে চাই।

    ফল্গু ওপরে যায়, মোবাইল থেকে ফোন করে এসপিণ্ডোলোকে।

    তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম ফল্গু, এসপিণ্ডোলো বলেন, ফিনিগানের সঙ্গে কিছুক্ষণ আগেই কথা হয়েছে আমার, মুড়কিকে নিয়ে সাকসেসফুলি ফিরে এসেছ খবর পেয়েছি, কনগ্র্যাচুলেশন।

    থ্যাঙ্ক য়্যু স্যর, বলে ফল্গু, কিন্তু আমি অন্য একটা কথা বলবার জন্যে আপনাকে ফোন করছি। আর একটা ভারতথেরিয়াম দেখলাম।

    ডোন্ট বি সিলি, এসপিণ্ডোলোর গলায় একরাশ বিরক্তি, আমার এখন বাজে রসিকতা শোনার সময় নেই।

    আপনার সঙ্গে রসিকতা করার ধৃষ্টতা আমার নেই স্যর, কিন্তু আমি দেখেছি। আপনি তো জানেন বিশাখাপত্তনমের পোর্টে সিঙ্গাপুর অভিমুখী জাহাজকে দাঁড় করিয়ে আমি এবং আমার বন্ধুরা ভারতথেরিয়ামকে নামিয়ে এনেছিলাম। আমি নিজের হাতে একা একা নামাইনি, কিন্তু সঙ্গে ছিলাম। ভারতথেরিয়ামকে আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি, ছুঁয়েছি। আমি চিনতে ভুল করব না স্যর। এখন একটা খুব জরুরি কাজ করছিলাম, সেটা ফেলে রেখে আপনার সঙ্গে কথা বলছি, কারণ ওটাকে এখনই না বাঁচাতে পারলে হয়তো দেরি হয়ে যাবে।

    ঠিক আছে, বল, কী দেখেছ, কোথায় দেখেছ, ডিটেলে বল।

    পুঙ্খানুপুঙ্খ সমস্ত বলার পর বলে ফল্গু, কোন সন্দেহ নেই যেটাকে দেখেছি সেটা আর একটা ভারতথেরিয়াম, কিন্তু খুব অসুস্থ। দেরি হয়ে গেছে স্যর, একা আপনিই ওকে বাঁচাতে পারেন, তাড়াতাড়ি করুন। আমার এদিকের কাজ আমি সামলে নেব, আপনাকে আর ডিস্টার্ব করব না। কিন্তু যে কোন মুহূর্তে ওটাকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারে ওরা।

    তোমার সব কথা আমি নোট করে নিয়েছি ফল্গু, আমার যা সাধ্য করব আমি। তোমার টাকাপয়সার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। ফিনিগান সব জানে। ওর সঙ্গে যোগাযোগ রেখো। লাইন কেটে দেন এসপিণ্ডোলো।

    নীচে নেমে ফল্গু দেখে, সবাই ওর জন্যে অপেক্ষা করছে। শ্যাভেজের পাশে বসে আছে মুড়কি, আর শ্যাভেজ হাসিহাসি মুখে মুড়কির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ফল্গুকে দেখেই হেসে বললেন, কনগ্র্যালুচেশনস, ফল্গু।

    একটা কথা জিজ্ঞেস করার জন্যে তোমাদের ডাকিয়ে এনেছি, মাঝিদের দিকে তাকিয়ে ফল্গু বলে, পাখি দেখার দিন আমরা যখন জঙ্গলে চলে গেলাম আর তোমরা অপেক্ষা করতে থাকলে আমাদের জন্যে, তখন হঠাৎ একটা নৌকোতে অচেনা চারজন লোক এসে তোমাদের নৌকোয় লাফিয়ে পড়ে, ঠিক তো?

    ঠিক, হেফা।

    লোকগুলোকে দেখতে কেমন ছিল?

    আমাদেরই মতো, সাধারণ জনজাতির চেহারা।

    সাধারণ যতই হোক, মানুষে মানুষে তফাৎ তো থাকবেই, একটু ভেবে বল।

    একেই অন্ধকার, তারপর ওরা এসেই রিভলভার বের করে ফেলল, তারপর আমাদের তিন বন্ধুকে...

    সবাই চুপচাপ। কথা বলে না ফল্গুও। এমন সময় একটু নড়ে চড়ে বসে মাঝির সঙ্গী। বলে, যে লোকটাকে ওরা নৌকো থেকে নামিয়ে দিয়েছিল, আমার এখন মনে পড়ছে ওর মাথায় চুল ছিল না, মাথা জোড়া টাক।

    হ্যাঁ, মাথা জোড়া টাক। ঠিক, বলে মাঝি।

    তোমরা বলছিলে লোকটা একটুও আপত্তি না করে রিভলভারটা নামিয়ে দিয়ে নিজেও নেমে গেল নৌকো থেকে। কী করল সে তারপর?

    আপনাকে তো বলেছি হেফা, আমরা খেয়াল করিনি। আমাদের তিন বন্ধু যে আর ফিরে এল না সেটাই আমরা...

