প্রফেসর চন্দ্রশেখর জিজ্ঞেস করলেন, প্রফেসর পেরীরাকে কেমন লাগল?
প্রফেসর পেরীরা?
হ্যাঁ, তোমরা তো তাঁরই গেস্ট, আমি তো শুধুই উপলক্ষ, বললেন চন্দ্রশেখর। পেরীরা এখানকার জিওলজি ডিপার্টমেন্টের প্রধান অধ্যাপক। আমি এসেছি ওঁর ডিপার্টমেন্টে একটা সেমিনার অ্যাটেণ্ড করতে।
ফল্গু-উল্কি-মুড়কির মনে পড়ে গেল গতকাল গেস্ট হাউজে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস ফার্ণাণ্ডেজ প্রথমেই খোঁজ নিয়েছিলেন ওরাই অ্যালবার্ট পেরীরার গেস্ট কিনা, তখনও ওরা ঠিক ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ড্রাইভার নয়, প্রফেসর পেরীরা নিজেই ওদের এয়ারপোর্টে রিসিভ করেছেন, এখানে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে এসেছেন, এমনকি ওদের মালপত্রও নিজে বয়ে ঠেলাগাড়ি করে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেছেন ভেবে শুধু অবাক নয়, একটু অস্বস্তিও বোধ করল ওরা।
চন্দ্রশেখর বললেন, এবার একটু কাজের কথা সেরে নিই। তোমাদের সঙ্গে ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর সম্পর্কটা কিন্তু টপ সিক্রেট, কোনমতেই কারো এটা জানা চলবে না। আমি তোমাদের একটু বুঝিয়ে বলছি। ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর বিভিন্ন দায়িত্বের মধ্যে প্রধান যেটা, সেটা হলো ব্রাজিলে খনিজ তেল এবং গ্যাসের অনুসন্ধান। আমি বলছি অনুসন্ধান, কিন্তু তার মানে শুধুমাত্র অনুসন্ধানই নয়, এই তেল বা গ্যাস কী ভাবে ব্যবহার করা হবে, কার কতটুকু ব্যবসা করার অধিকার, কী দামে কার কাছে এসব বিক্রি করা হবে, এমনকি সে ব্যাপারেও ন্যাশনাল অবজার্ভেটরী ব্রাজিল সরকারের কনসালট্যান্ট। এ দেশে পেট্রোলিয়মের সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো গ্যাসোব্রাস নামে একটা কম্পানীর। কীভাবে সারা পৃথিবীতে আজকাল ব্যবসা-ট্যাবসা হয়, তার ডিটেলে আমি যেতে চাই না, শুধু জেনে রেখ এই গ্যাসোব্রাসের মালিকানা নিয়ে পৃথিবীর বড় বড় ব্যবসাদারদের মধ্যে বিরাট প্রতিযোগিতা, আর এই প্রতিযোগিতায় দু-একজন ভারতীয় ব্যবসাদার একে বারে প্রথম সারিতে। কাজেই বুঝতেই পারছ, এই সব লোকদের, এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীতে নিয়মিত যাতায়াত আছে। বছরের যে কোন সময়ে, যে কোন দিনে, আমাদের গেস্ট হাউজে একাধিক এই ধরণের মানুষকে দেখতে পাওয়া যায়। আর এসব ব্যবসায়ীদের তো নানা ব্যাপারে ইন্টারেস্ট, আমার আশঙ্কা পেরুর কাণ্ডটাতেও এদের মধ্যে কেউ কেউ জড়িত থাকতেই পারে। আমাদের গেস্ট হাউজে তোমাদের মতো অসমবয়েসি তিনজন মেয়েকে দেখলে এসব মানুষের যে কৌতূহল হবে সেটা তোমাদের কাজের পক্ষে হয়তো ভালো হবে না।
