পরমাণু বিদ্যুতের বেহাল অবস্থা
পরমাণু অস্ত্রধারী দেশই পরমাণু বিদ্যুতের মূল প্রবক্তা। পরমাণু শক্তিবিরোধী আন্দোলনকারীরা বরাবরই বলেন, পরমাণু বোমা আর চুল্লি যমজ ভাই। প্রবক্তারা চিরকালই তা অস্বীকার করেছেন। এখন, সে কথা যে যথার্থ তার সমর্থন মিলেছে জার্মানির এক বড় গবেষণায়। ২০১৮ সাল পর্যন্ত গোটা বিশ্বে তৈরি হওয়া ৬৭৪টি পরমাণু চুল্লির আর্থিক হালচাল নিয়ে গবেষণা চালিয়ে জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইকনোমিক রিসার্চ দেখেছে যে, পারমাণবিক রাষ্ট্র সামরিক কারণেই পরমাণু বিদ্যুতের প্রসারে আগ্রহী। ২০১৯ সালে তারা জানিয়েছে: বেসরকারি মালিকানায় যে সব চুল্লি তৈরি হয়েছে তাদের উৎসাহ দিতে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চুল্লি তৈরি হয়েছে আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করে। পরমাণু বিদ্যুৎ কখনোই আর্থিকভাবে লাভজনক হয়নি। একটি বেসরকারি চুল্লিও প্রতিযোগিতামূলক অবস্থায় তৈরি হয়নি, বহুক্ষেত্রে আবার চুল্লি স্থাপনের আসল উদ্দেশ্য ছিল সামরিক।
দুই দশক ধরে প্রচার চলেছে, জলবায়ু বদল ও কার্বন নিঃসরণ রোধে, জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে উৎপন্ন বিদ্যুতের বিকল্প হল পরমাণু বিদ্যুৎ। অথচ উৎপাদন ক্ষমতার বিচারে পরমাণু শক্তির ভাগ কমছে। বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপায় হিসেবে পরমাণু চুল্লি পছন্দের তালিকায় নেই। নতুন চুল্লি চালু হচ্ছে কম, পুরনো চুল্লি একে একে বন্ধ হচ্ছে। ১৯৯৬ সালে তা পৃথিবীর ১৭.৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করত, আজ করে ১০.৩ শতাংশ। ২০০৪ সালে চালু ছিল ৪১৩টি চুল্লি, ১৬ বছর পরে ২০২০ সালেও চুল্লির সংখ্যা সেই ৪১৩টি (মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৩৬৩ গিগাওয়াট)। উৎপাদন ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল ২০০৬ সালে, ৩৬৮ গিগাওয়াট।
নির্মীয়মান চুল্লির সংখ্যা দিন দিন কমছে। ২০১৭ সালে চলছিল ৫০টির কাজ, তারমধ্যে ৩৩টিই চালু হবার নির্ধারিত সময় থেকে অনেক বছর পিছিয়ে ছিল। কিছুদিন আগেও চিনে চুল্লি তৈরি করতে সময় লাগত সবচেয়ে কম, গড়ে ৫ বছর। এখন লাগছে ৮/৯ বছর। ২০১০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বিশ্বে যে ৬৩টি নতুন চুল্লি চালু হয়েছে তা তৈরি করতে সময় লেগেছে গড়ে ১০ বছর। চুল্লি তৈরি করতে দেরি এবং খরচ অনেক বেড়ে চলাই পরমাণু বিদ্যুতের প্রসারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
২৫৪টি চুল্লির বয়স তেত্রিশ পেরিয়েছে, ৮১টির বিয়াল্লিশ বছর। বেশিরভাগই আমেরিকায়, কিছু ফ্রান্সে। আমেরিকায় চল্লিশ পেরনো অনেক চুল্লির মেয়াদকাল বাড়িয়ে ষাট বছর করা হয়েছে। ফ্রান্সে কয়েকটির আয়ু দশ বছর করে বাড়ানো হয়েছে। যেহেতু চুল্লির সংখ্যা আর তেমন বাড়ছে না, তাই মেয়াদকাল বাড়িয়ে পরমাণু বিদ্যুতের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা চলছে। তবে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ১৯০টি চুল্লির উৎপাদন বন্ধ করে দিতে হবে। তাই বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতা ধরে রাখতে হলে গত দশ বছর যে হারে চুল্লি তৈরি হয়েছে সেই হার তিন-চার গুণ বাড়াতে হবে, যা নিতান্তই দূরাশা।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি পৃথিবীতে মোট ৩২টি চুল্লি লংটার্ম আউটেজে (এলটিও) ছিল। কোনও চুল্লি অন্তত দু’বছর ধরে বন্ধ থাকলে তা এলটিও-তে রয়েছে বলে ধরা হয়। জাপানে এলটিও-তে ছিল ২৬টি চুল্লি, ভারতে দুটি এবং আর্জেন্টিনা, চিন, ফ্রান্স ও তাইওয়ানে একটি করে। জাপানে ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর নিরাপত্তার কথা ভেবে সমস্ত চুল্লি (৫৪টি) বন্ধ করে দেওয়া হয়, কয়েকটি চিরতরের জন্য। পরে, ২০১৭ সালে মোট পাঁচটি এবং ২০১৯ সালে আরও চারটি চুল্লি চালু হয়। বাস্তবে মাত্র ন’টি চুল্লি চালু থাকলেও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির (আইএইএ) হিসেবে পৃথিবীতে চালু ৪৫৩টি চুল্লির তালিকায় জাপানের চুল্লি সংখ্যা ৪২টি। ২০১১ সালে ফুকুশিমা পরমাণু বিপর্যয়ের পর এতদিন ধরে বন্ধ চুল্লিকে চালু হিসেবে দেখানোর উদ্দেশ্য পরিষ্কার। আইএইএ দেখাতে চায় যে, পরমাণু চুল্লির সংখ্যা ও উৎপাদন ক্ষমতা কমছে না।
২০১৮ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত পৃথিবীতে ১৭৩টি চুল্লি চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১৯টি ভেঙ্গে ফেলার (ডিকমিশনিং) কাজ শেষ হয়েছে -- আমেরিকায় তেরোটি, জার্মানিতে পাঁচটি এবং জাপানে একটি। ডিকমিশনিং প্রযুক্তিগত ভাবে খুবই জটিল ও ব্যয়সাপেক্ষ কাজ। অথচ তা থেকে দেশের লাভ বা আয় কিছু নেই। কাজে অবহেলা বা গাফিলতি হলে মানুষ বিকিরণের শিকার হবে। তাছাড়া প্রায় প্রতিটি দেশে পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদের সংখ্যায় টান পড়ছে।
জলবায়ু বদলের জন্যও পরমাণু বিদ্যুৎ বিপন্ন। বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পরমাণু চুল্লিতেই সবচেয়ে বেশি জল লাগে, চুল্লির অন্তস্থল ঠান্ডা করতে ক্রমাগত ঠান্ডা জলের ধারা বজায় রাখতে হয়। তাই বেশিরভাগ চুল্লির অবস্থান হয় সমুদ্র, নদী বা বড় হ্রদের পাশে। তাপমাত্রা বাড়ার প্রভাবে চুল্লিতে জলের জোগানে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বেড়ে চলা খরার ঘটনায় চুল্লির বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রভাব পড়ছে। ২০১৯ সালে ইউরোপে খুবই গরম পড়েছিল। তাই ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডের পরমাণু বিদ্যুৎ পরিষেবা চুল্লি চালু রাখার ক্ষেত্রে কিছু কড়া পদক্ষেপ নেয়। যেসব চুল্লির অন্তস্থল ঠান্ডা করতে জল আনা হয় নদী থেকে, সেগুলোর কর্মক্ষমতা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, কয়েকটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফ্রান্সে চারটি চুল্লি বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। এইরকম ঘটনা কিন্তু বাড়বে, চরম আবহাওয়া বাড়ছে। সে দেশে পরমাণু চুল্লির অন্তস্থল ঠান্ডা করতে মিষ্টিজলের শতকরা ৫১ ভাগ ব্যবহার করা হয়।
সৌর ও বায়ুবিদ্যুতের তুলনায় পরমাণু চুল্লি তৈরি করতে সময় লাগে বেশি, উৎপাদন খরচও অনেক বেশি। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনই যদি আসল উদ্দেশ্য হয় অত দীর্ঘ সময় ধরে কেউ বসে থাকতে চাইবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১৮ সালে সিমেন্স কোম্পানি মিশরে ১৪.৪ গিগাওয়াটের প্রাকৃতিক গ্যাস কম্বাইন্ড সাইকেলের কাজ শেষ করে গ্রিড সংযোগ করেছে। কাজ শেষ হয় শুরু হওয়ার ২৭ মাসের মধ্যে, চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার আড়াই বছরের মধ্যে। ওদিকে কয়েক বছরের মধ্যে মিশর বায়ুবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে করেছে ৭.২ গিগাওয়াট।
আমেরিকায় পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা মোট বিদ্যুতের ২০ শতাংশ (তাপবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১০ বছরে অর্ধেক হয়ে দাঁড়িয়েছে ২০ শতাংশ, প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে হয়েছে ৪৪ শতাংশ, বায়ু ও সৌরবিদ্যুৎ যথাক্রমে ৭ ও ২ শতাংশ)। ভর্তুকি না পেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু চুল্লি মেয়াদকালের আগেই বন্ধ হয়ে যেত। নতুন চুল্লি তৈরি হচ্ছে না বলে প্রায় অর্ধেক চুল্লির মেয়াদকাল বাড়িয়ে ষাট বছর করা হয়েছে। পঁয়ত্রিশটা পুরনো চুল্লির খরচ বাড়তে বাড়তে অলাভজনক হয়ে পড়েছে। সেরকম বেশ কয়েকটা চুল্লিকে ‘জিরো এমিশন ক্রেডিট’-এর অজুহাতে অর্থ দেওয়া হয়েছে, যাতে পরিষেবা পরমাণু বিদ্যুতের ব্যবসা গুটিয়ে না নেয়। তারপরও ছ’টা চুল্লি বন্ধ করে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছে। যেখানে সরকারই পরিষেবার মালিক অথবা চুল্লির জন্য বিপুল ভরতুকি দেওয়া হয় সেইসব দেশই এখনও পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহী।
আজন্মকাল পরমাণু বিদ্যুৎ শিল্পের প্রধান প্রচার ছিল – তা সবচেয়ে সস্তা, ‘টু চিপ টু মিটার’। এত সস্তা যে মিটারে মাপার দরকার হবে না। অথচ দামের প্রতিযোগিতায় একেবারেই পেরে উঠছে না। আমেরিকায় দুটি চুল্লি তৈরির জন্য বেশ কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করার পর আর্থিক ক্ষতি আর না বাড়াতে ২০১৭ সালে তৈরির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। খরচ যেভাবে বাড়ছিল, তাতে বিদ্যুৎ বিক্রি করে লাভের মুখ দেখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
যে সব দেশের বিদ্যুৎ বাজারে প্রতিযোগিতা রয়েছে, সেখানে পরমাণু চুল্লি স্থাপনের উদ্যোগ নেই। সরকার কিংবা গ্রাহকরা যেখানে বিদ্যুতের খরচ বেড়ে যাওয়া বা চুল্লি তৈরিতে দেরি হওয়ার ঝুঁকি নিতে রাজি সেখানেই চুল্লি স্থাপনের কাজ চলছে। বিষয়টি বোঝাতে সাম্প্রতিক যে কোনও বছরের উদাহরণ দেওয়া যায়। ২০১৭ চারটে বাণিজ্যিক পরমাণু চুল্লি তৈরিতে মোট বিনিয়োগ হয়েছিল প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার গিগাওয়াট (এই হিসেবে চিনের পরীক্ষামূলক চুল্লি সিএফআর-৬০০-কে ধরা হয়নি)। একই বছর নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগ হয়েছে ২৮০ বিলিয়ন ডলার। বায়ুবিদ্যুতে ১০০ এবং সৌরবিদ্যুতে ১৬০ বিলিয়ন ডলার। ওই বছর চিন পরমাণু বিদ্যুতে যে বিনিয়োগ করেছে তার আটগুণ করেছিল নবায়নযোগ্য শক্তিতে। সে বছর পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছিল ২৫৭ গিগাওয়াট, ১৫৭ গিগাওয়াটই ছিল নবায়নযোগ্য শক্তি। বায়ুবিদ্যুৎ বেড়েছিল ৫২, সৌরবিদ্যুৎ ৯৯, পরমাণুবিদ্যুৎ মাত্র ৩.৩ গিগাওয়াট। পরের বছরগুলোতে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা আরও বেড়েছে, পরমাণুবিদ্যুতের ক্ষেত্রে তা হয়নি।
গত প্রায় দশ বছর ধরে চিন বিশ্বে পরমাণুবিদ্যুৎ প্রসারে নেতৃত্ব দিয়েছে। তবে নতুন প্রকল্প তৈরিতে এখন ঢিলেমি এসেছে, পরমাণুবিদ্যুৎ প্রসারের গতি কমেছে। পরিকল্পনা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে তার উৎপাদন ক্ষমতা হবে ৫৮ গিগাওয়াট এবং আরও ৩০ গিগাওয়াট ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এখন উৎপাদনশীল ৫০টি চুল্লির ক্ষমতা হয়েছে ৫২ গিগাওয়াট (আমেরিকার ৯৮, ফ্রান্সের ৬২ গিগাওয়াট)। তবে আরও ১৯টি চুল্লি তৈরির কাজ চলছে, তা থেকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়বে ২১ গিগাওয়াট।
পরমাণুবিদ্যুৎ উৎপাদনে চিনের বিশেষ উদ্যোগের পরও সেদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি কয়েকগুণ এগিয়ে রয়েছে। প্রথমটির বিনিয়োগ সরকারি, দ্বিতীয়টি বেসরকারি। সে দেশে বায়ু এবং সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা যেমন অনেক বেশি, সে সবের আসল বিদ্যুৎ উৎপাদনও পরমাণু বিদ্যুতের চেয়ে বেশি। ২০১৮ সালে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল ২৮৬ টেরাওয়াট আওয়ার, পরমাণু বিদ্যুৎ ২৩৩ টেরাওয়াট আওয়ার (ওই বছর ভারতে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়েছিল ৫৩ টেরাওয়াট আওয়ার এবং পরমাণুবিদ্যুৎ ৩৫ টেরাওয়াট আওয়ার। ২০১৭ সাল থেকেই চিন, ভারত, ব্রাজিল, জার্মানি, জাপান, মেক্সিকো, নেদারল্যান্ডস, স্পেন এবং ব্রিটেনে পরমাণুবিদ্যুতের চেয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদন হচ্ছে বেশি। ২০২০ সালে আমেরিকাতেও তাই হয়েছে)। পরমাণু প্রযুক্তির খরচ বেড়ে চলা, তার নিরাপত্তা নিয়ে মানুষের উৎকন্ঠা, নবায়নযোগ্য শক্তির বিপুল বৃদ্ধি এবং বিদ্যুতের চাহিদায় পরিবর্তনের জন্য চিনে পরিকল্পনা স্তরেই কয়েকটি চুল্লি বাতিল করা হয়েছে, চুল্লি তৈরির কাজে দেরি হচ্ছে।
২০২০ সালে জাপানে দু’টি চুল্লি অস্থায়ী ভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে নতুন চুল্লি চালু হওয়ায় চিনে পরমাণু বিদ্যুতের উৎপাদন ৬ শতাংশ বেড়েছে। চিন, ভারত, রাশিয়া, বেলারুশ, কোরিয়া, স্লোভাকিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে নতুন চুল্লি চালু হয়েছে বলে উৎপাদন বেড়েছে ৮ গিগাওয়াট। ওদিকে ফ্রান্স, সুইডেন, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড ও আমেরিকায় ৫ গিগাওয়াট ক্ষমতার কেন্দ্র পাকাপাকি ভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। তাই ২০২০-তে আসল উৎপাদন ক্ষমতা বেড়েছে মাত্র ৩ গিগাওয়াট।
২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমায় পরমাণু চুল্লি বিপর্যয়ের পর উন্নত দেশ ধীরে ধীরে পরমাণু চুল্লি থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইউরোপের একাধিক দেশ পরমাণু শক্তি উৎপাদনের পথ থেকে সরে আসবে বলে ঘোষণা করে। জনমতের চাপে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল দেশের সবক’টি চুল্লি ২০২২ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে বন্ধ করে দেবেন বলে ঘোষণা করেন। সৌর বা বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ কম হলেও, জার্মানি নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বিপুলভাবে বাড়িয়েছে, কয়েক বছর আগে পর্যন্ত তা বেড়ে ওঠায় নেতৃত্ব দিয়েছে, এখন তার উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে মোট বিদ্যুতের ৪৬ শতাংশ। ২০২০-র শেষে বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে যথাক্রমে ৫৪ ও ৫৫ গিগাওয়াট। তবে একথাও ঠিক যে, বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি সামলাতে এবং পরমাণুবিদ্যুতের শূন্যস্থান পূরণ করতেই জার্মানি হিমশিম খাচ্ছে। নবায়নযোগ্য শক্তিকে কয়লা, তেল ও গ্যাস ছাড়া পরমাণু চুল্লির বিকল্প হয়ে ওঠার লড়াইও চালাতে হচ্ছে। তাই কার্বন নিঃসরণ মোটেই কমাতে পারেনি, বরং কিছুটা বেড়েছে।
ইদানীংকালে উন্নত দেশে পরমাণু শিল্পের অসহায় অবস্থার কথা বারবার প্রকাশ্যে এসেছে। চুল্লি তৈরির ব্যবসায় বিপুল ক্ষতির পর, কয়েক বছর আগে, আমেরিকার ওয়েস্টিংহাউস ও ফ্রান্সের আরেভা দেউলিয়া হয়ে গেছে। আরেভা দীর্ঘদিন ধরে তাদের সর্ব্বোন্নত এভলিউশনারি পাওয়ার রিঅ্যাক্টর (ইপিআর) প্রযুক্তির ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। ২০১৬ সালে সে দেশের সরকারি কোম্পানি(৮০ শতাংশ শেয়ার) ইলেকট্রিসাইট দ্য ফ্রান্স (ইডিএফ) আরেভার ৭৫.৫ শতাংশ শেয়ার কিনে নিয়েছে। শেষ ছ’বছরে আরেভা-র আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ১২.৩ বিলিয়ন (১২৩০ কোটি) ডলার। সরকার তাদের বাঁচিয়ে রাখতে ৫.৩ বিলিয়ন (৫৩০ কোটি) ডলার ভর্তুকি দিয়েছিল। ২০১৯ সালের শেষে ইডিএফ-এর ধারের পরিমাণ ছিল ৪১ বিলিয়ন ইউরো।
আরেভার ইপিআর চুল্লি নির্মাণের কাজ প্রথম শুরু হয়েছিল ২০০৭ সালে, ফ্রান্সের ফ্লেমানভিলেতে। সেই প্রকল্পের খরচ দফায় দফায় বেড়েছে। ২০১৫ সালে ফ্রান্সের পরমাণু নিরাপত্তা সংস্থা জানায়, ওই চুল্লির অন্তস্থল বা রিঅ্যাক্টর ভেসেলে গুরুতর ফাটল রয়েছে। তা নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়। নিরাপত্তা সংস্থা নির্দেশ দেয় যে অন্তত আটটি ঝাল দেওয়া জয়েন্টের ত্রুটির জন্য ফের ঝালাই করতে হবে। কথা ছিল, ফ্লেমানভিলের চুল্লি চালু হবে ২০১২ সালে, খরচ হবে ৩৩০ কোটি ইউরো। এরই মধ্যে চুল্লিটি তৈরি করতে খরচ হয়ে গেছে ১০৯০ কোটি ইউরো, চালু হবে ২০২২ সালে।
ফিনল্যান্ডের ওলকিলুওটো-৩ নম্বর ইপিআর চুল্লি স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছিল ২০০৩ সালে। কথা ছিল ২০০৯ সালে তা চালু হবে। তৈরির খরচ ধরা হয়েছিল ৩০০ কোটি ইউরো। ২০১২ সালে আরেভা জানিয়েছিল, খরচ বেড়ে হবে ৮৫০ কোটি। এরপর আর বর্ধিত খরচের হিসেব পাওয়া যায়নি। এখন আশা ১৬০০ মেগাওয়াটের চুল্লিটি চালু হবে ২০২২ সালের জুন মাসে।
২০০৫ সালে ফ্রান্সের ৭৮.৫ শতাংশ দিত পরমাণু চুল্লি, এখন তা কমে হয়েছে ৬৭ শতাংশ। কয়েকটি চুল্লির মেয়াদকাল ১০ বছর করে বাড়ানো হয়েছে। তবে ফ্রান্স জানিয়েছে উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে ফেলবে বলে ২০২৫ সালে পরমাণু বিদ্যুৎ জোগান দেবে দেশের ৫০ শতাংশ। সে দেশ এখন নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন বাড়াচ্ছে। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নবায়নযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে ৫৫ গিগাওয়াট, ২০২৩ সালের মধ্যে তা বাড়িয়ে করতে চায় ৭২ গিগাওয়াট।
ওদিকে ২০২০ সালের শেষে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাক্রঁ বলেছেন, সামরিক পরমাণু বিভাগ না থাকলে অসামরিক পরমাণু বিভাগের গুরুত্ব নেই। তাই তিনি মনে করেন – ফ্রান্সের অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ পরমাণু শক্তির উপর নির্ভরশীল। তাই মাক্রেঁর ইচ্ছে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জলবায়ু নীতিতে পরমাণু শক্তির উপর গুরুতব বাড়ুক, যাতে ‘গ্রিন নিউ ডিল’ খাত থেকে পরমাণু শক্তির জন্য অর্থের জোগান আসে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় একটিমাত্র পরমাণু চুল্লি চালু ছিল। কয়েক বছর আগে প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা রাশিয়ার সঙ্গে আরও ৯,৬০০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার চুল্লি স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। পরে হাইকোর্টের রায়ে সেই চুক্তি বাতিল হয়। প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা কম খরচের নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
২০১১ সালে জাপানে ফুকুশিমা বিপর্যয়ের পর জার্মানি, ইটালি, সুইজারল্যান্ড ও স্পেন পরমাণুবিদ্যুতের পথ থেকে সরে আসার কথা ঘোষণা করে। ইদানীং মালয়েশিয়া ও আমেরিকা নতুন চুল্লি তৈরির পরিকল্পনা বাতিল করেছে। মুলতুবি রেখেছে আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া ও কাজাখস্তান। কথা ছিল সংযুক্ত আরব আমিরশাহীতে একটি চুল্লি চালু হবে ২০১৭ সালে। আজও তা চালু হয়নি। ওদিকে বাংলাদেশ ও তুর্কিস্তানে চুল্লি তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বছর তিনেক আগে।
ওদিকে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও চুল্লি রপ্তানিকারী দেশ মধ্যপ্রাচ্যে (মিশর, তুর্কিস্তান, সৌদি আরব) বাণিজ্যের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। সেই সুবাদে ওইসব দেশ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির যোগ্য হয়ে উঠতে চলেছে। মিশরে গবেষণা ও উন্নয়নের জন্য দু’টি ছোট পরমাণু-চুল্লি রয়েছে। রাশিয়ার কাছ থেকে তারা চারটি ভিভিইআর চুল্লি কিনবে বলে স্থির করেছে। তুর্কিস্তান একটি পরমাণু চুল্লি তৈরি করছে, ২০২৩ সাল থেকে তা উৎপাদন শুরু করবে বলে ধরা হয়। তুর্কিস্তানের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, কিছু দেশের হাতে পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে – তারা বলে আমাদের তা তৈরি করা চলবে না, আমি তা মানতে পারি না। সৌদি আরবে যে তিনটি পরমাণু চুল্লি তৈরির কাজ চলছিল, তার একটি চালু হতে চলেছে। সে দেশের প্রিন্স মহম্মদ বিন সলমন জানিয়েছেন, ইরান বোমা তৈরি করলে তারাও করবে। তাদের সক্ষমতার কথা বিবেচনা করলে মনে হয় – আগেই করে ফেলবে। জর্ডানে একটি চুল্লি তৈরির কাজ চলছে। রাশিয়ার কাছ থেকে আরও দু’টি বড় চুল্লি কিনতে চায়। কোনও দেশে পরমাণু চুল্লি এবং পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ (এনরিচমেন্ট) বা পুনর্শোধন কেন্দ্র (রিপ্রসেসিং) চালু হলে পরমাণু বোমা তৈরি করা কেবল সময়ের অপেক্ষা। যতদিন পরমাণু শক্তির পক্ষে মিথ্যে প্রচার থাকবে, পরমাণু-বিদ্যুতের হাত ধরে মধ্যপ্রাচ্যের পরমাণু অস্ত্রধারী হয়ে ওঠার প্রচেষ্টাও থাকবে।
ব্রিটেনের নিউক্লিয়ার ইন্ডাস্ট্রি কাউন্সিলের ‘নিউক্লিয়ার সেক্টর ডিল’-এ বলা হয়েছে, “the sector is committed to increasing the opportunities for transferability between civil and defense industries and generally increasing mobility to ensure resources are positioned at required locations”। আমেরিকা, ব্রিটেন সহ অন্যান্য পারমাণবিক রাষ্ট্র সামরিক স্বার্থেই পরমাণু চুল্লি টিকিয়ে রাখতে চাইছে।
আমেরিকায় সামরিক ও অসামরিক চুল্লি নির্দ্দিষ্ট করা আছে। সামরিক চুল্লির নিঃশেষিত জ্বালানি থেকে প্লুটোনিয়াম নিষ্কাশন করে পরমাণু বোমা তৈরি করা হয়, এই ছিল সাধারণ ধারণা। এখন জানা গেছে, পারমাণবিক ডুবোজাহাজ কর্মসূচি বাঁচিয়ে রাখতে অসামরিক পরমাণু চুল্লির নিঃশেষিত জ্বালানি থেকে প্লুটোনিয়াম নিষ্কাশনের ওপর আমেরিকা নির্ভরশীল। বেশ কয়েকটি রিপোর্টে সে দেশের পারমাণবিক নৌবাহিনীর শক্তি অটুট রাখতে জাতীয় পারমাণবিক প্রযুক্তির গুরুত্ব এবং আসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রকে বাঁচিয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় সরকারি নীতির কথা বলা হয়েছে।
কিছুদিন আগে আমেরিকার প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস-এ প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে – “বিপুল খরচ এবং অন্যান্য জটিলতার জন্য কয়েক দশকের মধ্যে নতুন বড় চুল্লি খুব সম্ভবত তৈরি করা যাবে না”। তাই এখন মডিউলার চুল্লির কথা বলা হচ্ছে। মডিউলার চুল্লির ক্ষেত্রেও কিন্তু সেই একই বাধা রয়েছে। ২০২০ সালের শেষ ভাগে আমেরিকায় নুস্কেল পাওয়ার কোম্পানির ছোটো মডিউলার চুল্লির নকশা অনুমোদিত হয়েছে। ২০২৯ সালের মধ্যে তাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্য রয়েছে। রাশিয়ায় দু’টি মডিউলার চুল্লি ‘অ্যাকাডেমিক’ এবং ‘লোমোনোসোভ’ দু’টি বড় জাহাজে বসানো হয়েছে। সময় লেগেছে ১২ বছর। খরচ প্রথমে যা ধরা হয়েছিল হয়েছে তার ছ’গুণ।
আর্জেন্টিনায় ২৫ মেগাওয়াটের ক্যারেম-২৫ (CAREM) মডিউলার চুল্লিতে জ্বালানি ভরার কথা ছিল ২০১৭ সালে, তৈরির কাজ এখনো সম্পুর্ণ হয়নি। মডিউলার চুল্লি নিয়ে চিনের হাই টেম্পারেচার রিঅ্যাক্টর প্রকল্পও বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে রয়েছে। চিন পরিকল্পনা করেছিল আঠেরোটি মডিউলার চুল্লি তৈরি করবে। এখনও পর্যন্ত লক্ষণ দেখে মনে হয়, নির্মীয়মান চুল্লিটির কাজ শেষ করেই হাল ছেড়ে দেবে।
পরমাণু বিদ্যুৎশিল্পের এখন হতচকিত অবস্থা। চিন, ভারত, আমেরিকা, রাশিয়া, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডসহ আরও কয়েকটি দেশে যে পরমাণু বিদ্যুতের প্রসার নিয়ে কথা হয় তার আসল কারণ এইসব দেশ হয় পরমাণু অস্ত্রধারী, অথবা তা হতে চায়। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের ছলে পরমাণু বোমার মশলা প্লুটোনিয়াম পাওয়া সহজ। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের বিপদ, দুর্ঘটনার সম্ভাবনা, তেজস্ক্রিয় বর্জ্যপদার্থের সমস্যা, চুল্লির ডিকমিশনিং নিয়ে রাষ্ট্রের দুশ্চিন্তা তেমন নেই। এসব দুশ্চিন্তা প্রতিবাদীদের এবং তার জন্য পরমাণু রাষ্ট্রের মত বদল হয় না। খরচ বেশি, প্রযুক্তিগত প্রতিকূলতা বেশি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি সস্তা – এই তিন কারণেই পরমাণু বিদ্যুতের প্রসার বন্ধ হয়ে গেছে।
পৃথিবী কেমন আছে, কেমন থাকবে
বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার প্রায় কিছুই কমেনি। তাই ২০২১ সালের মে মাসে আইইএ জানিয়েছে যে, মানুষের কারণে জলবায়ুর জরুরী অবস্থার সবচেয়ে ভয়াবহ প্রভাব ঠেকাতে গেলে জীবাশ্ম জ্বালানিকে মাটির নীচেই রেখে দিতে হবে। জলবায়ু বদল ঠেকাতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে যেসব কথা হয়েছে তা আজ ফাঁকা আওয়াজে পর্যবসিত হয়েছে। ২০০৯ সালে শক্তি ব্যবহারের ৮০.৩ শতাংশ আসত জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে, দশ বছর পর ২০১৯ সালে মাত্র ০.১ শতাংশ কমে তা হয়েছে ৮০.২ শতাংশ। একই সময়ে ‘আধুনিক নবায়নযোগ্য শক্তি’ ৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১১.২ শতাংশ। অথচ তাপবিদ্যুৎ ও পরমাণুবিদ্যুৎ টিকিয়ে রাখতে নানা রাষ্ট্র যে বিপুল ব্যয় করেছে তা দিয়ে পৃথিবীর হাল ফেরানো যেত।
অন্য বছরের মত এ বছরও বিশ্বে ঘন ঘন তাপপ্রবাহ,ঝড়, বন্যা, দাবানল ও অন্য্যান্য বিপর্যয় ঘটেই চলেছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত মনে করা হত বন্যা ও খরা উন্নয়নশীল দেশের সমস্যা। আজ উন্নত বিশ্বকে তার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এ বছর জার্মানি ও বেলজিয়ামের বন্যায় দুশ’র বেশি মানুষ মারা গেছে – যা কয়েক বছর আগেও ভাবা যেত না।
এমন সময় জলবায়ু বদলে যাওয়া ও তার ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ ২০১১: দ্য ফিজিক্যাল সায়েন্স বেসিস’ প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধীনে আইপিসিসি (ইন্টার গভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ)। ওই রিপোর্টের গুরুত্ব হল, তাতে ১৯৫টি দেশের অনুমোদন রয়েছে। সাড়ে তিন হাজার পৃষ্ঠার ওই রিপোর্টটি আসলে চোদ্দহাজার গবেষণাপত্রের নির্যাস। ‘মানুষের প্রভাবেই যে বায়ুমন্ডল, সমুদ্র ও স্থলভাগ উষ্ণ হয়েছে তা দ্বর্থহীন ভাবে বলা দরকার’ - এই বাক্য দিয়েই শুরু হয়েছে রিপোর্টটি। বলা হয়েছে, রক্ষা পাবে না কোনও দেশ, কোনও সরকারই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না।
কুড়ি লক্ষ বছরের মধ্যে এখনই বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো ছাড়া কৃষিক্ষেত্রে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড নিঃসরণের জন্য মোট গ্রিনহাউস নিঃসরণ ৮ লক্ষ বছরের মধ্যে এখনই সবচেয়ে বেশি। এক লক্ষ পঁচিশ হাজার বছরের মধ্যে গত দশকই ছিল সবচেয়ে উষ্ণ। গত শতকের গড়ের চেয়ে এখন তাপমাত্রা বেড়ে গেছে ১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (অবশ্য তিন বছর আগেই ওয়ার্ল্ড মেটিওরলজিক্যাল অর্গানাইজেশন একথা জানিয়েছিল)। তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বেড়ে যেত, কিন্তু জীবাশ্ম জ্বালানির দূষণে বায়ুমণ্ডলে ভাসমান সূক্ষ্ম কণার (অ্যারোসল) জন্য কুলিং এফেক্ট হচ্ছে বলে অতটা বাড়েনি।
জলবায়ুর সংবেদনশীলতা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন আরও নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছেন। আদিমকালের জলবায়ু নিয়ে গবেষণার সঙ্গে উন্নত উপগ্রহ প্রযুক্তির সাহায্যে মেঘ ও নিঃসরণে পর্যবেক্ষন চালিয়ে নতুন মডেলের সাহায্যে বায়ুমণ্ডলে তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে আরও সুস্পষ্ট ভাবে বলা যাচ্ছে। এই শতকের বাকি সময়ে তাপমাত্রা কতটা বাড়বে তা নিয়ে আইপিসিসি আগের চেয়ে পরিস্কার ছবি দিয়েছে। শেষ রিপোর্টে (২০১৩-১৪) বলা হয়েছিল এই শতকে বাড়বে ১.৫ থেকে ৪.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবার জানিয়েছে, শিল্পসভ্যতা-পূর্ব সময়ের দ্বিগুণ নিঃসরণ হলে তাপমাত্রা বাড়বে ২.৫ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়বে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি।
কুড়ি বছর আগে কোনও বিশেষ ঝড় বা হঠাৎ তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে উষ্ণায়নের সম্পর্ক নির্দ্ধারণ করা যেত না। ২০১৩ সালের পর থেকে জলবায়ু বিজ্ঞান এতটাই উন্নত ও পরিণত হয়েছে যে এখন সে কথাও বলে দেওয়া যায়। আবহাওয়ার চরম ঘটনার সঙ্গে জলবায়ু বদলের এই সম্পর্ক চলমান বিপর্য্যয়ের সময়ই বলে দেওয়া যাচ্ছে। গত জুন মাসে উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে অস্বাভাবিক গরম পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশন’ জানায়, জলবায়ু বদল ছাড়া ওই তাপমাত্রা বাড়া সম্ভব ছিল না।
আইপিসিসি জানিয়েছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে স্থলভাগে বাতাসের উষ্ণ স্রোত আরও ঘন ঘন হতে দেখা যাচ্ছে, ভয়াবহতাও অনেক বেশি। ওদিকে শৈত্য প্রবাহ কমছে। ১৯০১ থেকে ১৯৭১-এর মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির হার ছিল বছরে ১.৩ মিলিমিটার। ২০০৬ থেকে ২০১৮-র মধ্যে বেড়েছে ৩.৭ মিলিমিটার হারে। সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় উচ্চতা বেড়েছে ০.২০ মিটার।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক অতীতের দাবানল ও বন্যা দেখিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে আমরা জলবায়ু ব্যবস্থাকে বদলে দিচ্ছি, জলবায়ুর কয়েকটি প্রভাব অপরিবর্তনীয় হয়ে গেছে। মানবজাতি এই গ্রহকে চিরস্থায়ী ভাবে বদলে দিচ্ছে। প্যারিস-চুক্তির লক্ষ্য যদি স্থির রাখতে হয়, তাহলে ২০৩০-এর মধ্যে নিঃসরণ অর্ধেক কমিয়ে ফেলতে হবে এবং দ্রুত নিঃসরণ শূন্যে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করতে হবে।
নিঃসরণ বন্ধ হলে উষ্ণায়নও দ্রুত বন্ধ হবে, তাপমাত্রা কয়েক দশকের মধ্যে থিতু হবে। তবে অন্য কয়েকটি প্রভাব, যেমন সমুদ্রস্তর বেড়ে যাওয়া অনেক শতক ধরে চলবে। রিপোর্টে নিঃসরণ শূন্য হলে কি ঘটবে তাও বলা হয়েছে। যেমন জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমলে অ্যারোসল কমবে বলে কুলিং এফেক্টও কম হবে। তখন তাপমাত্রা আরও বাড়বে। তার মোকাবিলা করতে হলে দ্রুত ব্যাপকভাবে মিথেন নিঃসরণ কমাতে হবে। কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড ছাড়া আরও চারটি গ্রিনহাউস গ্যাসের (ওজোন, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন, পারফ্লুরোকার্বন, সালফারহেক্সাফ্লোরাইড) নিঃসরণ দ্রুত বন্ধ করলে উষ্ণায়নের গতি কমবে।
বিশ্বের অন্য অংশের তুলনায় আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগরে তাপমাত্রা বাড়ছে বেশি দ্রুত। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্র। ওদিকে সমুদ্রস্তর উঁচু হওয়ার জন্য ভারতের ৭৫১৭ কিলোমিটার সমুদ্রতট বিপন্ন হতে চলেছে। এর ফলে উপকূলীয় অংশ ক্রমেই সমুদ্রে তলিয়ে যাবে। রিপোর্ট অনুযায়ী একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, সমুদ্র ৫০ সেন্টিমিটার উঁচু হলে ভারতের ছ’টি বন্দর শহর – চেন্নাই, কোচি, কলকাতা, মুম্বাই, সুরাট ও বিশাখাপত্তনমের ২.৮৬ কোটি মানুষ উপকূলের বন্যায় আক্রান্ত হবে। ডুবে যাবে ৪ হাজার কোটি ডলার মূল্যের সম্পত্তি।
তাপমাত্রা বাড়লে এশিয়ায় বছরে ৯০ থেকে ১০০ দিন সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা থাকবে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে। দাবানলের সংখ্যাও বাড়বে। ভারতে যখন স্থলভাগ গ্রাস করছে সমুদ্র, হিমালয়ের বরফ তুমুলভাবে গলছে। হিমবাহ পাতলা হয়েছে, আকার ও ব্যাপ্তিতে ছোট হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো চিরস্থায়ী। সমুদ্রের জলস্তর আর নামবেই না, বরং বেড়েই চলবে, নতুন হিমবাহও তৈরি হবে না। হিমবাহ গলা জলে তৈরি হ্রদের জলস্তর বেড়ে গিয়ে বন্যা হবে, পাহাড়ি এলাকায় ধস নামবে। কিছুদিন আগে হিমাচলে তা দেখা গেল, বহু মানুষ প্রাণ হারালেন। জানা গেছে, বায়ুদূষণ বাড়ার ফলে বাতাসে ভাসমান অ্যারোসল সূর্যরশ্মি শুষে নিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বর্ষা রাজত্ব করবে।
দক্ষিণ ভারতে বৃষ্টিপাত বাড়বে। তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি বাড়লে ভারতে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাড়বে ৪০ শতাংশ। গোটা দক্ষিণ এশিয়াতেই বাড়বে। এই অঞ্চলে মানুষের সংখ্যা ২৪ কোটি, তার ৮.৬ কোটি ভারতীয়। তারা দৈনন্দিন প্রয়োজনের জল পায় হিমালয় থেকে। পশ্চিম হিমালয়ের লাহুল-স্পিতি অঞ্চলের হিমবাহ এই শতাব্দির শুরু থেকেই প্রবল ভাবে গলছে। নিঃসরণ যদি না কমে, হিন্দুকুশ হিমালয়ের হিমবাহের দুই-তৃতীয়াংশই গলে যাবে। ভারতে বৃষ্টি যেমন বাড়বে, চরম উষ্ণতাও বাড়বে। বেশি তাপমাত্রার জন্য খরা, দাবানলও বাড়বে। কৃষকের জীবন ও জীবিকা অসহনীয় করে তুলবে। আগে দশ বা পঞ্চাশ বছরে যে ধরনের মারাত্মক গরম, অত্যধিক বৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা ইত্যাদি হয়েছে ভবিষ্যতে তা আরও ঘন ঘন দেখা দেবে, আরও ভয়ঙ্কর রূপ নেবে। নতুন নতুন জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ভারতের ক্ষেত্রে আইপিসিসি-র পূর্বাভাসের মানে হল, ঘন ঘন তাপপ্রবাহের মধ্যেই দীর্ঘ সময় ধরে শ্রমজীবী মানুষকে কাজ করতে হবে, শীতকালে রাতের তাপমাত্রা বেশি থাকবে। বৃষ্টিপাত হবে খামখেয়ালী, বিধবংসী বন্যা ও ঝড় বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটাবে, তাই জল সরবরাহেও বিঘ্ন ঘটবে। কৃষি ফলনেও তার প্রভাব পড়বে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালে বায়ুদূষণের জন্য ভারতে ১৬.৭ লক্ষ মানুষ মারা গেছে। গরিব মানুষের উপর দূষণের প্রভাব বেশি। মারাত্মক ভাবে দূষিত শহরের ৭৪ শতাংশই এই ধরণের শ্রমিক। বিশ্বের দশটি সবচেয়ে দূষিত শহরের ৬টিই এদেশের। চরম আবহাওয়া এবং বায়ুদূষণ গরিব কৃষক, মজুরের জীবনে ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনছে।
সূত্রনির্দেশ: