বেলারি সমন্না চন্দ্রশেখরের সঙ্গে আলাপ হায়দ্রাবাদে, ২০১২-র মার্চে, ন্যাশনাল জিওফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিট্যুটে, বলল ফল্গু। আমি তখন হায়দ্রাবাদের সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অব ইংলিশ অ্যাণ্ড ফরেন ল্যাঙ্গুয়েজে এক বছরের একটা ডিপ্লোমা কোর্স করছি, ইংরেজি শেখানোর আধুনিক পদ্ধতি শেখার জন্যে। ইনস্টিট্যুটের নোটিশ বোর্ডে হঠাৎই একটা চমকপ্রদ বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল একদিন। ভালিয়া মন্নথাল হামজা নামের কোন একজন প্রফেসর নাকি ব্রাজিলে মাটির তলায় ৬০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এক নদী আবিষ্কার করেছেন, সত্যিকারের অন্তঃসলিলা নদী। বিজ্ঞপ্তিতে ইনস্টিট্যুটের ছাত্র ছাত্রী এবং শিক্ষক শিক্ষিকাদের আহ্বান করা হচ্ছে জিওফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিট্যুটের এক সেমিনারে। উল্কি বললো, কেন ফল্গুদি, জিয়োফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিট্যুটের সেমিনারের নোটিশ ইনস্টিট্যুট অব ইংলিশে কেন?
আসলে কী জানিস তো, সায়েন্স শুধুমাত্র কয়েকজন হাতে গোনা লোকের জন্যে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন শুধু অল্প কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী, এ রকমটা মানতে চাইছেন না এখনকার বিজ্ঞানীরা। তাই বিজ্ঞানের নানারকমের আবিষ্কার, নানারকমের আইডিয়া, এসব ব্যাপারে আজকাল সারা পৃথিবীতেই অনেক পপুলার লেকচার আয়োজন করে বিভিন্ন সায়েন্টিফিক ইনস্টিট্যুট। হায়দ্রাবাদে এমন একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা – সেন্ট্রাল ইনস্টিট্যুট অব ইংলিশ, ওসমানিয়া য়্যুনিভার্সিটি, এসব জায়গার লোকজনদের জানাতে হবে না? তো, সম্ভবত সেমিনারে যোগ দেবার জন্যে সবাইকে উৎসাহিত করতে অন্তঃসলিলা নদীটার একটু বিবরণও দেওয়া হয়েছে। মাটি থেকে ১৩০০০ ফুট নীচে মোটামুটি অ্যামাজনের প্রবাহের রাস্তা ধরেই এই নদীও বয়ে চলেছে এবং তার জলও গিয়ে মিশছে অ্যাটলান্টিকে, সমুদ্রের তলায়। সবচেয়ে চমকপ্রদ খবর হল, যে প্রফেসর হামজা নদীটি আবিষ্কার করেছেন, এবং যাঁর নামে এই নদীর নাম দেওয়া হয়েছে রিও হামজা, তিনি আদ্যন্ত একজন ভারতীয়; কেরলে জন্মিয়েছেন, বড় হয়েছেন, লেখাপড়া শিখেছেন, এবং এমনকি তাঁর গবেষণার জীবন শুরুও করেছেন হায়দ্রাবাদের ন্যাশনাল জিওফিজিকাল রিসার্চ ইনস্টিট্যুটেই।
অনেককে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বিফল হয়ে একাই হাজির হলাম সেমিনারে। শেষ মুহূর্তে জরুরী কাজে আসতে পারেননি প্রফেসর হামজা, তাঁর বদলে বক্তৃতা দিলেন তাঁরই ছাত্র এবং ব্রাজিলিয়ন ন্যাশনাল অবজারভেটরিতে তাঁর সহকর্মী প্রফেসর চন্দ্রশেখর। বক্তৃতার শেষে প্রশ্নোত্তরের সময় প্রায় সব শ্রোতাই নীরব। প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি থাকলেও সাহস-টাহস করে শেষ পর্যন্ত আমিই শুরু করলুম ছোট একটা প্রশ্ন দিয়ে, তারপর কীভাবে যে পুরো সময়টা কেটে গেল প্রায় বোঝাই গেল না। সেমিনারের শেষে সেমিনার হলের বাইরে যখন কফি সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর সবাই লাইন দিয়ে নিজের নিজের কফি সংগ্রহে ব্যস্ত, একটা মেদু বড়ায় কামড় দিয়ে প্রফেসর চন্দ্রশেখর জিজ্ঞেস করলেন, সো, হোয়াট ইজ য়্যোর সাবজেক্ট?
