আগামী পৃথিবী যদি হিংসা-যুদ্ধ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের হয়, তবে তা পুরুষের। আর যদি তা হয় ভালবাসা, করুণার, সেবার – তবে সেই পৃথিবীতে আধিপত্য করবে মেয়েরাই। না না, আমি নই! বিতর্কিত কথাটা বলে গেছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
সুতরাং নারী মানে যদি কোমলতা হয়, তাহলে পুরুষ মানেই – কঠোরতা, কর্কশ রুক্ষতা। সেই অর্থে নবারুণও রুক্ষ, কর্কশ – পুরুষালি।
‘মস্তির নামে খাই চোলাই
ব্যাডলাক হলে রামধোলাই’
এভাষা একান্তভাবেই ব্যক্তিগত ও দলগত পুরুষের। পথচলতি পুরুষের মুখে, ট্রেনেবাসে, ক্লাবে চলিত পুরুষালি সংস্কৃতির।
কিন্তু চিরকাল এমনি ছিল না। কবি নবারুণের লেখনী। সাহিত্যজীবনের নবারুণকালে পেশিশক্তির বিপক্ষে যখন কলম ধরেছিলেন তিনি, তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছিল ঋজু ভদ্র অথচ কোমল প্রতিবাদ –
‘বাংলা দেশের কবিরাও লোরকার মতো প্রস্তুত থাকুক
হত্যার শ্বাসরোধের লাশ নিখোঁজ হওয়ার
স্টেন্গানের গুলিতে সেলাই হয়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত থাকুক
তবু, কবিতার গ্রামাঞ্চল দিয়ে কবিতার শহরকে
ঘিরে ফেলবার একান্ত দরকার।’
[এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না]
আর শতকান্তে সেই কবিই প্রতিবাদের পথ বদলে এলেন ফাজলামিতে-ফিচকেমিতে। সোজা পথের কবিতা বেঁকে গেল ব্যঙ্গের পথে –
‘কেহই বোঝেনি মোরে কেহই বাঁধেনি ডোরে
কেহই দেয়নি গলে মালা,
সকলেই লাথায়েছে বঁড়শিতে গাঁথায়েছে
বলিয়াছে, মর্ তুই শালা।
তাই আমি বলি ধিক্! হাসি শুধু ফিক্ ফিক্
গোপনে করিয়ে যাই ট্রাই,
কবে সব শালাগণে জড়ো করি কচুবনে
একযোগে করিব জবাই!
[কনফেশন]
এই ব্যাঁকাচোরা পথে সত্যিকথা বলার পদধ্বনি শোনা গেছিল হারবার্টের কবিতার খাতায়
‘স্থলবায়ু বহে বেগে জলবায়ু ভালো নয়
অক্টোপাসের ভয় কি হয়, কি হয়’
চৌবাচ্চার তেলাপিয়ার গঙ্গাসাগরে যাত্রার গল্প হারবার্ট। কিন্তু ‘ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ’-এর পরও সেখানে জ্বল্জ্বল্ করে একটি বাক্য –
‘কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।’
বিস্ফোরণ ঘটছিল, আর তা নবারুণের মধ্যেই। বদলাচ্ছিলেন কবি। কবি নবারুণ ভটাচার্যের পরিচয় বদলে যাচ্ছিল কবি পুরন্দর ভাটের মধ্যে। যেমন সাহিত্যসম্রাট ঔপন্যাসিক বঙ্কিম মন খুলতেন আফিংখোর কমলাকান্তের মুখোশের আড়ালে – হয়তো তেমনিভাবেই পুরন্দর ভাট ছদ্মনামটাই আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল সময়দীর্ণ নবারুণের। কবি নবারুণ সিরিয়াস – তার থেকে শতযোজন দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছ্যাবলামোভরা গদ্যকার নবারুণ। কিন্তু ধীরে ধীরে দুইধারা মিলেমিশে গেছে। তাই ২০১২ সালে ‘ভাষাবন্ধন প্রকাশনী’ থেকে প্রকাশিত ‘পুরন্দর ভাটের কবিতা’-তে কোথাও নেই নবারুণ ভট্টাচার্য! সেখানে ফিক্ফিক্ হেসে কপিরাইটের দাবি করেন ফ্যাতাড়ু ও চোক্তারেরা! সেখানে উৎসর্গ পত্রে লেখা থাকে – ‘সব খচ্চর ও হারামিদের’!
হারবার্ট তাঁর প্রথম পদক্ষেপ – সবকিছু উলটে ফেলার, উলটে বলার প্রথম পদক্ষেপ। তবু সেখানেও কোথাও কোথাও উঁকি দিয়ে যান জীবনানন্দ – তাঁর মহানাগরিক ‘রাত্রি’ নিয়ে। ‘হাইড্রেন্ট খুলে নিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল’ – এ বর্ণনাই মনে পড়ে যায় যখন পড়ি হারবার্টের মৃত্যুর রাত – ‘চাঁদের গায়ে স্যাঁত্লা। রাস্তার আলোগুলোর পাশে ফেনা ফেনা আলোর গুঁড়ো। গরমে সব হড়কে যাচ্ছে। পেটের অন্তেরা থেকে চপ, চানা আর হুইস্কি, রাম, বরফ জল সব গ্যাঁজগেঁজিয়ে উগরে আসছে। নর্দমার ঝাঁঝরি দিয়ে ভুরভুর করে আরশোলা বেরিয়ে রাস্তার আলো তাক করে উড়ে যাচ্ছিল। কোকা দত্তদের বাড়ির গেটের গায়ে বমি করেছিল। গরম, টক, হড়হড়ে সেই বমির ঝাঁঝটা কোকা আজও ভোলেনি।’ আর পরবর্তীতে কবি পুরন্দর এই বর্ণনার তীব্রতাকে আরও ঘনীভূত করবেন –
‘চারদিকে ছনছন সারা গায়ে ঘিন ঘিন
থই থই, ছপ ছপ ইউরিন! ইউরিন!’
প্রশ্ন জাগে – তবে কি বিপ্লবী নবারুণের বিদ্রোহ থেমে গিয়েছিল পাগলামিতে? নষ্টামিতে? যেমন নবারুণের নিপাট অভদ্রতাকে শিখন্ডী করে আধুনিক গদ্যসাহিত্যে একদল নতুন হুতোম প্যাঁচার আবির্ভাব হয়েছে, তেমনই কি নিছক বাজারি হাততালির মোহে রেবেল পোয়েটও কেবল খিস্তিখেউড়ের পথ ধরেছিলেন! না, তা তো নয়ই। প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে নবারুণের লড়াই জারি থেকেছে! বরং আরও তীব্রতর হয়েছে ব্যঙ্গের অস্ত্রধারণ করে! স্পষ্টবক্তা নবারুণ অন্ধ দাসবৃত্তিকে সপাটে চড় কষিয়েছিলেন তাঁর পদ্যে –
‘শব্দ আমার কাছে চুইংগাম
মৃত বুদ্ধিজীবির টেলিফোন নম্বর
মনোপলি দৈনিকের অশিক্ষিত
সম্পাদককে খুশি করার পাসপোর্ট বা প্রসাধন নয়’
[ভিয়েতনামের ওপর কবিতা]
পরেও নবারুণ একই রকম স্পষ্টবাদী, কেবল হুলটি আরও তীক্ষ্ণ হয়ে বেঁধে পুরন্দর অবতারে – যখন তিনি লেখেন :
‘যতই তাকাস আড়ে আড়ে, হঠাৎ এসে ঢুকবে গাঁড়ে,
বাম্বু-ভিলার রেকটো-কিলার গাঁট-পাকানো বাঁশ,
আজ্ঞাবহ দাস রে আমার, আজ্ঞাবহ দাস।’
যে পরিবর্তনের গাছ গজিয়ে উঠছে এখন দিনে দিনে, নগর-গ্রামে, আমাদের মনের ভিতর, তারই আরেক ফুল নবারুণ ভট্টাচার্য। যিনি দিনবদলকে অস্বীকার করেননি। বদলেছেন ভাষা – বদলাননি ভাব।
‘একটা কুঁড়ি বারুদগন্ধে মাতাল করে ফুটবে কবে
সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।’
[একটা ফুলকির জন্যে]
সত্তর দশকের কবি নবারুণের এই রোমান্টিকতা ধুয়ে মুছে সাফ করে একুশ শতকের কবি পুরন্দর ভাট যেন পাগলা দাশু সাজেন। নির্বিকার অশ্লীলতায় তিনি আওড়ান –
‘যেরকম কোঁকড়া কোঁকড়া ঝাঁট
যেরকম সেলুন ও দর্জির ছাঁট
সেরকমই আমি ও আমার কাব্য
কহে কবি পুরন্দর ভাট’
হয়তো নবারুণ হতাশ, হতাশা থেকেই পুরুষালি। কিন্তু আমাদের, তার নারীপাঠিকাদের আশাবাদী হতে কে আটকায়? শুধু একটাই ভয় – এই ভাষার কামড়ে নতুন প্রজন্মের সাহিত্যনবিশরা নতুন জোম্বিতে পরিণত হবে না তো! ভয় হয় – আজকালকার কিছু সাহিত্য, কিছু সিনেমা দেখে! ভয় হয় – সোশাল মিডিয়ায় পুরন্দর ভাটের জারজ সন্তানদের দেখে! বাপের অনুকরণে অক্ষম ব্যাটারা কেবল ‘বাল ও ভাটের বুকনি’ দিয়েই থেমে যাবে না তো? নবারুণের ‘ধক্’ নেই, তবু নবারুণের দোহাই দিয়ে সব হারামিরাই নিজেদের চোক্তার আর ফ্যাতাড়ু বলে পরিচয় দিচ্ছে না তো?