    ঠিক আছে, সেটাই তোমরা ভাবছিলে। কিন্তু, যে নৌকোটায় ওরা এসেছিল সেটা তো ছিল ওখানেই। খালি পড়েছিল। তাহলে সেই নৌকোটাতেও তো ও ফিরে আসতে পারে। তাই ভেবেই হয়তো চুপচাপ ছিল ও, ঝগড়াঝাটি করেনি।

    হ্যাঁ, হতে পারে। ঠিকই। হতে পারে। এই কথাটা আমার মাথায় আসেনি আগে, বলে মাঝি।

    ধর, তা-ই হয়েছিল। তোমরা রওনা দেবার পর ওই নৌকোটা নিয়েই লোকটা রওনা দেয় এপারে আসার জন্যে। সে ক্ষেত্রে, তোমরা কি মনে কর ওর পক্ষে তোমাদের চেয়ে আগে এপারে পৌঁছনো সম্ভব?

    তা হবে না কেন? – মাঝি বলে, এই নদীনালার দেশের জনজাতিরা কতদিন আগে থেকে নৌকো চালিয়ে আসছে কেউ জানে না। এরা সবাই ভালো নৌকো চালায়, ভালো সাঁতার কাটে। ওর যদি জরুরি দরকার থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই ও আমাদের চেয়ে আগে পৌঁছোবে। হয়তো সে জন্যেই ঝগড়াঝাটি না করে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ল ও আমাদের নৌকো থেকে।

    ঠিক আছে, আর একটা কথার উত্তর দাও, ফল্গু বলে। জলের তলা দিয়ে একরকমের নৌকো যায়, তোমরা জান?

    জানি তো, বলে মাঝি, সাব। বেআইনী নেশার জিনিস নিয়ে যায় ওরা।

    দেখেছ কখনো?

    হ্যাঁ, দেখব না কেন? সবাই দেখেছে। কতো সময়ই তো জলের নীচে নোঙর করা থাকে।

    জলের নীচে থাকে, তোমাদের নৌকোর সঙ্গে ধাক্কা লাগেনা কখনও?

    কী করে লাগবে? ওদের লোকরা ছোট ছোট নৌকোয় আশেপাশে থাকে। কাছাকাছি দিয়ে কোন নৌকো গেলেই সাবধান করে দেয়।

    কিন্তু সেই দিন, ধর, ইচ্ছে করেই তোমাদের সাবধান করেনি। অত রাত্তিরে নিশ্চয়ই নদীতে ভীড় ছিল না তেমন। ওপার থেকে এপারে আসতে তোমাদের যে গতিপথ, ওই নদীতে নৌকো চালায় যারা তাদের তো সে পথ ভালোভাবেই চেনা। সেই গতিপথ থেকে একটু সরে জলের নীচে দাঁড়ালে তোমাদের সাবধান করতে হবে কেন? আর, যেখানে নার্কোসাবটা দাঁড়িয়ে আছে, সেটা পেরিয়ে তোমরা একটু এগোলেই তো পেছন থেকে তোমাদের জোরে ধাক্কা দেওয়া সম্ভব, তাই না?

    একটু ভাবে মাঝি। তারপর বলে, ধাক্কা যে কেউ দিয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই, তা না হলে ওভাবে আমরা বেসামাল হয়ে পড়তাম না। আর আমরা তো কোন বড় নৌকো আমাদের পেছনে দেখিনি। আপনি যা বলছেন, সেটা কিন্তু হতেও পারে হেফা।

    এবার ওই টাকমাথা লোকটার কথায় আসি, বলে ফল্গু। লোকটা যদি তোমাদের চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি নৌকো চালিয়ে থাকে, আর ওর যদি জানা থাকে ঠিক কোন জায়গাটায় সাবটা দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে তোমরা পৌঁছোবার আগেই ও নিজের নৌকো ছেড়ে সাবটায় ঢুকে পড়তে পারে, তাই না?

    তা তো পারেই, বলে মাঝি।

    ঠিক আছে, তোমরা এখন যেতে পার।


    ২৬


    অনেক রাতে যখন পৌঁছল ওরা, ট্র্যাভ্‌লার্স-ইন এর ম্যানেজার, বোঝা গেল, খুবই খুশি। আগের ঘরটাই উনি পরিষ্কার করিয়ে রেখেছিলেন ওদের জন্যে। অত রাতেও শুয়ে শুয়ে অনেক গল্প হল, মুড়কি এমনকি এক সময় কেঁদে ফেলে স্বীকারও করল, ওর এক-একবার ভয় করছিল আর যদি কখনও ফিরতে না পারে! সেরিপের ব্যবহারটাও ও আর লুকিয়ে রাখতে পারল না।

    ভোরের দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় উল্কির। দেখে, একটা কাগজে হিজিবিজি দাগের পর দাগ কেটেই চলেছে ফল্গুদি। উল্কি জানে, এর মানে হচ্ছে, গভীর কোন চিন্তায় সে মগ্ন। উল্কি বাথরূমে যায়, ফিরে আসে, তারপর যায় ফল্গুর কাছে, ঘুম আসছে না ফল্গুদি?

    বোস, ফল্গু বলে।

    বসে উল্কি। ফল্গু বলে, তিনটে ঘটনা তোকে বলি। এক, মুড়কি চুরি হল; দুই, লণ্ড্রোম্যাটে দ্বিতীয় বারের জন্যে আমরা গেলাম; তিন, তাকিলে থেকে আমরা ফিরে এলাম মুড়কিকে উদ্ধার করে। এগুলোর মধ্যে কোন কমন থ্রেড দেখতে পাচ্ছিস?

    কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে উল্কি, তারপর বলে, না, কমন কিছু বুঝতে পারলাম না।

    ফল্গু বলে, কোকেইন। মুড়কি চুরি হবার পর আমরা যখন দ্বিতীয় বারের জন্যে প্রজেক্টে গেলাম, তখন যে তিনজন নৌকোর লোককে আগের দিন জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিল দুষ্কৃতিরা, তাদের ফিরে পাওয়া গেল। তিনজনকেই পাওয়া গেছে চামড়ার মুখোশ-পরা অবস্থায়। পরে মুখোশগুলোকে পরীক্ষা করে পাওয়া গেল 'ট্রেসেস অব কোকেইন', তাই না? দ্বিতীয় বার লণ্ড্রোম্যাটে গিয়ে আমরা আট-দশদিন আগে যে ঘুমন্ত কাকাতুয়াটাকে দেখেছিলুম সেটাকেই দেখলুম আরেকবার। তখনও ঘুমোচ্ছে সেটা। কিন্তু সত্যি সত্যিই কি একটানা আট-দশদিন একটা কাকাতুয়ার পক্ষে ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব? কাকাতুয়াটা কিন্তু মরেওনি, মরলে পচে গন্ধ বেরতো ততদিনে। তাহলে একটাই সিদ্ধান্তে আসা যায়, ঘুমোচ্ছিল না, নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছিল কাকাতুয়াটাকে: কোকেইন! এরপর দেখ, আমরা গেলুম তাকিলে দ্বীপে, মুড়কির সন্ধানে। গিয়ে প্রথমেই কী শুনলুম আমরা? মুড়কিকে যখন প্রথম নিয়ে যাওয়া হয় ওই দ্বীপে, ও তখন অজ্ঞান, ওর মুখ চাপা চামড়ার একটা মুখোশে। সেই একই মুখোশ! যাতে আগেই পাওয়া গেছে 'ট্রেসেস অব কোকেইন'!

    আরও শুনতে চাস? আচ্ছা, ঠিক আছে। বল্‌, মুড়কি ওই দ্বীপে গিয়েছিল কীভাবে? যারা নিয়ে গিয়েছিল ওকে, কীসে নিয়ে গিয়েছিল? নার্কোসাব, তাই না? আবার কোকেন। আমরা যেদিন দ্বীপ থেকে ফিরলাম, কেচুয়াদের নেতা অ্যাপো আমরা ফেরার কিছুক্ষণ আগে আমাদের একটা টাওয়ারে ওঠাল। প্রত্যেককে। তুইও উঠেছিলি। কী দেখেছিলি?

    অতিকায় একটা গণ্ডার।

    ঠিক আছে, মেনে নিলাম অতিকায় একটা গণ্ডারই দেখেছিলাম আমরা। সেই গণ্ডারটার খাদ্য কী? কী খাওয়ানো হয় তাকে এখন? রাশি রাশি ডালপালা-পাতা সমেত বেআইনী কোকা। কোকা কী জানিস তো? যা ডিস্টিল করে তৈরি হয় কোকেইন। এই কিছুদিন আগেও কলাম্বিয়া আর ইকোয়েডারের বর্ডারে ঘন জঙ্গলে আবিষ্কার হয়েছে এক বেআইনী লেবরেটরী, যেখানে কোকা থেকে তৈরি হয় কোকেইন। আর সেই কোকা, বোঝা বোঝা কোকা, মাসে দু'বার নার্কোসাবমেরিনে পাঠানো হয় তিতিকাকায়। মানুষের-নিজের-হাতে-তৈরি-করা এক পাঁচিল-ঘেরা অতি ক্ষুদ্র দ্বীপে!

    তোর তো নিশ্চয়ই মনে আছে আমাদের কক-অব-দ্য-রকের লেকিং সাইট দেখতে যাওয়ার কথা। সাইট থেকে তিন-চার মাইল দূর থেকেই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম প্রবল কোলাহল, মুড়কির যেটাকে মনে হয়েছিল সমবেত কণ্ঠের অবিরাম আবৃত্তি: ওঠো রে-এ ওঠো রে-এ ওঠো রে-এ ওঠো রে-এ এই এই এই এই যাই..., ওঠো রে-এ ওঠো রে-এ ওঠো রে-এ ওঠো রে-এ এই এই এই এই যাই...! গিয়ে আমরা দেখলাম বিরাট ফলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে শাখার পর শাখা, পত্রহীন শাখায় বসে আছে অগুনতি পুরুষ কক-অব-দ্য-রক। যারা মাছ ধরে তারা জলাশয়ের ধারে ধারে স্ট্র্যাটেজিক জায়গায় ছড়িয়ে রাখে সুগন্ধি চার, যার গন্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ চলে আসে সেখানে, ভীড় করে। তারপর জাল ফেল, আর টেনে নাও ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। আমার মনে হয়েছিল লেকিং-সাইটে ঠিক মতো জাল ছুঁড়তে জানলেই এক-একবারে পাওয়া যাবে ঝাঁক ঝাঁক পাখি। এবার ভাব, সঙ্গে যদি থাকে ওই কোকেন মাখানো চামড়ার থলিগুলো – যেগুলোকে মুখোশ বলছি – তার এক-একটায় এক-একটা পাখি চালান করে দিতে পারলে ঝাঁক ঝাঁক পাখি নিঃশব্দে পাচার হয়ে যাবে, তাই না? এর পর শুধু দরকার নেশা-ছোটানো বিশেষজ্ঞ একজন, ব্যস!

