এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • অন্য দেশের পাখি - ১৫,১৬

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ১৭৫ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: রমিত
    ১৫


    পারে নামতে-না-নামতেই, যেই-না মোবাইল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ হল, তখনই পর পর ফোনের আওয়াজে বোঝা গেল অনেকগুলো মিস্‌ড্‌ কল আছে। মিস্‌ড্‌ কল – প্রফেসর চন্দ্রশেখরের। ফল্গু রিং করে বলল, এখন রাস্তায় আছি স্যর, হোটেলে ফিরে কথা বলব।

    শ্যাভেজকে অনুরোধ করে প্রজেক্ট থেকে ফেরার পথে ওরা চামড়ার মুখোশগুলো ভালো করে আলাদা আলাদা বাক্সে প্যাক করিয়ে এনেছিল, এখন নৌকো থেকে নেমেই গেল কামিলার কাছে। মুখে বলা হচ্ছে বটে মুখোশ, কিন্তু জিনিসগুলো দেখতে খানিকটা একদিক-খোলা ব্যাগের মতো, কিংবা আরো ভালো করে বোঝাতে গেলে টি-পটের ঢাকনা যেমন, যাকে টি-কোজি বলে, সেরকম, যাতে সহজেই মানুষের মাথা দিয়ে গলিয়ে দিলে নেমে আসে একেবারে গলা পর্যন্ত। কামিলার কাছে সারাদিনের কাজের একটা মোটামুটি হিসেব দিয়ে জিজ্ঞেস করে ফল্গু, ফরেনসিক ল্যাব গোছের কিছু আছে এখানে? এই মুখোশগুলো একটু পরীক্ষা করার দরকার ছিল।

    ল্যাব, সে তো আছেই, বলে কামিলা, কিন্তু সেখানে যেতে হলে তো আগে পুলিশকে জানাতে হবে।

    আমার রিপোর্টের দরকার নেই, শুধু জানা দরকার, কী ছিল এই মুখোশগুলোতে যাতে পরাবার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এনে দেয়, দীর্ঘস্থায়ী ঘুম, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে অন্য কোন ক্ষতি হয় না শরীরের।

    কামিলা বলল, আমার সেই ডাক্তার বন্ধু, উল্কির চিকিৎসা করেছিল যে, তাকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি। ফোন লাগাব নাকি?

    ফোনে ডাক্তার বললো, আনঅফিশিয়াল রিপোর্ট একটা করে দেওয়া যেতেই পারে। স্টেট ফরেনসিক ল্যাব-এর এক ডাক্তার ওর বন্ধু।

    কামিলার জিম্মায় মুখোশগুলোকে রেখে হোটেলে ফিরে চন্দ্রশেখরকে পেতে বিশেষ সময় লাগল না। কী প্রোগ্রেস? – জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

    প্রোগ্রেস কিছুই হয়নি স্যর, ফল্গু বলে, তারপর শ্যাভেজ আর কামিলার সঙ্গে কথোপকথন থেকে শুরু করে আজকের প্রজেক্ট ভ্রমণ পর্যন্ত সবই বলে।

    কী করবে তাহলে? – খানিকটা হতাশ গলায় টেনে টেনে জিজ্ঞেস করেন চন্দ্রশেখর।

    যে চার দিন শ্যাভেজের কাছ থেকে সময় নিয়েছি ততদিন পর্যন্ত মুড়কির বাবা-মাকে কিছু জানাব না ঠিক করেছি।

    আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি তোমাদের? আমার মনে হচ্ছে আমিই তোমাদের এরকম একটা ঝামেলার মধ্যে ঠেলে দিলাম।

    তা হয়তো দিলেন, হেসে বলে ফল্গু, কিন্তু এখন ঝামেলার থেকে বেরোবার জন্যে আপনার সাহায্যই দরকার।

    বল, কী সাহায্য করতে পারি।

    আপাতত এসপিণ্ডোলোর সঙ্গে যোগাযোগ করুন, আমার ফোন নম্বরটা দিয়ে দিন ওঁকে। উনিই হয়তো হেল্প করতে পারবেন আমাদের।

    এসপিণ্ডোলো? হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। মানে, ডারেল ফাউণ্ডেশনের এসপিণ্ডোলো তো? কিন্তু, ও কী করবে? ওতো জুওলজিস্ট এসেনশিয়ালি। এসব ব্যাপারে ও কী করতে পারে?

    অ্যামাজনের বিভিন্ন ট্রাইবের সঙ্গে এসপিণ্ডোলোর যোগাযোগ আছে, উনি হয়তো কিছু টিপ্‌স্‌ দিতে পারেন আমাকে।

    ঠিক আছে, বলেন চন্দ্রশেখর, ওকে আজই ফোন করছি। কিন্তু শোন, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের যদি কোন হেল্প লাগে, আমাকে জানাতে দেরি কোরো না। ব্রাজিল নয় শুধু, পেরুরও অনেক ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোককে চিনি আমি।

    সে তো করবই স্যর, ফল্গু বলে, কিন্তু আপাতত, প্লীজ, কোন ইনফ্লুয়েনশিয়াল লোককে বলবেন না আপনি। যখন দরকার হবে, আমিই আপনাকে জানাব।




    ১৬


    দু দিন কেটে গেছে, কোন সুরাহা হল না। তৃতীয় দিনে কামিলার যে ডাক্তার বন্ধু, সে হাতে লেখা একটা রিপোর্ট পাঠিয়ে দিল, রেসিডুয়াল ট্রেসেস অব কোকেইন। এটাই ভাবা ছিল ফল্গুর, রিপোর্ট পেয়ে সে বুঝলো তার চিন্তা ঠিক পথেই এগোচ্ছে। আরও একটা ঘটনা। রাত্তিরবেলা ফোন করেছিলেন এসপিণ্ডোলো। পুরো ঘটনাটা ফল্গুর কাছ থেকে শুনে নিলেন, বললেন, তুমি সম্ভবত ঠিকই ভেবেছ, জঙ্গলেরই কয়েকজন মানুষকে লাগানো হয়েছে তোমাদের বিরুদ্ধে, এখনও পর্যন্ত অপরাধ যা সংঘটিত হয়েছে তা সবই করেছে জঙ্গলের মানুষ, তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তোমরা যাতে জঙ্গলের মানুষের সাহায্য পাও সে দায়িত্ব আমার।

    এ সব ঠিক আছে, কিন্তু, মুড়কির কী হলো? আজই চতুর্থ দিন, আজকের মধ্যে মুড়কির উদ্ধারের ব্যাপারে কোনও ফল না দেখাতে পারলে শ্যাভেজের বন্ধু পুলিশ-চীফের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তার চেয়ে বোধ হয় মুড়কির বাবা-মাকে খবর দিয়ে আনিয়ে নেওয়াই ভালো। ফল্গু নিশ্চিত, সে ক্ষেত্রে মুড়কিকে ফেরৎ পাওয়া যাবে। তবে হ্যাঁ, ওদেরও আর কোন গোয়েন্দাগিরি চলবে না। সোজা বাড়ি!

    ফল্গুরা এখন যে হোটেলটায় আছে সেটার নাম বায়োডাইভার্সিটি হোস্টেল। তাম্বোপাতা ট্র্যাভ্‌লার্স-ইন থেকে মাত্র মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ। ওদের দুজনের জন্যে যে ঘরটা সেটাই বোধ হয় এই হোটেলের সবচেয়ে খারাপ ঘর। কামিলা বুক করে দিয়েছিলেন যেটা, সেটার ভাড়া অনেক বেশি, ওরা নিজেরাই কথাবার্তা বলে অনেক কম খরচের এই ঘরটা নিয়েছে। প্রাইভেট বাথরূম নেই, পাশের আর একটা ঘরের সঙ্গে বাথরূম শেয়ার করতে হয়।

    কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি ফল্গুর। সাফল্য যাকে বলে, তার একটাও আসেনি গত তিন দিনে, বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করতে করতে যখনই চোখ বুজেছে নানা রকমের দুঃস্বপ্ন এসে ভীড় করছে যেন। কখনও কথা বলছে মুড়কির সঙ্গে, কখনও বা মুখোমুখি জঙ্গলের কোন মানুষ, যার হাতে ছোরা, সে আক্রমণ করছে মুড়কিকে, কখনও বা ব্যর্থ-মনোরথ ওরা সবাই মিলে ফিরে যাচ্ছে কলকাতায়। ভোরের আলো জানলার শার্সি ভেদ করে একটু ঢুকতেই উঠে বসলো ফল্গু, পাশের বিছানায় ঘুমোচ্ছে উল্কি। ঘুমোচ্ছে এখন ঠিকই, কিন্তু বিছানার চাদরে সারা রাত ঘুম-না-আসার চিহ্ণ, কুঁচকিয়ে তালগোল পাকিয়ে আছে চাদরটা। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকে ফল্গু, তারপর একটু সঙ্কোচের সঙ্গে ডাকে, উল্কি, ঘুমোলি?

    ঘুমজড়ানো গলা, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেয় উল্কি, কাল রাতে একটুও ঘুমোতে পারিনি, ভোরের দিকে বোধ হয় ঘুম এসে গিয়েছিল। বলতে বলতে উঠে বসে সে। তারপর বলে, মুড়কির কী হবে ফল্গুদি, অ্যাডভেঞ্চারের আশা করে এত দূর এল। ফল্গু দেখে চোখ ছলছল করছে উল্কির, জবাব দিতে পারে না, চুপ করে বসে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে চল্‌ না, ভোরবেলা একটু হেঁটে আসি রাস্তা দিয়ে, ভালো লাগবে।

    উল্কি বিছানা ছাড়ে, বাথরূম থেকে ঘুরে আসে একবার, চুল আঁচড়ায়। ফল্গু বলে, এ কদিন জামাকাপড় নোংরা হয়েছে অনেকগুলো, চল্‌ কাচিয়ে নিয়ে আসি, লণ্ড্রোম্যাটটা তো চব্বিশ ঘন্টাই খোলা থাকে।

    লণ্ড্রোম্যাটের রাস্তা ওদের চেনা, তাম্বোপাতা হোস্টেলকে বাঁ-দিকে রেখে আরও মিনিট দশেক হাঁটতে হয়। ওদিকটা একটু ফাঁকা, খানিকটা এগোলেই জনবসতি পাতলা হতে থাকে। তবুও, এত ভোরেও, দুখানা গাড়ি হু হু করে চলে গেল ওদের পাশ কাটিয়ে।

    কিন্তু খোলা তো নয় লণ্ড্রোম্যাটটা! লণ্ড্রোম্যাটের সামনে পৌঁছে ওরা দেখে রোলিং শাটারগুলো নামানো, দোকানে ওঠবার সিঁড়িটার সামনে যে আলো জ্বলে সেটাও নিভিয়ে দেওয়া আছে।

    উল্কি বলে, কিন্তু তাম্বোপাতার ম্যানেজার তো বলেছিলেন এরা চব্বিশ ঘন্টাই খোলা রাখে, আগে যখন এসেছিলুম, যতদূর মনে পড়ে ম্যানেজার ভদ্রমহিলাও বলেছিলেন একই কথা। ধাক্কা দিই? আওয়াজ করি?

    কর্‌, বলে ফল্গু।

    বিশেষ সময় লাগলো না, হাত মুঠো করে কয়েকবার শাটারের ওপর মারতেই কোণের দিকে একটা ভাঁজ করা দরজা খুলে গেল। প্রথমে শুধু মুখটা, পরে শরীরের অর্ধেকটা বের করলেন সেই ম্যানেজার মহিলা। মুখটা একটু থতমত খেয়ে-যাওয়া। নিয়ম না-মেনে দোকান বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ার অস্বস্তি নাকি? শরীরটা আবার ভেতরে ঢোকাতে ঢোকাতে বললেন, জাস্ট আ মিনিট।

    টিমটিমে আলোয় ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালানোয় মহিলাকে সাহায্য করতে করতে ওরা বোঝে মহিলা ঘুমোচ্ছিলেন না, কাজ করছিলেন। পরনে কোন রাতের পোশাক নয়, রীতিমত ওয়ার্কার্স ওভারঅল, যে কোনাটায় উনি বসেন সে জায়গাটা একটু এলোমেলো, একটা প্লাস্টিকের টুল মেঝেতে খাড়া।

    টুলটার থেকে চোখটা ওপরের দিকে তুলতে তুলতে পাশের ইলেকট্রিক সুইচটা টিপে আলোটা জ্বেলে দেয় ফল্গু, আর সঙ্গে সঙ্গে হেঁড়ে গলার একটা জোরালো আওয়াজে থতমত খেয়ে যায় সে।

    তু এরেস উন ত্রেইদর তু এরেস উন ত্রেইদর তু এরেস উন ত্রেইদর – ক্ষিপ্তপ্রায় এক ঝকঝকে সাদা কাকাতুয়া ফল্গুর দিকে তাকিয়ে।

    একটু দূরে দাঁড়িয়েছিল উল্কি, সে দৌড়ে চলে আসে ফল্গুর পাশে, আঙুল তুলে কাকাতুয়াটাকে বলে, তু এরেস উন ত্রেইদর!

    কাকাতুয়া জবাব দেয়, উস্তে দেস উন মেন্তিরস-অ।

    উস্তে দেস উন মেন্তিরস-অ, উল্কির জবাব।

    এরেস উন তন্ত-অ, ঘাড় ঘুরিয়ে কাকাতুয়া জবাব দেয়।

    এরেস উন তন্ত-অ, বলে উল্কি একবার, একবারই শুধু, আর জবাব দেয় না, ফল্গুর দিকে তাকিয়ে হাসে। কাকাতুয়াটা আপন মনে বলে চলে, এরেস উন তন্ত-অ এরেস উন তন্ত-অ এরেস উন তন্ত-অ......!

    উল্কি বলে, আমার মতই স্প্যানিশের জ্ঞান ওটার, আর বেশি কিছু জানে না, ওই একই কথা বলে চলেছে।

    একটু দূরে দাঁড়িয়ে মহিলা, হাসি হাসি মুখে ওদের দিকে তাকিয়ে, ভাবটা, কেমন দিলাম!

    উল্কি বলে, কাকাতুয়াটা বিদ্যে একেবারে উজাড় করে দিল, যা জানে সব বলে গেল পরপর।

    সে তো হল, কিন্তু কথাগুলোর মানে কী? – জিজ্ঞেস করে ফল্গু।

    প্রথমেই ও চেঁচাচ্ছিল যে কথাটা বলে – তু এরেস উন ত্রেইদর – ওটার মানে হলো, য়্যু আর আ ট্রেটর, তুমি বিশ্বাসঘাতক! ওর কথাটাই যখন আমি ফিরিয়ে দিলুম ওকে, ও প্রতিবাদ করে বললো, উস্তে দেস উন মেন্তিরস-অ, তুমি মিথ্যুক, য়্যু আর আ লায়ার! আমিও যখন মিথ্যুক বললুম ওকে, ও জবাব দিল, তুমি একটা বোকারাম, এরেস উন তন্ত-অ, য়্যু আর আ ফূল!

    হেসে ফেলে ফল্গু, মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে, কে শেখালো ওকে এসব? আপনি?

    না, আমি নই, আমি এসব শেখাতে পারি না, বলেন মহিলা, এরকম শেখা অবস্থাতেই এসেছে ও।

    কোথা থেকে এল?

    কোথা থেকে আসবে আবার? – বিরক্ত মহিলার গলাটা বেশ জোর হয়ে যায়, সাপ্লায়ারের কাছ থেকে!

    কয়েক সেকেণ্ড কথা বলে না ফল্গু, তাকিয়ে থাকে মহিলার দিকে একদৃষ্টিতে। এর পর কথা বলে যখন, মনে হয় ওর গলায় যেন একরাশ বরফ ঢেলে দিয়েছে কেউ, যা জিজ্ঞেস করছি উত্তেজিত না হয়ে জবাব দিন, না হলে অসুবিধেয় পড়ে যাবেন। সাপ্লায়ার কে? কোথা থেকে এল কাকাতুয়াটা?

    মহিলার গলা শুনে মনে হলো না তিনি ঘাবড়েছেন একটুও। বললেন, আমি লণ্ড্রোম্যাটের ম্যানেজার, পাখি আমি পুষি না। মালিক পাখিটা রেখে দেয় এখানে। এটা মাসখানেক আগে এসেছে, খাঁচায় আছে, এটুকুই আমি জানি।

    মাসখানেক? – বিস্মিত ফল্গু বলে, আপনার স্মরণ শক্তি খুব একটা ভালো নয় ম্যাডাম, আট-দশদিন আগে আমি নিজে এখানে এসেছিলাম, আপনার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করেছি, তখন পাশাপাশি দুটো খাঁচায় দুটো কাকাতু্য়া ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল ঘুমোচ্ছে, ঠিক যেমন – হাতটা তুলে পাশের খাঁচার কাকাতুয়াটাকে দেখায় ফল্গু – ঠোঁটটা বুকের মধ্যে গুঁজে দেওয়া কাকাতুয়াটা ঠিক আগের দিনের মতোই একই ভঙ্গিতে ঘুমোচ্ছে বলে মনে হয় – ওইটা! দুটোই তখন ঘুমোচ্ছিল, একটা এখন নেই, তার বদলে চনমনে এই বাক-পটিয়সী কাকাতুয়াটা! এখনও বলবেন ওটা এক মাস আগে এসেছে!

    আপনার সঙ্গে আট-দশদিন আগে কী কী কথাবার্তা হয়েছিল, জবাব এল মহিলার কাছ থেকে, তার সবটাই আমার মনে আছে। এখন যেটাকে এত কথা বলতে দেখছেন, ওটাও তখন ঘুমোচ্ছিল, এখন ঘুম ভেঙে উঠে কথা বলছে, এতে এত অবাক হবার কিছু নেই। এখন যেটা ঘুমোচ্ছে, হয়তো কাল এলে সেটাকেও কথা বলতে দেখবেন।

    হয়তো কাল এলে সেটাকেও কথা বলতে দেখব, বিড়বিড় করতে করতে পকেট থেকে ছোট একটা ক্যামেরা বের করে ফল্গু, পটাপট ছবি তুলতে থাকে কাকাতুয়া দুটোর, তাছাড়া আরও দুয়েকটা জিনিসের, থরে থরে সাজানো ওয়াশিং মেশিনগুলোরও, এমনকি মহিলার ছবিও বাকি থাকে না, আর মুখে বলতে থাকে যতগুলো ছবি তুলছি প্রত্যেকটার সঙ্গে আপনার লণ্ড্রোম্যাটের কোন-না-কোন অংশের ছবিও উঠছে, সঙ্গে তারিখ আর সময়, ফটোশপের কারচুপি বলে দাবি করতে পারবেন না কখনও!

    আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন – রুখে ওঠেন মহিলা – এবার আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হব।

    আপনাকে বাধ্য করতেই চেষ্টা করছিলুম, পুলিশই চাই, পুলিশের সামনেই সমস্ত কথাবার্তা হওয়া ভালো। এখন পুলিশ ডাকুন বা না ডাকুন এই প্রশ্নের উত্তরটা তো দিন প্লীজ। দুটো যখন ঘুমন্ত কাকাতুয়া দেখেছিলুম, তাদের দুটোকেই একই রকমের দেখাচ্ছিল। সাদা কাকাতুয়া, সাদা কিন্তু মলিন সাদা। অথচ এখন পাশাপাশি এই দুটোকে দেখুন তো, যেটা এখন আর ঘুমোচ্ছে না, বকবক করছে, সেটার সাদা যেন বসন্ত পূর্ণিমার চাঁদের কাছ থেকে ধার করা সাদা, তাই না? অথচ আগেরটাকে দেখুন, সাদা জার্সি-পরা ফুটবল প্লেয়ারের হাফ-টাইমের জার্সি যেন, ঠিক? কীভাবে এই দুঃসাধ্য শক্তি আয়ত্ব করলেন, ম্যাম? নতুনটাকে আপনার এই লণ্ড্রোম্যাটের বেস্ট ওয়শিং মেশিনে কেচেছেন নাকি?

    এটুকু বলেই উল্কির দিকে ফেরে ফল্গু, দেখিস উল্কি, যেমন-তেমন মেশিনে কাচতে যাস না কাপড়গুলো, পনেরোটার মধ্যে যেটা এখানকার বেস্ট, সেই ওয়শিং মেশিনটা খুঁজে বের করতে হবে তো সবার আগে।

    মহিলার মুখটা কেমন যেন পালটিয়ে যায় হঠাৎ, বলেন, এই ভোরবেলায় কেন অনর্থক ঝামেলা করতে এলেন আপনারা জানি না। আপনার কী কী প্রশ্ন আছে জিজ্ঞেস করুন, আমি জবাব দিয়ে দিচ্ছি, জামাকাপড় আর কাচতে হবে না আপনাদের।

    সহজ প্রশ্ন, একটুও যেন সময় নষ্ট করতে রাজি নয় এমন ভঙ্গিতে বলে ফল্গু, সাপ্লায়ার। আপনার ওই কাকাতুয়ার সাপ্লায়ারের ঠিকানাটা জানতে চেয়েছিলুম।

    অল মিরাদর দ্য লা বায়োডাইভার্সিদাদের নাম শুনেছেন আপনারা, মহিলা যেন জিজ্ঞেস করেন, এখানকার লোকরা যেটাকে বলে ওবেলিস্কো? ওই ওবেলিস্কোতে একটা ছোটখাটো মিউজিয়াম গোছের আছে। সেখানে গেলেই খোঁজ পেয়ে যাবেন সাপ্লায়ারের।

    থ্যাঙ্ক য়্যু ম্যাম, বলেই উল্কির হাত ধরে হন হন করে বেরিয়ে যায় ফল্গু।

    বেরিয়েই উল্কি জিজ্ঞেস করে, তুমি শুধুমাত্র এই খবরটুকু জানার জন্যে এতটা সময় নষ্ট করলে?

    এই খবরটুকু? আরে দূর, তুই কি পাগল নাকি! – বলে ফল্গু – এ খবরটা তো কোন ব্যাপারই নয়, এটা দিয়ে তো উনি হাঁফ ছাড়লেন। মহিলার অতগুলো ওয়শিং মেশিনের মধ্যে জেনে রাখিস একাধিক মেশিন শুধু্মাত্র দেখাবার জন্যে, বাইরে থেকেই ওয়শিং মেশিন, আসলে মেশিনগুলোতে কাপড় কাচা হয় না, যা হয় সেটা উনি গোপন রাখতে চান। বেস্টটা খুঁজে বের করবো বলতেই উনি ভয় পেলেন যে এবার আমি একটা একটা করে ওয়শিং মেশিন পরীক্ষা করব, হয়তো ছবিও তুলে নেব – আমাকে তাড়াবার জন্যে সাপ্লায়ারের খবরটা অক্লেশে দিয়ে দিলেন অতএব! আমার মনে হয় না উনি নিজেও ভেবেছিলেন এত সহজে কাজ হবে।

    উনি নিজেই যখন ভেবেছিলেন এত সহজে কাজ হবে না, তাহলে এত সহজে তুমিই বা মেনে নিলে কেন?

    আমার যা যা জানার ছিল তা তো জানা হয়ে গেছে; অন্তত একটা কাকাতুয়া আট-দশদিন ধরে একটানা ঘুমিয়ে চলেছে কিন্তু মরেনি, মরলে এতদিনে পচে গন্ধ বেরোতো, তা ছাড়া প্রয়োজন ছিল আরও একটা ব্যাপারে কনফার্মেশন: লণ্ড্রোম্যাটটা একটা আই-ওয়শ, মেশিনগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই অন্য কাজে ব্যবহার হয়।

    তাহলে ওই কাকাতুয়ার সাপ্লায়ারের ঠিকানাটা আদৌ জানতে চেয়েছিলে কেন?

    আমি জানতুম, জানতে চাইলে উনি বলতে চাইবেন না, ওটাই সাধারণ অ্যাটিট্যুড! তখন উনি ভেবেও দেখবেন না যে, কেউ যদি সত্যিই ইন্টারেস্টেড হয় তার পক্ষে সাপ্লায়ারের ঠিকানা পাওয়াটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। ওঁর পনেরোটা মেশিনের রহস্য যখন উনি নিজেই, অলমোস্ট, কনফার্ম করলেন, তখনই তো আমার যা কাজ তা হয়ে গেল। কাজেই আমাদের মীটিংটা শেষ করার জন্যে আমার পক্ষে সবচেয়ে সুবিধেজনক বার্গেন ছিল সাপ্লায়ারের ঠিকানা! আমিও বেরিয়ে আসতে পারলুম, উনিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন!

    এইটুকু কথা হয়েছে, এমন সময় উল্কি হঠাৎ ফল্গুর বাঁ হাতটা ডান হাতে চেপে ধরে নিঃশব্দে নিজের বাঁ হাতের তর্জনীটা তুলে ধরে। উল্টো দিক থেকে দৌড়িয়ে ওদের দিকে আসছে যে লোকটা তার মাথাজোড়া টাক, পরনে প্যান্ট আর বুশ-শার্ট। লোকটা দুহাত প্রবল বেগে নাড়িয়ে ওদের থামতে বলছে। যদিও আগে কখনও সামনাসামনি দেখেইনি লোকটাকে – পিছন থেকে বুশ-শার্ট প্যান্ট পরা একটা টাকমাথা লোককে দেখেছে অনেকবার – তবুও উল্কি আর ফল্গু দুজনেই নিঃসন্দেহ যে এ লোকটা সেই আগের লোকটাই। ফল্গু ডান-হাতের পাতাটা মেলে ধরে লোকটাকে আশ্বস্ত করতে যায়, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মাথা পেরিয়ে তীক্ষ্ণ হাওয়া-কাটা শব্দে একটা কিছু অতি দ্রুত এসে আমূল গেঁথে যায় লোকটার বুকে। আর্তনাদের সময়ও পায়না লোকটা, চিৎ হয়ে পড়ে যায় রাস্তার ওপরে, বুকে-গাঁথা তীরটা খাড়া দাঁড়িয়ে একটা ফ্ল্যাগের মতো, বুশ-শার্টটা ততক্ষণে লাল। পকেট থেকে ক্যামেরাটা বের করে দ্রুত দুটো ছবি তোলে ফল্গু, তারপর পা-চালিয়ে উল্কির হাত ধরে সোজা বায়োডাইভার্সিটি হোস্টেল।



    চলবে ---
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০২ নভেম্বর ২০২৪ | ১৭৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০২ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩৭539052
  • বাপ রে এ যে রহস্যের খাসমহল। আবার এক সপ্তাহ অপেক্ষা।
  • Kishore Ghosal | ০২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৩539062
  • তির বিদ্ধ মানুষ - ওয়াশিং মেসিনে রহস্য - কিন্তু মুড়কির দেখা নেই। অবস্থা পুরো জটায়ুর মতো ভ্যাবাচ্যাকা...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন