এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বাঙালীর বঙ্গদর্শন, মার্কশিট সমেত

    হারামির হাতবাক্স লেখকের গ্রাহক হোন
    ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৭৮ বার পঠিত
  • বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যখন পনেরো বছরের রিপোর্ট কার্ড বের করেন, তখন বুঝতে হবে নির্বাচন কাছে এসে গেছে। আমরা বাঙালিরা রিপোর্ট কার্ড দেখতে ভালোবাসি—স্কুলে ছেলেমেয়েদের, সরকারের, এমনকি প্রতিবেশীর বউয়ের রান্নার। এবার সাত হাজার কোটি টাকা থেকে বাষট্টি হাজার কোটি টাকা—সংখ্যাটা শুনলে মনে হয় আমরা সিঙ্গাপুরে আছি। কিন্তু হাসপাতালে গেলে এখনও সিরিয়াল পেতে রাত জাগতে হয়, স্কুলে বাচ্চাদের বেঞ্চ নেই, রাস্তায় গর্ত আছে যেখানে পুকুর বানানো যায়। তবু আমরা বিশ্বাস করি। কারণ বিশ্বাস না করলে আমাদের আর কী-ই বা আছে? 
     
    চুরানব্বইটা সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প—এই সংখ্যাটা শুনে মনে হয় আমরা প্রত্যেকে একেকটা প্রকল্পের ভাগীদার। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, কৃষক বন্ধু—এই নামগুলো শুনলে মনে হয় দেবী লক্ষ্মী নিজে এসে টাকা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে যে হাজার টাকা পাই, তা দিয়ে এক কুইন্টাল চাল কেনা যায় না। তবু আমরা খুশি, কারণ টাকা তো পাচ্ছি। সরকার আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে তারা আছে, আমরা ভুলে যাচ্ছি যে আমরা কর দিচ্ছি। এই খেলাটা দুপক্ষই খেলছি সমান উৎসাহে।
     
    স্বাস্থ্য আর শিক্ষায় বিশেষ নজর—এই কথাটা শুনলে হাসি পায়। হাসপাতালে ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, কিন্তু বরাদ্দ বেড়েছে। বরাদ্দ বেড়েছে মানে কাগজে সংখ্যা লেখা হয়েছে, বাস্তবে কোথায় গেছে তা আমরা জানি না। তিরিশটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, কিন্তু চাকরি কোথায়? ছেলেমেয়েরা পাস করে বেরিয়ে রিকশা চালাচ্ছে, কেউ কেউ অটো। শিক্ষা বেড়েছে, কিন্তু ভবিষ্যৎ নেই। এই অসঙ্গতিটা আমরা মেনে নিয়েছি, কারণ আমরা বাঙালি। আমরা অসঙ্গতি নিয়েই বাঁচি—সকালে রবীন্দ্রসংগীত শুনি, দুপুরে দুর্নীতি করি, সন্ধ্যায় ফেসবুকে নৈতিকতার পাঠ দিই।
     
    পথশ্রী প্রকল্পের নাম শুনলে মনে হয় রাস্তাগুলো শ্রীযুক্ত হয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে যে রাস্তা দিয়ে যাই, তাতে গাড়ির সাসপেনশন ভেঙে যায়, হাড়গোড় কাঁপে। বাংলার বাড়ি—নামটা সুন্দর, কিন্তু যারা বাড়ি পাওয়ার কথা, তারা এখনও তালিকায়। তালিকা হলো আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমরা তালিকা বানাতে পারি, তালিকায় নাম তুলতে পারি, কিন্তু তালিকা থেকে কাজ বের করতে পারি না। এটাই আমাদের সংস্কৃতি।
     
    নগদ অর্থ সহায়তা—এই কথাটা বলার সময় সরকার যেন আমাদের দাতা, আমরা যেন ভিক্ষুক। আমরা ভুলে যাই যে এই টাকা আমাদেরই। কিন্তু যখন হাতে পাঁচশো-হাজার টাকা আসে, তখন মনে হয় বিরাট উপকার হয়ে গেছে। আমরা কৃতজ্ঞ, আমরা ভোট দিই। এটাই সবচেয়ে বড় ব্যবসা—আমাদের নিজেদের টাকা আমাদেরই ফেরত দিয়ে আমাদের কৃতজ্ঞ বানানো।
     
    রিপোর্ট কার্ডে যা লেখা নেই, সেটাই আসল কাহিনী। বেকারত্ব, দুর্নীতি, দলীয় সন্ত্রাস, আইনের শাসনের অভাব—এসব কথা রিপোর্ট কার্ডে থাকে না। রিপোর্ট কার্ডে শুধু ভালো নম্বর দেখানো হয়, ফেল করা বিষয়গুলো লুকিয়ে রাখা হয়। আমরা বাঙালিরাও এই খেলা বুঝি, কিন্তু মানি। কারণ আমরা সুবিধাবাদী। আমরা জানি যে অন্য দল ক্ষমতায় এলেও একই কাণ্ড হবে, তাই বর্তমানটাকেই মেনে নিই।
     
    পনেরো বছরে চুরানব্বইটা প্রকল্প মানে বছরে প্রায় ছয়টা। প্রকল্পের সংখ্যা দিয়ে কি উন্নয়ন মাপা হয়? হাজারটা প্রকল্প থাকলেও যদি একটাও ঠিকমতো না হয়, তাহলে কী লাভ? কিন্তু আমরা সংখ্যা পছন্দ করি। সংখ্যা দেখলে আমাদের মাথা ঘুরে যায়, বুদ্ধি লোপ পায়। হাজার কোটি টাকা, লাখ মানুষ, শত প্রকল্প—এসব শুনলে আমরা ভাবি বিরাট কিছু হচ্ছে। কিন্তু আমাদের জীবনে কী পরিবর্তন হলো, সেটা ভাবি না।
     
    এই রিপোর্ট কার্ড আসলে আয়না নয়, মুখোশ। এটা দেখায় যা দেখাতে চায়, লুকায় যা লুকাতে চায়। আর আমরা বাঙালিরা সেই মুখোশটাকেই আয়না ভেবে নিজেদের সান্ত্বনা দিই। এটাই আমাদের নিয়তি। আমরা সত্য জানি, কিন্তু মিথ্যায় বিশ্বাস করি। কারণ মিথ্যা সুন্দর, আরামদায়ক। সত্য কঠিন, অস্বস্তিকর। তাই আমরা মিথ্যার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ি, আর স্বপ্ন দেখি উন্নয়নের।
     
    – বেসরকারি দপ্তরের "অ-ভাইরাল" কর্মচারী

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীপ | 2402:3a80:197f:9d5f:878:5634:1232:***:*** | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৪৯736377
  • আজ মুখ্যমন্ত্রী ১৫ বছরের সাফল্যের খতিয়ান তুলে ধরেছেন। ২ কোটি কর্মসংস্থান হয়েছে এই বঙ্গে। বাংলায় ৮০ হাজার বুথ। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী, বুথ পিছু প্রায় ২৫০ জনের কর্মসংস্থান হওয়া উচিৎ।
     
    সম্ভবত রাস্তার চপের বা চায়ের দোকানকে উনি রাজ্য সরকারের কর্মসংস্থান হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন!
  • হারামির হাতবাক্স | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০:৫১736378
  • হ্যাঁ, ১ কোটি তো চপ আর ঘুগনি শিল্পে বাকি ১ কোটি তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, বালি কয়লা খাদান দেখভাল করার কাজে নিয়োগ হয়েছে।
  • দীপ | 2402:3a80:197f:cf1b:878:5634:1232:***:*** | ০২ ডিসেম্বর ২০২৫ ২১:৩২736379
  • মাননীয়া আবার ইমনকে দিয়ে উন্নয়নের পাঁচালী গাইয়েছেন!
    ইমনের অবশ্য না গেয়ে উপায় নেই। না গাইলে টলিউডে একটা কাজ‌ও জুটবে না, কোনো হল ভাড়া পাবেন না! 
    হীরক রাজ্য! 
    মানিকবাবু সত্যিই প্রফেট!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন