কালিদাস ঠিক কোন সময়ে এই ধরাধামে বিরাজ করতেন এই নিয়ে প্রভূত বিতর্ক আছে। ডঃ মুরারিমোহন সেনের লেখা থেকে জানা যায়,
১) খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী – হিপ্পোলাইট ফসে (প্যারিস)
২) খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী – স্যার উইলিয়াম জোন্স এবং আরো অনেক ভারতীয় পণ্ডিত
৩) খৃষ্টীয় তৃতীয় শতক – ল্যাসেন
৪) খৃষ্টীয় পঞ্চম শতক – কে.বি.পাঠক
৫) খৃষ্টীয় ষষ্ঠ শতক – ফারগুসন, ম্যাক্সমুলার, ভাণ্ডারকর ; কার্ন
এরকম একদলও আছেন যারা মনে করেন কালিদাস সপ্তম শতকের কবি। অর্থাৎ খৃষ্টপূর্ব অষ্টম থেকে খৃষ্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত যে কোনো সময়ে তিনি থেকে থাকতে পারেন এরকম মনে করা হয়। প্রত্যেকেই তাঁদের মতের স্বপক্ষে যুক্তি বিন্যস্ত করেছেন। তবে তাঁর সময়কাল নিয়ে সাধারণভাবে গৃহীত মত হল তিনি গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকালে জীবিত ছিলেন। বিশেষত আধুনিক পাশ্চাত্য মনিষীরা কালিদাসের সময়কাল গুপ্তযুগ বলেই মনে করে এসেছেন। গুপ্তযুগ মোটামুটি ৩০০ খৃষ্টাব্দ থেকে ৬৫০ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত। ভিনসেন্ট স্মিথ মনে করতেন নিম্নলিখিত প্রথম দুজনের আমলে নিশ্চয়ই তিনি বিরাজ করতেন এবং তৃতীয় জনের আমলেও তাঁর অস্তিত্ব থাকতে পারে –
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৫৭-৪১৩ খৃষ্টাব্দ)
প্রথম কুমারগুপ্ত (৪১৩-৪৫৫ খৃষ্টাব্দ)
স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৮০ খৃষ্টাব্দ)
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও প্রথম কুমারগুপ্ত উভয়েরই উপাধি ছিল বিক্রমাদিত্য। ভিনসেন্ট স্মিথ জানাচ্ছেন – It is not unlikely that the earliest works of Kalidasa may have been composed before 413 A.D., that is to say, while Chandragupta II was on the throne : but I am inclined to regard the reign of Kumargupta I (413-455) as the time during which the poet’s later works were composed, and it seems possible, that the whole of his literary career fell within the limits of that reign. It is also possible that he may have continued writing after the accession of Skandagupta.
দুটি প্রত্নলেখের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, একটি অইহোল প্রত্নলেখ (৬৩৪ খৃষ্টাব্দ), অন্যটি মান্দাসোর প্রত্নলেখ (৪৭২/৪৭৩ খৃষ্টাব্দ)। প্রথম প্রত্নলেখে আছে – ‘স জয়তাং রবিকীর্তিঃ কবিতাশ্রিতকালিদাসভারবিকীর্তিঃ’; চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর এই অইহোল প্রশস্তির রচয়িতা রবিকীর্তি কালিদাসকে একজন বিশ্রুত কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। দ্বিতীয়টিতে ৪৭২/৪৭৩ খৃষ্টাব্দে উৎকীর্ণ সংস্কৃত ভাষায় বৎসভট্টি রচিত প্রথম কুমারগুপ্ত ও বন্ধুবর্মণের মান্দাসোর লেখটির রচনা শৈলীতে কালিদাসের মেঘদূত ও ঋতুসংহার থেকে ভাব ও ভাষা আহরণের ছাপ পাওয়া যায়। অর্থাৎ তিনি ৪৭২/৪৭৩ খৃষ্টাব্দের পূর্ববর্তী। আরো দুটি আকর উপাদান হল, তাঁর লেখা নাটক মালবিকাগ্নিমিত্রম্ এবং তাঁর রঘুবংশ কাব্য। মালবিকাগ্নিমিত্রম্ নাটকে শুঙ্গবংশীয় শাসক অগ্নিমিত্রের (আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মধ্যভাগ) রাজত্বকাল সম্পর্কে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রঘুবংশ কাব্যে সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয় এবং হূণদের পরাজয়ের বিবরণ আছে। অন্যদিকে বুদ্ধদেব বসু তাঁর ‘কালিদাসের মেঘদূত’ গ্রন্থটির অসামান্য ভূমিকায় লিখছেন, “তাঁর বিষয়ে প্রায় কিছুই জানিনা আমরা। আধুনিক কোনো কোনো পণ্ডিত দেখাতে চেয়েছেন তাঁর জীবৎকাল খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক কিন্তু এ-যাবৎ আমরা যা জেনেছি তারই সপক্ষে প্রমাণ এখনো প্রচুরতর বলে মনে হয়। সন্দেহ করা যায় না, হিন্দু সভ্যতার কোনো উজ্জ্বলতম মূহুর্তে তিনি বেঁচেছিলেন ও লিখেছিলেন, এবং ভারত-ইতিহাসের কোন যুগ গুপ্ত যুগের চেয়ে উজ্জ্বলতর? সেই কাল, যখন ভারতে বৌদ্ধ প্রভাব ও তজ্জনিত বৈদেশিক সংস্রবের অবসান হয় নি, অথচ হিন্দু ধর্মের সগৌরব পুনরুত্থান ঘটেছে, কালিদাসের ছত্রে ছত্রে তারই বিশেষ আবহটিকে আমরা অনুভব করি।”