তাই পেরীরার সঙ্গে কথা বলে আমি তোমাদের এখানে আনিয়েছি। আর যে কথাটা তোমাদের আগে বলা হয়নি, পেরীরার কিন্তু স্কুলের পড়াশোনা ইণ্ডিয়াতে। আসলে অ্যালবার্ট পেরীরা ইণ্ডিয়ারই লোক, ওর বাড়ি গোয়ায়। ও যখন স্কুলে পড়ে, ওর বাবা একটা কাজ নিয়ে ব্রাজিলে আসেন, জায়গাটা ওঁর ভালো লেগে যায়, উনি আর ইণ্ডিয়াতে ফিরে যাননি। অ্যালবার্টও স্কুলের পড়া শেষ করে এখানে চলে আসে, এ দেশের নাগরিকত্ব নেয়, এবং এখানেই সেট্ল্ করে যায়। ও-ই এখানে তোমাদের কন্ট্যাক্ট পয়েন্ট, যা যোগাযোগ রাখবে, ওরই সঙ্গে, আমি ঠিক খবর পেয়ে যাব এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব।
এই পর্যন্ত বলে চন্দ্রশেখর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আমি এখন চলি, সেমিনার বোধ হয় শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেল। আমি যতদূর জানি, অ্যালবার্ট আজ তোমাদের জন্যে বিশেষ কোন প্রোগ্রাম রাখেনি, তোমরা আজ একটু রিল্যাকস্ড্ মুডে ব্রাসিলিয়ায় ঘুরে বেড়াবে, ব্রাজিলিয়ান কুইজিন টেস্ট করবে, আর কাল ভোরবেলায় রওনা দেবে গোইয়া স্টেটে, চাপাদা ডো ভিডীরস ন্যাশনাল পার্কের উদ্দেশে। সেখানে বোধ হয় দু-তিন দিন থাকবে তোমরা। ওকে, বেস্ট অব লাক।
দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও আবার ফিরে এলেন চন্দ্রশেখর: বাই দি ওয়ে, আমার একটা কন্ট্যাক্ট নাম্বার রেখে দাও, কখনো যদি মনে হয় আমার সঙ্গেই কথা বলতে হবে, এই নাম্বারটায় ফোন কোরো। তিনজনেই সেলফোন ক্যারি করছ তো? ওরা মাথা নাড়ার পর হেসে বললেন, ভুলে গেছ বোধ হয় আমি সাউথ ইণ্ডিয়ান। তোমরা যেভাবে মাথা নাড়লে, সাউথ ইণ্ডিয়ায় তার মানে হচ্ছে, না, ক্যারি করছি না। যাই হোক, আমি তোমাদের ইন্টেণ্ডেড মানেটাই ধরছি, সেলফোন বের করে নাম্বারটা সেভ করে রাখ তিন জনেই, কিন্তু আমার নামটা লিখবে না। নাম্বারটা সেভ করা হয়ে গেলে বললেন, যদি ফোন করতে হয়, ডায়াল করে কোন কথা বলবে না, যতক্ষণ না উলটো দিক থেকে আমার গলা শোন। যদি শুনতে না পাও আদৌ, বুঝবে তখনই কথা বলার অসুবিধে আছে। পরে আমি যোগাযোগ করে নেবো। আচ্ছা, বাই।
বেলা সাড়ে বারটা নাগাদ মিসেস ফার্ণাণ্ডেজ নক করে ঘরে ঢুকলেন। অ্যালবার্ট পেরীরা বলে পাঠিয়েছেন দেড়টার সময় গাড়ি আসবে, ড্রাইভারের নাম ফ্লেভিও ক্যালিক্স; ফল্গুরা যেন রেডি হয়ে থাকে, শহরে ঘোরা হবে, এবং বাইরে লাঞ্চ খাওয়া হবে।
সোয়া একটার সময় রেডি হয়ে যখন রিসেপশনে পৌঁছোল ওরা, মাথা ভর্তি হলুদ চুল, প্রায় উল্কিরই বয়েসি একটা ছেলে মিসেস ফার্ণাণ্ডেজের সঙ্গে গল্প করছে। ওদের দেখে হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটা, হাই, আয়্যাম ক্যালিক্স, য়্যোর ড্রাইভার ফর দ্য রেস্ট অব দ্য ডে। হ্যাণ্ডশেক পর্ব শেষ হলে গাড়িতে উঠতে উঠতে ছেলেটা প্রশ্ন করে, খিদে পায়নি তোমাদের?
তেমন খিদে না পেলেও – সকালে টোস্ট, ডিম আর হট চকলেটের ব্রেকফাস্ট খেয়েছে ওরা – মনে হল, ছেলেটার যদি খিদে পেয়েই থাকে, তাহলে একেবারে খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। অতএব মিনিট পনেরো প্যারানোয়া লেকের ধার ঘেসে গাড়ি চালানোর পর বেন্টো নামের একটা ছোটখাটো রেস্টোর্যান্টের সামনে গাড়ি দাঁড় করাল ক্যালিক্স। গাড়িতে সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশেই বসেছে ফল্গুদি, আর আসতে আসতে জেনে নিয়েছে ও আণ্ডারগ্র্যাজুয়েট ছাত্র জিয়োলজির, ভালো ইংরিজি জানে, তাই ওকেই পাঠিয়েছেন পেরীরা। গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ক্যালিক্স বলল, প্রফেসর পেরীরা অবিশ্যি আমাকে বলে দিয়েছেন একটু আপমার্কেট রেস্টোর্যান্টে নিয়ে গিয়ে ভালোমন্দ খাওয়াতে তোমাদের, আর টাকাও দিয়ে দিয়েছেন প্রচুর, কিন্তু সত্যি কথা কী জানো তো, ঐসব রেস্টোর্যান্টে ঢুকতে কেমন ভয় ভয় করে আমার, বেন্টো আমার ফেভারিট জয়েন্ট, ওখানে সবাই আমাকে আর আমার বন্ধুদের চেনে; অবিশ্যি তোমরা যদি চাও, সাউথ হোটেল সেক্টরে যেতেই পারি আমরা।
ফল্গু কিছু বলার আগেই মুড়কি জিজ্ঞেস করল, সাউথ হোটেল সেক্টরটা কী ব্যাপার? – আসলে দামী দামী রেস্টোর্যান্টে খেতে মুড়কি খুবই ভালবাসে, কিন্তু সে ইচ্ছেটা এখানে প্রকাশ করাটা অভদ্রতা হবে কিনা বুঝতে পারছিল না, ভাবল সাউথ হোটেল সেক্টরটা কী সেটা জেনে যদি ফল্গুদি আর উল্কিদি একটু দামী রেস্টোর্যান্টে যেতে রাজি হয়!
আমাদের ব্রাসিলিয়া একটু বেশিই প্ল্যানড্, বুঝতে পারলে! – বললো ক্যালিক্স – এখানে সব কিছুই সেক্টর অনুযায়ী, কোন কিছুর এলোমেলো হবার জো নেই। নর্থ হোটেল সেক্টর আর সাউথ হোটেল সেক্টরে যত হোটেল, দামী দামী রেস্টোর্যান্ট এই সব, এম্ব্যাসী সেক্টরে শুধুই রাজ্যের এম্ব্যাসী, সাউথ ব্যাঙ্কিং সেক্টরে শুধুই ব্যাঙ্ক, কোথাও একটা খালি জায়গা দেখে কারো যদি ইচ্ছে করে এখানে মনের মতো একটা ম্যুজিয়ম তৈরি করি তো, উঁহু, চলবে না, সরকারি দপ্তরে গিয়ে খোঁজ নিতে হবে তোমার ম্যুজিয়মের বিষয় অনুযায়ী কোন্ সেক্টরে তোমার গতি! সমস্ত শহরটাই ঐ ফিফটীজ-সিক্সটীজে যাঁরা প্ল্যান করেছিলেন তাঁদের মর্জিমাফিক চলবে চিরকাল, বুঝলে?
মুড়কি এখনো ফল্গুদিকে চেনেনা ততটা ভালো করে, কিন্তু ক্যালিক্সের বিবরণ শুনে উল্কি বুঝল যতই নতুন ধরণের আর চোখ-ধাঁধানো হোক, এ শহরটার বোরিং হবার যথেষ্ট চান্স আছে। এমনিতেই ফল্গুদির মতে পৃথিবীর যেখানেই যাসনা কেন, সব দামী রেস্টোর্যান্ট একই রকমের, দামী ছাড়া অন্য কোন চরিত্র নেই, নতুন জায়গায় গেলেই তাই এমন জায়গায় খেতে যেতে হয় যেখানে সাধারণ মানুষের ভীড়; তার ওপর ক্যালিক্সের কথা শুনে মনে হল শহরের সৌন্দর্যের ব্যাপারে অন্তত ফল্গুদির সঙ্গে ক্যালিক্সের চিন্তাভাবনার বেশ মিল আছে, কাজেই আর কথা না বাড়িয়ে উল্কি বললো, খাবারটা ভালো হলে আমার মনে হয় বেন্টোই বোধ হয় ঠিক আছে।
বেন্টোতেই ঢুকল ওরা।
ইণ্ডিয়ানরা তো সব শুনেছি ভেজিটারিয়ান, মাংস-টাংস খাও তো তোমরা? – কোণের দিকে একটা টেবিলে বসে ক্যালিক্সের প্রথম প্রশ্ন।
খেতে ভালো হলে সব কিছুই খাই – রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎ শিষ্য, আমাদের দেশের এক মস্ত সাহিত্যিক কী বলেছেন জানো তো? জলে নৌকো, স্থলে চেয়ার-টেবিল, আর অন্তরীক্ষে অ্যারোপ্লেন ছাড়া সব সুস্বাদু খাদ্যই গ্রহণ করে থাকি, – উল্কির আশ্বাস।
ক্যালিক্সকে হাত নাড়তে নাড়তে হেড-ওয়েটার গোছের দেখতে একটি বৃদ্ধ অর্ডার নিতে চলে এল টেবিলে। ফল্গু প্রশ্ন করল, তোমাদের এই বেন্টোর স্পেশালিটি কী? কোন খাবারটা সবচেয়ে ভালো?
খাবার তো সবই ভালো, কিন্তু ব্রাজিলে এসে ব্রাজিলের ন্যাশনাল ডিশ খাবে না?
সেটা কী?
নাম যা কিছুই হতে পারতো, এ ক্ষেত্রে এটার নাম ফীজোয়াদা ব্রাসিলাইরা, সহজ ইংরিজিতে ব্রাজিলিয়ান ফীজোয়াদা।
ফীজোয়াদা? – বলে মুড়কি – শুনতে তো বেশ ভালো, কী কী আছে তাতে?
কী কী আছে? দেখো, মূলত মাংস, একাধিক প্রাণীর, কিন্তু যেমন তেমন মাংস হলেই হলো না, বাছাই বাছাই অংশের মাংস ব্ল্যাক বীনের একটা বেডের ওপর বসিয়ে অল্প আঁচে তাকে রান্না করা হয়, মাংস যখন সেদ্ধ হয়ে আসে, তখন নানা রকমের সব্জী - বাঁধাকপি, গাজর, আলু, চালকুমড়ো, ওকরা ইত্যাদি মাংসের ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়, মাংসের ভাপে সেগুলো যখন সেদ্ধ হয়ে যায়, তখন খেতে হয় ভাতের সঙ্গে।
শুনতে মন্দ লাগছে না, কী বলিস? – উল্কির মন্তব্য মুড়কির উদ্দেশে।
ক্যালিক্সও ঐ ফীজোয়াদাতেই উৎসাহী, অতএব অর্ডার গেল সেটারই।
আচ্ছা, ক্যালিক্স তো তোমার পদবী নিশ্চয়ই, তোমার নিজস্ব নামটা কী? – প্রশ্নটা করলো ফল্গু।
সে কী, আমার নামটাই শোননি এখনও পর্যন্ত! – ক্যালিক্সের গলায় রীতিমত বিস্ময় এবং অনুকম্পা।
শুনেছিলাম একবার, মিসেস ফার্নাণ্ডেজ বলেছিলেন, কিন্তু তুমি তো প্রথম আলাপে শুধুই ক্যালিক্স বললে, তাই ভুলে গেছি।
ওঃ শুনেছো একবার, তা-ও মনে রাখতে পারনি! ক্যালিক্সের কথা শুনে মনে হল এরকম হদ্দ বোকা, প্রায় ভেজিটেব্ল্, বিস্মরণশক্তির চ্যাম্পিয়ন, ও দেখেনি আগে। তারপরেই নিজের এলোমেলো চুলে একবার আঙুল চালিয়ে, যেন এ প্রসঙ্গ আর চালাতে চায় না এরকম ভাব দেখিয়ে, বললো, আমার চুলটা কেমন লাগছে?
একটু বোকা বোকা, হলুদ চুল আগে দেখিনি কখনো, জানিনা রং করেছ কিনা, প্রায় শোধ নেবার ভঙ্গীতে মুড়কির জবাব।
নো ম্যাম, রংটা ঈশ্বর নিজেই করে এই ভবসাগরে পাঠিয়েছেন আমায়, আর তাই আমার নাম ফ্লেভিও।
ফ্লেভিও মানে হলুদ রং? উল্কির প্রশ্ন।
শুধু হলুদ রং নয়, হলুদ রঙের চুল।
আচ্ছা, নামের মানে-টানে থাকে নাকি তোমাদের? আমি তো ভেবেছিলাম টম-ডিক-হ্যারি, যা হয় একটা হলেই হলো, রাগটা যে এখনো পুরোপুরি যায়নি মুড়কির, ওর প্রশ্নেই সেটা স্পষ্ট।
থাকে বৈকি, পুরোপুরি পর্তুগিজ নাম হলেই থাকে। যেমন ধর, অ্যাবিলিও নাম যদি হয় কারোর, বুঝতে হবে যিনি নামটা দিয়েছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন ছেলেটা খুব কাজের ছেলে হোক, ইংরিজিতে এব্ল্ যাকে বলে আর কী! চিকো নামের ছেলের স্বাধীনচেতাই হওয়া উচিত। তবে হ্যাঁ, ক্রীশ্চান ওয়ার্ল্ডে কতকগুলো চালু নাম আছে, সব সময় তার আসল মানে বোঝা যায় না, অনেক ব্যবহারে ছোট হতে হতে মূল অর্থটাই বদলে যায় অনেক সময়। যেমন ধর, সাও পাওলো, ব্রাজিলের বিখ্যাত সহর, এই নামটার মানে জানো?
এখনো অবধি জানি না, তুমি শুধু একবার যদি বলে দাও, তাহলে শিখে যাব।
সেণ্ট পল, সাও পাওলো মানে সেন্ট পল, আচ্ছাঃ, আমি তো অনেক পরীক্ষা দিলাম, তোমাদের নামের মানে-টানে যদি থাকে কিছু, সেগুলো শোনা যাক এবার।
এই যে ফল্গুদি, দি মানে দিদি, অর্থাৎ এল্ডার সিস্টার, এর ফল্গু নামটা কী বোঝাচ্ছে জানো? তোমাদের যেমন রিও হামজা, আমাদের দেশেও সেরকম রিও ফল্গু, হামজার মতই মাটির নীচের নদী, বুঝলে? ফল্গুর পর এবার উল্কির দিকে মুড়কির নির্দেশ, আর এই যে উল্কিদি, উল্কি এক ধরণের ছবি, তবে ক্যানভাসে নয়, মানুষের শরীরে। তোমাদের দেশে তো খুবই পপুলার, প্রায় সব ফুটবলারের গায়েই তো দেখি উল্কি।
ও, তুমি ট্যাটুর কথা বলছো?
আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর, ট্যাটুই, ট্যাটু মানে উল্কি।
আর তোমার নাম?
শিঞ্জিনী। মানে নূপুরের সুমধুর শব্দ, বুঝলে?
বুঝিনি আবার, যা সুমধুর কণ্ঠস্বর শোনাচ্ছ সেই থেকে!
সমবেত হাসির মধ্যেই ফল্গুদি বললো বাংলায়, আর তোর ডাক-নামের মানেটা বলে দি' এবার!
বড় বড় চোখ পাকিয়ে তাকায় মুড়কি, আর কেউ কিছু বোঝার আগেই খাবার-দাবার নিয়ে হাজির হয় ওয়েটার।
খুবই সুস্বাদু, কিন্তু এত খাবার! শুধু স্যালাড আর ফলেই তো পেট ভরে যাবার দাখিল! আর তা-ও কমপ্লিমেন্টারী! দুজনের খাবার একাই খেল ফ্লেভিও, বাকি দুজনেরটা ওরা তিনজনে মিলেও শেষ করতে পারেনা আর। তবুও, এতই ভাল খেতে, কষ্ট করে খেয়েই নিল ওরা।
বিল-টিল শোধ করার সময় সেই বৃদ্ধ ওয়েটারকে জিজ্ঞেস করল উল্কি, বেন্টো মানে কী?
ওঃ বেন্টো? আমাদের এই রেস্টোর্যান্ট? বেন্টো – আশীর্বাদধন্য। তোমাদের আশীর্বাদ পেলাম তো আমরা?
রেস্টোর্যান্ট থেকে বেরিয়ে ফ্লেভিও বলে, সাড়ে তিনটে বেজে গেল, এখন কী কী দেখাই তোমাদের? শোন, সাতটার মধ্যে এই প্যারানোয়া লেকে ফিরতেই হবে আমাদের, জে-কে ব্রিজ থেকে এখানকার সূর্যাস্ত একটা দেখবার মতো দৃশ্য। তার আগে কী করি আমরা? একটা কথা বলব তোমাদের? এত সাজানো-গোছানো শহরে দেখবেটা কী? যেদিকে যাবে প্রায় একই রকম। এ শহরের যেটা বৈশিষ্ট, সেটা হল এর বাড়িগুলো। এক-একটা বাড়ি যেন এক-একটা স্কালপ্চার। আর এই স্কালপ্চারগুলোর স্রষ্টা জানো কে? এই যে কয়েকমাস পরেই এখানে অলিম্পিক ফুটবল খেলা হবে, আর দু বছর আগেই হয়ে গেলো ওয়র্ল্ড কাপ, এর দৌলতে এখন তো সারা পৃথিবীতেই ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার নেইমার এক সেলেব্রিটি, তার নাম সবাই জেনে গেছে। আর ব্রাসিলিয়া শহরের এই অসাধারণ বাড়িগুলোর ভাস্কর-স্থপতি যিনি, তিনিও একজন নেইমার। অস্কার নেইমার। আমি একটা প্রস্তাব দিই, শোন। আমরা একটাই বাড়ি ভালো করে দেখব। আমার মনে হয় এটাই ব্রাসিলিয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ, ক্যাথিড্রাল অব ব্রাসিলিয়া, রাজি?
