এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  সিনেমা

  • ঈশ্বরের হাত

    শুভদীপ ঘোষ
    আলোচনা | সিনেমা | ১১ জুন ২০২৩ | ১৯৫৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৫ জন)

  • "He has avenged the great Argentine people oppressed by ignoble imperialist in the Malvinas..It's a political act..he humiliated them, you understand?" - বৃদ্ধ আঙ্কল আলফ্রেডো উত্তেজনায় ফ্যাবিয়েত্তর হাতটা চেপে ধরেন! মালভিনাস হল ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগরের প্যাটাগোনিয়ান শেল্ফে অবস্থিত। এই দ্বীপপুঞ্জের আবিষ্কার ও ইউরোপীয়দের দ্বারা এর উপনিবেশায়ন নিয়ে প্রভূত বিতর্ক আছে। ফরাসিরা, স্প্যানিশরা ও আর্জেন্টিনীয়রা বিভিন্ন সময়ে এই দ্বীপগুলিতে বসবাস করলেও ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশরা তাদের শাসন পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু আর্জেন্টিনা এই দ্বীপপুঞ্জের উপর তাদের দাবি বজায় রাখে। ১৯৮২ সালে ২রা এপ্রিল আর্জেন্টিনা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের সার্বভৌমত্বকে অস্বীকার করে ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ আক্রমণ করে ও দখল করে। তাদের দাবি ছিল দ্বীপগুলি আর্জেন্টিনার ভূখণ্ডেরই অংশ এবং এই আক্রমণের দ্বারা তারা আসলে নিজস্ব ভূখণ্ডই পুনরুদ্ধার করতে চাইছে। ৫ই এপ্রিল ব্রিটিশ সরকার পাল্টা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অঘোষিত এই যুদ্ধ চুয়াত্তর দিন স্থায়ী হয়েছিল। ১৪ই জুলাই আর্জেন্টিনা আত্মসমর্পণ করে এবং দ্বীপগুলিতে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণ ফিরে আসে। আঙ্কল আলফ্রেডো এই ফকল্যান্ড যুদ্ধের কথাই বলছেন।

    জীবন বিশৃঙ্খল, কিন্তু এই বিশৃঙ্খলার মধ্যেই থাকে একটা শৃঙ্খলা। কিংবা সুশৃঙ্খল বলে যে জীবনকে দূর থেকে মনে হচ্ছে, কাছে গেলে দেখা যাবে তার মধ্যে আসলে কোনো শৃঙ্খলাই নেই। জীবন প্রহেলিকা, চরম এই সত্যে যে সব শিল্পী তৎপরতার সঙ্গে উপনীত হতে পেরেছিলেন চলচ্চিত্র জগতে ফেদেরিকো ফেলিনি (১৯২০-১৯৯৩) তাদের মধ্যে একমেবাদ্বিতীয়ম। কারণ ব্যাপারটাকে শুধুমাত্র উপলব্ধির স্তরে থাকতে না দিয়ে ফেলিনি খুঁজে পেয়েছিলেন একে ব্যক্ত করার সেই প্রকাশরীতি যার প্রভাবে ভেসে গেছে জেনারেশনের পর জেনারেশনের চলচ্চিত্রকাররা। কার্নিভাল সদৃশ উন্মাদনা, ফেলিনির ছবির একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। বিচিত্র ও বর্ণাঢ্য মানব-জীবনের এর থেকে সার্থক উপস্থাপনা চলচ্চিত্রে ফেলিনির ছবি ছাড়া আর দ্বিতীয় পাওয়া যায় না। নেপলস শহরে ফ্যাবিয়েত্ত তার দাদা মার্চিনো এবং মা-বাবা যথাক্রমে মারিয়া ও সাভেরিওর সঙ্গে থাকে। আশির দশকের কোনো এক সকালে অডিশন রুমের বাইরে ফ্যাবিয়েত্তকে বসে থাকতে দেখি আমরা। চারপাশে অডিশানের জন্য অপেক্ষারত বিচিত্র পোশাকের ও ভাব-ভঙ্গীর অসংখ্য পার্শ্বাভিনেতা। দাদা মার্চিনো ভিতরে গেছে অডিশন দিতে। ফেদেরিকো ফেলিনির ছবির অডিশন চলছে! মার্চিনো ব্যর্থ হয়ে দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসে, ভিতর থেকে শুনতে পাওয়া যায় ফেলিনির পরিচিত গলা। ফ্যাবিয়েত্ত দরজার ফাঁক দিয়ে দেখে দেওয়ালে আটকানো রয়েছে এযাবৎ অডিশন দিতে আসা একের পর এক সুন্দরীদের ছবি। স্থানীয় এইসব সুন্দরীদের মধ্যে অবশ্য ফ্যাবিয়েত্ত ও মার্চিনোর সবচেয়ে প্রিয় তাদের আন্ট প্যাট্রিজিয়া! প্যাট্রিজিয়া ও তার স্বামী ফ্রাঙ্ক নিঃসন্তান। প্যাট্রিজিয়া ভল্যাপচুয়াস। প্যাট্রিজিয়ার আবেদন নিয়ে ফ্রাঙ্কের দুর্ভাবনার শেষ নেই এবং পরপুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সন্দেহে সে যখন-তখন তাকে প্রহার করে। অসুখী দাম্পত্য প্যাট্রিজিয়ার মানসিক ভারসাম্যকে ধীরে ধীরে নষ্ট করেছে। ফ্যাবিয়েত্ত, বোন মারিয়া ও জামাই বাবু সাভেরিওর সামনেই সে অকস্মাৎ উন্মুক্ত করে দেয় তার স্তন। সমুদ্রে বোটের পাটাতনের উপর আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও স্বামীর সামনে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে শুয়ে থাকে সে। প্যাট্রিজিয়া ফ্যাবিয়েত্তকে ডাকে একটা গামছা দিয়ে যাওয়ার জন্য। ফ্যাবিয়েত্তর উত্থিত লিঙ্গ প্যাট্রিজিয়ার চোখে সোনালী অতীতের প্রতীক যেন। কিন্তু এ-সবই পরিবেশিত হয়েছে কমিক ভঙ্গীতে। ফেলিনির অদ্ভুত নির্মাণশৈলীর প্রভাব এখানে সুস্পষ্ট।



    প্যাট্রিজিয়া


    ফেলিনির আত্মজৈবনিক ছবি ‘অ্যামারকর্ড’(১৯৭৩)-এ চিত্রিত গ্রাম জীবনের যাবতীয় ক্যারিকেচার ফেলিনির আইকনিক স্টাইলের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। এই ব্যাপারটা প্রতিরুপায়িত না হয়ে পাওলো সরেন্টিনোর (১৯৭০) নিজের ছেলেবেলার ছায়ায় অঙ্গীকৃত হয়েছে তাঁর এই ‘দা হ্যান্ড অফ গড’ (২০২১) ছবিটিতে। উপরন্তু ‘অ্যামারকর্ড’ ছবির মারিয়া অ্যান্টোনিয়েটা বেলুজি অভিনীত বিখ্যাত তামাক-বিক্রেতা চরিত্রটিকে আমাদের এখানে মনে পড়তে বাধ্য। পৃথুলা রমণীর সুবৃহৎ স্তন ফেলিনির প্রথম যৌবনের অবসেশান শুধু নয়, পরবর্তীকালে তাঁর কাছে যৌনতা ও জীবন উদযাপনের অবধারিত প্রতীক। পৃথুলা রমণীরা তাদের অতিরিক্ত দেহ-বৈশিষ্ট্য নিয়ে ফেলিনির ছবিতে ফিরে ফিরে এসেছে। ফ্যাবিয়েত্ত-মার্চিনোর কাছে প্যাট্রিজিয়া যেমন। যৌবনের হরমোন ক্ষরণ, কিন্তু ইন্দ্রিয়পরায়ণতার আড়ালে অদ্ভুত, অনিশ্চিত ও বোহেমীয় জীবনের ডাক। আশির দশকের নেপলস সময়োচিত ভাবেই তাই সরেন্টিনোর ছবিতে ফেলিনিকে নিয়ে এসেছে, আর স্থানিক-বৈচিত্র্যকে দেশকালের ঊর্ধ্বে কিভাবে নিয়ে যেতে হয় সরেন্টিনোও শিখেছেন বোঝা যায় ঐ ফেলিনির থেকেই। ফ্যাবিয়েত্তর মা মারিয়া এদিকে এক নম্বরের ঢপবাজ। উল্টো দিকের প্রতিবেশী গ্র্যাজিয়েল্লাকে ফোন করে তিনি একদিন জানান প্রখ্যাত ফ্র্যাঙ্কো জাফারেল্লি (১৯২৩-২০১৯) তার নতুন ছবিতে একটি চরিত্রের জন্য গ্র্যাজিয়েল্লাকে নির্বাচন করেছেন! আত্ম-জৈবনিক এইসব কমিক মুহূর্ত থেকে বোঝা যায় সরেন্টিনোর বয়ঃসন্ধিতে চলচ্চিত্র কতখানি জায়গা অধিকার করে ছিল। সাধারণ গৃহবধূর জাফারেল্লির ছবিতে ডাক পাওয়া নিয়ে উন্মাদনা তৎকালীন নেপলসর উচ্চ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেরও পরিচায়ক। বোঝা যায় নেপলস একটি আবেগপ্রবণ শহর। অথচ নেপলসর অর্থনৈতিক অবস্থা তখন মোটেই ভালো নয়। দারিদ্র, বেকারত্ব ও সংঘটিত অপরাধ – উত্তর ইতালির নিরিখে নেপলস নিম্ন-বিত্তদের শহর, কিন্তু আবেগপ্রবণ। বিশেষত ফুটবলের প্রশ্ন যখন আসে নেপলস তখন রীতিমত উন্মাদ।


    ‘দা হ্যান্ড অফ গড’ ছবির পোস্টার


    আশির দশকের মাঝামাঝি নেপলসর আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে ফুটবলের ঈশ্বরের আগমন বার্তা। ফ্যাবিয়েত্ত তার বাবা সাভেরিওকে এই রটনার বাস্তবতা নিয়ে জিগ্যেসও করে। সাভেরিও উত্তরে জানান, “No way, he’d never leave Barcelona for this shithole”। কিন্তু দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার (১৯৬০-২০২০) কাছে বার্সিলোনার দু-বছর ছিল রীতিমত পীড়াদায়ক। তাকে বার্সিলোনার স্থানীয়রা 'সুদাকা' বলে মনে করত । 'সুদাকা' একটি বর্ণ-বিদ্বেষ মূলক শব্দ। কালো চামড়ার লাতিন আমেরিকানদের উদ্দেশ্যে এই অবমাননাকর শব্দটি ব্যবহার করা হত। মারাদোনা আসলে আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসের শহরতলি ভিলা ফিওরিটোতে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছিলেন। পানিয় জলের অভাব, কাঁচা রাস্তা এবং দারিদ্রের সঙ্গে যোঝার জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম - এই দেখে বড় হন তিনি। ইটভাটার শ্রমিক বাবা ডন দিয়েগো প্রতিদিন ভোর চারটায় কাজে যেতেন এবং তার ছেলের ভাষায়, "বাড়িতে পৌঁছতেন মৃত অবস্থায় "। এই হিসেবে দেখলে চার্লি চ্যাপলিনের জীবনের সঙ্গে তাঁর মিল আছে। লন্ডনের বস্তিতে লাম্বেথের ওয়ার্কহাউসে চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়ে বৈভবের শিখর ছুঁয়েছিলেন চ্যাপলিন, কিন্তু দারিদ্র্যকে কখনো ভোলেন নি। প্রান্তিক, অন্ত্যজ, ব্রাত্য মানুষের পাশে থেকেছেন সর্বদা। একই ভাবে মারাদোনা সারাজীবন গরিব ও নিপীড়িতদের পাশে থেকেছেন। তাঁর চিরকালের ভালোবাসার আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্স ক্লাব ছিল শ্রমিক শ্রেণীর এবং তথাকথিত উচ্চ শ্রেণীর ক্লাব রিভার প্লেট ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ। যে মানুষটি বার্সেলোনা ছুটে জান মারাদোনাকে নাপোলিতে (নেপলস শহরের ফুটবল ক্লাব S.S.C. Napoli) নিয়ে আসার জন্য সেই আন্তোনিও জুলিয়ানোও (১৯৪৩-) জন্মে ছিলেন নেপলসর বস্তিতে। নাপোলিতে পনেরো বছর ধরে খেলা আন্তোনিও জুলিয়ানো নিজেই ছিলেন একজন লিজেন্ড! তিনি মারাদোনাকে ভবিষ্যৎবাণী করে বলেন যে মারাদোনা যদি নাপোলিতে যোগদান করেন তাহলে তিনি 'জীবন্ত ঈশ্বর' হিসেবে নেপলসর মানুষের কাছে দেখা দেবেন এবং নেপলসর মানুষরা এমনকি তাঁর জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত! কথাটা কতটা সত্যি ছিল মারাদোনা সেটা কিছু দিনের মধ্যেই টের পান। বার্সেলোনার প্রেসিডেন্ট জোসেফ লুইস নুনেজ, জুলিয়ানোওর প্রস্তাবের উপর অতিরিক্ত পাঁচ লক্ষ্য পাউন্ড দিতে রাজি হন। এদিকে কুখ্যাত স্প্যানিশ কোয়ার্টারের জনাকীর্ণ বস্তি থেকে শুরু করে কুখ্যাত মাফিয়া অর্গানাইজেশন ‘ক্যামোরা’র ফোরসেলা জেলা পর্যন্ত নেপলসর জনগণ মারাদোনার জন্য রাস্তায় অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছে! সাভেরিওর বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে মারিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিসমাপ্তি ঘটে যখন সাভেরিও জানায় তার অফিস-কর্মী ফিলিপো আঞ্জালোন ফোনে এইমাত্র জানালো, "Thirteen billion in bank guarantees. Nepoli bought Maradona"! এরপর থেকে ফ্যাবিয়েত্ত-মার্চিনো তাদের কল্পনায় নেপলস শহরের যত্রতত্র মারাদোনাকে দেখতে পেত!


    ফ্যাবিয়েত্তদের পরিবার


    ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে মারাদোনা নেপলস এসে দেখেন এ এমন একটা শহর যার অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিসর তাঁর অনেক দিনের চেনা। এ তাঁর শৈশবের ভিলা ফিওরিটো ও প্রথম যৌবনের বোকা জুনিয়র্স। উপরন্তু নেপলসর মানুষের কাছে ফুটবলই জীবন আর প্রকৃতই সেই জীবনের বিধাতা তিনি স্বয়ং। তাই মার্চিনোর প্রশ্ন "if you had to choose between Maradona coming to Napoli and screwing Aunt Patrizia...which would you choose?"-র উত্তরে, মনের গহন বাসনাকে উপেক্ষা করে ফ্যাবিয়েত্ত জবাব দেয় "Maradona"! আসলে আবেগপ্রবণ যে কোনো শহরের সাধারণ বৈশিষ্ট্য বোধহয় সংস্কৃতি-খেলাধুলার প্রতি অবশ্যম্ভাবী ঝোঁক এবং বাস্তব-বৈষয়িক জীবনের প্রতি একটা ঢিলেঢালা মনোভাব। কলকাতার কথাই ভাবুন। যে বাঙ্গালি এককালে বিদেশ বসুর বাঁ-প্রান্ত ধরে দৌড় দেখার জন্য বা মজিদ বিস্কারের গোলে শট দেখার জন্য বা কৃশানু দে-র বাঁ পায়ের কাজ দেখার জন্য (আরো আরো অনেক উদাহরণ বাকিরা তাদের ফুটবল-স্মৃতি থেকে ভেবে নেবেন) ময়দানে ভিড় জমাতো, সেই বাঙ্গালিই আবার সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল নিয়ে চায়ে তুফান তুলত কফি-হাউসে। এদিকে সাংসারিক সচ্ছলতার ক্ষেত্রে তাদের হয়ত একটু কমতিই আছে। কিন্তু তাতে কি? কৃশানু দে-মজিদ বিস্কারই কলকাতার মারাদোনা-পেলে! নাপোলিতে খেলতে খেলতেই মারাদোনার ১৯৮৬-র বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া এবং ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই বহু-বিখ্যাত ও বহু-বিতর্কিত হাত দিয়ে গোল। এই প্রবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত আঙ্কল আলফ্রেডোর সংলাপের প্রেক্ষিতটি ছিল এই বিখ্যাত 'দা হ্যান্ড অফ গড'। মারাদোনা পরে বলেছিলেন, "a little with the head of Maradona and a little with the hand of God" যা কিনা ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে ইউনাইটেড কিংডমের দু-বছর পূর্বের যুদ্ধ-জয়ের প্রতিবাদে তাঁর "symbolic revenge"।


    ঈশ্বরের হাত


    ফ্যাবিয়েত্তর মা-বাবা রোক্কারাসোতে তাদের নতুন ছোট্ট বাড়িতে ছুটি কাটাতে যান। এদিকে নেপলসর ঘরের মাঠে খেলতে আসছে এম্পলি, দিয়েগোর খেলা কাছ থেকে দেখার সুযোগ কিছুতেই হারাতে চায় না ফ্যাবিয়েত্ত। ফ্যাবিয়েত্ত বলে “দিয়েগো আমায় ডাকছে”। সে তাই মা-বাবার সঙ্গে রোক্কারাসো যায় না। ১৯৮৭ সালে অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল পাওলো সরেন্টিনোর জীবনেও। কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস লিক করে ছবির ফ্যাবিয়েত্ত ও বাস্তবের সরেন্টিনোর মা-বাবা চিরতরে ইহলোক ত্যাগ করেন। ফ্যাবিয়েত্ত/সরেন্টিনোর এই বেঁচে যাওয়া যেন মারাদোনা নামক ঈশ্বরের হাতের কৃপা! ছন্নছাড়া হয়ে যায় ফ্যাবিয়েত্তদের জীবন। প্রিয় আন্ট প্যাট্রিজিয়া ততদিনে মানসিক হাসপাতালের স্থায়ী বাসিন্দা। ফ্যাবিয়েত্তদের উপরের ফ্ল্যাটে থাকেন বয়স্ক বিধবা বারনেসা। ঘরে বাদুড় ঢুকে যাওয়ার অছিলায় তিনি ফ্যাবিয়েত্তকে ডেকে আনেন। এই ছবির সবচেয়ে রহস্যময় ও অদ্ভুত চরিত্র এই বারনেসা। ডাইনি সদৃশ এই বারনেসা মা-বাবার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকা ফ্যাবিয়েত্তর উদ্দেশ্য-বিহীন জীবনে নতুন মাত্রা নিয়ে আসেন। বারনেসাই হন ফ্যাবিয়েত্তর প্রথম যৌন-অভিজ্ঞতা, কিন্তু তিনি দ্বিতীয়বার মিলনে আর রাজি হন নি। ফ্যাবিয়েত্ত অনুভব করে তাকে তার নিজস্ব নারী ও নিজের জীবন এবার খুঁজে নিতে হবে এবং এই উপলব্ধিতে উপনীত করাই বারনেসার উদ্দেশ্য ছিল। ফ্যাবিয়েত্ত চলচ্চিত্র পরিচালক হতে চায়। আসলে এতো সরেন্টিনোর নিজের জীবনেরই গল্প। তাই তাঁর সত্যিকারের চলচ্চিত্র-গুরু আন্তোনিও ক্যাপুয়ানোর(১৯৪০-) পিছনে ধাওয়া করে ফ্যাবিয়েত্ত। যে জীবন অলীক , কল্পনাময় - যখন মা-বাবা বেঁচে ছিলেন, মারাদোনা ছিলেন স্বপ্নের ফেরিওয়া, ফ্যাবিয়েত্ত সেই জীবনে ফিরে যেতে চায়। তাই সে সিনেমা বানাতে চায়, সিনেমা তাকে সেই মায়াবী জীবন দেবে। কি অসামান্য এই অসহায়তা।


    ফ্যাবিয়েত্ত ও ক্যাপুয়ানো


    ক্যাপুয়ানো তাঁর গল্প খুঁজে পেয়েছেন নিজের শহরেই, তাই রোম তাকে টানে না। মৃত্যুর সময় মা-বাবার মুখ পর্যন্ত তাকে দেখতে দেওয়া হয় নি ফ্যাবিয়েত্ত জানায় ক্যাপুয়ানোকে। ক্যাপুয়ানো ফ্যাবিয়েত্তকে বলেন, "অসম্পূর্ণ রেখে এস না, সময় (তারা) তোমায় ডাকছে ফ্যাবিয়েত্ত…..কারণ তারা তোমাকে ছেড়ে যায় নি...তারা তোমাকে পরিত্যাগ করে গেছে"। সিনেমাকে সেই যন্ত্রণা থেকে উঠে আসতে হবে। "বলার জন্য একটা গল্প আছে? তোমার বলার মত গল্প? আছে না নেই?"- ক্যাপুয়ানো চিৎকার করেন। এরপরেই একটি দৃশ্য আছে যেখানে টিভিতে নাপোলির ইতালিয়ান লীগ জয়ের দৃশ্য দেখান হচ্ছে, মারাদোনা মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু ফ্যাবিয়েত্তর মধ্যে সেই আবেগ আর নেই, সে টিভিটা বন্ধ করে দেয়। যে সিনেমা বাস্তব থেকে পলায়নের উপায় তার টানেই ফ্যাবিয়েত্ত একদিন রোমের ট্রেন ধরে। সরেন্টিনোর মায়াবী ও পালসেটিং ব্যক্তিগত অডিসি এই অসামান্য ‘দা হ্যান্ড অফ গড’ কি চৌত্রিশ বছরের ব্যবধানে ক্যাপুয়ানোকে ফিরিয়ে দেওয়া নিগূঢ় উত্তর!



    পাওলো সরেন্টিনোর ‘দা হ্যান্ড অফ গড’ ছবিটি বর্তমানে Netflix-এ উপলব্ধ


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১১ জুন ২০২৩ | ১৯৫৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শ্রীমন্ত | 223.223.***.*** | ১৭ জুন ২০২৩ ১৭:৩৩520465
  • চমৎকার লাগলো আলোচনাটি। সিনেমাটি অবশ্যই দেখবো। ধন্যবাদ লেখককে।
  • দেবেশ | 223.223.***.*** | ২৩ জুন ২০২৩ ২৩:২১520665
  • অনবদ্য আলোচনা। সিনেমা নিয়ে এত ভালো লেখা ইদানিং তেমন দেখা যায় না।
  • Sobuj Chatterjee | ২৪ জুন ২০২৩ ১৬:১৫520682
  • "এই ছবির সবচেয়ে রহস্যময় ও অদ্ভুত চরিত্র এই বারনেসা। " -  যথার্থই এক অসাধারণ চরিত্র সৃষ্টি। মা বাবার অবর্তমানে ছন্নছাড়া ,আত্মবিশ্বাস হীন, দ্বিধাগ্ৰস্ত যুবককে ,যার পেটে ক্ষিদে মুখে লাজ তাকে সম্মতি সূচক দেহ দান করে যেন জীবনের পাথেয় নিজেই যোগাড় করার সাহস দেয়।সমস্ত জড়তা উধাও হয়। এই অতি বাস্তব পরিবর্তন তার দাদার চোখে ধরা পড়ে। তখন ফ্যাবিয়েত্তর মুখে তৃপ্তির হাসি।এ একটা আলাদা সিনেম্যাটিক ডাইমেনশন।
    সেক্সের এমন অসাধারণ প্রয়োগ আমি দেখিনি।
    সিনেমাটা দেখেছি। আপনার রিভিউ দারুন তবে সবটাই বিষয় বস্তু কেন্দ্রিক। আপনার ক্ষমতার প্রতি ভরসা রেখে অন্যান্য দিক গুলোর আলোচনা হলে আরও ভালো লাগবে। ধন্যবাদ।
  • Subhadeep Ghosh | ২৭ জুন ২০২৩ ১২:০২520730
  • @শ্রীমন্ত, মোহাম্মদ কাজী মামুন ও দেবেশ
    অনেক ধন্যবাদ আপনাদের মতামতের জন্য।
    @Sobuj Chatterjee 
    আপনার পরামর্শ প্রণিধানযোগ্য, আমার চেষ্টা থাকবে। অনেক ধন্যবাদ আপনার মতামতের জন্য।
  • নীলাদ্রি | 45.25.***.*** | ০২ জুলাই ২০২৩ ১৭:৩৮520945
  • সরেন্টিনোর সিনেমার পারস্পেক্টিভকে দারুন ভাবে পেলাম আলোচনার মধ্যে। লেখককে ধন্যবাদ। 
  • Subhadeep Ghosh | ০৫ জুলাই ২০২৩ ০১:৩৫521009
  • ধন্যবাদ নীলাদ্রি আপনার মতামতের জন্য।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন