পরমাণু চুল্লির প্রবক্তা আলভিন ভেইলবার্গ ১৯৭২ সালে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনকে "ফাউস্টিয়ান বার্গেন বলে্ছিলেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্র ওক রিজ ন্যাশনাল ল্যাবরেটরীর প্রধান।সোভিয়েট ইউনিয়ন্ চেরনোবিলে চার নম্বর পরমাণু চুল্লির দুর্ঘটনার পর তিনি বলেন যে, তিনি যখন পরমাণু চুল্লিকে ফাউস্টিয়ান বার্গেন বলেছিলেন তখনো তাঁর ধারণা ছিল না যে মানুষের ত্রুটির ফল এত ভয়াবহ হতে পারে।পারমাণবিক দুর্ঘটনার সঙ্গে বড় বাঁধ কিংবা রাসায়নিক কারখানার বিপর্যয়ের তুলনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, পরমাণু শক্তির সমর্থকদের মানতেই হবে যে পারমাণবিক বিপর্যয় স্বতন্ত্র।
দুর্ঘটনার পাঁচ মাস পরে এক আন্তর্জাতিক সভায় অস্ট্রিয়ার বিদেশমন্ত্রী পিটার জ্যাস্কোভিয়া বলেছিলেন - জার্মান গল্পের ফাউস্টের মত শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করে পরমাণু শক্তি। জ্ঞান ও ক্ষমতা অর্জনে দরাদরির পরাজয় ঘটেছে। পরমাণু শক্তি ব্যবহারের পথে চলার যে চেষ্টা হয়েছে এখনই সে পথ পরিত্যাগ করার উপযুক্ত সময়। আমাদের এই গ্রহে প্রাণের স্পন্দন বজায় রাখতে এটুকু মূল্য দিতে হবে।
কিন্তু পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ মোটেই পরিত্যক্ত হয় নি। ওদিকে ঐ দুর্ঘটনার ২৩ বছর পর ২০০৯ সালে নিউইয়র্ক অ্যাকাডেমী ওফ সায়েন্সেস প্রকাশিত “চেরনোবিল কন্সিকোয়েন্সেস অফ দ্য ক্যাটাস্ট্রোফ অ্যান্ড দ্য এনভেরানমেন্ট” বইটি থেকে জানা গিয়েছে ঐ দুর্ঘটনায় যে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়িয়েছিল, তার প্রভাবে মারা গিয়েছেন্ গোটা পৃথিবীতে ৯ লক্ষ ৮৫ হাজার মানুষ। রাশিয়ান ও ইউরোপীয়ান তিন বিশেষজ্ঞের লেখা এই বইটি ৫০০ গবেষণার নির্যাস।
ওদিকে নানা রাষ্ট্রের অদম্য ইচ্ছায় পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয় নি। বরং কার্বন নিঃসরণ কম - এই অজুহাতে উষ্ণায়ন থেকে বাঁচাবে পরমাণু বিদ্যুৎ-এই কথা প্রচার করা হয়েছে। অথচ পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন এমনই ব্যয়বহুল যে ২০০০ সালের পর থেকে কার্যতঃ তার বিকাশ ঘটেনি। কয়েকটি দেশে কিছু চুল্লি নির্মিত হলেও বেশ কিছু চুল্লি দীর্ঘকাল চালু থাকার পরে বয়েসের ভারে বাতিল করা হয়েছে।
২০০০ সালে পৃথিবীতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩ লক্ষ ৭২ হাজার মেগাওয়াট। ২০১৩ সালের শেষেও উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় একই জায়্গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। তবে আসল উৎপাদন কমেছে কারণ জাপানের ৫৪ টি পরমাণু চুল্লি বন্ধ রয়েছে। আমেরিকান ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে মিলিয়ে একটি নতুন চুল্লিও চালু হয় নি। বরং চুল্লি বন্ধ করে দেওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে। ঐ সময়কালে ইউরোপীয়ান ইউনিয়নে উৎপাদন ক্ষমতা কমেছে ১৩ হাজার মেগাওয়াট।
এর মধ্যে ২০১১ সালে মার্চ মাসে জাপানের ফুকুশিমায় ঘটলো এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। প্রায় একই সময়ে তিনটি চুল্লির জ্বালানি দন্ড পুরোপুরি গলে বহুদূর পর্যন্ত বিপুল পরিমাণ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ছড়াল। শুধু তসি নয়, আজও সেখান থেকে তেজস্ক্রিয় জল ভূগর্ভে এবং সমুদ্রে মিশে চলেছে। দুর্ঘটনার পর জার্মানি, বেলজিয়াম ও সুইজারল্যান্ড তাদের চুল্লি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ইতালি, অস্ট্রিয়া পরমাণু কর্মসূচী বাতিল করে। ফ্রান্স ২০২৪ সালের মধ্যে অর্ধেক চুল্লি বন্ধ করে দেবে বলে জানায়।
ওদিকে একযুগের বেশি সময় ধরে মার্কিন সরকারের বিপুল প্রচেষ্টার পর মাত্র একটি নতুন চুল্লি নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এখন যেকোন পরমাণু চুল্লি তৈরি করতে গেলে খরচের সবটাই সরকারি লোন গ্যারান্টি হিসেবে পাওয়া যায়। কিন্তু বিদ্যুৎ কোম্পানি মনে করে যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ এত বেশি যে বিদ্যুৎ বিক্রি করে লাভের আশা কম। তাই তারা আগ্রহী নয়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রচলিত সব উপায়ের মধ্যে পরমাণু বিদ্যুৎই সবচেয়ে ব্যয়বহুল। দুর্ঘটনার সম্ভবনা এবং তার প্রভাবও সবচেয়ে বেশি। তেজষ্ক্রিয় বর্জ্যপদার্থ সংরক্ষণ এবং মেয়াদকাল শেষ হলে চুল্লি বিস্থাপনের কোনও ব্যবস্থা পৃথিবীতে চালু হয় নি। যে ব্যবস্থা চালু আছে তা অস্থায়ী, স্থায়ী ব্যবস্থা কী হতে পারে তা কেউ জানে না। কয়েক হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে আমেরিকার ইউক্কা মাউন্টেনের নীচে অতিগভীর সুড়ঙ্গ তৈরি করে তেজস্ক্রিয় বর্জ্যপদার্থ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হলেও তা হাজার হাজার বছর ধরে সঞ্চিত থাকা তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নিরাপদে রাখতে যে পারবে তার নিশ্চয়তা ছিল না। ইউক্কা মাউন্টেন প্রকল্প বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
এত ঝুঁকি, বিপদ ও খরচের জন্য পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও চিন, ভারত, রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের জোরকদমে পরমাণু কর্মসূ্চী চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতে ছয় দশকের চেষ্টায় এবং অফুরন্ত খরচে এখন ২১ টি চুল্লি চালু আছে, যার উৎপাদন ক্ষমতা ৫৩২২ মেগাওয়াট। আরো ছ’টি নির্মাণ চলছে। নতুন চুল্লি স্থাপনের জায়গা খোঁজা হচ্ছে। নেতা-মন্ত্রীরা বলছেন, পরমাণু বিদ্যুৎ ছাড়া ভারতের নাকি মোটেই চলবে না। অথচ সাত-আট বছরের বেসরকারি উদ্যোগেই এদেশে বায়ু বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে ২২ হাজার মেগাওয়াট। বছর দু-তিনের চেষ্টায় সৌর কোষের উৎপাদন ক্ষমতা হয়েছে ২২০০ মেগাওয়াট। তাহলে পরমাণু বিদ্যুৎ নিয়ে অত মাতামাতির উদ্দেশ্য কী? পরমাণু বিদ্যুৎ কর্মসূচী চালু থাকলে পরমাণু বোমা তৈরীতে সমস্যা হয় না বলে, পরমাণু শক্তি ও পরমাণু অস্ত্র যমজ ভাই বলেই কি তাঁরা পরমাণু বিদ্যুতের কথায় গদগদ হয়ে পড়েন? বিদেশি কোম্পানি যখন আবদার করে যে তারা চুল্লি বিক্রি করবে কিন্তু তাদের নির্মাণের কোন ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তার দায় নেবে না, অমন আবদারও মেনে নেন! আর অন্যদিকে পরমাণু বিদ্যুৎ বিরোধীদের দমন করে, জেলে ভরে, দেশদ্রোহীর আখ্যা দেন।