। কালিদাস বিক্রমাদিত্যের ‘নবরত্ন’ সভার অন্যতম রত্ন ছিলেন - এই জনশ্রুতিকে এইসবের সঙ্গে মেনে নিলে তিনি গুপ্তযুগের মানুষ বলেই মনে হয়। দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বৃহৎ বঙ্গ’ মহাগ্রন্থে লিখছেন – “সমুদ্রগুপ্ত সূর্যের রশ্মির ন্যায় প্রখর ছিলেন, কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন জনপ্রিয়, নয়নানন্দবর্দ্ধন চন্দ্রলেখার মত, শিলালেখের বিশেষণে একের প্রখর তেজ ও অপরের মধুর চরিত্রেরই যেন আভাস দিতেছে। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের উপাধি ছিল ‘বিক্রমাদিত্য’।…অনেকে মনে করেন কালিদাস এই বিক্রমাদিত্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি ছিলেন। এ সম্বন্ধে খাঁটি ঐতিহাসিক তথ্য উদ্ঘাটন করবে কে? কালিদাস যদি কোনো রাজসভার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হইয়া থাকেন, তবে মগধরাজের সঙ্গেই তাহার ঐ সম্বন্ধ ছিল বলিয়া মনে হয়। লৌকিক সংস্কার তিনি বিক্রমাদিত্যের রাজসভা উজ্জ্বল করিয়াছিলেন।…মগধের রাজা হইলেও চন্দ্রগুপ্তের অন্যতম রাজধানী উজ্জয়িনীতে ছিল। লৌকিক সংস্কার কালিদাস উজ্জয়িনীবাসি ছিলেন। কালিদাস যে গুপ্তযুগের কবি তাহা তাহার ভাষাও রচনাভঙ্গি আলোচনা করলে অস্বীকার করা যায় না। ইন্দুমতীর সংসারে যদিও নায়িকা উত্তর-কোশলাধীপতি অজকেই বরমাল্য দান করিয়াছেন, তথাপি মগধের প্রাধান্য সেই রাজমন্ডলীর মধ্যে স্বীকৃত হইয়াছিল। মগধপতিই রাজন্যবর্গের পুরোভাগে ছিলেন। কালিদাসের ‘আসমুদ্রক্ষিতীশানাং’ প্রভৃতি পদ পরিয়া কেহ কেহ মনে করেন কবি রুপকপ্রয়োগে গুপ্ত বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি সমুদ্রগুপ্তের প্রতি ইঙ্গিত করিতেছেন এবং সম্ভবতঃ চন্দ্রগুপ্তের পুত্র কুমারগুপ্তের জন্ম উপলক্ষে কবি ‘কুমারসম্ভব’ রচনা করিয়াছিলেন। এই সকল যুক্তি বৈজ্ঞানিক হিসেবে দোষশূন্য না হইলেও একটা অনুমানকে সুদৃঢ় করিতেছে। কেহ কেহ অনুমান করেন, চন্দ্রগুপ্তের (দ্বিতীয়) আদেশক্রমে কালিদাস রাজকন্যা প্রভাবতীর বিবাহ উপলক্ষে ‘সেতুবন্ধ’ কাব্য রচনা করেন। এই কাব্যের টীকাকার রামদাস এই কথার উল্লেখ করিয়াছেন, বাকাতক, মহারাজ প্রবরসেনের বংশে জাত রুদ্রসেনের সঙ্গে প্রভাবতীর বিবাহ হয় এবং এই বংশের গৌরব ‘সেতুবন্ধ’কাব্যে বর্ণিত হইয়াছে।”। অর্থাৎ কালিদাস গুপ্তযুগের মানুষ এবং উজ্জয়িনীবাসি। আর কাব্য-প্রতিভা? কালিদাসকে জয়দেব আখ্যা দিয়েছেন ‘কবিকুলগুরু’বলে। মধুসূদন লিখেছেন ‘কবিতানিকুঞ্জে তুমি পিককুলপতি!’। রবীন্দ্রনাথ কালিদাসের আমলে জন্ম নেওয়ার বাসনাই সরাসরি ব্যক্ত করেছেন। বিদেশিদের মধ্যেও কালিদাসকে নিয়ে প্রভূত উচ্ছ্বাস। অধ্যাপক ল্যাসেন কালিদাসকে বলেছেন ‘The brightest star in the firmament of Indian poetry’। মহাকবি গ্যেটে অভিজ্ঞানশকুন্তলম সম্পর্কে ১৭৯২ সালে মন্তব্য করেছিলেন,
—ই.বি.ইস্টউইক কর্তৃক জার্মান থেকে অনূদিত
কালিদাসের জীবনের প্রেক্ষাপটে হিন্দি নাট্যকার মোহন রাকেশ (১৯২৫-১৯৭২) ১৯৫৮ সালে ‘আষাঢ় কা এক দিন’নাটকটি রচনা করেন। এই নাটকটি হিন্দি ভাষার প্রথম আধুনিক নাটক হিসেবে স্বীকৃত হয়। পরের বছর ১৯৫৯ সালে সেরা নাটক হিসেবে ‘সঙ্গীত নাটক একাডেমী পুরস্কার’ লাভ করে। এই নাটকটি থেকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার মনি কাউল (১৯৪৪-২০১১) ১৯৭১ সালে নির্মাণ করেন ‘আষাঢ় কা এক দিন’ ছবিটি। ছবির কথায় প্রবেশ করার পূর্বে শিল্প এবং বিশেষ করে চলচ্চিত্র সম্পর্কে কাউলের ধারণা কি ছিল সেটা একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন।