এ একেবারে ফল্গুর মনের কথা। সময় যদি কম থাকে, নতুন জায়গায় গিয়ে একটাই দ্রষ্টব্য দেখ ভাল করে, একগাদা জিনিসে টিক না লাগিয়ে। রাজি হয়ে গেল ওরা। যেতে যেতে ফ্লেভিও বললো, আমরা যাচ্ছি ক্যাথিড্রাল দেখতে, চার্চ; অথচ ডন বস্কোর চার্চে যাচ্ছি না! শুনলে এখানকার লোকরা অবাক হয়ে যাবে। কারণ ডন বস্কোই ব্রাসিলিয়ার পেট্রন সেন্ট। ডন বস্কো আর ব্রাসিলিয়াকে নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। তোমরা ডন বস্কোর নাম শুনেছ তো?
আবার মুড়কি: আজ্ঞে হ্যাঁ স্যর, খোদ কলকাতা শহরে এবং তার আশপাশে অন্তত তিন-চারটে ডন বস্কো স্কুল আছে।
ভালো ভালো, গল্পটা শোন এখন। এই ইটালিয়ান সাধু নাকি সতেরোশো তিরাশি সালে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পনের থেকে কুড়ি ডিগ্রী অক্ষাংশের মধ্যে এক ফিউচারিস্টিক শহর তৈরি হবে একদিন, সেই শহরই হবে হিব্রু বাইবেলের প্রমিসড ল্যাণ্ড। এবার ব্রাসিলিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখ একবার। উনিশশো ষাট সালে তৈরি হলো এই শহর, এর
স্থাপত্য-ভাস্কর্য দেখলে কে না একে ফিউচারিস্টিক শহর বলবে! আর ভূগোল? একেবারে পনেরো থেকে কুড়ি ডিগ্রী দক্ষিণ অক্ষাংশের মাঝখানে!
কলকাতার সেন্ট পল্স্ ক্যাথিড্রাল নিয়ে খুবই গর্ব ফল্গুদির, তাছাড়া ক্যান্টারবেরী, ওয়েস্টমিনস্টার, নত্র্-দাম, এসবের কথা কে না জানে, ক্যাথিড্রাল শুনলেই তো খোঁচা খোঁচা খিলেনওয়ালা গথিক গির্জার কথা মনে পড়ে যায়, কিন্তু এ কেমন ক্যাথিড্রাল! মডার্ণ স্থাপত্য, সে তো বলে দেবার দরকারই নেই, কিন্তু কী আশ্চর্য সুন্দর জ্যামিতিক মন্দির! ঘুরে ঘুরে বারবার দেখেও মন ভরে না। নেহাতই যখন ফিরতে হবে, ক্যাথিড্রালের প্রধান দরজায় ঢোকার মুখে কতকগুলো স্টীলের পাত দিয়ে তৈরি মানুষের মূর্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে ফল্গুদি বলল, এই মূর্তিগুলো দেখে আমার কার কথা মনে পড়ছে জানিস? সোমনাথ হোড়। অনেক ছোটবেলায় বাবা-মার সঙ্গে একবার শান্তিনিকেতনে বেড়াতে গিয়েছিলুম, তার পর আর যাওয়া হয়নি। সেখানে সোমনাথ হোড়ের একটা ছোট বাড়ি ছিল; তখন তালা দেওয়া, কেউ থাকত না সেখানে। বাড়ির সামনে সোমনাথ হোড়ের নিজের তৈরি একটা পোস্টম্যানের মূর্তি ছিল, ঠিক যেন চিঠি বিলি করতে এসেছে। স্টীলের পাত দিয়ে তৈরি। ফিরে গিয়ে আর একবার যেতে হবে শান্তিনিকেতন। আমি ভাবছি, পৃথিবীর দু প্রান্তে দুজন শিল্পী – যাঁরা কেউ কাউকে চিনতেন না – কী অসাধারণ শিল্পচিন্তার মিল ছিল তাঁদের!