স্টেট ও চার্চকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিতে হবে। রাজ্য পরিচালনার কাজে চার্চ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং রাজ্যও চার্চের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজ্য পরিচালনার কাজে রোমান ক্যাথলিক চার্চ সরাসরি হস্তক্ষেপ করত। নিয়ম-শৃঙ্খলা বলবৎ ছিল, যাকে বলা হত খৃষ্টীয় অনুশাসন। কিন্তু পরবর্তীতে স্টেট ও চার্চের এই বিযুক্তিকরণই ছিল সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার আদি সংজ্ঞা। নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্থাৎ অনুশাসনের ভাবনা নিশ্চয়ই আদিম যুগে ছিল না, গুহামানবের যুগে ছিল না। জৈবিক বিবর্তনের পথ ধরে সমাজ তৈরি হয় এবং সেই পথেই কোনো একসময় নিশ্চয়ই নিয়ম- শৃঙ্খলা বা অনুশাসনের ভাবনা এসেছিল। ধর্মের উৎপত্তি ও সামাজিক অনুশাসন কি যমজ সন্তান! প্রাচ্যের প্রাচীন ধর্মগুলিই হোক বা আব্রাহামিক (সেমেটিক) ধর্মগুলিই হোক, পাপ-পুণ্যের ভয় দেখানো ব্যাপারটা ধর্মীয় অনুশাসন কায়েম রাখার পিছনে কাজ করত, তা হয়ত অস্বীকার করা যাবে না। ফলত সামাজিক অনুশাসন বা নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রত্ন-রূপ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে ধর্মীয় অনুশাসন গুলির মধ্যে! মনুসংহিতাতে আছে, ফ্রয়েড টোটেম এন্ড ট্যাবু-তেও উল্লেখ করেছেন এরকম বিধানের - মাতৃস্থানীয়া (মাসি পিসি কাকিমা জেঠিমা) কারো সাথে একই পথে যেতে যদি তোমার (মায়ের ছেলে) সাথে দেখা হয়ে যায় তাহলে তুমি তাঁর পায়ের পাতা ভিন্ন অন্য কোনো দিকে তাকাবে না, আর মাতৃস্থানীয়া ঢেকে নেবেন তাঁর মুখমণ্ডল! কিনসিপ বা আত্মীয়তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনায় ক্লদ লেভিস্ত্রস সামাজিক বিভিন্ন বিধানের বিকাশের কেন্দ্রে রেখেছেন বিবাহ নামক অধুনা টলমলে ইন্সটিটিউশনটিকে। প্রমিসকিউটিকে আটকানোর প্রবল প্রচেষ্টা, অভিজ্ঞতা-নির্ভর বিধান বা অনুশাসনের সূচনা - এর মধ্যে মিশে আছে পাপ-পুণ্যের চেতনা। পাপ বা পুণ্য হবে, পাপ করলে শাস্তি পুণ্য করলে পুরস্কার, কিন্তু কে দেবে সেটা? এখানেই ঈশ্বরকে মাথায় নিয়ে ধর্মের অনুপ্রবেশ। আদিম মানুষের মাথায় ঈশ্বরের চিন্তা হয়ত আসেনি, তাদের ভয় ছিল পঞ্চভূতের প্রয়লঙ্কর রূপগুলি নিয়ে। যেহেতু তাতে মৃত্যু ছিল নিয়মিত ও অনিবার্য। কিন্তু ঐ অসহায়তাই একসময় তাদের ভাবতে বাধ্য করে অনন্ত ক্ষমতাশালী অতি-প্রাকৃতিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে। ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ালো, ধর্মহীন সমাজ আসলে নিয়ম-শৃঙ্খলা-অনুশাসন-হীন ও ঈশ্বরহীন সমাজ। বলা-বাহুল্য সেকুলার (প্রবন্ধের প্রারম্ভে বলা অর্থে সেকুলার) সমাজ অনুশাসন-হীন, এটা আধুনিক রাষ্ট্র নিশ্চয়ই মনে করে না। অনুশাসন বলবৎ করার জন্য কোর্ট-পুলিশ আছে। কিন্তু এটাও নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে পুরো ব্যাপারটা বাইরে থেকে বলবৎ করা অনুশাসন নিয়ে নয়, ব্যক্তি ও সমাজ-মানসের স্বশাসিত নৈতিক অনুশাসনের এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। আব্রাহামিক ধর্মের সূচনা হয় ইহুদি ধর্ম বা জুডাইজমের দ্বারা। তৎপরবর্তী খৃস্টান ও সর্বশেষ ইসলাম। ক্রুশবিদ্ধ খৃষ্টের মিনিয়েচার ধর্মপ্রাণ খৃষ্টানদের গলায় গলায় আমরা ঝুলতে দেখি। ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর বিখ্যাত ক্রাইস্ট দা রিদিমার থেকে সর্বত্র আমরা দেখেছি স্থাপিত খৃষ্টকে। কিন্তু ফেলিনির La Dolce Vita (১৯৬০) শুরুর দৃশ্যটির কথা ভাবুন! রোম শহরের উপর দিয়ে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্রাইস্ট দা রিদিমারের মত সর্বংসহায় ভঙ্গীর খৃষ্ট-মূর্তিকে। মার্শেলো ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের দেখতে পাওয়া যায় আরেকটা হেলিকপ্টারে। বিকিনি পরা অভিজাত রমণীদের প্রশ্নের উত্তরে তারা জানায় খৃষ্টকে পোপের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আসলে আমাদের মনে হয় পরিচালক যেন ইঙ্গিত করছেন, খৃষ্টের জন্য স্থাপন করার মত উপযুক্ত স্থান সারা শহরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! এই ছবির পরিচালক ফেদেরিকো ফেলিনি (১৯২০-১৯৯৩) তাহলে কোনদিকে ইঙ্গিত করছেন? ধর্মনিষ্ঠ অনুশাসন-যুক্ত সুশৃঙ্খল সমাজের দিকে নাকি ধর্মহীন অনুশাসন-হীন উৎশৃঙ্খল সমাজের দিকে? এটা বুঝতে গেলে জানতে হবে ধর্মের ব্যাপারে ফেলিনির মনোভাব কি ছিল?
“It’s difficult biologically and geographically not to be a Catholic in Italy. It’s like a creature born beneath the sea – how can it not be a fish? For one born in Italy, it’s difficult not to breathe, from childhood onward, this catholic atmosphere. One who comes from Italian parents passes a childhood in Italy, enters the church as baby, makes his Communion, witnesses Catholic funerals – how can he not be a Catholic? Still, I have a great admiration for those who declare them selves a detached laity – but I don’t see how this can happen in Italy.” একে ধর্ম নিয়ে ফেলিনির সরাসরি মতামত বলা যাবে না। কিন্তু ফেলিনির এই উচ্চারণের মধ্যে নিহিত আছে আধুনিক মানুষের মধ্যে ধর্ম-বিশ্বাস কি ভাবে জন্মায় তার রহস্য। ধর্ম যেন, যাকে কার্ল ইয়ুং বলেছিলেন ‘সমষ্টিগত মগ্ন-চৈতন্য’ (collective unconscious), তার আওতাধীন! অর্থাৎ ধর্ম-বিশ্বাস আসলে আধুনিক মানুষ পায় ‘সমষ্টিগত মগ্ন-চৈতন্য’ থেকে। কেননা এটা দীর্ঘদিন ধরে লালিত হতে হতে ক্রমেই সমাজ-মানসের অংশ হয়ে গেছে। মানুষ যেন ধর্ম-বিশ্বাস নিয়েই জন্মায়। পরবর্তীকালে যুক্তি-বুদ্ধির চর্চার ফলে কারো কারো মনে ধর্ম নামক অপৌরুষেয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং তারা তখন নাস্তিকতার দিকে ঝোঁকে। নাস্তিকতা যেন স্বাভাবিকতার বিরুদ্ধে একটা লড়াই। ফেলিনির চলচ্চিত্রীয় শিকড় কিন্তু নিহিত ছিল বহুল প্রসিদ্ধ ইতালির নব্য-বাস্তববাদের অন্দরে। তাঁর শুরুর দিকের ছবিতে বিশেষত ১৯৫৭ সালের Night of Cabiria পর্যন্ত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের চিত্রায়ন, স্বাভাবিক আলোয় শুটিং ও নন-অ্যাক্টরদের ব্যবহার করার যে ব্যাপারটা আমরা দেখতে পাই, বোঝা যায় সবটাই ইতালির নব্য-বাস্তববাদের প্রভাব। ইতালির নব্য-বাস্তববাদ সম্পূর্ণত মার্ক্সীয়-বীক্ষার ফসল এবং এর পুরোধা তাত্ত্বিক সিজার জাভাত্তিনি বলেছিলেন “there must be no gap between life and what is on the screen”। সত্যিকারের জীবন ও চলচ্চিত্রে-চিত্রিত জীবনের মধ্যে কোনো তফাৎ না থাকার ব্যাপারটা ফেলিনি নিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এর সমান্তরালে তাঁর একটি নিজস্ব ধরনও গড়ে উঠছিল। তাঁর ছবিতে ক্রমেই ঢুকে পড়তে থাকে ‘সমষ্টিগত মগ্ন-চৈতন্য’র জায়গা থেকে রোমান ক্যাথলিসিজমের অনুকল্প, ধর্মীয় শুদ্ধির বিপরীতে যৌনতা নামক খ্রিষ্টীয় পাপের অনিবার্য হাতছানি এবং পঞ্চাশ-ষাটের দশকের অর্থ-প্রাচুর্যের ফলে ইতালির সমাজ-জীবনের হেডনিস্টিক প্রবণতা। এই সমস্ত বিষয়কে একসাথে ধরার জন্য ফেলিনি কার্নিভাল-সুলভ একধরনের নির্মাণ-শৈলী তৈরি করছিলেন। বিষয় ও নির্মাণ-শৈলীর এই যুগ্মই নব্য-বাস্তববাদকে অতিক্রম করে তাঁর স্বতন্ত্র একটি স্টাইলের জন্ম দিয়েছিল। ১৯২০ সালে ইতালির রোমানি শহরে রোমান ক্যাথলিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ফেলিনি। তাঁর চিত্র-সমাহারে সরাসরি ভাবে বাইবেলের উল্লেখ যদিও দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় ও মোটিফ ফিরে ফিরে আসে। তবে এসব কিছুই বলা-বাহুল্য রোমান ক্যাথলিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা ফেলিনির নিজস্ব বিবলিক্যাল ব্যাখ্যা। যদিও তিনি লুই বুনুয়েলের মত খৃষ্টকে সরাসরি আক্রমণ করেন নি। খৃষ্ট সম্পর্কে তাঁর মত ছিল – “যীশুর প্রতি আমার বিশ্বাস আছে। মানবজাতির ইতিহাসে তিনি যে মহত্তম মানুষ তাই নয়, উপরন্তু প্রতিবেশীর জন্য যেই নিজেকে উৎসর্গ করে তাঁর মধ্যে তিনি বেঁচে থাকেন – এই বিশ্বাস।”। ব্যাবিলন থেকে প্যালেস্টাইন পর্যন্ত যে অঞ্চলের এককালে নাম ছিল ‘কানান’ সেখানে দীর্ঘদিন ধরে মানুষ এক মহাপুরুষের আবির্ভাবের জন্য অপেক্ষা করছিল। একে মেসিয়ানিজম বা মাহদীবাদ বলে। যীশু যখন নাজারেথে জন্ম গ্রহণ করেন তখন সেটা ছিল রোমক উপনিবেশ। এই রোমক উপনিবেশে ইহুদীরা দীর্ঘদিন একজন পরিত্রাতার কথা চিন্তা করতেন এবং তাঁর জন্য অপেক্ষা করতেন। অনেকে মনে করেন যীশু হচ্ছেন সেই পরিত্রাতা। অনেকে মনে করেন প্রাথমিক সময়ে যীশুর কাজের (ধর্মীয় নয়, রাজনৈতিক কাজের মধ্যে) মধ্যে একটা বৈপ্লবিক ব্যাপার ছিল কিন্তু পরের দিকে তিনি থিয়োক্রিটিক হায়্যারারকির সঙ্গে সমঝোতার পথে হাঁটেন। তাছাড়া স্ক্রিপচারে মাসিহার আগমনে সমাজে যে যে সুফল আসবে বলে লেখা ছিল, যীশুর আগমনের পর ইহুদীরা সেগুলি দেখতে পান নি। ফলে তাঁরা যীশুকে স্বীকার করে নিতে পারেন নি। বলা-বাহুল্য এই নিয়ে প্রভূত বিতর্ক আছে এবং সেটা আলাদা আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গে ফিরে বলা যায় বিবিধ ব্যাপারে স্বেচ্ছাচারিতা ও দ্বৈত-অবস্থানের জন্য রোমান ক্যাথলিক চার্চকে অনেক ক্ষেত্রেই ফেলিনি সমালোচনা করেছেন। ফলস্বরূপ চার্চের সেন্সর সরকারিভাবে তাঁর The Temptation of Dr. Antonio (Boccaccio 70 (১৯৬২) ছবির একটি গল্প) ও 8 & half (১৯৬৩)-কে ব্যান্ড করে। রক্ষণশীল গোষ্ঠীর সদস্যরা তাঁর অন্য ছবিগুলির ক্ষেত্রে অনেক সময়ই হলের বাইরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করত।
ফেলিনির শুরুর সাদাকালো সাতটি ছবিতে খৃষ্টীয় নৈতিকতার দিক থেকে পীড়া, অপরাধ, ক্ষমা, অনুতাপ, এবং মুক্তির মত অনুষঙ্গ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই ছবিগুলিতে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কার্যকলাপকে প্রায়শই সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। প্রথম ছবি The White Sheikh (১৯৫২)-এই ফেলিনির খৃষ্টীয় মনন-বিশ্বের জোরাল প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। The White Sheikh-এ দুটি গল্প সমান্তরালে এগোতে থাকে। প্রথম গল্পে সদ্য-বিবাহিত দম্পতি ওয়ান্ডা ও ইভানকে আমরা দেখতে পাই তারা প্রথম বারের জন্য রোমে এসেছে। ভ্যাটিকানের কর্মচারী ইভানের কাকাকে প্রভাবিত করার জন্য ইভান চায় তার স্ত্রী ওয়ান্ডার সঙ্গে পরিবারের সকলের আলাপ করিয়ে দিতে। কাকা ভ্যাটিকানের দর্শকবৃন্দের সম্মুখে পোপের সঙ্গে নব্য-দম্পতির আলাপের একটা সুযোগও করে দেন। দ্বিতীয় গল্পটি সোপ অপেরার হিরো White Sheikh-র সঙ্গে ওয়ান্ডার গোপন সাক্ষাৎ নিয়ে। White Sheikh-র সঙ্গে দেখা করার জন্য ওয়ান্ডা হোটেল থেকে পালিয়ে যায়। ইভান ওয়ান্ডাকে খুঁজতে শুরু করে এবং রোমের রাস্তায় তার সঙ্গে দুজন বেশ্যার দেখা হয়। এদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ইভান রাত কাটায়। ইতিমধ্যে হাসপাতাল থেকে ইভানের কাছে খবর আসে যে ওয়ান্ডা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে এবং এখন সে হাসপাতালে ভর্তি! ইভান হাসপাতালে যায় এবং তারা দুজনেই তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ করতে থাকে। কিন্তু সত্যি তারা গোপনে কি করেছিল সেটা একে-অপরের কাছে প্রকাশ করে না। নবদম্পতি হাতে হাত ধরে বাকি দর্শকদের সঙ্গে যখন পোপের দিকে এগোতে থাকে তখন সেন্ট পিটার গির্জার ঘণ্টা বেজে ওঠে। তারা আসলে গোপনে কি করেছিল এটা না জেনেই একে-অপরকে ক্ষমা করে দেয় এবং ওয়ান্ডা তার স্বামী ইভানের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, “Ivan, mio sceicco bianco sei tu!” অর্থাৎ “তুমিই এখন আমার ওয়াইট সেইখ!”। প্রকৃতপ্রস্তাবে এই সুখী সমাপ্তি কিন্তু ঐ নবদম্পতির সরলতার পুনরর্পণ নয় বরং এ যেন চার্চ নামক প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে তাদের গতানুগতিক বাস্তবতায় ফিরে আসার দ্যোতনা। দর্শক শুধুমাত্র জানে এরা আসলে গোপনে কি করেছিল। চার্চ সেই সবের গভীরে প্রবেশ না করেই উপর-উপর তাদের সরল বলে প্রতিপন্ন করে। ফেলিনি দেখাতে চান সাংগঠনিক ধর্ম কি ভাবে কাজ করে। চার্চ নৈতিকতার দিকে জোর দেয় কিন্তু তাদের উদ্বেগটা ভাসা-ভাসা। সত্যটাকে ধামাচাপা দেওয়া হয় শুধুমাত্র আদর্শ রোমান ক্যাথলিক দম্পতিকে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার জন্য।
দুটি গল্প যেন ফেলিনি-কৃত দুটি বিশ্বের স্মারক। একদিকে ফেলিনির ছবির চরিত্রদের মনে হয়, নিজেদের মত ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। পরিচালক সেখানে একজন সাইলেন্ট অবজারভার, তাঁর চরিত্রগুলির উপর কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ নেই। কিঞ্চিৎ খ্যাপাটে, অনেক সময় বহিরাগত এবং কখনো অতিরঞ্জিত এই সব চরিত্রদের প্রবৃত্তির তাড়নাকে ফেলিনি স্থাপন করেন কখনো সোপ অপেরার (The White Sheikh) প্রেক্ষাপটে, কখনো সার্কাসের (La Strada (১৯৫৪), I clown (১৯৭০)) প্রেক্ষাপটে, কখনো থিয়েটার বা ভ্যারাইটি সোয়ের (Variety Lights (১৯৫০)) প্রেক্ষাপটে, কখনো চলচ্চিত্রের/টেলিভিশনের (Intervista (১৯৮৭) , Ginger & Fred (১৯৮৬)) প্রেক্ষাপটে, কখনোবা অর্কেস্ট্রার (Orchestra Rehearsal (১৯৭৯)) প্রেক্ষাপটে। অন্যদিকে রয়েছে, ছবির চরিত্রগুলির জীবনযাত্রার বিপরীতে বহমান রোমান ক্যাথলিক চার্চের নিজস্ব নৈতিক অনুশাসনের ভাবনা। মুশকিল হল চার্চ চরিত্রগুলির কৃতকাজের মনস্তাত্ত্বিক জায়গাটি নিয়ে না ভেবেই নৈতিক অনুশাসন বলবৎ করার চেষ্টা করায়, সেটা চরিত্রগুলির অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের কোনো প্রকার সমাধান দিতে পারে না। সাদাকালো পর্বের প্রথম দিকের ছবিগুলিতে হ্যাপি এন্ডিংয়ের একটা ব্যাপার থাকলেও ঐ পর্বের শেষের দিকের ছবিগুলিতে প্রধান চরিত্রের নেতিবাচক পরিণতি প্রায়শই আমরা দেখতে পেয়েছি। অপরাধী ও নির্যাতিত – কারোর প্রতিই পরিচালক অতিরিক্ত আবেগ প্রদর্শন করেন নি। গরীব ও অসহায় চরিত্ররা খৃষ্টীয় অর্থে অশুভ শক্তির শিকার, কিন্তু তারা তখনো অলৌকিকের প্রতি আস্থাশীল। চরিত্রগুলির যন্ত্রণা ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট হিসেবে বিধৃত হওয়ায় ব্যাপারটা দর্শকের মনে গভীর সহানুভূতির সঞ্চার করে
অপরের প্রতি সহমর্মিতার যে ভাবনা খৃষ্টধর্মে আছে, নৈতিকভাবে ছবিগুলি সেই মূল্যবোধের দ্বারা চালিত। যন্ত্রণা, অনুতাপ ও মুক্তি – এই খৃষ্টীয় ভাবনা এখানে যুক্ত হয়ে আছে। La Starda ছবিটিতে যেরকম। তরুণী ভবঘুরে গেলসোমিনা (ফেলিনির স্ত্রী Giulietta Masina অভিনীত) সার্কাসের প্রধান জ্যাম্পানোর (Anthony Quinn অভিনীত) পাশবিক আচরণের শিকার হয়। এই জ্যাম্পানোকে ফেলিনি চিত্রিত করেছেন একেবারে আবেগ ও মনুষত্বহীন একজন পাশবিক প্রকৃতির মানুষ হিসেবে। একদা পরিত্যক্ত গেলসোমিনার মৃত্যুর খবর একদিন জ্যাম্পানোর কানে আসে। কি হয় এই মানুষটির? La Starda-র অসাধারণ অন্তিম দৃশ্যে মদ্যপ জ্যাম্পানোকে আমরা দেখতে পাই সমুদ্রের পাড়ে অন্ধকার রাত্রিতে কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে। সমুদ্রের পাড়ে সুবিশাল আকাশের দিকে একবার তাকিয়ে জ্যাম্পানো ডুকরে কেঁদে ওঠে। কিন্তু ফেলিনি আমাদের আকাশটা দেখান না। সমুদ্রের পাড়ে শুধুমাত্র জ্যাম্পানোতে আবদ্ধ ফেলিনির ক্যামেরা অনুতাপকে এমন উচ্চতায় নিয়ে যায় যাকে শৈল্পিক সিদ্ধির চূড়ান্ত ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না। অভিভূত আমরা শুধু বিস্ময়ে হতবাক হয়ে ভাবি কিভাবে এরকম পাশবিক একটি মানুষের মনের অন্দরে এরকম মানবিক একটা স্পন্দন জাগতে পারে? একার্থে গেলসোমিনা যেন খৃষ্ট নিজেই এবং গোটা ছবিটা যেন খৃষ্টীয় নীতিকথা।
এই ছবিগুলি রোমান ক্যাথলিসিজমের প্রতীকে ঠাসা। La Starda-য় এক জায়গায় ক্রস ও খৃষ্টের স্ট্যাচু নিয়ে বিশাল একটি মিছিলের পাশে গেলসোমিনাকে দেখা যায় হাঁটু গেড়ে বসে আছে। পরে জ্যাম্পানোর সঙ্গে যাত্রার সময় একটি মঠে একজন সহৃদয় নানের সঙ্গে গেলসোমিনার পরিচয় হয়। এই মঠে যাত্রীরা রাত্রি যাপন করে। গেলসোমিনা ভীষণ শান্তি বোধ করে ঐ মঠে রাতযাপনের সময় এবং পরের দিন মঠ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় সে কেঁদে ফেলে। The Swindle (১৯৫৫) ছবিতে পিকাসো নামক একটি চরিত্র ভার্জিন মেরীর একটি স্ট্যাচু দেখতে পায়। স্ত্রীকে মিথ্যে কথা বলার জন্য পিকাসো ঐ স্ট্যাচুর সামনে অনুশোচনা করতে থাকে। একটু পরে চার্চের ঘণ্টা বেজে উঠলে সে বাড়ি চলে যায়। The night of Cabiria (১৯৫৭) ছবিতে ভার্জিন মেরীর একটি প্রার্থনাস্থলের অভিমুখে আগত তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে বেশ্যা ক্যাবিরিয়া (ফেলিনির স্ত্রী Giulietta Masina অভিনীত) যোগ দেয়। তীর্থযাত্রীরা নতুন জীবনের অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে মেরীর চার্চের দিকে এগোতে থাকে। ক্যাবিরিয়া মেরীর ছবির সামনে প্রার্থনা করতে থাকে যাতে তার জীবনেও পরিবর্তন আসে। কিন্তু আচারানুষ্ঠানটির পরে সে অনুভব করে কোনো মিরাকল ঘটে নি তাই তার জীবনের পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাই নেই।
মধ্য-পঞ্চাশের দশক থেকে ইতালির অর্থনীতিতে জোয়ার আসে। নব্য-বাস্তববাদকে আত্মস্থ করে ফেলিনির স্বতন্ত্র স্টাইল আরো ঘনীভূত হতে থাকে। তথাপি, ১৯৬০-র La Dolce Vita-তে বা ১৯৬২-র The Temptation of Dr. Antonio-তে বা ১৯৬৩-র 8 & half-এ রোমান ক্যাথলিসিজমের চিহ্ন বিদ্যমান এবং সমালোচনা এখানে আরো বেশি স্পষ্ট। এই আলোচনার শুরুর La Dolce Vita-র সেই যীশুকে হেলিকপ্টারে করে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যে ফিরে আসা যাক। ১৯৫৭ সালের পয়লা মে, যীশুর একটি বিশাল স্ট্যাচুকে সত্যিই হেলিকপ্টারে করে সেন্ট পিটার স্কোয়ারে নিয়ে আসা হয়েছিল। চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত এই দৃশ্যটির দিকে ভালো করে তাকালে আমরা দেখতে পাবো ফেলিনির স্বতন্ত্র স্টাইল এখানে রোমের আইডেন্টিটির তিনটি দিককে একসঙ্গে ধরেছে। পিছনে কলসিয়ামের মত ধ্বংসাবশেষ রোমের পরম্পরাগত অতীতের প্রতীক, হেলিকপ্টারটি হল অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হেডনিস্টিক বর্তমানের প্রতীক এবং রোমান ক্যাথলিক আইডেন্টিটির প্রতীক হলেন ঝুলন্ত খৃষ্ট। এই তিনটি বিষয়ের ঘাত-প্রতিঘাত ধরেই যে ছবিটি পরবর্তীতে অগ্রসর হবে ফেলিনি শুরুতেই তার ইঙ্গিত দিয়ে দেন!
নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রগুলিতে মূলত চিত্রিত হয়েছে - অর্থনৈতিক দুর্দশা জনিত সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং সেখানে চার্চ অনেকাংশেই উপশম ও আশার প্রতীক। ফিয়েট অটোমোবাইল, ভেস্পা স্কুটার ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী রপ্তানি করে মধ্য-পঞ্চাশ থেকে ইতালির অর্থনীতি সমৃদ্ধ হতে থাকে। একই সঙ্গে কমতে থাকে চার্চে যাওয়া মানুষের সংখ্যা এবং বাড়তে থাকে হেডনিস্টিক জীবনযাপনের প্রতি উদগ্র টান। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬২ সাল, চার্চে যাওয়া মানুষের সংখ্যা ৬৯% থেকে কমে দাড়ায় ৫৩%-এ। চার্চ ছেড়ে বিনোদনের দিকে ঝোঁকার এই প্রবণতাকে ফেলিনি যতটা ক্যাথলিক চার্চের অধঃপতন হিসেবে দেখেছেন তার চেয়ে অবশ্য অনেক বেশি দেখেছেন চার্চের প্রতি আনুগত্য-হীনতা ও ধার্মিকতার প্রতি বীতরাগ হিসেবে। ফেলিনির দৃষ্টিতে ধর্মের চিহ্ন হিসেবে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলির প্রতি তখনো সমাজের আগ্রহ ছিল বটে, কিন্তু সেই চিহ্নগুলির অন্তর্নিহিত অর্থের প্রতি কোনো আগ্রহই তখন আর অবশিষ্ট নেই। আধুনিক সমাজের কাছে ধর্ম একটা স্পেক্টাক্যালের বেশি কিছু নয়, বিনোদন মাত্র! La Dolce Vita-র শুরুতে হেলিকপ্টার সমেত ঝুলন্ত যীশুর ছায়া দেখতে পাওয়া যায় নতুন বহুতল বিল্ডিংয়ের গায়ে। বাচ্চা ছেলেরা (আগামী প্রজন্মের প্রতীক) সেটা দেখার জন্য দলে দলে দৌড়তে থাকে। এই দৃশ্যটি একই সঙ্গে দুটি জিনিসকে প্রতিকায়িত করে। এক, ধর্ম এখন স্পেক্টাক্যাল হিসেবে কাজ করছে, বিনোদন হিসেবে বাচ্চারা সেদিকে দৌড়চ্ছে। দুই, ক্যাথলিসিজমের মধ্যে সত্যি একটা স্পেক্টাক্যালের ব্যাপার আছে - গির্জাগুলির সুবিশাল উপস্থিতি, যীশুর প্যাশন, এগুলিকে ঘিরে পবিত্র দিনের উৎসব। আগামী প্রজন্ম বিশ্বাসের ছায়ায় বড় হয়েছে, স্পেক্টাক্যাল রয়ে গেছে, কিন্তু অবয়বটা আর নেই।
আজকের দিনে যাকে ড্রোন শট বলে অনেকটা সেই ভঙ্গিতে ঝুলন্ত যীশুর হেলিকপ্টারটিকে রোম শহরের উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখা যায়। নীচে ঝাঁ চকচকে আধুনিক ঘরবাড়ি কলকারখানা পরিলক্ষিত হয়। দুজন গৃহ-নির্মাণকর্মীকে দেখা যায় উড়ন্ত হেলিকপ্টারের দিকে হাত নেড়ে টাটা করতে। খৃষ্টধর্মের প্রভাবের ক্রমক্ষয়িষ্ণুতা এবং কন্সিউমার-সংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সূচক এই দৃশ্যগুলি। দুই গৃহ-নির্মাণকর্মী আক্ষরিক অর্থেই যেন হাত নেড়ে ক্যাথলিসিজমকে বিদায় জানায়। অতঃপর মার্সেলো রুবিনি (Marcello Mastroianni অভিনীত) ও পাপারাজ্জিদের হেলিকপ্টারটিকে প্রথমবারের জন্য দেখা যায়। যীশুকে ছেড়ে সিউমিংপুলের ধারে শুয়ে থাকা মেয়েদের দিকে তারা এগিয়ে যায়। খৃষ্টধর্ম থেকে বিযুক্তি এবং শারীরিক সুখের দিকে ধাবমান আধুনিক মানুষের প্রতীক-হিসেবে রুবিনি ও পাপারাজ্জিরা প্রথমেই চিহ্নিত হয়। কিন্তু মেয়েগুলি রুবিনিকে তাদের ফোন-নম্বর দিতে অস্বীকার করে। এই প্রত্যাখ্যানই আসলে রুবিনির ভবিতব্য, সারা ছবিজুড়ে আমরা সেটাই দেখবো। শারীরিক সুখ বা হেডনিস্টিক প্রবণতা যে খৃষ্টীয় আদর্শের বিপরীত এই ব্যাপারটাও এই ছবির প্রধানতম বক্তব্যগুলির একটি। বিত্ত-বৈভব যখনই সমাজে বেড়েছে হেডনিজম মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, এটা ইতালির সমাজে বহুকাল ধরেই পরিলক্ষিত। Gaius Petronius-র রচনা Satyricon থেকে ফেলিনি ১৯৭০ সালে Fellini Satyricon নামে একটি ছবি করেন। ছবিটি সম্রাট নিরোর সময়কালকে এই হেডনিজামের প্রেক্ষাপটে ধরে। রুবিনির সঙ্গে তার প্রেমিকা এম্মার সম্পর্ক মনস্তাত্ত্বিক-সমস্যার ঘেরাটোপে বন্দি। এম্মা অন্য-নারীদের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারে রুবিনিকে ক্রমাগত সন্দেহ করে যায় । ব্যাপারটা অমূলকও নয়। আমরা রুবিনিকে দেখেছি ধনী ম্যাদালেনার (Anouk Aimée অভিনীত) সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে। সুইডিশ-আমেরিকান চিত্রতারকা সিল্ভিয়ার (Anita Ekberg অভিনীত) প্রতি রুবিনির লালসা বিখ্যাত নৈশ-অভিযানের দৃশ্যে পরিলক্ষিত। কিন্তু রুবিনির সেই লালসা চরিতার্থ হয় না। শারীরিক সুখের সন্ধানে রুবিনির এই একের পর এক প্রচেষ্টা আসলে শরীর-সর্বস্ব আধুনিক সভ্যতার ব্যর্থ সুখানুসন্ধান। ট্রেভি ফাউন্টেইনের জলধারা বন্ধ হয়ে যায়। কিংকর্তব্যবিমুঢ় ও দিকভ্রান্ত আধুনিক সমাজের প্রতীক রুবিনি ও সিল্ভিয়ার দিকে সাইকেল আরোহীসহ ছবির সমস্ত দর্শককুল যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
এদিকে রোমান ক্যাথলিসিজমের অবস্থানটা কি? দুটি বাচ্চার কাছে ভার্জিন মেরীর অলৌকিক চেহারা প্রকাশিত হয়েছে - এম্মার পীড়াপীড়িতে রুবিনি ও এম্মা সেটা দেখতে শহরতলীতে যায়। এম্মার আশা এই উপলক্ষে যদি তাদের সমস্যাসঙ্কুল সম্পর্কেরও একটা মির্যাক্যাউলাস সমাধান ঘটে। কিন্তু এই গোটা ব্যাপারটাই সিরিয়াসনেস হারিয়ে দেখা যায় আদতে একটি টেলিভিশন ইভেন্টে রূপান্তরিত হয়েছে! পাপারাজ্জিরা চারিদিকে থিকথিক করছে। এদিকে একটি অসুস্থ মেয়েকে তার মা বাঁচার আশায় নিয়ে আসে। কিন্তু মেয়েটি মারা যায়। ভার্জিন মেরী কেন, কোন মিরাকলই ঘটে না। উপরন্তু অসুস্থ মেয়েটির মৃত্যুতে শোকাহত সকলে পরের দিন ভোর বেলা দেখতে পায় একজন পাদ্রি মেয়েটির মৃতদেহের পাশে বসে শোকগাথা পাঠ করছে! ফেলিনি যেন দেখাতে চান মৃত মানুষের প্রতি সন্মান-সহমর্মিতায় সাঙ্ঘঠনিক ধর্মের দিক থেকে কোনো অভাব নেই বটে, কিন্তু মিরাকল হল অসহায় মানুষের সর্বশেষ আশা যা ব্যর্থ হবে জেনেও সাঙ্ঘঠনিক ধর্ম তা প্রচার করে থাকে।
মার্সেলো রুবিনি বস্তুত ফেদেরিকো ফেলিনিরই অল্টার-ইগো। গসিপ সাংবাদিকতার বাইরেও রুবিনির একটা সাংস্কৃতিক সত্তা আছে। সে একজন বড় উপন্যাসিক হতে চায়। সাংস্কৃতিক-অভিজাতদের সংস্পর্শে থাকার তার একটা বাসনা আছে। রুবিনি তার বন্ধু স্টেইনারকে খুবই সম্মান করে। রুবিনির চোখে স্টেইনার ‘আদর্শ মানুষ’। শৈল্পিক উপাদানে সুসজ্জিত স্টেইনারের প্রসাদপম বাড়ি, বুদ্ধিজীবী বন্ধুদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকা, তদুপরি তার অপূর্ব স্ত্রী ও দুই সন্তান – রুবিনির কাছে প্রকৃত অর্থে ‘La dolce vita’ বা ‘মিষ্টি জীবন’। রুবিনি ও এম্মা যেদিন স্টেইনারের বাড়িতে যায় সেদিন রুবিনি স্টেইনারকে বলে, “Your home is a refuge. Your children, your wife, your books, your extraordinary friends. I am wasting my life. I am not going anywhere. I had ambitions once…”। রুবিনি আসলে তার জীবনযাত্রার অন্তঃসারশূন্যতা অনুভব করে । কিন্তু চার্চে যাওয়া স্টেইনার প্রত্যুত্তরে অপ্রত্যাশিত ভাবে বলে, “Don’t do what I have done … I fear peace more than anything else. It seems to me like it’s a façade with hell hiding behind it.”। স্টেইনারের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে কিরকম একটা অস্বস্তি রয়েছে। স্টেইনারের জীবন আপাতদৃষ্টিতে সুখী ও আকর্ষণীয় লাগলেও, বোঝা যায় অন্তরালে কোথাও একটা গভীর দুঃখ-কষ্ট আছে। স্টেইনার যেন রোমের চাকচিক্যময় সমাজের পিছনের নৈতিক ভঙ্গুরতার প্রতীক। স্টেইনার তার দুই সন্তানকে মেরে নিজে আত্মহত্যা করে! ধর্মনিষ্ঠ অনুশাসন-যুক্ত সমাজ নাকি ধর্মহীন অনুশাসন-হীন উৎশৃঙ্খল সমাজ – এরকম কোনো বাইনারিতে কি আদৌ পৌঁছান সম্ভব? স্টেইনারের পরিণতি রুবিনির শেষ আশা ও বিশ্বাসের জায়গাটাকেও ধস্ত করে দেয়। উদ্দাম রাত্রি-শেষে ভোরবেলা রুবিনি যখন সমুদ্রের পাড়ে এসে দাঁড়ায়, মাঝিরা তখন একচোখ খোলা একটা বড় জেলি-মাছকে পাড়ে এনে তুলেছে। ফেলিনি এরপর রচনা করেন পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাইম্যাক্সটি। ঋত্বিক ঘটক যাকে মাইলেকেঞ্জেলোর ভাস্কর্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, La dolce vita-র সেই একমাত্র সরল-নিষ্পাপ মেয়েটি অন্তিম দৃশ্যে রুবিনিকে হাত নেড়ে ডাকে। ধর্ম-অধর্মের সীমানা ছাড়িয়ে যাবতীয় নৈরাশ্যকে অতিক্রম করে শাশ্বত মানবতার কাছে পৌঁছান ছাড়া আমাদের যে আর কোনো গত্যন্তর নেই।