    বুঝলি উল্কি, পাখি-চোর ধরব বলে যখন এখানে এলুম তখন ভাবিনি আমাদের আসল লড়াইটা কোন কোকেইনের কারবারির সঙ্গে। ছোটখাটো কোকেইন স্মাগলার নয়, কোকেইনসম্রাট! যার সাম্রাজ্যে হেক্টরের পর হেক্টর কোকার ফলন, বেআইনী কোকেইন লেবরেটরী, শয়ে শয়ে নার্কোসাবমেরিনের ফ্লীট, আর ম্যানহাটনে পৃথিবীর ধনীতম পাড়ায় বিশাল প্রাসাদে নানারকমের বিরল পাখি, কীটপতঙ্গ, পশু, গাছ!

    শুধু তা-ই নয়, আরেকটা ব্যাপার। আমরা যখন পেরুতে এলুম আমরা শুনেছিলুম চুরি হচ্ছে কক-অব-দ্য-রক। কোন কাকাতুয়ার গল্প কেউ আমাদের বলেনি তখন। যেদিন এসেছি তার পরের দিনই হোটেলের মালিক বা ম্যানেজার, যা-ই বলিস না কেন, তার কথায় আমরা গেলুম স্থানীয় লণ্ড্রোম্যাটে। গিয়ে দেখলুম দুটো ঘুমন্ত কাকাতুয়া আর পেরুর পাখিদের ছবিওয়ালা একটা বিরাট পোস্টার। পেরুর পাখির কথা ছাড়, লণ্ড্রোম্যাটের ম্যানেজার মহিলা আমাদের অস্ট্রেলিয়ার থেকে আমদানি করা কাকাতুয়া, বার্ড লাভার্স ইউনিয়ন, পাখিকে পোষ-মানানোর স্বাভাবিক মানবিক প্রবৃত্তি, এমনকি জেরাল্ড ডারেলকে উদ্ধৃত করে পাখি-পোষা এবং প্রাণী-সংরক্ষণের যোগাযোগের বিষয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথা বললেন। আমরা অভিভূত হয়েছিলাম, অস্বীকার করতে পারবি না। মনে হয়েছিল, এই শহরে যেখানেই যাব, দেখতে পাব দাঁড়ে অথবা খাঁচায় সাদা সাদা অস্ট্রেলিয়ান কাকাতুয়া!

    সেইদিনই ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সার্ভিসের অফিসে আমরা আবার কাকাতুয়া দেখলাম। আমার নাম শুনেই সে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো ফল্গু ফল্গু ফল্গু, আমরা আবার অভিভূত হলাম। কিন্তু সেই শেষ। তারপর আর কাকাতুয়া দেখিনি কোত্থাও। আমরা এখানে দুটো হোটেলে থেকেছি, একটাতেও কোন পোষা কাকাতুয়া দেখিনি। দুটো প্রাইভেট ট্যুরিস্ট অফিসে গেছি, দোকান-বাজারে ঘুরেছি, নানা রেস্টোর‍্যান্টে খেয়েছি, এমনকি পুনোতেও একটা হোটেল আর একটা ট্রান্সপোর্ট কম্পানির অফিসে গেছি, কাকাতুয়া খাঁচায় ঝোলানো নেই কোথাও। পুন্টু যেদিন খুন হলো সেদিন লণ্ড্রোম্যাটে আর একটা কথা-বলা নতুন কাকাতুয়া দেখলাম, এবং ভয়েই হোক বা বিরক্ত হয়েই হোক, ওই ম্যানেজার মহিলা আমাদের বললেন ওবেলিস্কোতে গেলে কাকাতুয়ার সাপ্লায়ারের খোঁজ পাব। সেদিন কথায় কথায় ট্যুরিস্ট ইনফরমেশন সার্ভিসের অফিসে কামিলাও পেরুর প্রেসিডেন্টের ফ্যামিলির সঙ্গে তাঁর ওবেলিস্কো ভ্রমণের কথা বলছিলেন। এক বছর আগে ওবেলিস্কোতে তিনি আর প্রেসিডেন্টের বন্ধু কথা-বলা কাকাতুয়া দেখেছিলেন একটা, আর তিনটে কথা-না-বলতে-পারা। ওবেলিস্কোর দায়িত্বপূর্ণ প্রদর্শক সেদিন জানিয়েছিলেন, বার্ড লাভার্স ইউনিয়নের একজন উপদেষ্টা নাকি কাকাতুয়াকে কথা-বলা শেখাবার দায়িত্ব নিয়েছেন। কামিলা একজন দায়িত্বশীল সরকারী কর্মচারী, তাঁর সামনেই প্রেসিডেন্টের বন্ধুর মতো একজন সম্মানিত অতিথিকে ওই প্রদর্শক জানিয়েছিলেন, এই অস্ট্রেলিয়ান পাখি এক বছর ধরে পেরুতে প্রচুর আসছে। অর্ডার না-থাকা সত্ত্বেও পরের দিন প্রদর্শক ভদ্রলোক কামিলার অফিসে একটা কথা-বলা কাকাতুয়া পাঠিয়ে দেন, দাম নিয়েছিলেন কিনা জানিনা। সেটাই ওঁর অফিসে আছে, এবং সেটাই আমাকে নাম-ধরে ডেকে চমকিত করে।

    তুই হয়তো ভাবছিস, আমি বিনা কারণে কাকাতুয়া নিয়ে এত মাথা ঘামাচ্ছি। বিনা কারণে নয়, যে পাখিকে প্রায় কোত্থাও দেখা যাচ্ছে না সে পাখি এক বছর ধরে প্রচুর আমদানি হচ্ছে। তাহলে পাখিগুলো যাচ্ছে কোথায়?

    উল্কি বলে, যেখানেই যাক, আমাদের তাতে কী? হয়তো আমদানি-রপ্তানীর কারসাজিতে বিদেশী মুদ্রার অসাধু ব্যবসার একটা কায়দা এটা, আমাদের দেশেও তো এমন কতো হয়!

    ফল্গু বলে, তা যদি হয় তাহলে হয়তো এই মাথা-ঘামানোটা আমার অমূলক, কিন্তু আমার তা মনে হচ্ছে না। আজ চল্‌ তৈরি হয়ে, ওবেলিস্কো থেকে একটু ঘুরে আসি, একটু কথা বলে আসি কাকাতুয়ার ব্যাপারে, মুড়কিকে তুলে দে।

    মুড়কির ঘুম-ভাঙানোটা সহজ হলো না। বেচারার দুচোখ জুড়ে আজ রাজ্যের ঘুম। ফলে, ব্রেকফাস্টে যেতে দেরি হলো ওদের। ম্যানেজার বললেন, সরি, আজ চানা কচৌরি নেই। কেন নেই সে ব্যাপারে একটা নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেবার চেষ্টা করছিলেন তিনি, সেসব না শুনে যা আছে তারই সদ্ব্যবহার করলো ওরা পেট পুরে।

    তৈরি হয়েই বেরিয়েছিল, মোটোট্যাক্সির স্ট্যাণ্ডে গিয়ে ধরে নেয় ওরা একটা মোটোট্যাক্সি, ওবেলিস্কো যাবার।

    মোটোট্যাক্সি থেকে নেমে ওবেলিস্কোর দিকে হাঁটতে শুরু করেই উল্কির নজরে পড়ল ব্যাপারটা। হাতে একটা চামড়ার ব্যাগ নিয়ে ওদের থেকে খানিকটা এগিয়ে বাটারফ্লাই পার্কের ছেলেটা হনহন করে হাঁটছে ওবেলিস্কোর দিকে। উল্কি দেখালো ওদের। ফল্গু বললো, একটু দাঁড়া, আমরা এখন ঢুকছি না। ছেলেটা কী করতে ওখানে যাচ্ছে জানিনা। কাছেই একটা ছোট্ট রেস্টোর‍্যান্ট। আয়, আমরা রেস্টোর‍্যান্টে বসে ওর বেরোনো পর্যন্ত অপেক্ষা করি।

    হট চকোলেট খেতে খেতে ফল্গু বলে, তোদের খেয়াল আছে, বাটারফ্লাই পার্কটায় আমরা যখন গিয়েছিলাম ছেলেটা তখন আচমকা একটা প্রশ্ন করেছিল চিত্রগুপ্ত্‌কে বাংলায়? কিন্তু ওটাই শেষ, তারপর আর কথাই বলেনি? খেয়াল আছে তোদের?

    খেয়াল ওদের আছে, কিন্তু সে কথা এখন উঠছে কেন?

    কেন, বুঝবি এখনই। আপাতত কী আমরা করতে যাচ্ছি শোন। ছেলেটা বেরিয়ে খানিকটা এগিয়ে গেলে উল্কি দৌড়িয়ে পেছন থেকে একটা ধাক্কা দেবে ওকে। তারপর ওর ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে। এমন ভাবে, যেন দুজনেই পড়ে যায়। শুধু একটা কথা, আচমকা ধাক্কাটা খেয়ে কী কথা বলে ও, উল্কিকে সেটা কান খাড়া করে শুনতে হবে। পারবি?

    পারব।

    যে কথা সে-ই কাজ! অসতর্ক মুহূর্তের ধাক্কায় ছেলেটা পড়ে যায়, তার ওপর উল্কি,– কে রে এটা!

    বাংলা বললে! – ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উল্কি বলে। ততক্ষণে পৌঁছে গেছে মুড়কি আর ফল্গু। একটাও বাজে কথা বলবে না, বলে ফল্গু, আমি প্রথম থেকেই জানি তুমি বাঙালি। বাঁচতে চাও তো আমাদের সঙ্গে এস, মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে কথা বলে ফল্গু কামিলার সঙ্গে, একজনের সঙ্গে কথা বলতে হবে, একটু প্রাইভেট স্পেস চাই।

    চলে আসুন, আমার অফিসে বসবেন, নয়তো ওপরে।

    জানা গেল ছেলেটার নাম নূর-উদ্দিন, বাড়ি ক্যানিং এর কাছে, ক্যানিং থেকে সন্দেশখালির রাস্তায় ঢুড়ি নামে একটা বাজার অঞ্চল আছে, জনপ্রিয় নামে একটা স্কুলও আছে সেখানে, ও ক্লাস টেন-এ পড়তো সেই স্কুলে। বড় রাস্তা থেকে মিনিট দশেক হাঁটলে ওর বাড়ি। মা মরেছে ছেলেবেলায়, থাকতো মামা আর বাবার সঙ্গে। ঢুড়ির বাজারে ওদের মাংসর দোকান, মামাও বাবার সঙ্গে কাজ করত সেখানে। বাবা হঠাৎ মারা গেল, মামা ওকে পাঠিয়ে দিল কলকাতার ট্যাংরায়, একটা ঠিকানাহীন ট্যানিঙের কারখানায় কাজ শেখবার জন্যে। মাস দুয়েকের মধ্যেই শিখে গেল কাজ, এতই ভালো শিখল যে ওর ট্যান করা চামড়ায় ছাগলের প্রতিটি লোমও থাকতো অটুট। সে লোমে রঙ করে চামড়াটা বিক্রি করত ওর মালিক হরিণের চামড়ার নামে। এই কারখানাতেই ওর আলাপ চিত্রগুপ্ত্‌ বর্মার সঙ্গে। একটা মরা পায়রা নিয়ে এসেছিলেন চিত্রগুপ্ত্‌ ট্যাক্সিডার্মি, মানে, স্টাফ করাবার জন্যে। যে কারখানায় কাজ করত ও, সেখানে কেউই জানত না এই কাজ। চিত্রগুপ্ত্‌ জানতেন। নূরকে দিয়ে কাজটা উনি করিয়ে নিলেন। তারপর নূরকে জিজ্ঞেস করলেন ও বিদেশে যেতে চায় কিনা।

    বিদেশ? মানে?

    আমেরিকায় যাবি?

    এক মাসের মধ্যেই চিত্রগুপ্তর সঙ্গে প্লেন-এ চাপলো নূর, দু-তিনটে প্লেন বদলিয়ে এই ম্যালডোনাডো। প্লেনেই ওকে পর্তুগিজ ভাষা শেখাতে শুরু করেছিলেন চিত্রগুপ্ত্‌, এক মাসের মধ্যেই ও মোটামুটি কথা বলতে শিখে গেল। আর এখন যেরকম পর্তুগিজ ভাষা ও বলে, যা শুনে অনেকেই মনে করে ওটাই ওর মাতৃভাষা, সেরকম শিখতে ওর সময় লেগেছিল ছ'মাস।

    তুমি থাক কোথায়? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।

    বাটারফ্লাই ফার্মে যেখানে ক্যান্টিন (মুড়কি আর উল্কি লক্ষ্য করে স্ন্যাক বার-কাম-স্যুভেনির শপটাকে ও ক্যান্টিন বলছে) সেটা পাহাড়ের একটা বাঁকের মুখে। ক্যান্টিনটার নীচেও একটা ঘর আছে, বাইরে থেকে ভালো করে বোঝা যায় না। ওখানে স্যর অনেক কাজ করেন। প্রথম একমাস আমি ওখানেই থাকতাম। তারপর স্যর নিজের একটা শোয়ার ব্যবস্থা করেন ওখানে, মাঝে মাঝে থাকেন। সেই থেকে আমি রাত্তিরে ক্যান্টিনেই শুই।

    আর তোমার ওই ক্যান্টিনের মালিক?

    ও মালিক নয়। মালিক স্যর নিজেই। ওর নাম দিয়েগো, ওর একটা কাপড়-কাচা দোকান আছে, ওর বউ সেটা দেখাশোনা করে। ও সেখানে রাতে ফিরে যায়।

    তুমি কত মাইনে পাও?

    কিছুই পাই না। খেতে পাই, হাত খরচের টাকা যেমন দরকার হয় পাই। আমার কোন কাগজ নেই, এখানে একটা নাম দিয়েছে, আদ্রিয়ানো, সেই নামেই সবাই ডাকে। আমি তো ক্রীতদাস।আমার কেউ নেই, ক্রীতদাসই থাকব চিরকাল।

    ফল্গু বলে, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তুমি যদি আইনকানুন মেনে চল, আমাদের কাজে সাহায্য কর, আমি তোমার দায়িত্ব নেব, নিশ্চিত তোমার একটা ব্যবস্থা করে দেব। কাগজ না-থাকা নিয়ে তোমায় চিন্তা করতে হবে না।

    এই কথাটুকুর পর একটা ফোন করতে বাইরে যায় ফল্গু, ফিরে এসে দেখে মুড়কি আর উল্কি গল্প করছে ছেলেটার সঙ্গে। ও জিজ্ঞেস করে, কী গল্প করছিস তোরা?

    মুড়কি বলে, ও এখন অনেক কাজ করে; রান্না করে, বাটারফ্লাই মাউন্টিং করে, কাকাতুয়ার ট্যাক্সিডার্মিও করে।

    কাকাতুয়া?

    নূর বলে, হ্যাঁ, মাঝে মাঝে ওবেলিস্কোর মিউজিয়াম থেকে কয়েকটা করে কাকাতুয়া নিয়ে আসেন স্যর, কথা-বলা শেখাবার জন্যে। কিন্তু বেশি কাকাতুয়াকে কথা বলা শেখান না উনি, এক-আধটাকে শেখান, তারপর ফেরৎ পাঠিয়ে দেন মিউজিয়ামে।

    বাকিগুলো?

    বাকিগুলোর পেট চিরে মেরে ফেলা হয়। উনি নিজেই মারেন, মাঝে মাঝে আমিও মারি। আমার মারতে ভালো লাগে না, কিন্তু না মারলে উনি খুব রেগে যান।

    মেরে ফেলা হয় কেন?

    ট্যাক্সিডার্মি করা হয়। করার পর বাইরে থেকে দেখে মনে হয় জলজ্যান্ত কাকাতুয়া।

    আর কাটা পেটটা?

    কাটা পেটে ঢোকানো হয় একরকমের পাখি। এখানকার পাখি, ভারি সুন্দর দেখতে। প্রায় কাকাতুয়ারই সাইজের। খাপে-খাপে ঢুকে যায়।

    জ্যান্ত পাখি? জ্যান্ত পাখি ঢোকানো হয়?

    জ্যান্তই, কিন্তু ওষুধ দিয়ে ঘুম-পাড়ানো।

    ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়ায় কে?

    কে পাড়ায় আমি জানিনা। যখন পাখি আসে, একসঙ্গে পঞ্চাশ-ষাটটা। সব বেহুঁশ।

    কাকাতুয়ার পেটে বেহুঁশ পাখি? পরে তাদের হুঁশ ফেরে?

    আমরা ফাঁক-ফোকর রাখি, যাতে নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলতে পারে, হুঁশ ফিরলে বাঁচতে পারে।

    কিন্তু কাকাতুয়ার পেটে কেন? বেআইনী পাচারের জন্যে? দেখে মনে হবে কাকাতুয়া যাচ্ছে, কিন্তু আসলে যাচ্ছে অন্য পাখি?

    তা হতে পারে, তবে, আজ অবধি একটাও পাখি এভাবে পাচার করা যায়নি, একটাও বাঁচেনি।

    কেন বাঁচেনি?

    স্যর বলেন, ওষুধের ডোজ কমবেশি হয়ে যাচ্ছে। তাই স্যর এখন নানারকম ডোজ নানারকম কাকাতুয়াকে দিয়ে দেখছেন, কোন্‌টায় কাকাতুয়া তাড়াতাড়ি বেহুঁশ হয়ে যাবে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি হুঁশ ফিরেও আসবে।

    কাকাতুয়াকে দিচ্ছেন? কাকাতুয়াকে কেন? কাকাতুয়া তো এমনিতেই পাঠানো যায় সব জায়গায়, কাকাতুয়াকে বেহুঁশ করতে হবে কেন?

    নূর বলে, কাকাতুয়ার জন্যে নয় কাকাতুয়ার জন্যে নয়। এই যে এখানকার পাখিগুলো, বললাম না, কাকাতুয়া আর এগুলো প্রায় সমান মাপের, সমান ওজনের। স্যর বলেন, কাকাতুয়ার যা ডোজ হবে এই পাখিগুলোর ডোজও হবে তাই। এই পাখিগুলো বিক্রি করে তো অনেক টাকা পাওয়া যাবে, স্যর তাই পরীক্ষা করেন কাকাতুয়া দিয়ে। কাকাতুয়াকে নানা ডোজে কোকেইন দেন। দিয়ে দেখেন কোন্‌ ডোজের কেমন ফল। স্যর বলেছেন কোকেইন কাজ করে মনের ওপর, তাই ভিন্ন ভিন্ন ডোজে কোকেইন দিলে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার পাওয়া যাবে।

    কিরকম?

    ধরুন আপনি চাইছেন পাখিটা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ুক, কিন্তু ঘুমটা ভেঙেও যাক তাড়াতাড়ি, তার জন্যে এক ডোজ, অথবা ঠিক ঘুম চাইছেন না, কিন্তু চাইছেন সারাদিন ধরে পাখিটা ঝিমিয়ে থাকুক, তার জন্যে আর এক রকমের ডোজ। স্যর বলেন অনেক সময় একটা বিশেষ ডোজ পাখিটার মনের স্ফুর্তি বাড়িয়ে দিতে পারে, কোন কোন ডোজে আবার পাখি খুব রাগী হয়ে যায়, যেন ক্ষেপেই আছে সারাদিন।

    বাঃ, এ তো বেশ ইনটারেস্টিং, বলে ফল্গু।

    তবে ট্যাক্সিডার্মি-করা কাকাতুয়ার মধ্যে এই দেশের সুন্দর পাখিগুলো স্টাফ করার জন্যে স্যর শুধু চান তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া আর তাড়াতাড়ি জেগে ওঠার ডোজ। এখনো সে ডোজ বুঝতে পারেননি স্যর, কিন্তু পারবেন ঠিক। লেগে আছেন।

    ফল্গু বলে, তোমরা যে এত কাকাতুয়ার ট্যাক্সিডার্মি করে ফেলেছ, সেগুলো থাকে কোথায়? এখানকার পাখিরা যখন বাঁচছেই না, তখন তো আর সেগুলোকে দিয়ে ট্যাক্সিডার্মি-করা কাকাতুয়াকে স্টাফ করার কোন মানে হয়না। আমরা যখন বাটারফ্লাই ফার্মে গিয়েছিলাম, কাকাতুয়া দেখিনি তো একটাও। আমরা তো তোমাদের স্ন্যাক-বারেও গিয়েছিলাম, কই, দেখিনি তো।

    কোথায় থাকে সব আমি জানিনা। ট্যাক্সিডার্মি করলে আর তো পচে না ওগুলো, অনেক দিন রেখে দেওয়া যায়। রাত্তিরে যখন দিয়েগো কাপড়-কাচার দোকানটায় ফিরে যায়, ও সঙ্গে করে নিয়ে যায় কিছু কিছু। কিন্তু কোথায় রাখে আমি জানিনা।স্যরও মাঝে মাঝে কিছু কিছু নিয়ে যান, কোথায় রেখে আসেন আমি জানিনা।

    ট্যাক্সিডার্মি ছাড়, ফল্গু বলে, তোমার স্যর যে এত এত কাকাতুয়াকে কোকেইন দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছেন, তাতে তো মরছেও নিশ্চয়ই অনেক। সেগুলোকে কী করছেন? আর তাছাড়া, একই ডোজ নিশ্চয়ই এখানকার পাখিদেরও দেন, সেগুলো মরলেই বা করেনটা কী?

    নূর বলে, কাকাতুয়া তো সাদা, তাই মরা কাকাতুয়াকে পালক-টালক ছাড়িয়ে কেটেকুটে ক্যান্টিনের ময়লার সঙ্গে ফেলে দেওয়া যায়, কেউ বুঝতেও পারবে না, মুরগীর পালক-টালকের সঙ্গে মিশে যায়। এখানকার পাখিগুলোকে স্যর ক্যান্টিনের নীচের তলায় বেড়ালকে খাওয়াতেন আগে। কিন্তু ওই ঘুমের ওষুধ খাওয়া পাখি খেয়ে একটা-দুটো বেড়াল মারা গেছে। স্যর তাই ওগুলোকে আমাকে দিয়ে টুকরো করান। আলাদা একটা ডেকচি আছে, তাতে সেদ্ধ করান আমাকে দিয়ে, জলটা ফেলে দিয়ে তারপর বেড়ালকে খাইয়ে দেন। স্যর বলেছেন, খুব সাবধানে করবি, একটা টুকরোও যেন পড়ে না থাকে কোথাও।

    ফল্গু বলে, তবে তো তুমি ভালোই আছ। স্যরও ভালোই বাসেন তোমাকে মনে হচ্ছে।

    কিছুক্ষণ কথা বলে না নূর। তারপর তার চোখ দিয়ে ধারা নেমে আসে, ভালো নেই দিদি, আমি যে একটা খারাপ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছি সে তো আমি বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমার কোন উপায় নেই। স্যর বলেছেন, যদি কেউ জানতে পারে আমার আসল নাম আদ্রিয়ানো নয়, কিংবা আমার কাগজপত্র ঠিকঠাক নেই, তাহলে আমার জেল হয়ে যাবে।

    কিন্তু, ফল্গু বলে, তুমি তো স্যরকে ভালোও বাসো খুব, তোমাকে জীবজন্তুর ব্যাপারে কত কিছু শিখিয়েছেন।

    শিখিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু ভালোবাসিনা একেবারেই। আপনারা যেদিন পার্কে বেড়াতে এসেছিলেন, আমি ভুল করে বাংলা বলে ফেলায় স্যর আমাকে খুব মেরেছিলেন। আপনারা বেরিয়ে যাবার পর স্যরও বেরিয়ে গেলেন, ফিরলেন তিন-চার দিন পর। ফিরে আবার মারলেন আমাকে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, মাংস কাটার কাতান দিয়ে স্যরকে কেটে ফেলি, অথবা খাবারে মিশিয়ে দিই বেশি করে ঘুমের ওষুধ। কিন্তু তাতে আমারই অসুবিধে। কাগজপত্র নেই আমার, আমি কে, তারই পরিচয় নেই, এই বিদেশে বাঁচব কী করে!

    তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে না এখানে এতক্ষণ কথা বলতে বলতে? ফিরলে তোমার স্যর ধরবে না?

    সন্ধ্যে অবধি স্যর থাকবেন না, গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছেন, অনেকগুলো স্টাফ্‌ড্‌ কাকাতুয়া সঙ্গে নিয়ে। আমাকে চারটে দিয়েছিলেন, দিয়েগোর কাপড়-কাচা দোকানের জন্যে দুটো, আর দুটো ওবেলিস্কোর জন্যে, হাতের ব্যাগটা দেখায় নূর, এই ব্যাগে করে নিয়ে গেছিলাম।

    কাপড়-কাচা দোকান খোলা ছিল?

    কাস্টমারদের জন্যে এখন বন্ধ, বাইরে একটা নোটিস দেওয়া আছে, কিন্তু পাশে একটা ছোট দরজা আছে, সেটা দিয়ে ঢোকা যায়। দিয়েগোর বউ ভেতরে থাকে, ধাক্কা দিলে খুলে দেয়।

    স্যর সন্ধ্যের আগে ফিরবেন না তুমি শিওর? তাহলে ঠিক বিকেল চারটের সময় বাটারফ্লাই পার্কের গেট দিয়ে বেরিয়ে এয়ারপোর্টে যাবার রাস্তাটায় দশ মিনিট হেঁটে উল্টো, মানে এয়ারপোর্টের দিকে, আমার জন্যে অপেক্ষা করবে।

    নূর বেরিয়ে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়ায়। ফল্গু বলে, দাঁড়াও, তোমার ব্যাগটা দিয়ে যাও, ওটাকে পরীক্ষা করাতে হবে।



    চলবে ---
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ৪০৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৫:৩৫540241
  • এবার মোটামুটি শেষ হয়ে এসেছে। যদি না আরো কোন অপ্রত্যাশিত চমক আসে। 
  • স্বাতী রায় | 117.194.***.*** | ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ ২১:৫৮540245
  • ভীষণ ভাল লাগছে পড়তে। জাল মোটামুটি গুটিয়ে এসেছে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন