চাঁদু ও সোমা। সত্য, সত্যর বন্ধু, বিউটি ও মালা। জগা। গণেশ, সুধাময় ও তাঁর পরিবার। 'মায়ার জঞ্জাল' ছবির চরিত্রগুলির দিকে তাকালে এই চারটি শ্রেণি-বিভাজন চোখে পড়তে বাধ্য। প্রথম দুটি শ্রেণি বাংলা ছবিতে দীর্ঘকাল উপেক্ষিত একথা অস্বীকার করা যাবে না। এদের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিনিধিত্বের কথা ভাবলে, উপেক্ষিত কথাটি মাথায় আসবেই। মৃণাল সেনের ছবি গুলির পর শহুরে নিম্নবিত্ত মানুষ আমরা আর সেভাবে দেখেছি কি? বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিতে এই ধরণের লুম্পেন, যৌনকর্মী আমরা দেখিনি তা নয়। কিন্তু তারা প্রধানত পরা-বাস্তবতার বয়ান তৈরির কুশীলব হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে বা অন্যভাবে বললে এই ধরণের চরিত্রগুলির পরিণতি ঘটেছে সাধারণত বাস্তবের বাইরে পরা-বাস্তবতায়। এদিকে মৃণাল সেন যে সময়ে এই শ্রেণিটিকে নিয়ে ছবি করেছিলেন তখন সারা পৃথিবী তৃতীয় আন্তর্জাতিক অনুসারী সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্নে বিভোর। ফলত মৃণাল সেনের নিম্নবিত্তরা ছিল নিপীড়িত, কিন্তু সেই নিপীড়ন তাদের ঠেলে দিয়েছিল একটি আইডিওলজির ছাতার তলায়। সেই আইডিওলজির সংগঠনের ব্যানারে তাদের হওয়ার কথা ছিল শোষণ-মুক্ত সমাজের ভ্যানগার্ড। শোষণ-মুক্ত সাম্যবাদী সমাজ হয় নি, কিন্তু বহু ভাগে বিভক্ত সংগঠন বা পার্টি রয়ে গেছে। 'মায়ার জঞ্জাল' ছবিতে সেরকমই একটি পার্টি অফিসে চাঁদার পয়সা যোগাড় করতে না পারা চাঁদুকে বসে থাকতে দেখা যায়। তার ফ্যাক্টরির চাকরি গেছে, বোঝা যায় ট্রেড-ইউনিয়ন করেও লাভ হয় নি। সমাজ-পরিবর্তনের স্বপ্নের চাইতে অনেক গুণ বেশি পরিবর্তিত হয়েছে খোদ শূন্য-দশক পরবর্তী সমাজই। কিন্তু যাই হোক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বহুকাল আগে লেখা দুটি গল্পের মূল ভাব আজকের ঊর্ণনাভ সভ্যতার জটিল তন্তুজালের মধ্যেও যে অটুট রয়েছে এটা প্রতিপন্ন করাই 'মায়ার জঞ্জাল' ছবিটির অভিনবত্ব।
শ্রেণি বিভাজনে আজ যদি প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন-প্রলেতারিয়েত, লুম্পেন-বুর্জোয়া, বুর্জোয়া, পেটি-বুর্জোয়া ইত্যাদি বলা হয় তাহলে মানুষ যার পর নাই বিরক্ত হবেন। আবার সেইসব বস্তাপচা বিশেষণ! এসব বিংশ-শতাব্দীর ব্যাপার, একবিংশ শতাব্দীতে এইসব চলে না। একবিংশ শতাব্দী হল উত্তরাধুনিকতার যুগ এবং উত্তরাধুনিকতা বামপন্থা বা মার্কসবাদকে আধিপত্যকামী বা হেজিমনিক মনে করে ও বিরোধিতা করে। ব্যাপার যে এখন আরও অনেক জটিল এবং উক্ত বিশেষণগুলি যে এখন আর এদের সম্যক পরিচয় বহন করে না জগার মত সিন্ডিকেট-বস বা বিউটি (দেশান্তরিত ও অত:পর স্বামী কর্তৃক বিক্রিত), মালাদের মত একবিংশ শতাব্দীর শহুরে যৌনকর্মীদের দেখলে অবশ্যই বোঝা যায়। সত্য বিউটিদের সঙ্গে জগা গণেশ এবং চাঁদু সোমাদের সঙ্গে সুধাময়দের পরিবার - দুটি আলাদা উলম্বে স্থাপিত। সত্য ও জগার মধ্যেকার সমীকরণের থেকে অনেক জটিল সত্য ও বিউটির সমীকরণের জায়গাটি। অন্যদিকে চাঁদু নিজের দোষে ফ্যাক্টরি থেকে বিতাড়িত। এটিএমে বসে সে মদ খায় এবং এজন্য যে কোনো দিন তার চাকরি যেতে পারে। অভাবের সংসারে স্ত্রীয়ের কাজ করতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এদিকে সে মেনে নিতে পারে না। গল্পের এই প্রারম্ভিক দুটি সূত্র ধীরে ধীরে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে গেছে। এই জটিলতায় অবশ্যই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্পদুটির সময়ের বা মৃণাল সেনের ছবির সময়কার জটিলতার থেকে পারিপার্শ্বিকের প্রভাব অনেক বেশি। শপিং মল - আজকের ফ্যাক্টরি, কর্মীদের নিপীড়িত হওয়ার কনসেন্টের ভিত্তিতে কাজে নিযুক্ত করে। এই ছলটা নতুন কিছু নয়। তৃতীয় আন্তর্জাতিক থেকে সরে এসে মানবতাবাদী চিন্তাধারার সূত্রপাতের সময় আন্তোনিও গ্রামশিদের লেখায় এই কনসেন্টের ব্যাপারে আমরা জেনেছি। আজ এর ফলিত চেহারা এত ব্যাপক যে অভ্যস্ত হতে হতে আমরা সেসব ভুলেই গেছি। মানুষ তার জন্মের জন্য দায়ী থাকে না। চাঁদু বা সত্যর জিনিওলজি যাইহোক বোঝা যায় তাদের আজকের অবস্থা তাদের প্রারম্ভিক অবস্থার থেকে খুব আলাদা নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের যাবতীয় ছলনার পরেও তো অনেক সময় থাকে ঊর্ধ্ব সামাজিক অবস্থায় পৌঁছনোর একটা সৎ উপায়। চাঁদু, সত্যরা প্রায়শই দেখা যায় সেই সম্ভবনাটুকুও ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করে! কেন করে? মার্কসের ভাষায় প্রলেতারিয়েত পরিণত হয় লুম্পেন-প্রলেতারিয়েতে কিংবা ব্যাপারটা হয়ত এর চাইতে আরো অনেক জটিল। কিন্তু এসব বিংশ শতাব্দীর ভাষা। আইডিয়ালিজম বা আদর্শের মৃত্যুর পর এই টাই তো হওয়ার কথা, এতে আজ আর আমরা বিস্মিত হই না। লাগানোর সময় বিউটির কোনো কাজ না থাকার জন্য, সে যে মুখগুলি দেখে, আজকের সমাজে সেই মুখগুলির সত্যিকারের পরিচয় কি? যদি ধরে নি চাঁদু নিপীড়িত তাহলে তার স্ত্রীয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে তো সে নিজেই নিপীড়ক। সত্য নিপীড়িত কিন্তু বন্ধুর প্ররোচনায় পা দিয়ে সেও তো বিউটিকে ঠকাতে যায়। অর্থাৎ যে তীরের লক্ষ্য সে নিজেই কখনো তীরন্দাজ। উত্তরাধুনিকতার ভাষায় চাঁদুর নিপীড়িত হওয়া, সোমার নিপীড়িত হওয়া এগুলিকে একেকটা বয়ান হিসেবে ধরলে, এগুলি যে অর্থ (নিম্নবিত্তের শোষণ, নারীর শোষণ) বহন করে সেগুলি একেকটা ডিসকোর্স । চাঁদুকে উপেক্ষা করে সোমা কাজে গিয়ে কিন্তু পাল্টা একটা ডিসকোর্স তৈরি করে। আসু (সুধাময়দের ড্রাইভার)-সোমা আরেক ডিসকোর্স। সুধাময়দের পরিবার কি তাহলে চাঁদু-সোমার পাল্টা ডিসকোর্স! চাঁদু-সোমা মিলে কিন্তু সুধাময়দের পরিবারে কোনো অন্তর্ঘাত ঘটায় না। দক্ষিণ কোরিয়ার বং জো হো-র ২০১৯ সালের ছবি 'প্যারাসাইট'-এ যেরকম আমরা দেখেছি । পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী তার বিষয়ের স্থানীয় বাস্তবতা ও তদনুরূপ নির্মাণশৈলীর গতিপ্রকৃতি মেনেই থ্রিলারের উত্তেজক সাম্প্রতিক ট্রেন্ডকে সঠিক ভাবেই এ-ছবিতে বর্জন করেছেন। মার্কসবাদের প্রেক্ষাপট থেকে দেখলেও কিন্তু চাঁদু-সোমার পক্ষে অন্তর্ঘাত ঘটানো সম্ভব নয় যেহেতু সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা এখন আর সঙ্ঘটিত নয় এবং মার্ক্সবাদ অন্তর্ঘাত ব্যাপারটাকে ফলদায়ী বলে বিবেচনা করে না, যেহেতু সেটা সাধারণত সামগ্রিক কোনো আইডিওলজির অংশ হয় না।
এই ডিসকোর্স-পাল্টা ডিসকোর্স, অন্তর্ঘাত এইসব উত্তরাধুনিকতার ভাষা মেনে বলা কথা। উত্তরাধুনিকতা মানুষকে মার্কসের মত একরৈখিক অৰ্থনৈতিক মানুষ হিসেবে মানতে রাজি নয় এবং মার্কসবাদকে তারা পুঁজিবাদের পাল্টা ডিসকোর্স হিসেবে বিবেচনা করে। সত্যর সঙ্গে বিউটির সম্পর্কের পরিসরটিকে নিয়ে ভাবলে, বা গণেশের সঙ্গে বিউটি-মালাদের সম্পর্কের কথা ভাবলে, তা থেকে একাধিক ডিসকোর্স ও পাল্টা ডিসকোর্সের সম্ভাবনা তৈরি হয়। গণেশ কৌতুকপূর্ণভাবে বাঙ্গালির ইতিহাসের সন্ধিক্ষণের সেই ‘বাবু’দের কথা মনে করিয়ে দেয়। বিউটির ঘরের ভিতরটা এমনভাবে সাজানো হয়েছে, সেই কস্মেটিসিটি থেকে বিউটিকে অনেক সময় আলাদা করা যায় না। মোহময় অন্দরমহল। আবার সোমাদের অন্দরমহলের তীব্র কন্ট্রাস্টে বিউটির অন্দরমহলকে দাঁড় করানো হয়েছে এও অনেক সময় মনে হয়। অর্থনীতির থেকেও সামাজিক নির্মিতির দিকে ঝোঁকটা এখানে প্রকট। উত্তরাধুনিকতা বলবে বাস্তব হল সম্ভাব্য এই সবরকম ব্যাখ্যার অবিরাম স্রোত, অর্থাৎ বাস্তবের কোনো নির্দিষ্ট রূপ নেই। নেই কোনো একটা কর্তৃত্বকারী ডিসকোর্স বা হেজিমনি। যেন সবাই সবার শত্রু! একমাত্র ‘ক্ষমতা’-কে উত্তরাধুনিকতা সমস্ত ডিসকোর্সে ক্রিয়াশীল বিষয় হিসেবে দেখে। রাষ্ট্র এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং অবস্থার শিকার হয়ে দুটি সমান্তরাল গল্প ছবির শেষে একত্রিত হয়। ড্রাগ সাপ্লায়ার চাঁদু জেলে ঢুকে ড্রাগ কনজিউমার সত্যকে দেখে একই গরাদে বন্দি। এই যে এই দুজনকে অবস্থার শিকার বলা হল, এই অবস্থাটা কি? অর্থনৈতিক অবস্থা কেবলমাত্র, নাকি শুধু তা নয়? নাকি মানুষের বহুবিধ অবস্থার মধ্যেও প্রধান হল অর্থনৈতিক অবস্থা? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়ের অর্থনৈতিক মানুষের ধারণার থেকে আজকের বহু-বিধ ডিসকোর্স সমন্বিত মানুষের ধারণা যাই হোক, একটা বিশাল সংখ্যক মানুষের পরিণতির কোনো পরিবর্তন যুগের তফাতে ঘটেছে কি? 'মায়ার জঞ্জাল' শেষ পর্যন্ত এই ভাবনায় এনে আমাদের উপনীত করে।