দুহাজার পাঁচ সাল। বাড়িতে দিদির বিয়ের ম্যাট্রিমনি দেখবার জন্যে আনন্দবাজার কাগজ রাখা শুরু হয়েছে। তার আগে বাড়িতে কাগজ বলতে আসতো বিশুদ্ধ গণশক্তি। সুতরাং পাঠের অভ্যাসও গণশক্তি মাফিকই ছিলো। মনে বড় সাধ বিশ্বজোড়া যৌথ খামার, বিপ্লব টিপ্লব এইসব। তখন সবে কলেজে যেতে শুরু করেছি। এবং দিন বদলের স্বপ্ন দেখার সেই তো বয়েস।
যাই হোক। এমন একদিন কাগজে হারবার্ট সিনেমার রিভিউ বেরোলো। এবং আমি সেই অমোঘ বাক্যবন্ধ পড়লাম। যেহেতু হারবার্ট সম্ভবতঃ নবারুণের বইগুলির মধ্যে সর্বাধিক পঠিত, সুতরাং পুনরুল্লেখ বাদ থাক।
বাবা আমাকে নিয়ে যেতেন কলেজস্ট্রীটে বই কিনতে। মাটিতে পড়ে থাকা বইয়ের রাশ থেকে আলতো হাতে তুলে নিলাম হারবার্ট আর কাঙাল মালসাট। সেই আমার প্রথম সচেতন নবারুণ পাঠ। আমি সাহিত্যের ছাত্রী নই। বস্তুতঃ অদীক্ষিত পাঠক। সুতরাং নবারুণ কতটা উত্তর-আধুনিক, কত সমাজ সচেতন সেটা বোঝা বা জানার এবং অবশ্যই প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি তাই নবারুণের লেখাগুলো গল্প হিসেবে পড়ি। যে গল্পে আমার মধ্যে কেবলি দৃশ্যের জন্ম হয়।
বহুদিন আগে বইমেলায় নবারুণের প্রেম ও পাগল নামের একটি বই কিনেছিলাম। সেখানে সম্ভবতঃ ‘জনৈক নৈরাজ্যবাদীর সংবাদ’ (বইটি কোনো বন্ধুজনে চক্ষুদান করেছেন, তাই একটু সন্দেহ রয়েই গেলো) নামের একটি আখ্যান ছিলো। একটি নৈরাজ্যবাদী পিওন গোপনে তার নাশকতা ছড়াচ্ছে বিড়ির টুকরো (কারণ বিড়ির কোনো স্টাম্প বা বাট হয় না।) পোস্টবক্সের মধ্যে ফেলে। পরেরদিন চিঠির গায়ে ছোট্ট ছোট্ট পোড়া দাগ। এবং আমার ধারণা হয় যদি আমরা একাধিকজনে বিড়ির টুকরোগুলো পোস্টবক্সে ফেলি, হয়তো একদিন তা সর্বগ্রাসী অগ্নিকান্ড হবে। পুড়ে যাবে গোপন সংকেতবার্তা। পুড়ে যাবে সামরিক তথ্য। কে জানে এই সব ছোট ছোট বিড়ির আগুনের মতো ব্যক্তিগত বিপ্লব একদিন সমষ্টিগত রূপ নেবে।
কাঙাল মালসাট প্রথম পড়ি যখন তা ধারাবাহিক বেরোচ্ছিল। বইটা আমি দ্বিতীয়বার পড়ি যখন কলেজে। [আজও (অহঙ্কার নয়) কাঙাল মালসাটের কিছু কিছু অংশ আমি মুখস্থ বলতে পারি।] ডিএন-১৮ বাস ধরতাম খালপাড় থেকে। চাকার উপরকার সীটে গুছিয়ে বসতাম। তারপর ঘন্টা দেড়েক নির্বিঘ্ন নবারুণ যাত্রা। ক্লাসের অন্য ছেলেরা বইটা একদিন পড়বে বলে নেয়, এবং জানায় ‘বাহ, বেশ খিস্তি আছে তো’। আমি যুগপৎ বিমর্ষ ও আনন্দিত হই। বিমর্ষতার হেতু বন্ধুরা বুঝতে পারছে না, আর আনন্দিত কারণ আমি না বুঝলেও প্রতিটি বাক্যবন্ধ ও বাক্যের মধ্যবর্তী নীরবতাটুকু অনুভব করতে পারছি। যার বক্তব্য খুব পরিষ্কার না হলেও আমার মাথার মধ্যে শিকড় গেঁড়ে বসছে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমার শৈশবের শিক্ষায়। বিদ্রোহ বিপ্লব মুক্তি। কিন্তু তার বাইরে আরো ম্যাজিকাল কিছু ঘটছে। দৃশ্য। যাকে আধ্যাত্মিক অরার সাথে তুলনা করা যায়। একটা ছোট্ট স্পেসিমেন। কাঙাল মালসাটের গোড়ার দিককার ছোট্ট চারলাইন কবিতা। ‘ওই দেখো ঢুলু ঢুলু গ্রাম / মাঝে মাঝে হাঁটে জলপিঁপিঁ / ক্যাঁতামুড়ি চাষা, চাষা-বউ / নাক ডেকে যায় ফুলকপি।’ খুবই অকিঞ্চিৎকর একটি চতুষ্পদী। অথচ আজ অবধি যখনই আমি এটা পড়ি বা বলি আমি দেখতে পাই চিলেকোঠার ঘরে মাদুর পেতে পড়তে বসেছি। আবছা কুয়াশা ঘেরা মাঠের উপর দিয়ে উত্তরে হাওয়া দিচ্ছে, সে হাওয়াতে জটবাঁধা কুয়াশাও কেঁপে উঠছে। মেহগনি গাছে শালিখেরা নিজেদের পিঠ চুলকাচ্ছে, আমার সামনে ধোঁয়াওঠা চায়ের গেলাস। এবং এই ভরা বর্ষাতেও আমার ঘরে হাত পা সমেত একটা গোটা শীতকাল উঠে আসছে। আমি টের পাচ্ছি আমার শিরদাঁড়ায়।
আমার আরেকটি প্রিয় উপন্যাস ‘ভোগী’। অনেক পুণ্য করলি পরে ভোগী দেখা যায়। চারদিকে এতো অনাচার অত্যাচার এইসব অনাছিষ্টি দেখে তবেই ভোগী আসে। এবং আত্মঘাতী হয়।
ভোগী উপন্যাসটি আমার কাছে সিনেমাটিক দ্যোতনা নিয়ে আসে (যেমন আসে ছোট গল্প ‘ফুল, মাছ...’। এবং ভোগীর মতই সে গল্পটিও ক্যামেরার চোখে দেখা)। সেই একজন বিশ্ববিশ্রুত পরিচালক একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন না সেখানে মৃত্যুর সাথে দাবাখেলার একটি অনৈসর্গিক দৃশ্য ছিলো। গা’য়ে কাঁটা দেওয়া। ভোগী পড়তে পড়তে আমি কণ্টকিত হয়ে উঠি। (গায়ে কাঁটা অর্থে নয়)। আমার পাশের জন এবং আমি নিজেও হয়তো ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করতে করতে কোথাও যাচ্ছি, কিন্তু আমাদের আত্মত্যাগ নেই, অপনোদনের ক্লান্তি আছে বলে কোনো ফল নেই। আমার চারপাশে অতৃপ্ত ভোগবাসনা চেপে রেখে আত্মহত্যার দিকে, স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে কত যাতায়াত। আমার পাপের দায় কেউ তো নেয়। কেউ তো নেবে। কেউ তো নিক। এবং ভোগীর শেষে গিয়ে আমার ক্লান্ত লাগতে থাকে।
খেলনানগর আরেকটি উপন্যাস। আমাকে দেখায় জাদুগোড়া। গত পঞ্চাশ বছর ধরে তেজস্ক্রিয় বিষে মরে যেতে থাকা একটা জনপদ। আমার পুতুল কারখানার শেষ দুই শ্রমিকের জন্যে অসম্ভব কান্না পায়। তাদের স্বপ্নে সেই রুগী মানুষটিকে তারা দেখে যার পাথর কুড়িয়ে হাতিয়ার করে ফেলার মূর্তি অমর হয়ে আছে কোন এক উদ্বুদ্ধ সোভিয়েত ভাস্করের দুরন্ত খোদাই কাজে। দুই বিশ্বস্ত সৈনিকের ঘুমের সময় দেওয়াল জুড়ে পাহারায় থাকেন মার্কস ও লেনিন। আন্দোলন থেকে এক আঙ্গুলও পিছু না-হঠার নির্দেশ বলবৎ থাকে। আমার বাবার জন্যে কান্না পায়। রোগা রোগা হাতে ওঠা শির। আন্দোলন থেকে এক আঙ্গুল পিছনে না-হঠার নির্দেশ যাঁর জন্যে জারি আছে। বৃদ্ধ বয়েসেও যিনি এখনও স্বপ্ন দেখেন বিপ্লব আসবেই। হাতে হাতে কাজ হবে। পেটে পেটে ভাত। যৌথ খামার। না খেতে পাওয়া বাচ্চারা স্কুলে যাবে।
সুতরাং এই ভাবে আমার ব্যক্তিগত পরিসরে ক্রমাগত পেনিট্রেট করতে থাকেন নবারুণ। আমি তাকে গুরু মুর্শেদ মানতে থাকি। বিখ্যাত পিতা-মাতার সন্তান এই আন্ডাররেটেড লেখক কোনো ভাবে আমার আত্মীয় বনে যান। অবিসংবাদী বন্ধু। আমিও তাই ঠিক করি ‘আমাকে কেনা সহজ নয়’। কোনোভাবেই না। সবকিছু বিক্রয়যোগ্য যে কালে সেখানে শেষ অবধি আমার ধারণা নবারুণের লেখায় আপোষ কেনা যায়নি কোনো। তাই আমি ভালোবাসি লেখাগুলো, ভালোবেসেই যাই।
[আর যদি বিষয় হয় লেখা ও নবারুণ। তাহলে আমি আরো কিছু চিনি নবারুণকে। তাঁর মায়ের লেখায়। মা সবে ‘ঝাঁসির রানী’র জন্যে ফিল্ড ওয়ার্ক সেরে ফিরেছেন। ছোট্ট বাপ্পা মায়ের আঁচল ধরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলছে ‘মা আজ রান্না করবে’।
ঝাঁসির রানীর কন্টেক্সটে মনে পড়লো হঠাৎ রানী যুদ্ধে যাচ্ছেন পিঠে বাঁধা আনন্দরাও। এরকম একটা ছবি দেখতাম প্রায়ই।
ইতিহাস কতরকম রঙ্গই যে করে। ]