বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যখন পনেরো বছরের রিপোর্ট কার্ড বের করেন, তখন বুঝতে হবে নির্বাচন কাছে এসে গেছে। আমরা বাঙালিরা রিপোর্ট কার্ড দেখতে ভালোবাসি—স্কুলে ছেলেমেয়েদের, সরকারের, এমনকি প্রতিবেশীর বউয়ের রান্নার। এবার সাত হাজার কোটি টাকা থেকে বাষট্টি হাজার কোটি টাকা—সংখ্যাটা শুনলে মনে হয় আমরা সিঙ্গাপুরে আছি। কিন্তু হাসপাতালে গেলে এখনও সিরিয়াল পেতে রাত জাগতে হয়, স্কুলে বাচ্চাদের বেঞ্চ নেই, রাস্তায় গর্ত আছে যেখানে পুকুর বানানো যায়। তবু আমরা বিশ্বাস করি। কারণ বিশ্বাস না করলে আমাদের আর কী-ই বা আছে?
চুরানব্বইটা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প—এই সংখ্যাটা শুনে মনে হয় আমরা প্রত্যেকে একেকটা প্রকল্পের ভাগীদার। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, কৃষক বন্ধু—এই নামগুলো শুনলে মনে হয় দেবী লক্ষ্মী নিজে এসে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে যে হাজার টাকা পাই, তা দিয়ে এক কুইন্টাল চাল কেনা যায় না। তবু আমরা খুশি, কারণ টাকা তো পাচ্ছি। সরকার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তারা আছে, আমরা ভুলে যাচ্ছি যে আমরা কর দিচ্ছি। এই খেলাটা দুপক্ষই খেলছি সমান উৎসাহে।
স্বাস্থ্য আর শিক্ষায় বিশেষ নজর—এই কথাটা শুনলে হাসি পায়। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, কিন্তু বরাদ্দ বেড়েছে। বরাদ্দ বেড়েছে মানে কাগজে সংখ্যা লেখা হয়েছে, বাস্তবে কোথায় গেছে তা আমরা জানি না। তিরিশটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, কিন্তু চাকরি কোথায়? ছেলেমেয়েরা পাস করে বেরিয়ে রিকশা চালাচ্ছে, কেউ কেউ অটো। শিক্ষা বেড়েছে, কিন্তু ভবিষ্যৎ নেই। এই অসঙ্গতিটা আমরা মেনে নিয়েছি, কারণ আমরা বাঙালি। আমরা অসঙ্গতি নিয়েই বাঁচি—সকালে রবীন্দ্রসংগীত শুনি, দুপুরে দুর্নীতি করি, সন্ধ্যায় ফেসবুকে নৈতিকতার পাঠ দিই।
পথশ্রী প্রকল্পের নাম শুনলে মনে হয় রাস্তাগুলো শ্রীযুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে যে রাস্তা দিয়ে যাই, তাতে গাড়ির সাসপেনশন ভেঙে যায়, হাড়গোড় কাঁপে। বাংলার বাড়ি—নামটা সুন্দর, কিন্তু যারা বাড়ি পাওয়ার কথা, তারা এখনও তালিকায়। তালিকা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমরা তালিকা বানাতে পারি, তালিকায় নাম তুলতে পারি, কিন্তু তালিকা থেকে কাজ বের করতে পারি না। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।
নগদ অর্থ সহায়তা—এই কথাটা বলার সময় সরকার যেন আমাদের দাতা, আমরা যেন ভিক্ষুক। আমরা ভুলে যাই যে এই টাকা আমাদেরই। কিন্তু যখন হাতে পাঁচশো-হাজার টাকা আসে, তখন মনে হয় বিরাট উপকার হয়ে গেছে। আমরা কৃতজ্ঞ, আমরা ভোট দিই। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবসা—আমাদের নিজেদের টাকা আমাদেরই ফেরত দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ বানানো।
রিপোর্ট কার্ডে যা লেখা নেই, সেটাই আসল কাহিনী। বেকারত্ব, দুর্নীতি, দলীয় সন্ত্রাস, আইনের শাসনের অভাব—এসব কথা রিপোর্ট কার্ডে থাকে না। রিপোর্ট কার্ডে শুধু ভালো নম্বর দেখানো হয়, ফেল করা বিষয়গুলো লুকিয়ে রাখা হয়। আমরা বাঙালিরাও এই খেলা বুঝি, কিন্তু মানি। কারণ আমরা সুবিধাবাদী। আমরা জানি যে অন্য দল ক্ষমতায় এলেও একই কাণ্ড হবে, তাই বর্তমানটাকেই মেনে নিই।
পনেরো বছরে চুরানব্বইটা প্রকল্প মানে বছরে প্রায় ছয়টা। প্রকল্পের সংখ্যা দিয়ে কি উন্নয়ন মাপা হয়? হাজারটা প্রকল্প থাকলেও যদি একটাও ঠিকমতো না হয়, তাহলে কী লাভ? কিন্তু আমরা সংখ্যা পছন্দ করি। সংখ্যা দেখলে আমাদের মাথা ঘুরে যায়, বুদ্ধি লোপ পায়। হাজার কোটি টাকা, লাখ মানুষ, শত প্রকল্প—এসব শুনলে আমরা ভাবি বিরাট কিছু হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন হলো, সেটা ভাবি না।
এই রিপোর্ট কার্ড আসলে আয়না নয়, মুখোশ। এটা দেখায় যা দেখাতে চায়, লুকায় যা লুকাতে চায়। আর আমরা বাঙালিরা সেই মুখোশটাকেই আয়না ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দিই। এটাই আমাদের নিয়তি। আমরা সত্য জানি, কিন্তু মিথ্যায় বিশ্বাস করি। কারণ মিথ্যা সুন্দর, আরামদায়ক। সত্য কঠিন, অস্বস্তিকর। তাই আমরা মিথ্যার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি, আর স্বপ্ন দেখি উন্নয়নের।
– বেসরকারি দপ্তরের "অ-ভাইরাল" কর্মচারী
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।