সেমিনার শেষ হবার পরেও থেকে গিয়েছিলেন চন্দ্রশেখর, ফল্গুদের সঙ্গে আর একবার দেখা না করে রিওতে ফেরার ইচ্ছে ছিল না তাঁর। পরের দিন সকালবেলায় য়্যুনিভার্সিটি রেস্টোর্যান্টে ব্রেকফাস্টের সময় দেখা হয়ে গেল তাঁর সঙ্গে, খানিকটা আশাহত এবং অবাক হয়ে শুনল ওরা এসপিণ্ডোলো চলে গেছেন ভোরবেলাতেই, এমনকি ব্রেকফাস্ট না করেই। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের কাছ থেকে শুনে নিলেন চন্দ্রশেখর ওদের জঙ্গল আর আক্রে ঘোরার অভিজ্ঞতার কথা, মুড়কির কিং ভালচার পোষবার সখের কথাটা শুনে হাসলেন খুব একচোট।
কী প্ল্যান তোমাদের আজ? – জিজ্ঞাসা করলেন চন্দ্রশেখর।
ভাবছি আজই রওনা দিলে কেমন হয়? – ফল্গুর জবাব।
আজই? কেন, এত তাড়া কিসের?
এখানে বসে সময় নষ্ট করে লাভ কী, যত তাড়াতাড়ি পুয়ের্তো ম্যালডোনাডোতে পৌঁছোন যায় ততই তো ভালো।
সেটা ঠিক, কিন্তু আমি যতদূর জানি পরশুর আগে ফ্লাইট পাবে না তোমরা। ম্যালডোনাডো বোধ হয় সরাসরি কনেক্টেড নয়, তোমাদের প্রথমে যেতে হবে কাস্কো, সেখান থেকে ম্যালডোনাডো বাই রোড। আর কাস্কোর ফ্লাইট তো সপ্তাহে তিনদিন।
কিন্তু স্যর, ফ্লাইট নেব কেন আমরা, আমরা তো ভাবছিলাম, মানে, বাস-ট্যাক্সি-ফেরী সার্ভিস, এ সব তো আছেই! – এবার কথা বলল উল্কি।
আছে নাকি? হেসে বললেন চন্দ্রশেখর, জানলে কী করে?
এবার মুড়কির কথা বলার পালা। বলল, গুগ্ল্ করে জেনে নিয়েছি তো রাস্তা।
জেনে নিয়েছ? কীভাবে যাবে?
ঐ যে আমরা আক্রে স্টেটে গিয়েছিলাম কাল, সেখানেই ফিরে যেতে হবে আবার, আক্রের রাজধানী রিও ব্র্যাঙ্কোতে। যাওয়ার জন্যে বাস পাওয়া যায়, মাঝে মাঝে পাওয়া যায় কালেক্টিভোও, মানে শেয়ার ট্যাক্সি। সেখান থেকে আসিস ব্রাসিলি নামের একটা ছোট জায়গায়। এই জায়গাটায় সম্ভবত রাতটা কাটাতে হবে আমাদের। ছোট হলেও এটা একটা ম্যুনিসিপালিটি টাউন, কাজেই ছোট-খাটো থাকার জায়গা পেয়ে যাওয়া উচিত। পরের দিন সকালে আক্রে নদী পেরিয়ে ইনাপারি। নদীর ওপারটাই পেরু, কাজেই ইনাপারি পেরুতে। আসলে, আসিস ব্রাসিলিতে রাত না কাটিয়েও আক্রে নদীর ওপরে যে ব্রিজ তৈরি হয়েছে ট্রান্সওশিয়ানিক হাইওয়ে দিয়ে ব্রাজিল আর পেরুর মধ্যে যোগাযোগের জন্যে, সেটা দিয়ে রাত্তিরের মধ্যেই আমরা ইনাপারিতে পৌঁছিয়ে যেতে পারতাম, কিন্তু সেটা আমাদের ইচ্ছে নয়। আমরা ফেরিতে নদীটা পেরোবো। আর ইনাপারি থেকে তো সোজা! কালেক্টিভো, মিনি বাস, এসবের অভাব নেই পুয়ের্তো ম্যালডোনাডো যাওয়ার জন্যে।
এক্সেলেন্ট, উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন চন্দ্রশেখর, তুমি তো দারুণ স্মার্ট।
উৎসাহ পেয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে মুড়কি বলল, আমি একটা রাফ রূট ম্যাপও এঁকেছি, দেখবেন নাকি?
কৈ, দেখি।
ম্যাপটা আগ্রহ নিয়ে দেখলেন চন্দ্রশেখর, তারপর বললেন, তোমার প্ল্যানটা মন্দ নয়, তবে ছোট একটা অ্যামেণ্ডমেন্ট প্রোপোজ করব আমি, করতে পারি?
বলুন না, এবার গলাটা ফল্গুর।
আমি বলব আসিস ব্রাসিলিতে রাত না কাটিয়ে রাতটা তোমরা রিও ব্র্যাঙ্কোতেই কাটাও। রাজধানী হলেও নিজেদের চোখেই তো দেখেছ শহরটা কেমন, সেখানে তো একটা রাত কাটিয়েছ তোমরা। আমার মনে হয়, যতই ম্যুনিসিপালিটি টাউন হোক, রাত কাটানোর জন্যে আসিস ব্রাসিলি প্রপার হবে না, তোমরা তিনটে মেয়ে অসুবিধেয় পড়ে যেতে পার। বরঞ্চ রিও ব্র্যাঙ্কো থেকে ভোরবেলা বেরিয়ে আসিস ব্রাসিলি চলে যেও। অত সকালে যদি অন্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না-ও পাও, একটা গাড়ি ভাড়া করতে পারবেই। প্রচুর বাইরের লোক আসে রিও ব্র্যাঙ্কোতে, ভাড়ার গাড়ির অভাব হবে না।
ফল্গু বললো, হ্যাঁ এটা তো ভাল আইডিয়া, কিন্তু আপনাকে একটা ট্রাব্ল্ দেবো স্যর।
কী বলো।
আমাদের লাগেজ-টাগেজগুলো আপনার জিম্মায় রেখে যেতে চাই, আমরা তিনজন তিনটে ব্যাক-প্যাক কিনে নেব এখানকার বাজার থেকে। ব্যাক-প্যাকের অনেক সুবিধে, সবচেয়ে বড় কথা বাজেট-ট্যুরিস্টের ওটাই ট্রেড মার্ক, কেউ অন্য কোন সন্দেহ করবে না।
ভালো আইডিয়া, তবে লাগেজ রাখতে হবে অ্যালবার্ট পেরীরার জিম্মায়, আমার নয়। পেরীরা আজ তোমাদের সঙ্গে দুপুরে খাবে বলছিল, তখন একবার কথাটা পেরো, অসুবিধে হবে না। আর একটা কথা। তোমরা তিনটে সেলফোন কিনে নাও, লোকাল একটা কনেকশন থাকা ভাল। আমি টেলিব্রাসের একটা ছেলেকে বলে রেখেছি, তোমরা ইনস্ট্রুমেন্ট কিনে জানালেই এসে সিম-টিম যা দেবার দিয়ে যাবে।
ব্রেকফাস্টের পর ওরা বাজারে বেরিয়ে গেল ব্যাক-প্যাক আর সেলফোন কিনতে। চন্দ্রশেখর একটা গাড়ি দিয়ে দিতে চাইছিলেন, ওরা রাজি হল না, বললো নিজেরাই যাবে পায়ে হেঁটে আর বাস-টাসে।
গেস্ট হাউজে ফিরে মিসেস ফার্নাণ্ডেজকে জানিয়ে দিল ফল্গু ওরা ফিরে এসেছে, আর আজই চলে যাবে দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে, ওদের ফেরার খবরটা যেন প্রফেসর পেরীরাকে পাঠিয়ে দেন উনি। সাড়ে বারোটার সময় পেরীরা এসে সোজা ঢুকলেন ওদের ঘরে, বললেন চল, রেস্টোর্যান্টে যাওয়া যাক।
খেতে খেতে ওদের ম্যালডোনাডো যাওয়ার প্ল্যানটা শুনে খুবই উৎসাহ দিলেন পেরীরা, বললেন এই তো চাই। শুধুমাত্র ইংরিজি ছাড়া অন্য কোন ভাষা না জেনে এতটা রাস্তা যখন যাবে তোমরা, তা-ও মূলত আক্রের মতো ট্রাইবাল এরিয়া দিয়ে, এখানে কাজ চালাবার জন্যে একটা ওয়র্কিং স্ট্র্যাটেজি নিজে নিজেই তৈরি হয়ে যাবে তখন। তারপর মুড়কিকে টীজ করে বললেন, শুনলাম মুড়কিই লিডারশিপ দিচ্ছে তোমাদের, ওর প্ল্যান অনুযায়ীই তোমরা যাচ্ছ এই রাস্তা দিয়ে।
উল্কি বললো হ্যাঁ, মুড়কিই গুগ্ল্-টুগ্ল্ করে রূট-প্ল্যানটা বানাল।
সে আমি ওকে দেখেই ভেবেছিলাম ও-ই তোমাদের মধ্যে লিডার মেটিরিয়াল, দেখ না, তোমাদের মধ্যে দুজনের মাত্র একটা করে নাম, মুড়কির নাম কিন্তু দু-দুটো!
তারপর মুড়কির দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বললেন, একটা ব্যাপারে কিন্তু আমার অবজেকশন আছে মুড়কি। শুনলাম তুমি নাকি আমাদের দেশ থেকে একটা বিরাট বড় পাখি নিয়ে চলে যাচ্ছ!
মুড়কি সুযোগ পেয়ে গেল, বললো বিরাট বড় পাখি নিয়ে যাচ্ছি না, নিয়ে যাচ্ছি একটা পুচকে পাখি, তারপর সেটা বিরাট বড় হবে কলকাতার জল হাওয়ায়!
ওয়েল, তুমি কি মনে করো পাখিটা বড় হলে তোমার কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হয়ে যাওয়ার চান্স আছে?
মেয়র কেন?
বা রে, এত বড় পাখিটা একাই তো সাবাড় করে দেবে কলকাতার যাবতীয় ময়লা, দেখতে যতই সুন্দর হোক্, ওটা তো আসলে একটা ভালচার, মানে শকুন, স্ক্যাভেঞ্জার হয় তো ওরা।
আপনারও দেখছি শকুন সম্বন্ধে সুপারস্টিশন আছে, আমি যদি খাঁচায় রেখে পেট-ভরা খাবার দিই ওকে, তাহলে ময়লা খাবে কেন? রাস্তার কুকুর তো ময়লা খায়, বাড়িতে পোষা কুকুর খায় নাকি?
ঠিক ঠিক, তোমারই জয়, আমিই হারলাম। তাহলে এবার তোমার সাপোর্টে একটা কথা বলি। তুমি একা নও, কিং ভালচারের রং দেখে মুগ্ধ হয়েছে অনেকেই। এর রং এতই সুন্দর যে, আঠেরো শতকে মেক্সিকোয় এই পাখির নাম ছিল পেন্টেড ভালচার, এর ছবিও এঁকেছেন অনেকে। আর দক্ষিণ আমেরিকার পৌরানিক কাহিনীতে বলা হয় শকুন নয়, আসলে কিং ভালচার সত্যি সতিই রাজা ছিল, আর অনেক ওপরে উড়তে পারত তো, তাই লোকে বিশ্বাস করত ভগবানের কাছ থেকে মানুষের জন্যে বার্তা নিয়ে আসত এরা।
খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে গেস্ট হাউজে মিসেস ফার্নাণ্ডেজকে ওদের লাগেজগুলোকে আলাদা করে রাখতে বলে নিজে ড্রাইভ করে বাস স্টেশনে ওদের পৌঁছে দিলেন অ্যালবার্ট পেরীরা। ওঁর নিজের কাঁধে একটা কিট-ব্যাগ গোছের ব্যাগ ছিল, বাসে ওঠার আগে সেটা খুলে তিনটে বাক্স বের করলেন উনি, তারপর ওদের তিনজনের হাতে এক-একটা বাক্স তুলে দিয়ে বললেন, আজ রাত্তিরে কখন পৌঁছোবে বলা যায় না, কোথায় খাবার-দাবার পাবে কে জানে! এই পার্সেলগুলোয় আছে শুকনো মাংস আর পিটা, তোমাদের রাত্তিরের খাবার! যতক্ষণ না রিও ব্র্যাঙ্কোর বাস ছাড়ে, অপেক্ষা করলেন পেরীরা। বাস ছাড়লে ডান হাতের বুড়ো আঙু্লটা তুলে বললেন, হ্যাপি অ্যাডভেঞ্চার!