হলিউডের অতি-জাগতিক সিনেমার আকর্ষণে এসপ্ল্যানেডের হল গুলিতে কলেজের কত ক্লাস যে আমরা করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ক্রমে-ক্রমে অন্য-ধারার সিনেমার প্রতি আকর্ষণে এ.জে.সি বোস রোডের একটি স্থান আমাদের কাছে হয়ে ওঠে তীর্থক্ষেত্র। সময়কাল শূন্য-দশকের শুরুর বছর গুলি। টরেন্ট, ওটিটি এসবের তখন কল্পবিজ্ঞানের গল্পেও অস্তিত্ব নেই। ফলে অন্য-ধারার একটা ভালো ছবি অমুক জায়গায় দেখানো হচ্ছে, এসব ছিল লাখ-টাকার খবর! মাথার উপর ফ্লাইওভার তখনও হয় নি, তাই মোটামুটি লাউডান স্ট্রিট পেরলেই দেখা যেত গোটা গোর্কি সদনটা। অঙ্কের অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও বাবা এককালে ছিলেন ফিল্ম সোসাইটির সদস্য, ফলে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল তো ছিলই উপরন্তু দাঁত-ভাঙা নামের কিছু পরিচালক ও তাদের কাজের গল্প মোটামুটি জানা ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয় এঁচোড়ে পাকা কিছু বন্ধুবান্ধবের সান্নিধ্য, ব্যাস! অনির্দিষ্ট নানান সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি গোর্কি সদনের এ.জে.সি বোস রোডের দিকের দেওয়ালের বোর্ডে প্রতি মাসের শেষের দিকে একটু নজর রাখা প্রয়োজন! ওখানেই টাঙানো হত সামনের গোটা মাসের কর্মকাণ্ডের সূচি। মাসের শুরুর দিকে বা মাঝামাঝি দেখানো হত ঐ সব দাঁত-ভাঙা নামের পরিচালকদের ছবিগুলি। ছবি তো দেখানো হবে, কিন্তু ঢুকতে পারবো তো? এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা ধন্দ ছিল। ছবি দেখানোর দিন গেটের বাইরে ছোটখাটো একটা জমায়েত হত। 'আইজেন্সটাইন সিনে ক্লাব'-এর সদস্যরা আগে ঢুকতেন, তারপর আমাদের মত অ-সদস্যরা। হ্যাঁ, 'আইজেন্সটাইন সিনে ক্লাব'-এর উদ্যোগেই ছবি দেখানো হত, কর্ণধার ছিলেন গৌতম ঘোষ (চলচ্চিত্র পরিচালক গৌতম নন)। এই গৌতমদার মত দেবতুল্য মানুষ আমরা আর দুটি দেখিনি। প্রতিটি শো-তে গৌতমদা নিয়ম করে সদস্য হতে অনুরোধ করতেন, আমরা ঘাড় নাড়তাম এবং যথারীতি পরের শো-তে নির্লজ্জের মত হাজির হতাম অ-সদস্য হিসেবেই। কলেজের ছাত্রদের চা-বিস্কুট-সিগারেটের হাতখরচাটুকুকে অক্ষুণ্ণ রেখেই গৌতমদা নির্দ্বিধায় আমাদের ঢুকতে দিতেন হল-এ!
যত-দূর মনে পড়ে, গোর্কিতে আমাদের দেখা প্রথম ছবি ছিল চেক পরিচালক জিরি মেনজেলের 'ক্লোজলি ওয়াচড ট্রেনস'! চেক প্রজাতন্ত্রের বিখ্যাত উপন্যাসিক বোহুমিল রাবালের (Bohumil Hrabal) উপন্যাস থেকে তৈরি এ ছবি চেক নিউ-ওয়েভ সিনেমার সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ছবি হিসেবে স্বীকৃত। এই মেনজেল পরে কলকাতাতেও এসেছিলেন 'সিনে সেন্ট্রাল' আয়োজিত তাঁর ছবির রেট্রোস্পেক্টিভ উপলক্ষে। 'বাইসাইকেল থিফ' প্রথমবার দেখি এই গোর্কি সদনেই, ২০০১-২ সাল নাগাদ। আমাদের সিটের ঠিক পিছনের সিটে বসেছিলেন মৃণাল সেন। মনে পড়ে ছবি শেষ হওয়ার পর পাশের বন্ধু-স্থানীয় একজনকে মৃণাল বাবু বলছেন, "ভাবতে পারো এ ছবি আটচল্লিশ সালে বানানো! দেখে যেন মনে হয় কাল বানানো হয়েছে!"।
তবে গোর্কি জমে গিয়েছিল আন্দ্রেই তারকভস্কির রেট্রোস্পেক্টিভের সময়। গোর্কির বাইরে ওরকম ভিড় আমরা আর কখনো দেখিনি! 'দা স্টিমরোলার এন্ড ভায়োলিন' থেকে 'দা স্যাক্রিফাইস', কালক্রম অনুযায়ী আটটি ছবিই দেখানো হয়েছিল দশ বারো দিনের মধ্যে। সে এক অভিজ্ঞতা! আর কে না আসতেন? জয় গোস্বামী থেকে পরিতোষ সেন - কাউকে না কাউকে কোনো না কোনো শো-তে প্রতিদিন দেখতে পেতাম। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের একটি বইয়ের নাম 'ধ্বংসের মধ্য দিয়ে যাত্রা', আমাদের কাছে ঐ আটটি দিন ছিল 'স্বপ্নের ভিতর দিয়ে যাত্রা'! সঙ্গীতের মত সিনেমাও কালে দেশ(স্থান) নির্মাণ করে। সিনেমাকে টেম্পোরাল মিডিয়ামের চরমে পৌঁছে দেওয়া শুধু নয়, তারকভস্কি তার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন মনোরম বর্ণ লেপন, কাব্যিক গাম্ভীর্য এবং সঙ্গীতের সুষমা। কবি থেকে চিত্রকর তাই তাঁর নামে এককাট্টা। শেষ ছবি ‘দি স্যাক্রিফাইস’-এ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার বিখ্যাত শেষ দৃশ্যটি ক্যামেরার রীল আটকে যাওয়ায় দ্বিতীয়বার তুলতে হয়েছিল বলে শোনা যায়! চিত্রগ্রাহক ছিলেন প্রবাদপ্রতিম ভেন নিকভিস্ট (Sven Nykvist)। মনে পড়ে হল থেকে বেরোনোর সময় এক ভদ্রলোক মন্তব্য করছেন, “পোড়া গন্ধটা পর্যন্ত নাকে আসছিল!”। এর মধ্যে অতিশয়োক্তি আছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু তারকভস্কিকে নিয়ে কলকাতার মানুষের আবেগটা এতে স্পষ্ট। বার্নার্দো বার্তলুচ্চির ছবি প্রথম দেখি এখানেই, 'দা ড্রিমার্স'। প্যারিসে ৬৮-র উত্তাল ছাত্র-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ছবি নিয়ে কোনো স্পষ্ট মতামতে আমরা পৌছতে পারিনি। বিষয় নিয়ে তর্ক ছিল না, বিষয়ী বাস্তবতা নিয়েও নয়, কিন্তু ছবিটি কলা কৈবল্যে দীর্ণ কি না এ নিয়ে অমীমাংসিত তর্কবিতর্ক রয়েই গেছে।
এই গোর্কির দেওয়ালেই প্রথম দেখি সেমি কাপলানোগ্লুর নাম, নুরি বিলজ সেলানের নাম, ইলমাজ গুনের নাম! কাপলানোগ্লুর 'এঞ্জেল'স ফল'-এর স্মৃতি আজও অমলিন। আত্মহত্যাকামী এক নারীর আত্মানুসন্ধানের গল্প 'এঞ্জেল'স ফল'। পরে অন্যত্র কাপলানোগ্লুর 'ইউসুফ ট্রিলজি' দেখে আমরা অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। জনৈক ইউসুফের জীবনের গল্প পরিচালক ফেঁদেছেন উল্টো দিক থেকে, অর্থাৎ ট্রিলজির প্রথম ছবি 'এগ'-এ ইউসুফ পূর্ণ-বয়স্ক একজন মানুষ, 'মিল্ক'-এ যুবক ও শেষ ছবি 'হানি'-তে শিশু! নুরি সেলান নিয়ে ইতিপূর্বে গুরুতে আলোচনা করেছি। এখানে সংযোজন করতে চাই, সেলানের ছবি 'ডিস্ট্যান্ট' দেখানোর পূর্বে মনে আছে ধীমান দাশগুপ্ত মানে আমাদের ধীমানদা অসাধারণ একটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। 'ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ-পাথর', ইলমাজ গুনের 'হোপ' যারা দেখেছেন এ-কথা তাদের মনে পড়তে বাধ্য। ম্যাক্সিম গোর্কির 'মাদার' পড়ে খুব ভালো লেগেছিল একথা বলব না, কিন্তু সেই গল্প থেকেই ভেসেভোলোদ পুডোভকিনের নির্বাক চিত্র 'মাদার' সত্ত্বার মর্মমূল ধরে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। সের্গেই আইজেন্সটাইনের 'ইভান দা টেরিবেল'–এর দুটি পার্ট এবং অসামান্য তথ্যচিত্র ‘কুয়ে ভিভা মেক্সিকো’ এই গোর্কিতেই প্রথম। সত্যজিৎ রায়ের 'জনঅরণ্য' বড় পর্দায় দেখার সুযোগও হয় এখানেই! রবি ঘোষ অভিনীত নটবর মিত্তিরকে দেখে মনে হয়েছিল বিয়াত্রিচে প্রেরিত ভার্জিল যেন, যে শেষ পর্যন্ত সোমনাথকে নরকের দ্বারমুখ অবদি পৌঁছে দেবে!
'আইজেন্সটাইন সিনে ক্লাব'-এর ও বিশেষ করে গোর্কি সদনের ইতিহাসে ঘটা বিরল একটি ঘটনার কথাও মনে পড়ছে। ফেদেরিক ফেলিনির 'সিটি অফ উইমেন' দেখানো হচ্ছিল, হলের পিছন দিকের সিট থেকে ক্রমাগত ভেসে আসতে থাকে সিটির আওয়াজ! ছবিটি শেষ পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়! পরের দিন গৌতমদা এই নিয়ে একটি কড়া বিবৃতিও দেন। ঘটনাটি ২০০৭-৮-সালের হবে। ততদিনে অন্ন-সংস্থানের জন্য আমাদের গোল্লাছুট শুরু হয়ে গিয়েছে। ফলে অচিরেই বন্ধ হয়ে যায় গোর্কিতে ছোটাছুটি। দিন কয়েক আগে এ.জে.সি বোস রোড দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখে পড়ল গোর্কি সদনটা, আর সিনেমার ফ্রেমের মত একের পর এক ভেসে উঠতে থাকলো উপরে বলা স্মৃতি চিত্রগুলি!