কাউল মনে করতেন ইউরোপের রেনেসাঁর পর শিল্প সম্পর্কে বিশেষত ভিস্যুয়াল কালচারের ব্যাপারে আমাদের উপলব্ধিতে প্রভূত পরিবর্তন আসে। বলা-বাহুল্য ভিস্যুয়াল কালচারের চৌহুদ্দিতে চলচ্চিত্র নবতম, রেনেসাঁর সময় তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। রেনেসাঁর সময় এক নতুন ধরনের পারস্পেক্টিভ বা দৃষ্টিকোণের জন্ম হয়। এই দৃষ্টিকোণ স্থানকে নতুন রূপে আত্মস্থ করে, যেখানে ফোরগ্রাউন্ড মিডলগ্রাউন্ড ব্যাকগ্রাউন্ডের হাত ধরে বাস্তবতার এক নতুন ধরনের অর্থের জন্ম হয়। এমনকি সঙ্গীত ও সাহিত্যেও পরিবর্তন আসে। বহু পূর্বের গ্রীক সাহিত্যে যেমন একটা নতুন ফর্ম ছিল - যাকে বলা হয় যুক্তি, প্রতি-যুক্তি থেকে সমাধান। আমাদের দৃষ্টিশক্তির সীমাবদ্ধতার জন্য যেমন দুটি সমান্তরাল সরলরেখাকে আমরা শেষে দূরে মিলিত হতে দেখি, এই সমাধান বা ক্লাইম্যাক্সও বহুদিন ধরে লালিত ঐ-রকম একটি শৈল্পিক ধারণা। পাশ্চাত্যের সঙ্গীতেও এরকম ছোট ছোট দ্বন্দ্বের ছোট ছোট ক্লাইম্যাক্স পরিশেষে একটা বড় ক্লাইম্যাক্সে পরিণত হয়। এই ক্লাইম্যাক্সের ব্যাপারটা রেনেসাঁর সময়ও বিদ্যমান ছিল কিন্তু রেনেসাঁ এই কনভারজেন্স-কে একটা অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও বিশ্বজনীন চেহারা দেয়! সেই সময় থেকেই কনভারজেন্সের ধারণা এমন ভাবে আমাদের মধ্যে প্রথিত হয়ে আছে যে, কোনো একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনাকেও যদি আমরা একটা পরিণতিতে পৌঁছে দিতে না পারি তাহলে সবাই বলবে আমাদের ধারণায় যথেষ্ট স্বচ্ছতা নেই! কনভারজেন্স বলতে কাউল যা বলতে চেয়েছেন তাকে ‘অর্থবহ’নাম দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আরো ঠিকঠাক হবে যদি আমরা বলি প্রতিনিধিত্বমূলক বা রিপ্রেজেন্টেটিভ। চলচ্চিত্র নিয়ে কাউলের দুটি কয়েনেজ হল ‘রিপ্রেজেন্টেশানাল’ সিনেমা এবং ‘নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল’ সিনেমা। কাউল স্বীকার করেছেন যে নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল সিনেমার ধারণা তিনি পেয়েছিলেন বিখ্যাত ফরাসী চলচ্চিত্রকার রোবের ব্রেঁসর (১৯০১-১৯৯৯) বই ‘নোটস অন দা সিনেম্যাটোগ্রাফার’ থেকে। এই নন-রিপ্রেজেন্টেশন আর ব্রেঁসর ‘ফ্র্যাগমেন্টেশান’-এর ধারণা আসলে একই। কাউলের মতে বিশেষত দ্বিতীয়-বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীতে দুজন চলচ্চিত্রকার চলচ্চিত্রকে চলমান চিত্রমালার বিপরীতে অর্থাৎ মুভি বা ভিস্যুয়াল মাধ্যমের পরিবর্তে টেম্পরাল মাধ্যমে পরিণত করেছিলেন। এঁরা হলেন ফ্রান্সের রোবের ব্রেঁস এবং জাপানের ইসুজিরো ওজু (১৯০৩-১৯৬৩)! চলমানতার বিপরীতে তাঁদের ক্যামেরা স্থির। এবং শুধু স্থির নয় তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রগুলিও যথাসম্ভব নিশ্চল। চলচ্চিত্রের চলমানতার ধারণা এই দুজনের হাতে বাস্তবিকই অস্বীকৃত হয়। ব্রেঁসর ছবিতে যদিও ওজুর থেকে কিঞ্চিৎ বেশি মুভমেন্ট থাকে, কিন্তু সেটাও একটা চরিত্রের থেকে ক্যামেরার মিড-শট দূরত্বের বেশি নয়! ব্রেঁস খুব দুরূহ অ্যাঙ্গেল থেকে কোনো শট তোলেন না, আলোকসম্পাতেও থাকে না তেমন নাটকীয়তা। মানে সব মিলিয়ে প্রচলিত অর্থে তাঁর শট গুলি একেবারেই ভিস্যুয়ালি স্ট্রাইকিং নয়। ব্রেঁস ও ওজুর ছবি দেখার পর আমরা এই প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছি যে, একটা দৃশ্য বা ভিসুয়্যালের এহেন পরিণতির পরেও তাঁদের ছবিতে সময়ের উপলব্ধি আসে কিভাবে? একজন দর্শক যখন একটা ইমেজ বা দৃশ্যের দিকে তাকায় তখন কিছুটা সময় প্রয়োজন হয় সেই ইমেজটা উপলব্ধিতে আসতে। ইমেজটা উপলব্ধিতে চলে আসার পর একটা সময়ে কাট করে পরের ইমেজে চলে যেতে হয়। ইমেজের এই অগ্রগতি একটা নেরেটিভ বা ডিস্কোর্সকে রূপ দেয়। অর্থাৎ একটি ইমেজের উপলব্ধিতে আসতে যে সময় লাগে তারপরেও যদি ক্যামেরা সেই ইমেজটিকেই ধরে থাকে তাহলে তাতে বোঝার মত তো আর কিছু থাকে না। কিন্তু বোঝা না-বোঝার বাইরে একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে দৃশ্যটি প্রচলিত অর্থে অর্থহীন হয়ে যাওয়ার পরে যেটা পরে থাকে সেটা হল সময়ের উপলব্ধি! সবাই এই ধারার ছবি করবে এরকম কথা বলা হচ্ছে না, কিন্তু এই ধারার পরিচালক ব্রেঁস ও ওজুর ছবি প্রতিপন্ন করে - মনোযোগ জিনিসটা আসলে স্থানের বৈশিষ্ট্য নয় মনোযোগ হল সময়ের বৈশিষ্ট্য! তাঁদের চলচ্চিত্রের সব কিছু অতি সাধারণ হওয়া সত্ত্বেও, ক্যামেরা স্থিরীকৃত হওয়া সত্ত্বেও, ছবিগুলি এত আবেদনময় হয় কি ভাবে? এখানেই কাউল নিয়ে এসেছেন পূর্বে উল্লেখিত ‘রিপ্রেজেন্টেশানাল’ সিনেমা ও ‘নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল’ সিনেমার (ব্রেঁস যাকে ‘ফ্র্যাগমেন্টেশান’বলেছিলেন) ধারণাটিকে। ব্রেঁস বলেছিলেন তিনি রিপ্রেজেন্টেশান-কে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং গ্রহণ করেছিলেন ফ্র্যাগমেন্টেশান-কে। কিন্তু রিপ্রেজেন্টেশানের ধারণা এমন ভাবে আমাদের মধ্যে প্রথিত যে ব্রেঁস বা ওজুর মত মুষ্টিমেয় কিছু বাদ দিলে সবাই প্রায় শেষ পর্যন্ত এই রিপ্রেজেন্টেশানের কাছে আত্ম-সমর্পণ করে। ব্রেঁস যখন বলেন একটি দৃশ্য কিচ্ছু রিপ্রেজেন্ট করবে না তখন তিনি আক্ষরিক অর্থেই সেটা বলতে চান। যখন নন-একটিং বা না-অভিনয়ের কথা বলেন তখনও ঠিক সেটাই বলতে চান। ব্রেঁস একেকটি শটে অভিনেতাদের চল্লিশ পঞ্চাশটি পর্যন্ত টেক নিতেন যাতে একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে অভিনয় করার যাবতীয় বাসনা তাঁরা ত্যাগ করেন। তিনি মনে করতেন একজন অভিনেতাকে নির্দেশ দেওয়া উচিত নয় যে তোমার রাগ হয়েছে তাহলে তোমার মুখভঙ্গিটা এরকম কর বা বিরক্ত লাগছে তাহলে এরকম কর। তাঁর মতে সিনেমাটোগ্রাফিতে এই ব্যাপারটাই অসম্ভব! অভিনেতা ও দর্শক শুধুমাত্র সশরীরে উপস্থিত থাকে না , এ ছাড়া সিনেমার সঙ্গে নাটকের আর কোনো তফাৎ নেই – তাঁর মতে। কিন্তু সিনেমাটোগ্রাফি নাটকের মত আলোকচিত্রিত নাট্যাভিনয় নয়, সিনেমাটোগ্রাফি হল সময়ের অন্দরে ভাব-প্রবাহের এমনতরও দৃশ্য-শ্রাব্যগত বাস্তবতা যা অর্জন করা অন্য শিল্পমাধ্যমগুলির সাধ্যাতীত। নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল হওয়ার জন্যই রিপ্রেজেন্টাশানাল ছবির মত প্রত্যেকটি দৃশ্যের অর্থ তাঁদের ছবিতে আপনি পাবেন না, কিন্তু এই ধরনের ছবির দৃশ্য-পরম্পরার দিকে তাকালে এক অন্য ধরনের চলচ্চিত্রীয় অভিজ্ঞতা আপনাকে ঋদ্ধ করবে।
কাউল আরো বলছেন ধরা যাক একটা গ্লাস রাখা আছে। একজন গ্লাসটাকে এমন ভাবে তুলবে যে রিপ্রেজেন্টেশানাল সিনেমা এতে আলোকসম্পাত ক্যামেরা-এঙ্গেল ইত্যাদি জুড়ে এই গ্লাসের লিটার্যাল অর্থকে অতিক্রম করে এক ধরনের মেটাফরিক্যাল ব্যঞ্জনা প্রদান করবে। অর্থাৎ গ্লাসের গ্লাস-অতিরিক্ত ব্যঞ্জনা। এখন নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল/ফ্র্যাগমেন্টেশানাল/প্রেজেন্টেশানাল ধারায় গ্লাসের লিট্যারল অর্থকেই ধরে রাখা হয়, ব্রেঁস তাই করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল গ্লাসটি যদি ব্যঞ্জনা-প্রাপ্ত নাই হয় তাহলে এটার অর্থ কি? অর্থাৎ চলতি কথায় ব্যাপারটা অর্থহীন হলে, এর প্রকৃত অর্থটা কি? কাউল বলছেন এক্সটেন্ডেড অর্থকে বাতিল করে লিট্যারল অর্থ কে গ্রহণ করে নিলে প্রকৃত অর্থ তৈরির একমাত্র পথ হল দৃশ্য-পরম্পরা! একটি দৃশ্যের সঙ্গে পরের দৃশ্য জুড়ে দেওয়া কিন্তু আইজেনস্টাইনের (১৮৯৮-১৯৪৮) A1 x A2 x A3…= Z নয়, ব্রেঁস এবং অনেকাংশে মনি কাউলের ধারা হল দুই বা একাধিক দৃশ্যকে এমন ভাবে জুড়ে দেওয়া যাতে অর্থটা তৈরি হয় দৃশ্যগুলির সংযোজিত অংশে। সচেতন পাঠক-দর্শক যখন ব্রেঁস বা কাউলের ছবি দেখবেন তখন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা লক্ষ করবেন। সাহিত্যেও এই ব্যাপারটা আছে। কাউল উদাহরণ দিয়েছেন মাৎসুও ব্যাসোর (১৬৪৪-১৬৯৪) হাইকু কবিতা থেকে।