ইংরিজি। একটা ই-এল-টি, মানে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ টীচিঙের ডিপ্লোমা করছি ইনস্টিট্যুট অব ইংলিশে।
ইংরিজি? ফিজিক্স নয়, জিওলজি নয়, জিওগ্রাফি নয়, এমনকি সায়েন্সের কোন সাবজেক্টই নয়, ইংরিজি! দ্যাট্স্ স্ট্রেঞ্জ।
আমার নামটা যদি জানতেন স্ট্রেঞ্জ বলতেন না।
কী নাম তোমার?
ফল্গু।
ফল্গু? তাতে কী হল?
এত জিয়োফিজিক্স জানেন, সায়েন্সের নানা ব্যাপারে এত পাণ্ডিত্য, ইণ্ডিয়ানও বটে, কিন্তু রামায়ণ-মহাভারত বিশেষ জানেন বলে মনে হচ্ছে না।
আই অ্যাক্সেপ্ট। সত্যি সত্যিই রামায়ণ-মহাভারত প্রায় জানি না বললেই হয়। ছোটবেলায় ছবিতে রামায়ণ, ছবিতে মহাভারত গোছের দুয়েকটা বই পড়েছি বটে, কিন্তু ফল্গু নামটা কোথাও পেয়েছি বলে মনে করতে পারছি না।
দশরথের মৃত্যুর পর গয়াতে পিণ্ডদান করতে এলেন রাম-লক্ষ্মণ ইত্যাদি, সঙ্গে সীতা, শুরু করলাম গল্পটা। গয়ায় যে বিষ্ণুপাদ মন্দিরে পিণ্ডদান করা হয়, তার ঠিক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে যে নদী, তার পারে বালুচরে সীতাকে বসিয়ে ভাইরা গেলেন নদীতে চান করতে। হঠাৎ সীতার সামনে হাজির দশরথের প্রেতাত্মা, বললেন খিদে পেয়েছে, পিণ্ডদান কর। সীতা বোঝাতে চেষ্টা করলেন নদীতে চান সেরেই তাঁর ছেলেরা এসে নিয়মমাফিক চাল আর তিল দিয়ে পিণ্ডদান করবে। দশরথ নাছোড়বান্দা: আমার খিদে পেয়েছে, তোমার সামনে এত বালি, সেই বালি আমাকে খেতে দাও।
জানেনই তো একেই অতৃপ্ত আত্মা, তার ওপর তখনকার দিনে যখন তখন অভিশাপ দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। ভয় পেয়ে দশরথ যেমনটা বলেছেন তাই করলেন সীতা, আর পাঁচজনকে সাক্ষীও রাখলেন। বটগাছ, গোরু, তুলসী গাছ, ব্রাহ্মণ, আর সামনের ঐ নদী। কিছুক্ষণ পর চানটান সেরে রাম যখন এলেন, তাঁকে পুরো ঘটনাটা বললেন সীতা। রাম বললেন, দূর এ কখনো হয়! রাজচক্রবর্তী দশরথ কিনা খাবেন বালি! সীতা ডাকলেন সাক্ষীদের, বটগাছ ছাড়া কেউ সত্যি কথা বলল না। মিথ্যে যারা বলেছিল রেগেমেগে সীতা তাদের প্রত্যেককে দিলেন অভিশাপ; তার মধ্যে নদীকে বললেন, তুমি মাটির নীচে চলে যাবে, এমন চমৎকার স্রোতস্বিনী হয়ে আর বইতে পারবে না। এই নদীই ফল্গু, সেই থেকে অন্তঃসলিলা।
বাঃ, এক্সেলেন্ট, উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন প্রফেসর চন্দ্রশেখর, দারুণ গল্প তো। তাহলে তো তোমার মোটিভেশনের কারণটা বোঝা গেল, তুমি নিজেই অন্তঃসলিলা নদী, হামজার মতো। ঠিক আছে, তোমার সঙ্গে আলাপ করে ভাল লাগল, এই নাও আমার ব্রাজিলের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর, পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বলবার জন্যে বলছি না, বললেন প্রফেসর, কখনো যদি মনে হয় কোন ব্যাপারে আমি কাজে লাগব, জানিও আমাকে। তিনটে সেল নাম্বার আছে