থাপ্পড় মেরেছেন নবারুণ। হ্যাঁ, একদম কষে সপাটে থাপ্পড় মেরেছেন। বাঙ্গালির চিরকালের শুয়ে বসে আরাম করে প্রেম-থ্রিল-কমেডির কাহিনি ও কবিতা পড়ার অভ্যাসের মূলে আঘাত করেছেন তিনি। এবং একদম ঠিক করেছেন।
প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি আছে। আমি জানিনা মহিলা পাঠক বলে কোনো আলাদা বিভাগ আছে কিনা, তাই স্বভাবতই মহিলা পাঠকের বিচারে নবারুণের লেখার বিশ্লেষণ করতে আমি অক্ষম। আমি বরং একজন সাধারণ পাঠক হিসাবে নবারুণকে দেখব। মানে তার এই থাপ্পড় আমার কেমন লেগেছে আর কি!
সাহিত্যকে মাধ্যম করে এইভাবে থাপ্পড় মারার দৃষ্টান্ত অবশ্য প্রথম নবারুণ দেখাননি। মনে করুন, প্যারীচাঁদ-কালীপ্রসন্নের কথা। ঊনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত র্যাশনালিজম্, রেনেসাঁস আর হিউম্যানিজম্-এর মুখোশ যখন খুলে দিচ্ছেন প্যারীচাঁদ-কালীপ্রসন্ন, সে ভাষা কিন্তু মাখোমাখো তৎকালীন সাহিত্যভাষা নয়। সে ভাষা যুগের থেকে অনেকটা এগিয়ে। প্যারীচাঁদের উচ্চারণ তাও কিছুটা মার্জিত, তৎকালীন সাহিত্যের বিচারে মার্জিত, কিন্তু কালীপ্রসন্নের বিষ উদ্গীরণ কিন্তু এক্কেবারে গালাগালের ভাষায়। আর হবে নাই বা কেন? আপনারাই বলুন, ট্রেনে ভিড়ের মধ্যে কেউ আপনার পা মাড়িয়ে দিয়ে ‘সরি’টুকু না বলে চলে গেলে আপনি কি ভারী মিষ্টি ক’রে কথা বলবেন তার সঙ্গে? গালাগালি ছাড়া বাবু সংস্কৃতিকে ধিক্কার আর কোন্ ভাষায় দিতেন কালীপ্রসন্ন? যদিও সেই সময়কার পরিপ্রেক্ষিতে এই গালাগালি-সাহিত্য এতটাই অনাকাংক্ষিত যে, তখনকার সমাজ-সাহিত্য জগতের মহান ব্যক্তিদের, বলাই বাহুল্য, তা অত্যন্ত অপছন্দ হয়েছিল। কিংবা, মনে করুন সমরেশ বসুর কথা। ‘প্রজাপতি’তে ক্লেদাক্ত বড়লোক সমাজকে এমন একটি ছেলের ন্যারেশনে তুলে ধরেছেন লেখক, যাকে সকলে রকবাজ, মস্তান বলেই জানে। যে ভাষা ব্যবহার করেছেন লেখক তাও তৎকালীন প্রচলিত সাহিত্য-ভাষা নয়। তার অনিবার্য ফলশ্রুতিতে এক দীর্ঘ মামলা চলেছিল প্রজাপতিকে নিয়ে। লেখক কিন্তু এ বিষয়ে খুব স্পষ্ট – একটি রকবাজ ছেলের মুখের ভাষায় যখন গ্রন্থটি লেখা, তা কিভাবে খুব মার্জিত ভাষা হবে? ছেলেটির ভাবনাই বা কিভাবে মার্জিত হবে? না তা হওয়া সম্ভব নয়। হাল আমলে যখন সমরেশ মজুমদার ‘কালপুরুষ’ লিখেছেন, সেখানেও কিছু অংশে অজস্র ‘স্ল্যাং’ রয়েছে। কিশোরটি সমাজের যে স্তরের সঙ্গে মিশছে তাকে বোঝাতে কি মার্জিত ভাষা ব্যবহার করা যায়! অতি ধনী এবং অতি দরিদ্র সমাজ দুজায়গাতেই যে ক্লেদ, ভাষাকেও তো তার উপযোগী হতে হবে। এ তো একান্তই সাহিত্যের প্রয়োজন। সমাজকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে হলে এভাবে নগ্ন করে তুলে ধরাটাই উচিত, এবং এই নগ্নতা কোনোভাবেই অশ্লীল নয়। বরং এই উদ্দেশ্যে মার্জিত ভাষা ব্যবহার করা হলে তা হবে মোজা পরা নগ্ন মেয়ের ছবির মত, এবং এতদিনের শ্লীল-অশ্লীল-এর বিচারে এই ছবিকে অশ্লীল-ই বলতে হবে। একইভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে নবারুণের সাহিত্যভাষাকেও। নবারুণ নিজেই বলছেন, “যে-ধরণেই লিখি না কেন সেটা শুধু ব্যক্তিগতের কাহিনী যেন না হয়ে ওঠে। আমি চাই নৈতিকতা, মানবনীতি, অস্তিত্ব – এসব ব্যাপারকে স্পর্শ করছে না যে-বিষয় সে বিষয়ে আমার কোনো উৎসাহ নেই। এর সঙ্গে আর একটা দায় আখ্যানের আছে – সেটা দলিল তৈরি করা, ডকুমেনটেশন” (নবারুণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে কথাবার্তা, দেবেশ রায়, অক্ষরেখা, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৮) তাই যখনি লিখছেন নবারুণ, সমাজের আলগা পলেস্তারাটা ঘষে তুলে দেবার জন্যই লিখছেন, ডকুমেন্টেশনই তার উদ্দেশ্য। তার গল্প-উপন্যাসের চরিত্রগুলি প্রচলিত অর্থে সমাজবিচ্ছিন্ন বা সমাজবিরোধী। হারবার্ট, কোকা, মদনা, ভদি এরা সকলেই সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধী। এবং স্বভাবতই এদের ন্যারেশনে বা এদের আঙ্গিক থেকে লেখা গল্প-উপন্যাসের ভাষাও এদের চরিত্রের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। এদের দিয়েই প্রকৃতপক্ষে সমাজের দলিল তৈরি করেছেন নবারুণ। ‘খোঁচড়’ গল্পটা দেখুন। প্রধান যে চরিত্র, অনেকদিন খুন করতে না পারলে সে অস্বস্তি বোধ করে। খুন হচ্ছে, তা স্বত্ত্বেও সবকিছু স্বাভাবিক ক’রে দেখাচ্ছে পুলিশ-প্রশাসন, এর চেয়ে বড় সমাজের দলিল আর কিছু হয়? ‘শেষ রাত’ গল্পে সমাজের নিম্নস্তরের অবাধ যৌনতা – এও কি সমাজের এক স্তরের দলিল নয়! আধুনিক বিচারে তাই নবারুণের পদক্ষেপ একেবারে যথার্থ।
খুব ছোট্ট করে নবারুণের রচনাপঞ্জীর হিসেব এইরকম (প্রথম প্রকাশ হিসেবে) —
১। উপন্যাস – হারবার্ট (প্রমা প্রাকাশনী, ১৯৯৩), ভোগী (বারোমাস, শারদ সংখ্যা, ১৯৯৩), যুদ্ধ পরিস্থিতি (প্রতিক্ষণ, শারদ সংখ্যা, ১৯৯৫), কাঙাল মালসাট (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০৩), খেলনানগর (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০৪), লুব্ধক (অভিযান পাবলিশার্স, ২০০৬), মসোলিয়ম (দে’জ পাবলিশিং, ২০০৬)।
২। গল্প সংকলন – হালাল ঝাণ্ডা (প্রমা প্রকাশনী, ১৯৮৭), নবারুণ ভট্টাচার্যের ছোটগল্প (প্রতিক্ষণ পাবলিকেশনস্ প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৯৬), অন্ধবেড়াল (সৃষ্টি প্রকাশন, ২০০১), ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক (প্রমা প্রকাশনী, ২০০১), ফ্যাতাড়ুর বোম্বাচাক ও অন্যান্য (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০৪), শ্রেষ্ঠ গল্প (দে’জ পাবলিশিং, ২০০৬), প্রেম ও পাগল (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০৭)।
৩। কাব্যগ্রন্থ – এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না (প্রমা প্রকাশনী, ১৯৮৩), পুলিশ করে মানুষ শিকার (গ্রন্থ প্রকাশনী, ১৯৮৭), মুখে মেঘের রুমাল বাঁধা (সপ্তর্ষি প্রকাশন, ২০০৬), রাতের সার্কাস (২০০৯), বুলেটপ্রুফ কবিতা (২০১৩)।
আমি বিশেষ করে উল্লেখ করেছি গ্রন্থগুলির প্রথম প্রকাশকাল এবং একটি বিশেষ উদ্দেশ্যেই উল্লেখ করেছি। বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নবারুণ বারবার ঘোষণা করেছেন যে তিনি গল্পকার বা ঔপন্যাসিক যতটা, ঠিক ততটাই কবি, বাস্তব বিচারে কিন্তু তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। মজার ব্যাপার এই যে, কথাকার নবারুণ যত পাঠকের কাছে পৌঁছেছেন, কবি নবারুণ কিন্তু সেই সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছননি। প্রকাশকালগুলি দেখলে খুব স্পষ্ট যে, তাঁর গদ্যধর্মী রচনা যেমন ধারাবাহিক, কবিতা বোধহয় ঠিক তেমনটা নয়। এ জন্যেই বোধহয় নবারুণকে অধিকাংশ পাঠক চেনেন তাঁর গল্প-উপন্যাসের জন্য, কবিতার জন্য নয়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থে তাঁর উচ্চারণ অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং অমোঘ –
“এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাস মঞ্চ আমার দেশ না...” ।
কিংবা,
“যে পিতা সন্তানের লাশ সনাক্ত করতে ভয় পায়
আমি তাকে ঘৃণা করি...” ।
তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটি কিন্তু প্রকাশিত হচ্ছে দ্বিতীয়টির সঙ্গে দীর্ঘ উনিশ বছরের ব্যবধানে এবং তাও “১৯৬৯ থেকে ২০০৫ – তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখা” কবিতা নিয়ে। তাই স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে আগের বইতে বাদ পড়া কবিতাগুলি নতুন বইতে ঠাঁই পেয়েছে। তিনি যদি কবিতা নিয়মিতই লেখেন, তাহলে তো এমনটা হওয়ার কথা নয়। সেখান থেকে শেষের দিকের কাব্যগ্রন্থে যেন একেবারে নিভে যাচ্ছেন নবারুণ, নতুন করে কিছুই যেন বলার থাকছেনা তার—
“পড়ে থাকে বড়ই একাকী
চড়াই পাখি
......
পাশে পড়ে খড়কুঠো, এ কে ফর্টিসেভেন
এভাবেই শেষ হল এবারের সব লেনদেন”।
জরুরি অবস্থার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যে নবারুণ আগুন-কবিতা লিখেছেন, পরবর্তী সময়ে তিনি এত নিষ্প্রভ কেন? শুধু কি বয়সের জন্য? অল্প বয়সে প্রতিটি সচেতন নাগরিকেরই মনে হয় যে সমাজকে পথ দেখানো একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব। আর বয়স বাড়লে যখন ধীরে ধীরে বোঝা যায়, ক্ষমতা বা রাষ্ট্রযন্ত্র কোনোকিছুই বদলাবে না, তখন সবকিছুই বড্ড অর্থহীন মনে হয়। নবারুণেরও কি এমনটাই হয়েছিল?
আসা যাক, নবারুণের গদ্যধর্মী লেখা প্রসঙ্গে। অল্পস্বল্প লেখালেখির অভিজ্ঞতায় এটুকু বলতে পারি যে, একেকসময় একেক ধরণের মাধ্যম ব্যবহার করে লিখতে ভালো লাগে। আমি প্রধানত লিখি কবিতা, মাঝেমধ্যে গল্প বা ব্যক্তিগত গদ্য, আর দায়ে পড়ে মাঝেমধ্যে প্রবন্ধ, যেমন করে সম্পাদকের চাপে এটা লিখছি আর কি! তবে এটা কিন্তু একেবারে কারণছাড়া নয়। সত্যি বলতে গেলে কোনো বিষয় সম্পর্কে প্রবন্ধ রচনা সঠিকভাবে করতে গেলে অনেকটা সময় দিতে হয় তথ্য অনুসন্ধানে। কোনো বিষয়ভিত্তিক গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমাদের ছোটবেলার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বিশেষত শারদীয়াতে যে ধরণের বিষয়ভিত্তিক গল্প-উপন্যাস থাকত, এখনকার পত্রপত্রিকা ও শারদীয়ায় সেই সংখ্যা অনেকটাই কম । তদুপরি তার মানও আগের তুলনায় কিছুটা পড়ে গেছে বলেই আমার মনে হয়। এর কারণ বোধহয় লেখকদের লেখার চাপ এবং বিষয় নিয়ে ভাবনা ও গবেষণার সময় কমে যাওয়া। এমনকি প্রতিষ্ঠিত ও প্রবীণ বহু লেখকের রচনাতেও বর্তমানে এই তাড়াহুড়োর ছাপ স্পষ্ট। অনেকসময়ই দেখা যায় যে, গল্পের শেষটা যেন তেমন অমোঘ হল না, যেমনটা হওয়া উচিত ছিল আর কি! নবারুণের লেখা কখনোই এই তাড়াহুড়ো দোষে দুষ্ট হয়নি। তার গল্প-উপন্যাসের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখলেই বোঝা যায়, তা কতটা যত্নে গড়া। এর কারণ গল্পের শেষ না ভেবে তিনি লিখতেন না। সেটাই তো স্বাভাবিক, কারণ তিনি তো সবসময় লিখছেন একটি উদ্দেশ্য নিয়ে, কেবল পাতা ভরানো বা বিপণন তো তার উদ্দেশ্য নয়। একটি সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি গল্প উপন্যাসের শেষটা লিখতে লিখতে হঠাৎ করে ভাবেন নাকি আগে ভেবে শুরু করেন। তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “শেষটা মোটামুটি ভাবা থাকে। তবে অনেক সময় আমি আগে পরে করে লিখি। হয়তো শেষ দিকটা অনেক আগে থেকেই লিখে রাখলাম।…” (উপার্জনের উদ্দেশ্যে আমি লিখি না, সাক্ষাৎকার হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়, পুনর্মুদ্রন অক্ষরেখা, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারী ২০০৮)
মেয়েদের নবারুণ নিয়ে লিখব না, আগেই বলেছি, তবে নবারুণের মেয়েদের নিয়ে লিখতে আপত্তি নেই কোনো। কোন্ মেয়েরা এলেন নবারুণের সাহিত্যে? যদিও সামান্য সংখ্যায়, তবু যারা এলেন তারা মূলত একটি বিশেষ শ্রেণিগত অবস্থান থেকেই এলেন। কিন্তু যেভাবে এলেন, তেমনভাবেই কি আসার কথা ছিল? ‘হারবার্ট’-এ ডি এস যেমন করে কনুই মারলেন এক মেয়েকে, কবি পুরন্দর ভাট ‘সাইজ করার’ চেষ্টা করলেন সে তো আজও রোজই দেখে যাচ্ছি আমরা। রোজকার সমাজে যেভাবে প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হন মেয়েরা, ভদ্র মেয়েরা যেভাবে আজও সাবধানে আঁচল বাঁচিয়ে চলার প্রাণপণ চেষ্টা করে যান, মেয়েদের মৌলিক অধিকার— অন্তত প্রাণখুলে বাঁচার অধিকার যেভাবে প্রতিনিয়ত খর্ব হয় সেখানে তো নবারুণের কষাঘাত নেমে এল না! অন্ধকার এল, কিন্তু অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখানোর চেষ্টা এল না। বেচামণি-বেগম জনসন এল, মেয়েদের চলা-বলার ধরণ এল, কিন্তু শব্দ এল না, কথা এল না। ‘ফোয়ারার সেই মানুষজন’ এবং ‘ফোয়ারার জন্য দুশ্চিন্তা’ দুটোই বলা হল তার প্রেমিক (পড়ুন ‘লাভার’)-এর ভাষ্যে। ‘মার্ডারারের ভাই’ গল্পে ব্যাকগ্রাউণ্ডে একজন মেয়ের কথা এল, কিন্তু মার্ডারারের ভাই তাকে দুষল এবং সে চরিত্রটি এতই অপ্রধান যে সেই ন্যারেশনই থেকে গেল, অন্য কোনো প্রেক্ষিত থেকে তাকে দেখা হল না, বা দেখার দরকারও পড়ল না। ‘প্রতিবিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক’ গল্পেও ব্যাকগ্রাউণ্ডে এল একজন মেয়ে, চেতনার মত হয়ে, কিন্তু সেটাও চরিত্র হয়ে উঠল না। আর ‘হারবার্ট’-এ? সেখানেও বুকি এল, তার জন্য হারবার্ট গুমরে কাঁদল, কিন্তু কোনো পূর্ণতা পেল না চরিত্রটি। আসলে মেয়েদের মন পড়তে পারলেন না নবারুণ, শুধু শরীর দিয়ে বিশ্লেষণ করলেন তাদের। সমাজকে নগ্ন করে দেখাতে তার লেখনী যতটা সফল, মেয়েদের প্রসঙ্গে তা যেন ঠিক ততটাই ব্যর্থ। একজন লেখক যে যুগে দাঁড়িয়ে লেখেন, সে যুগের ছাপ তার লেখনীতে আসবেই, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এইজন্যেই, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দেবী চৌধুরাণী’-তে অত বড় বিপ্লব ঘটালেও শেষরক্ষা হল না; শেষ দৃশ্যে প্রফুল্ল সে-ই ঘাটে বসে বাসন মাজতে লাগল। যুগের সামনে গিয়ে মেয়েদের দেখতে পারলেন না বঙ্কিমচন্দ্র, এবং সে যুগের প্রেক্ষিতে সেটা ততটা দোষণীয়ও নয়। কিন্তু নবারুণ! তিনি যে যুগে দাঁড়িয়ে, সেখানে কি এতটা উপেক্ষা আসা উচিত ছিল? মহাভারতের কর্ণ-র কথা মনে পড়ল নাকি আপনাদের? দ্রৌপদীর প্রতি দ্যূতসভায় তাঁর আচরণ? এ আমার মৌলিক ভাবনা নয়, কিন্তু ‘পাঞ্চজন্য’-এ যেভাবে কর্নের আচরণ বিশ্লেষণ করেছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্র, তা আমার বেশ স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছিল। স্বয়ম্বর সভায় যোগ্য প্রার্থী কর্ণকে যেভাবে তীব্র ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন দ্রৌপদী এবং দ্রৌপদীর প্রতি যে ব্যথা ছিল কর্ণের মনে, যা প্রেম ও ঘৃণার মাঝামাঝি একটা অবস্থান, তা থেকেই দ্যূতসভায় দ্রৌপদীর প্রতি অমন উগ্র হয়ে উঠলেন কর্ণ। মেয়েদের সম্পর্কে নবারুণেরও কি এমনটাই হল? কোনো আকৈশোর লালিত ঘৃণা থেকেই কি মেয়েদের এমনভাবে দেখলেন তিনি!
এই দেখুন, নবারুণকে নিয়ে লিখলাম, কিন্তু এই মার্জিত ভাষায়! তাহলেই বুঝুন, সে ভাষায় লেখা কেমন শক্ত। একটা প্রবন্ধই যে ভাষায় লিখে উঠতে পারলাম না, সে ভাষায় গল্প-উপন্যাসে সমাজকে তুলোধোনা করলেন নবারুণ। কিন্তু শেষ অব্দি, নবারুণ-পাঠ কতগুলো প্রশ্ন নিয়েই রয়ে গেল। নবারুণকে যতটুকু পড়েছি, তার ভিত্তিতে এই লেখা, পুরোটা আমার পড়া নয়, তাই এ লেখা ত্রুটিমুক্ত বলে আমি দাবি করছি না। এই প্রশ্নগুলো আসলে নবারুণকে বোঝারই চেষ্টা। তবু যেমন করে অমূল্য সামাজিক দলিল হয়ে রইল প্যারীচাঁদ-কালীপ্রসন্নের সাহিত্য, যে অর্থে কালজয়ী হয়ে উঠল সেগুলি, সেই অর্থে নবারুণের সাহিত্য সত্যিই কালজয়ী হল কিনা তার বিচার কেবলমাত্র ভবিষ্যৎ সময়ের কষ্ঠিপাথরেই হওয়া সম্ভব।