-রবার্ট হ্যাস কর্তৃক অনূদিত
old pond বা frog jumps-এ অন্যতর কোনো ব্যঞ্জনা নেই, মেটানমি নেই মেটাফর নেই, অর্থাৎ রিপ্রেজেন্টেশান নেই। যা যেরকম তাকে সেরকম ভাবে রেখে দিয়েও পুরো পদ্যটি প্রেজেন্টেশানের বা ফ্র্যাগমেন্টেশানের গুণে আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ। আপাত সরল, কিন্তু এই সরলতাকে প্রকাশ করা অতীব কঠিন! কাউল ধীরে ধীরে পদার্পণ করছেন তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যে। ব্রেঁস এই ধারণা আহরণ করেছিলেন জেসুইটসদের থেকে পাস্কালের থেকে। কাউল বলছেন জাঁ লুক গদারের (১৯৩০-২০২২) ছবি তাঁর কাছে সময়ের থেকে বেশি গতিশীল বলে মনে হয়। ছটফটানি নয় তাঁর পছন্দ সহিষ্ণুতার সঙ্গে একটা দৃশ্যকে ধরে থাকা - যার মধ্যে আসলে প্রবাহিত হয়ে চলেছে নিরবধি সময়। প্রবহমান সময় আসলে সমাপতিত হয় অপেক্ষার সঙ্গে। একটা অপেক্ষা যেন! এই অপেক্ষা থেকেই তো এই জগত সৃষ্টি হয়েছে। মনস্তত্ত্বের গণ্ডী মন ও চেতনা পর্যন্ত (ভারতীয় দর্শনের কিছু ধারায় মনও শরীরেরই অংশ)। কাউল বলছেন, কিন্তু আমাদের দর্শনে self বা সত্তা হল তাই, যা অবাঙমানসগোচর! আসলে তিনি স্থির ‘সাক্ষী’-র কথা বলছেন। ভারতীয় দর্শনের ধারাটা মোটামুটি ভাবে হল --- দৃষ্টব্য -> চোখ -> মন বা চেতনা (changing mind/consciousness) -> অহং (changing awareness)-> সাক্ষী (non-changing)…..। ‘সাক্ষী’ও ‘সাক্ষী’-উত্তর স্তরগুলিকে ধরা যায় না, এমনকি উপলব্ধিও করা যায় না, কিন্তু সেগুলি সবসময় আছে। ঋত্বিক ঘটক (১৯২৫-১৯৭৬) উপনিষদ থেকে নিয়েছিলেন ‘তত্ত্বমসি’ (সুবর্ণরেখা, ১৯৬৫)। রবীন্দ্রনাথের গানের ভাষায়, ‘নয়ন সমুখে তুমি নাই, নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাই’। কিন্তু যা ধরা ছোঁয়ার বাইরে তাকে চলচ্চিত্রে ধরব কি ভাবে? বস্তুত এ তো ছবি নিয়ে নয় বরং ছবির নির্মাতাকে নিয়ে ভাবনা! কাউল যেন মনে হয় দ্রষ্টা ও দ্রষ্টব্য-কে এক করে দেখতে চাইছেন।
বৈদিক ও উপনিষদীয় যুগের পর ভারতের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় গুপ্তযুগ এবং গুপ্তযুগের একাধিক প্রতিভার মধ্যে অন্যতম হলেন কালিদাস। কাউলের যা চলচ্চিত্রীয়-দার্শনিক মনোভাব তাতে মোহন রাকেশের নাটকটির প্রতি তিনি আগ্রহী হবেন সেটা অস্বাভাবিক নয়। মোহন রাকেশের তিনাঙ্কের নাটকটির তিনটি অঙ্ককেই কাউল তাঁর ছবিতে অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
প্রথম অঙ্ক - রাজা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কালিদাসকে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত করেছেন। কালিদাসকে হিমালয় ছেড়ে রাজধানী উজ্জয়িনীতে রাজসভার কবি হতে তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। একদিকে খ্যাতি-যশের আকাঙ্ক্ষা এবং অন্যদিকে প্রেমিকা মল্লিকার প্রতি কালিদাসের ভালবাসা। বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে মল্লিকা কালিদাসকে শহরে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মল্লিকার মা অম্বিকাও এদিকে চান না মল্লিকার সঙ্গে কালিদাসের বিবাহ হোক। তিনি মনে করেন শিল্প করে অর্থ হয় না। কালিদাস উজ্জয়িনী চলে যান।
দ্বিতীয় অঙ্ক - কালিদাস উজ্জয়িনীতে খ্যাতি অর্জন করেছেন এবং সম্ভ্রান্ত প্রিয়ঙ্গুমঞ্জরীকে বিয়ে করেছেন। মল্লিকা একা ও ভগ্নহৃদয়। কালিদাস লোকলস্কর নিয়ে কাশ্মীরে আসেন কারণ তাকে রাজ্যের গভর্নরের পদে উন্নীত করা হয়েছে। গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি মল্লিকার সঙ্গে দেখা করেন না, কিন্তু তাঁর স্ত্রী দেখা করতে যান। মল্লিকার কথা কালিদাসের কাছে অনেক শুনেছেন বলে প্রিয়ঙ্গুমঞ্জরী জানান এবং মল্লিকাকে অনুরোধ করেন রাজবংশীয় একজনকে বিবাহ করতে। মল্লিকা রাজি হন না।
তৃতীয় ও শেষ অঙ্ক - বেশ কয়েক বছর পর কালিদাস মল্লিকার সঙ্গে দেখা করতে ফিরে আসেন। ততদিনে তিনি কাশ্মীরের গভর্নর পদ ত্যাগ করেছেন। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার পর পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। মল্লিকার মা অম্বিকা মারা গেছেন এবং মল্লিকা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বসবাস করছেন। মল্লিকা ততদিনে ভিলোমকে বিবাহ করেছেন এবং এখন এক সন্তানের জননী। একটি মুহূর্তে কালিদাস মল্লিকার কাছে স্বীকার করেন যে তিনি নিজেও অনেক বদলে গেছেন। ছবির শেষে কালিদাস আবার কোথাও চলে যান।
ছবিটিতে আছে কালিদাস বলছেন যে তাঁর সমস্ত কাব্যে আসলে মল্লিকাই ছিলেন। কিন্তু সবথেকে সন্নিকটে মনে হয় ‘মেঘদূত’ কে। ‘মেঘদূত’-এর অলকা যেন এই ছবির পাহাড় ঘেরা কাশ্মীর। মল্লিকা যেন যক্ষীকা। ‘মেঘদূত’-এ যক্ষ যক্ষীকার সঙ্গে মিলিত হতে পারে নি, মেঘ বার্তাবাহক মাত্র এবং কাব্যটি চির-বিরহের। আর ছবিতে কালিদাস মল্লিকাকে পেয়েও পেল না, ফলে এখানেও চির-বিরহ। প্রসঙ্গত, কাশ্মীরী পণ্ডিত ও সংস্কৃতের একজন বিদগ্ধ মানুষ লক্সমী ধর কল্লা (১৮৯১-১৯৬৩) তাঁর ‘দা বার্থ প্লেস অফ কালিদাস’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে কালিদাস কাশ্মীরে জন্মেছিলেন এবং পরবর্তীতে দক্ষিণে অগ্রসর হন। মনি কাউলরাও আসলে কাশ্মীরী পণ্ডিত ছিলেন এবং বহুকাল আগে এক্সুডাসের সময় তাঁর পিতামহরা রাজস্থানে চলে আসেন। কাউল জানিয়েছেন কেন জানি না রাজস্থান তাঁর কাছে বহুদিন পর্যন্ত ছিল বাইরে থেকে পরিলক্ষিত একটা সাংস্কৃতিক পরিসর। পরে অবশ্য রাজস্থানের অসামান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য তাঁকে মুগ্ধ করে। মুম্বাইয়ের মূলধারার ছবির চাইতে ভারতবর্ষের মত বৈচিত্র্যময় দেশে আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত ছবিগুলিই তাঁর মতে প্রকৃত অর্থে ভারতীয় ছবি।
এখন দুটি বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই - ১) কালিদাসের টেক্সট ২) ছবির কিছু অংশ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও ধারণা।
১) ডঃ মুরারিমোহন সেন জানিয়েছেন –“প্রকৃতপক্ষে কালিদাস ছিলেন বৈদর্ভীরীতির কবি। শাস্ত্রে বলা হয়েছে বৈদর্ভীরীতির দশটি গুণ –
শ্লোকের অর্থ স্পষ্ট। এই দশটি গুণেরই তিনি অধিকারী ছিলেন…কালিদাস যখন কাব্য রচনা করেছিলেন তখনও অলঙ্কার শাস্ত্রের কৃত্রিম অনুশাসন কবির কণ্ঠ রোধ করতে পারে নি। তাঁর সম্পর্কে এইটাই সবচেয়ে বড় কথা যে তিনি খুবই সহজে লিখতে পারতেন – যেন কোথাও কোনো চেষ্টা নেই, যেন কোনো কিছুর জন্যই তাঁকে ভাবতে হয় না – যেন সব কিছুই ‘অযত্নসিদ্ধ’।“। আবার বুদ্ধদেব বসু জানাচ্ছেন, বিশেষত ‘মেঘদূত’ প্রসঙ্গে – “সংস্কৃত সমালোচকেরা ‘মেঘদূত’ কে খণ্ডকাব্য বলেছেন, তাতে তার আকারের পরিচয় আছে, প্রকৃতির নয়। য়োরোপীয় পরিভাষার মধ্যে কোনোটির সঙ্গেই এর সঠিক মিল নেই – এই কাব্য ড্রামাটিক নয়, ন্যারেটিভ বা লিরিকও একে বলা যাবে না। অথচ এই তিনেরই লক্ষণ এর মধ্যে বিদ্যমান; কাহিনীর একটি সূত্র আছে, মাঝে-মাঝে (উত্তরমেঘে) লিরিকের আভাস, আর আছে নাটকীয় বিন্যাস, যা কাব্যটিকে নম্য ও বন্ধুর করে তুলেছে; - নৌকাটি একই ছন্দে চলেছে কিন্তু ছোট বা বড় ঢেউয়ের সংঘাতজনিত লয়ের প্রভেদও আমরা অনুভব করি।…একদিক থেকে বলা যায় ‘মেঘদূত’ আধুনিক উপন্যাসের মত যাতে প্লট বলে কিছু নেই, কিন্তু যেটুকু আছে তার পরিণাম গ্রন্থারম্ভেই বলে দিয়ে লেখক আমাদের ধরে রাখেন শিল্পীতার চাতুরীতে; অথবা এটিকে একটি রসান্বিত ভ্রমণ কাহিনী বললেও ভুল হয় না।" নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল বা প্রেজেন্টেশানালের ভাবনা তখন হয়ত ছিল না কিন্তু সে কি সতেরশো শতকের হাইকু কবিরও ছিল? আসলে এসব হল ঐ নতুন ধারার প্রত্যয়কে বোধগম্য করার মত কাছাকাছি কিছু উপমা। ‘মেঘদূত’-এর চিত্ররূপ কল্পনা করা কঠিন বরং তুলনায় ‘আষাঢ় কা এক দিন’ (আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে) কাউলের মনোভাবের কাছাকাছি।
২) ১৯৬৯ সালে নির্মিত কাউলের ‘উসকি রোটি’ যারা দেখেছেন তাঁরা লক্ষ করবেন ‘উসকি রোটি’-র বালোর সঙ্গে প্রথম অঙ্কের মল্লিকার সাযুজ্য আছে। বালো প্রতিদিন রুটি বানিয়ে কয়েক মাইল পাড়ি দিয়ে হাইওয়ের ধারে যায় তার বাস ড্রাইভার স্বামীর উদ্দেশ্যে। ভাগ্য ভালো থাকলে সপ্তাহে একদিন হয়ত তার স্বামী বাড়িতে আসে। কিন্তু বালোর এই নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই। প্রকাশ্যে না থাকলেও এই আত্মত্যাগ, এই একাকীত্ব ও এই একঘেয়ে অনুবর্তন রক্তমাংসের সাধারণ মানুষের মনের গভীরে যে আকুলতার জন্ম দেয় ‘উসকি রোটি’ আশ্চর্য পরিমিতির সঙ্গে সেই দ্বন্দ্বকে ধরেছে। বালোর সঙ্গে মল্লিকার মিল থাকলেও মল্লিকার কষ্ট বালোর চাইতে অনেক বেশি। ১৯৭৩ সালে নির্মিত ‘দুভিধা’ ছবির গল্পটি বিচিত্র। বিবাহের পরেই লচ্চির স্বামী পাঁচ বছরের জন্য ব্যবসার কাজে বাইরে চলে যায়। কিন্তু লচ্চির ভাগ্য বালোর থেকে কিছুটা প্রসন্ন। কারণ লচ্চিকে অপেক্ষা করতে হয় নি, একটি ভূত তার স্বামীর রূপ নিয়ে তাকে সঙ্গ দিতে থাকে! লচ্চির স্বামী ফিরে এলে ভূতটি বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এদিকে লচ্চি সন্তানসম্ভবা। ভিলোমকে কি কালিদাসের ভূত বলা যায়? ভিলোম আসলে প্রতিভাহীন গড় মানুষের প্রতিভূ তাই কালিদাসের বিপরীতে তাঁর উপস্থিতি কিঞ্চিৎ তিক্ত। ছবিতে সংলাপ আছে –
ভিলোম কালিদাসকে বলেন – “রাজধানীর বৈভবের মধ্যে গিয়ে তুমি গ্রাম-প্রান্তরকে ভুলে যাবে না তো? শুনেছি ওখানে গিয়ে মানুষ খুব ব্যস্ত হয়ে পরে, ওখানকার জীবনে নানান আকর্ষণ আছে। রঙ্গশালা, মদিরালয় ও আরো নানা ধরনের বিলাসের জায়গা!”
ইঙ্গিতবহুল ভাবে এই সময় লং শটে মল্লিকার অর্ধেকটা দেখা যায়, বাকি অর্ধেক গাছের অন্তরালে। গাছের গায়ে একটি পিদিম জ্বলছে।
…
ভিলোম – “ভিলোম কি? এক অসফল কালিদাস, আর কালিদাস এক সফল ভিলোম। আমরা কি ভাবে যেন একে-অপরের খুব কাছাকাছি”
কালিদাস – “নিঃসন্দেহে! সমস্ত বিপরীত একে অপেরের খুব কাছাকাছিই হয়।”
লক্ষণীয়, প্রথম অঙ্কে কালিদাসের নিষ্ক্রমণ পর্যন্ত কালিদাসকে আমরা সর্বদা কালো পোশাকে দেখতে পাই, আর ভিলোমকে সর্বদা সাদা পোশাকে। তৃতীয় ও শেষ অঙ্কে কালিদাস যখন ফিরে আসেন তখন থেকে কালিদাস সাদা পোশাকে আর ভিলোম কালো পোশাকে। এই ব্যাপারটা দুটি চরিত্রের বৈপরীত্যের প্রতীক। কিন্তু তৃতীয় অঙ্কের কালিদাসের সাদা পোশাক একই সঙ্গে উজ্জয়নীর জটিল ও চকাচিক্যময় শহুরে জীবনে নিঃশেষিত একজন মানুষের পুনরায় সরল অতীতে প্রত্যাগমনের বাসনার প্রতীক।
‘দুভিধা’-র লচ্চি ও তৃতীয় অঙ্কের মল্লিকা কি কোথাও একটা মিলে যাচ্ছেন? কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হল মল্লিকার সন্তানটি কি সত্যিই ভিলোমের? এটা স্পষ্ট করা হয় নি। কালিদাস ফিরে এসে যখন বর্ষার রাত্রিতে ঘরের মধ্যে মল্লিকার সঙ্গে কথা বলছেন, তখন হঠাৎ বন্ধ দরজার কড়া নড়ে ওঠে! বাইরে অস্ফুট গলা।
মল্লিকা – “দরজা বন্ধই থাকতে দাও, তুমি যে কথা বলছ, বলতে থাকো।“
কালিদাস – “দেখ একবার, কে এসেছে?”,
মল্লিকা – “বর্ষার দিন, যে কেউ হতে পারে, তুমি কথা বলতে থাকো, ও চলে যাবে।”
কালিদাস – “কে ছিল ও?”
মল্লিকা – “বললাম তো, বর্ষার দিন, যে কেউ হতে পারে, বর্ষায় যে কোনো মানুষের আশ্রয়ের প্রয়োজন হতে পারে।”
কালিদাস – “কিন্তু অস্ফুট স্বরটা আমার বিচিত্র লাগলো।…মনে হল যেন আমি স্বরটার সাথে পূর্বপরিচিত, এখানকার অন্য সমস্ত বস্তুর মত এটাও যেন কোনো পরিচিত স্বরের বদলে যাওয়া রূপ!”
এর কিছু পরেই ভিলোম আসেন এবং কালিদাসকে বলেন –
“এ-ঘরে এখন আমি নিজের অধিকারে আসি……আমি এই জন্য বলছি সম্ভব হলে কালিদাসই দেখে জানাক অষ্টাবক্রর কথা আসলে কতটা সত্যি? বাচ্চার চেহারা কি সত্যিই ভিলোমের সঙ্গে মেলে, নাকি,….চল দেখো।”
দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে মল্লিকাকে কি শেষ পর্যন্ত বেশ্যাবৃত্তি করতে হয়েছিল? এর কোনো স্পষ্ট উত্তর নেই। ভিলোম মল্লিকাকে ভালবাসতেন, কিন্তু মল্লিকা শেষ অবধি কালিদাসকেই ভালোবেসে গেছেন। বহুকাল পরে ফিরে এসে কালিদাস সেটা বুঝতে পারেন। মল্লিকার দেওয়া সাদা খাতায় মল্লিকার এত বছরের চোখের জল লেগে আছে, লেগে আছে হাওয়া-মাটি। কালিদাসের মনে হয় এই সাদা খাতাই যেন শ্রেষ্ঠ মহাকাব্য।
সাদা-কালোয় নির্মিত ‘আষাঢ় কি এক দিন’ ছবিটিতে ক্লোজ ও মিড শটের আধিক্য বেশি। ন্যূনতম সেট ডিজাইন, চিত্রকলার মত প্রতিটি ফ্রেম এবং চরিত্রগুলির আপাত নির্লিপ্ত সংলাপ উচ্চারণে আবেগের এক নতুন ধরনের বহিঃপ্রকাশ আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। কে কে মহাজনের (১৯৪৪-২০০৭) ক্যামেরা বাইরের হিমালয়কে আউট-অফ-ফোকাসে রেখে মল্লিকার কুঁড়েঘরটিকে এমন ভাবে চিত্রিত করে যেন মনে হয় স্বর্গীয় আবাস! ছবিটি পিরিয়ড ছবি, কিন্তু নাটক থেকে নির্মিত হওয়ায় অতিরিক্ত সংলাপ নির্ভর। একটা কথা বলা প্রয়োজন ছবিটি খুব প্রত্যয়যোগ্য ভাবে গুপ্তযুগকে তুলে ধরে না। কাশ্মীর ও উজ্জয়নীর কথা আছে। প্রিয়ঙ্গুমঞ্জরী আসবেন বলে রাজদরবার থেকে বিদূষকের মত দুজন অনুচর আসেন যাদের গৃহসজ্জার নামে প্রগলভতা হাসির উদ্রেক করে। কিন্তু গুপ্তযুগের রূপ রস ও দোষের ছোঁয়া তেমন ভাবে পাওয়া যায় না। বরং হরিণ শিশু নিয়ে মল্লিকা ও কালিদাসের দৃশ্যগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’-র কথা। কিংবা কুয়াশা ও মেঘের দৃশ্যগুলি মনে করিয়ে দেয় ‘মেঘদূত’-এর কথা। অসমাপ্ত ‘কুমারসম্ভব’ মহাকাব্যটিও শুরু হয়েছিল হিমালয়ের অপরূপ বর্ণনা দিয়ে। নাট্যকার মোহন রাকেশ তাঁর ‘লহঁরো কে রাজহংস’ নাটকের ভূমিকায় লিখেছিলেন যতবারই তিনি‘মেঘদূত’পাঠ করেছেন ততবারই তাঁর মনে হয়েছে কবি নিজের অপরাধবোধ ও বিচ্ছিন্নতাবোধকে এই মহাকাব্যে গোপন করতে চেয়েছেন এবং এই উপলব্ধিই তাকে নাটকটি লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ‘নন-রিপ্রেজেন্টেশানাল’ ধারার একমাত্র শিল্পী মনি কাউল এই সূক্ষ্ম ব্যাপারটিকেই ছবিতে ধরেছেন অননুকরণীয় ভঙ্গীতে। ‘উসকি রোটি’ যদি হয় থেকেও নেই-এর উপাখ্যান, ‘দুভিধা’ তাহলে না থেকেও আছে এবং ‘আষাঢ় কি এক দিন’ অনিঃশেষ অপেক্ষার নান্দনিক চিত্ররূপ।