এখানে, কোন-না-কোন একটায় পেয়ে যাবেই। আর ইনভিটেশন রইল তোমার জন্যে ব্রাজিলে আসার। খুব সুন্দর দেশ, খুব মজার মজার মানুষজন, আর সী ফুড যদি ভালবাসো, তাহলে তো স্বর্গ। এলে, একটু আগে থেকে জানিও, ব্রাজিলিয়ন ন্যাশনাল অবজারভেটরির গেস্ট হাউজে ফ্রী অ্যাকোমোডেশন পেয়ে যাবে। আর কী আশ্চর্য, কয়েকমাস পরেই চন্দ্রশেখরের সঙ্গে যোগাযোগের একটা সুযোগ হয়ে গেল। হেসোরাম হুঁশিয়ারের গোমরাথেরিয়াম, ল্যাগব্যাগর্নিশ আর হ্যাংলাথেরিয়ামের কথা মনে আছে? হোস্টেলের রীডিং রূমে একদিন ডেকান হেরাল্ডে একটা ছোট খবর পড়লাম, পৃথিবীর একমাত্র ভারতথেরিয়ামটি খোয়া গেছে।
ভারতথেরিয়াম? হ্যাঃ, তুমি গুল মারছ, মন্তব্য করে মুড়কি। মুড়কির দিকে তাকিয়ে, একটু করুণার হাসি নিঃশব্দে হেসে, হাতের ইঙ্গিতে উল্কি বুঝিয়ে দেয়, অযথা সময় নষ্ট করাস না।
ঠিক তোর মতো মন্তব্য মনে মনে আমিও করেছিলাম ডেকান হেরাল্ডের রিপোর্টারের উদ্দেশে, বুঝলি মুড়কি? কিন্তু ডিটেল পড়ে আমি হাঁ, বলে ফল্গু। জানা গেলো ১৯৮৯ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের নস্কাল নামের এক গ্রামে প্রায় সাত কোটি বছরের পুরোনো তৃণভোজী এক স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিল পাওয়া গিয়েছিল। একে একে কিছুদিন পর পর সেই একই প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেল মাদাগাস্কারের এক গ্রামে, এবং আবার আমাদের দেশে, আরো দু জায়গায়। কর্ণাটকের গোককে, আর মধ্য প্রদেশের কিশলপুরীতে। আর কী আশ্চর্য, কিছুদিন পর এমনকি দক্ষিণ আমেরিকার আর্জেন্টিনা এবং আরো দুয়েকটা জায়গা থেকেও আবিষ্কৃত হলো একই ফসিল। বোঝা গেল সাত কোটি বছর আগে, যে সময় ডাইনোসররা দাপটে ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর নানা জায়গায়, তখন এই তিনটি জায়গাই একই ভূখণ্ডের অংশ ছিল। ১৯৯৭ সাল থেকে দশ বছর ধরে বিজ্ঞানীদের মধ্যে নানারকমের তর্কবিতর্ক আর আলোচনার পর অবশেষে প্রাণীটির নাম দেওয়া হয় ভারতথেরিয়াম বোনাপার্ট। যেহেতু প্রথম ফসিলটি পাওয়া গেছে ভারতে তাই ভারত, আর প্রথম যে বিজ্ঞানী প্রাণীটির সম্পূর্ণ আকৃতির সর্বজনগ্রাহ্য বিবরণ দেন, সেই জোস বোনাপার্টের নাম মিলিয়ে ভারতথেরিয়াম বোনাপার্ট।
এবং তারপর আশ্চর্যের আশ্চর্য, প্রায় অবিশ্বাস্য এক ঘটনা। হঠাৎ একদিন কর্ণাটকের বন্দীপুর ন্যাশনাল পার্কের এক বিট অফিসার ভোরের দিকে জঙ্গলের রাস্তার ধারে আশ্চর্য এক প্রাণী দেখতে পান। অচেনা ছোটখাটো প্রাণীটি প্রায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। অভিজ্ঞ বিট অফিসার প্রাণীটিকে না চিনলেও তাকে প্রায় সদ্যোজাত বলে বুঝতে ভুল করেন না। যত্ন করে তাকে তুলে নিজের অফিসে নিয়ে এসে তিনি যেগুলো স্ট্যাণ্ডার্ড পরিচর্যা, তাই শুরু করেন, এবং তাঁর ঊর্ধ্বতন অফিসারদের খবর পাঠান। সারা পৃথিবীতে খবর চলে যায়, এবং তিন চার দিনের মধ্যেই প্রায় জন পঞ্চাশেক বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানী পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বন্দীপুরে এসে জোটেন। এই তিন চার দিন বন্দীপুর এবং তার সংলগ্ন সমস্ত অঞ্চলে তোলপাড় করে খুঁজেও ঐ জাতীয় আর কোন প্রাণী – ছোট বা বড় – অথবা ডিম জাতীয় কোন খোলসের ভগ্নাংশ পাওয়া যায় না। অনেক আলোচনা, অনেক তর্ক-বিতর্কের পর সমবেত বিজ্ঞানীরা একমত হয়ে একটা লিখিত মত প্রকাশ করেন; অবিশ্বাস্য শোনালেও, বিজ্ঞানীরা একমত যে আবিষ্কৃত এই প্রাণী আর কিছুই নয়, সাত কোটি বছর আগের সেই ভারতথেরিয়াম বোনাপার্ট। ভারতেই পাওয়া গেছে, অতএব অনেক দেশের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও ভারতথেরিয়াম এ দেশেই থেকে যায়।
থেকে যায়, কিন্তু কোথায়? এই খবরটি অতি যত্নে গোপন রাখা হয়, সারা দেশে বোধ হয় তিন-চার জনের বেশি মানুষকে এ তথ্য জানতে দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক স্তরে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যদি অন্তত তিন বছর প্রাণীটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় তাহলে তখন আর একবার ভারতথেরিয়ামের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা হবে।
সেই ভারতথেরিয়াম উধাও? তারপর কীভাবে সেই ভারতথেরিয়ামকে বিশাখাপত্তনমের পোর্ট থেকে সিঙ্গাপুর অভিমুখী এক জাহাজের খোলে উদ্ধার করলাম আমরা চার জনের একটা দল, সেটা তুই উল্কির কাছ থেকে শুনে নিস। দুঃখের কথা এই যে এত বড় একটা কাণ্ড ঘটল, কিন্তু শাস্তি পেল না কেউ। কীভাবে যে প্রাণীটাকে জাহাজে 'বুক' করা হয়েছে, কে করেছে, আর সিঙ্গাপুরে কে সেটা 'রিসিভ' করবে, এক আশ্চর্য ধাঁধার মতো সে রহস্যের কোন কিনারা করা গেল না কিছুতেই। ইন্টারপোল বহু চেষ্টায় একটা লোককে গ্রেপ্তার করল। খুবই সাধারণ লোক, পারাদীপের এক দোকানদার, কিন্তু এক রাত্তিরের মধ্যে কোনরকমের প্রশ্ন করার আগেই, হাই সিকিওরিটি প্রিজনে খুন হয়ে গেলো লোকটা।
আচ্ছা, জেরাল্ড ডারেলের নাম শুনেছিস তুই, হঠাৎ মুড়কিকে প্রশ্ন করে ফল্গু।
এই সদ্য শুনলাম, লজ্জিত লজ্জিত মুখ করে বলে মুড়কি, গত মাসে আমার জন্মদিনে মাই ফ্যামিলি অ্যাণ্ড আদার অ্যানিম্যাল্স নামে একটা বই উপহার পেয়ে, তা-ও সেটা উল্কিদি দিয়েছিল।
হ্যাঁ, দেখলাম তোর এডুকেশনটা ঠিক ঠিক হচ্ছে না, তাই – উল্কি বললো।
যাকগে, পেয়ে তো গেছিস, বলে ফল্গু। এবার তোর গোগ্রাসে গিলতে সময় লাগবে না। আমার যখন তোর মতো বয়েস তখন যে আমি কটা ডারেল পড়েছি বলতে পারবো না, বোধ হয় সেই পর্যন্ত যতগুলো বেরিয়েছে সবই। কিন্তু ১৯৮৯-তে, যখন আমার এগারো বছর বয়েস, একটা মনুমেন্টাল ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। ডারেলকে একটা চিঠি লিখে ফেললাম। সেই থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত, আমৃত্যু, জেরাল্ড ডারেল আমার পেন ফ্রেণ্ড ছিলেন, আর তাঁর মৃত্যুর পর থেকে লী, ডারেলের স্ত্রী। ভারতথেরিয়ামের উদ্ধারের সময় আমাকে নিয়মিত চিঠি লিখতেন লী, টেলিফোনেও কথা বলতেন মাঝে মাঝে। জানিস তো, লুপ্তপ্রায় প্রাণীদের সংরক্ষণের ব্যাপারে জেরাল্ড ডারেল অনেক কাজ করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট যে কাজ তা হলো তাঁর কনজার্ভেশন অ্যাকাডেমি। প্রথমটা জার্সিতে, যেখানে তাঁর স্বপ্নের চিড়িয়াখানা, আর তারপর এক্সটেণ্ডেড অ্যাকাডেমি, মরিশাসে। এই অ্যাকাডেমির ছাত্রছাত্রীরা শুধুই যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কনজার্ভেশন শেখে তা-ই নয়, তারা আজীবন লুপ্তপ্রায় প্রাণীদের বাঁচিয়ে আর বাড়িয়ে তোলার জন্যে লড়াই করতে শেখে। আর জানিস তো এখানকার গ্র্যাজুয়েটদের কী নাম সারা পৃথিবীর প্রকৃতিবিজ্ঞানী আর প্রকৃতিকর্মীদের কাছে? ডারেল আর্মি। ভারতথেরিয়ামকে যখন বিশাখাপত্তনম থেকে উদ্ধার করা হল, তখন এই প্রাণীকে এবার কোথায় রাখা হবে তাই নিয়ে একেবারে আন্তর্জাতিক ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়ে গেল। যদিও প্রথম সুযোগটা আমরাই পেয়েছিলুম, আমরা তো আমাদের অপদার্থতার প্রমাণ ভালভাবেই দিয়েছি। এবার ফীল্ডে নেমে পড়ল আর্জেন্টিনা সহ দক্ষিণ আমেরিকার নানান দেশ আর মাদাগাস্কার। তা ছাড়াও পৃথিবীর বড়লোক দেশগুলো তো আছেই, তাদের তো সব ব্যাপারেই অধিকার! হঠাৎ একটা চিঠি পেলুম লীর কাছ থেকে, চিঠিতে বিশেষ কিছু বলেননি, লিখেছেন তাঁর সঙ্গে যেন টেলিফোনে কথা বলি। চন্দ্রশেখরের সঙ্গে আলাপ হবার পর আমি লীকে লিখেছিলুম চন্দ্রশেখরের কথা। টেলিফোনে লী বললেন ভারতথেরিয়ামকে যদি বাঁচিয়ে রাখতে হয়, চন্দ্রশেখরকে দরকার।
চন্দ্রশেখরকে কেন? প্রকৃতিবিজ্ঞানে ডারউইনের যাত্রা শুরু যেখান থেকে সেটা হলো দক্ষিণ আমেরিকার গ্যালাপ্যাগোস দ্বীপপুঞ্জ, আর এখানকার এক জাতের ছোট ছোট পাখি, ফিঞ্চ। ফার্নান্দিনা আর ইসাবেলা নামে গ্যালাপ্যাগোসের দুটি দ্বীপে সুন্দরবনের সুঁদরী গাছের মতো একরকমের গাছের জঙ্গলে প্রায় চড়াই পাখির মাপের অজস্র এই পাখির সমবেত কিচির মিচির শুনেছিলেন ডারউইন। আজ আর ফার্নান্দিনায় তাদের গলা শোনা যায় না, একটি পাখিও বেঁচে নেই সেখানে। জেরাল্ড ডারেল যখন বেঁচেছিলেন, তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টায় ইসাবেলায় তাদের সংখ্যা বাড়ানো গেছে, ভবিষ্যতে হয়তো ফার্নান্দিনাতেও আবার দেখা যাবে তাদের। ডারেল কনজার্ভেশন অ্যাকাডেমি এই দক্ষিণ আমেরিকাতেই অন্তত পনের-কুড়ি রকমের লুপ্তপ্রায় প্রাণীকে ফিরিয়ে এনেছে। লী মনে করেন ভারতথেরিয়ামকে যদি বাঁচাতে হয়, একমাত্র এই অ্যাকাডেমিই সেটা করতে পারে, আর করতে হবে দক্ষিণ আমেরিকাতেই। আর এ ব্যাপারেই সাহায্য চাই চন্দ্রশেখরের।
লী বললেন, দক্ষিণ আমেরিকায় ব্রাজিল যে সবচেয়ে বড়লোক দেশ শুধু তাই নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী সাত-আটটা দেশের মধ্যে ব্রাজিল অন্যতম। আর গত সাত-আট বছর ধরে এরকম একটা বড়লোক দেশকে এক পয়সারও খনিজ তেল আমদানি করতে হয় না, সবটাই নিজের দেশ থেকে পাওয়া যায়। এত যে তেল, এ উদ্ধারের ব্যাপারে চন্দ্রশেখরের অবদান এক নম্বর। তাই ব্রাজিলের যারা কর্তা ব্যক্তি, তারা যথেষ্ট খাতির করে চলে চন্দ্রশেখরকে। দক্ষিণ আমেরিকার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে মিলে ব্রাজিলও যদি দাবি করে ভারতথেরিয়ামকে দক্ষিণ আমেরিকাতেই নিয়ে আসা হোক, তাহলে দাবিটা জোরদার হবে; এর মধ্যে ব্রাজিল আছে জানতে পারলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও নানা ব্যবসায়িক কারণে সম্ভবত ব্রাজিলের দাবিকে সমর্থন করবে। এ ছাড়াও আরো একটা কথা শুনেছেন লী; চন্দ্রশেখর নাকি পড়াশোনা করেছেন ক্যানাডার য়্যুনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ণ অন্টারিওতে, আর এই য়্যুনিভার্সিটির জুয়োলজি ডিপার্টমেন্টের কথা নাকি ক্যানাডার বন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বেদবাক্য। অর্থাৎ চন্দ্রশেখর যদি তাঁর ছাত্রজীবনের বন্ধুবান্ধবদের কাজে লাগান, তাহলে দক্ষিণ আমেরিকার দাবিটা শুধু দক্ষিণ আমেরিকারই থাকে না, ক্যানাডা আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিলে সমস্ত আমেরিকা মহাদেশের দাবি হয়ে দাঁড়ায়। লী বললেন, ভারতথেরিয়ামকে যদি বাঁচাতে চাও, যে করেই হোক, চন্দ্রশেখরকে বোঝাও।
তুমি কী করলে? – ব্যগ্র প্রশ্ন উল্কি আর মুড়কির।
সেই যে বছরখানেক আগে হায়দ্রাবাদের জিয়োফিজিকাল ইনস্টিট্যুটে আলাপ হয়েছিল প্রফেসর চন্দ্রশেখরের সঙ্গে, ফল্গু বলে, তারপর দুয়েকবার ই-মেলে গ্রীটিংস কার্ড পাঠানো ছাড়া আর কোন যোগাযোগ তো হয়নি, তবুও তাঁর তিনটে সেল নাম্বারের একটায় ফোন করে বসলাম একদিন। তখন তিনি একটা মীটিঙে ব্যস্ত ছিলেন, বললেন ঘন্টা দুই পর তিনি নিজেই ফোন করবেন আমাকে। করলেনও। আর ধৈর্য ধরে সমস্ত ব্যাপারটা শুনলেন, বললেন, চিন্তা কোরো না, ভারতথেরিয়াম দক্ষিণ আমেরিকাতেই আসবে, আর থাকবে ডারেল কনজার্ভেশন ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই। য়্যুনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ণ অন্টারিওর জুয়োলজি ডিপার্টমেন্টের প্রায় সব টীচারই ডারেল অ্যাকাডেমির প্রাক্তন ছাত্র, আর সেই সুবাদে ডারেল আর্মির এক একজন সৈনিক। অ্যাকাডেমির তিন হাজার প্রাক্তন ছাত্রের নেটওয়র্ক তিন দিনের মধ্যেই ফীল্ডে নেমে পড়ল। মাসখানেকের মধ্যেই অন্তত গোটা দশেক আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা, শ'খানেক নামকরা য়্যুনিভার্সিটি, ক্যানাডা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেট বৃটেন আর ব্রাজিল সহ দক্ষিণ আমেরিকার প্রায় সব কটা দেশ মিলে এমন জনমত গড়ে তুললো যে, ব্রাজিলে এক আন্তর্জাতিক সভায় ইউ-এন-ওর সেক্রেটারি জেনারাল ডারেল কনজার্ভেশন ফাউণ্ডেশনের চেয়ারম্যানের হাতে ভারতথেরিয়াম সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র তুলে দিলেন। ভারতথেরিয়ামের দায়িত্ব পেলো তারাই।
তাহলে ভারতথেরিয়াম এখন কোথায়? ব্রাজিলে? – আবার ব্যগ্র প্রশ্ন উল্কি আর মুড়কির।
কোথায়, আমি তা জানিনা, এ প্রশ্ন আমি কোনদিন কাউকে করিনি, আর আমার জানার দরকারও নেই। সারা পৃথিবীতে তিন-চার জনের বেশি এ প্রশ্নের উত্তর জানেনা, তবে সে যে ভালোই আছে, আর দিন দিন তার যে কলেবর বৃদ্ধি হচ্ছে, এর প্রমাণ ডারেল ফাউণ্ডেশনকে মাঝে মাঝেই বিজ্ঞানীদের সামনে দিতে হয়।
ফল্গুদি, আমরা যে ব্রাজিলে যাচ্ছি, সে কি এই ভারতথেরিয়ামেরই কাজে? প্রশ্ন করলো উল্কি।
না, ভারতথেরিয়াম যেখানে আছে, ভালোই আছে, আমরা যাচ্ছি অন্য কাজে। ভারতথেরিয়ামের কাহিনীটা তোদের বললাম অন্য কারণে। চন্দ্রশেখরকে বোঝাবার জন্যে। এই যে চন্দ্রশেখর ভারতথেরিয়ামের সংরক্ষণের জন্যে এত কিছু করলেন, এর ফলে জিয়োফিজিক্সের বাইরে আর একটা ব্যাপারে তাঁর নতুন করে আগ্রহ তৈরি হল, সেটা হলো দক্ষিণ আমেরিকার বন্যপ্রাণী আর তাদের সংরক্ষণ। মনে রাখিস, সারা পৃথিবীতে যত রেনফরেস্ট আছে, তার অর্ধেক শুধুমাত্র দক্ষিণ আমেরিকাতেই, ফলত বনজ উদ্ভিদ আর প্রাণীর এরকম প্রাচুর্য আর কোথাও নেই। ভাবলে অবাক হতে হয় এমন প্রাণী এখনো আছে, যাদের সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায়নি আজও। কাজেই, এগুলোর মধ্যে কোন কোনটা যদি চিরকালের মতো বিলুপ্তও হয়ে যায়, আমরা হয়তো তা জানতেও পারবো না। চন্দ্রশেখর ঠিক করলেন যতগুলো বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থা দক্ষিণ আমেরিকায় কাজ করে, সেটা যে দেশেই হোক, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন তিনি, আর চেষ্টা করবেন তাদের সাহায্য করতে। কয়েকমাস আগে তিনি একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার জানতে পেরেছেন, আর সে ব্যাপারেই কাজে লাগাতে চান আমাদের।
পেরুর জাতীয় পাখির নাম জানিস? প্রশ্নটা হঠাৎ ছুঁড়ে দিল ফল্গু, উল্কি আর মুড়কির মধ্যে বিশেষ কারোর উদ্দেশে নয়।
লজ্জিত মুখ করে মাথা নাড়ল মুড়কি, বললো, বুঝতে পারছি অনেক কিছু জানতে হবে আমাকে এখন। উল্কি বললো, সে তুই ঠিক জেনে যাবি, ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তারপর ফল্গুর দিকে তাকিয়ে হেসে বললো, অ্যাণ্ডিয়ান কক্-অব-দ্য-রক।
অ্যাণ্ডিয়ান কেন? – ফল্গুর প্রশ্ন।
কারণ, আর এক রকমের আছে, গায়ানান কক্-অব-দ্য-রক, তবে দুটোর মধ্যে চেহারায় বিশেষ পার্থক্য নেই। মেয়েদের তুলনায় পুরুষদের চেহারা অনেক আকর্ষক, প্রায় কাকাতুয়ার সাইজের, মাথায় বিরাট বড় অর্ধচন্দ্রাকার ঝুঁটি, গায়ের রং ভোরবেলার সূর্যের মতো, তাতে রোদ লাগলে রং যেন ঠিকরে বেরোয়। এই প্রকট সৌন্দর্যের জন্যে অনেক দূর থেকেও স্পষ্ট দেখা যায়, তার ফলে শিকারী পাখি, যেমন ঈগল বা বাজের হাতে মারা পড়ে অনেকেই।
এক্সেলেন্ট, উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে ফল্গু, দক্ষিণ আমেরিকা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছিস বোঝা যাচ্ছে। এবার শোন্। চন্দ্রশেখর খবর পেয়েছেন যে কিছুদিন ধরে পেরুর জঙ্গলে পুরুষ কক্-অব-দ্য-রক অসম্ভব রকম কমে যাচ্ছে। বনকর্মীরা কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও একেবারেই মৃতদেহ দেখতে পাচ্ছে না। এমনকি কোন পাখিকে শিকারী পাখিরা মারলে ভুক্তাবশেষ যা পড়ে থাকার কথা, যেমন ছেঁড়া পালক-টালক, তারও হদিশ নেই। এই পাখির ডাক রীতিমতো জোর, কেউ যদি জ্যান্ত অবস্থায় চুরি করে, এক-আধবার অন্তত সে ডাক শুনতে পাওয়া উচিত, কিন্তু সে রকমটা শুনেছে বলে কোন বনকর্মীও মনে করতে পারছে না। স্বাভাবিক ভাবেই পেরুর বনদপ্তর বিশেষ উদ্বিগ্ন। এখনই এ ব্যাপারে খুব একটা হৈ চৈ করতে চায় না পেরুর সরকার। চন্দ্রশেখর চাইছেন আমরা একটু চেষ্টা করে দেখি কিছু করতে পারি কিনা। লীর সঙ্গেও কথা বলেছি, উনিও চান আমরা একটু চেষ্টা করি। ঠিক হয়েছে আমরা প্রথমেই পেরুতে যাব না, কলকাতা থেকে ব্রাজিল, সেখানে আমরা থাকবো ব্রাজিলিয়ান ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর অতিথি হিসেবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। এটা কোন দুষ্কৃতি চক্রের কাণ্ড যদি হয়, ন্যাশনাল অবজার্ভেটরীর অতিথিদের চট করে তারা সন্দেহ করবে না।
আর তর সইছে না, এরকম ভঙ্গীতে মুড়কি বললো, আমরা কবে যাচ্ছি ফল্গুদি?
দাঁড়া, এ কি আর কুলু-মানালি বেড়াতে যাওয়া, যে টিকিট কিনেই বেরিয়ে পড়লাম! সবে তো উল্কির পাসপোর্ট করতে দেওয়া হয়েছে, এবার তোরটাও দিতে হবে। সেগুলো করতে কতদিন সময় লাগবে তা পাসপোর্ট অধিকর্তাই জানেন। ভিসায় অবিশ্যি সময় লাগবে না বেশি, ওরা অপেক্ষা করে আছে কবে আমরা পাসপোর্ট পাঠাতে পারব। বাকি যা যা কাজ আমাদের আছে, ইঞ্জেকশন-টিঞ্জেকশন নেওয়া, একটু-আধটু শপিং-টপিং করা, কালই ই-মেলে তার লিস্ট পেয়ে যাব চন্দ্রশেখরের কাছ থেকে। তারপর তোর স্কুলের ব্যাপারটা আছে। আমাদের সময় হলে কোন প্রবলেমই ছিল না, উমাদিকে একবার বললেই কাজ হয়ে যেত। এখন তো আর উমাদি নেই, দেখা যাক্। তবে তুই ঘাবড়াস না, মনে রাখিস তোর আর আমার একই স্কুল!