গতকাল মাঝরাতে অনিয়ন এর একটা ম্যাসেজ। স্যার যেটা হচ্ছে ভালো হচ্ছে না। যেটা এখানে হয়ে চলেছে সেটা ভয়ের। কাল পারলে একবার আসবেন। এর আগে গোটা এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বেশ কিছু দামাল ছেলে মুখে কুটোটি না কেটে। কাউকে গালাগালি না দিয়ে চুপচাপ বসে আছে তাদের কয়েকটি দাবি পূরণের জন্য। ছবি দেখেছি তাদের ফেসবুকে। ছবি দেখেছি হোয়াটস-এ্যাপের ম্যাসেজে। তীর্যক ব্যঙ্গোক্তি এসেছে। আরও এসেছে তাদের পাশে থাকার অনুরোধ। কিন্তু আমি কে? মধ্য রাতে একটা ভার্চুয়াল চিরকুট। অনেক অনেক লেখা। দাবি-দাওয়া। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে আমার উপস্থিতি কী এমন কাণ্ড ঘটাবে যার থেকে ওই যে এতোগুলো দিন না খেয়ে, মুখ বুঁজে প্রশাসনিক ভবনে পড়ে থাকা মানুষগুলোর আশা ভরসা জাগাতে পারে?কী এমন হবে আমার মতো একজনের উপস্থিতি নিয়ে আসতে পারে একটা আরও এগিয়ে যাবার মানে। পাশে দাঁড়ানোর। কাছে বসার। বিচ্ছিন্ন হতে বসা জনপদের এক মানে?
জানি না।
বৃষ্টি পড়ছিল।
কলেজস্ট্রিটের রাস্তা ছিল ফাঁকা।
অতিপরিচিত ইউনিভার্সিটির সামনেটাও মনে হল আজ কেমন যেন নিঝুম।
অপরিচিত।
কেন যাচ্ছি আমি?
আমার কি তাহলে নিজের দাঁড়াবার জায়গা চাই? আমি কি তাহলে অনেকদিন সেইসব মানুষের। সেইসব জোয়ারের টানে গা ভাসিয়ে দিই নি অনেক দিন? যেখানে প্রশ্নবান ছুটে আসতে বাধ্য?
এর আগে মেডিকেল কলেজে গিয়েছি অনেকবার। আত্মীয়দের চিকিৎসা। নিজের চিকিৎসা। অসুস্থ বন্ধুদের দেখার জন্য। কিন্তু আজকের যাওয়া অন্য। কিছু মানুষের সাথে নিজের দাঁড়াবার পরিসরটুকু বুঝতে চাই আমি। ভার্চুয়ালে অনেক পিটিশান জমা পড়লো। অনেকবার লাইকের বন্যা বইয়ে দিলাম। যতবার চৌখুপ্পির জানলা খুললাম ততবার দেখলাম বিকিয়ে যাওয়া...বিক্রি হওয়ার মুহূর্তগুলো। “সোজা গিয়ে বাঁদিকে যাবেন। ওখানেই আমাদের অবস্থান।” যে ছেলেটি পোষ্টার লাগাচ্ছিল দেওয়ালে আমার দিকে তাকিয়ে বললো সে। আমি একটু একটু করে এগোলাম। কতদিন মিছিলে অনেকবার অনেকের সাথে হাঁটিনি? আমার গা দিয়েও কি বইছে না চৌত্রিশ বছরের মেদ? আমার গায়েও কি নেই আস্ফালনের সেই দিগচিহ্ন গুলো? মিলিয়ে দেওয়ার আগে সেগুলোও ট্যাটুর মতো ফুটে উঠছে না শরীরে? “কাকু...এই যে এই লিফলেট। বেশি ছাপানো হয়নি। পড়া হয়ে গেলে অন্য কাউকে দিয়ে দেবেন”। আরও এক তরুণ বন্ধু এগিয়ে দেয় জেরক্স করা একটা কাগজ। আমার সামনে অনেক দিনের পুরনো এক ইমারতে ঝুলছে “আমরণ অনশন”।
আমার সামনে একটা সাদা কাগজের ইস্তেহার।
আমার সামনে বৃষ্টিতে ভিজে নিঝুম হওয়া অনেক গুলো মানুষ।
তার আগেই তো দেখে নিয়েছি এখনকার শাসক গোষ্ঠীর ডিগবাজি খাওয়া নেতা। অন্য দলের গেরুয়া উত্তরীয় পরে কিভাবে সশস্ত্র রক্ষী নিয়ে ঘুরে গেছেন চত্ত্বরে। ফেসবুকে তার ছবি ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। বাড়ি ফিরছি যখন তখন আগের শাসক দলের আর এক ডিগবাজি খাওয়া নেতা এখনও যার পার্লামেণ্টে সিট অক্ষত আছে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন ছাত্রদের প্রতি সহনশীল হলেও আসলে এই আন্দোলন কতিপয় লোকের বুজরুকি। ঘুরে বেড়াচ্ছে এই মুহূর্তে ফেসবুক জুড়ে স্বাস্থ্য আধিকারিকের এক চিঠি আসলে এটা এক প্রতীকি অনশন?
“বাঁ দিকে একবার ঘুরে তাকান। ওখানে ওরা শুয়ে আছে। এই কদিনে আপনারা ওদের চিনে নিয়েছেন ফেসবুকে। এই ক'দিনে আপনারা ওদের দেখেছেন নানা ভাবে। এদের মধ্যে বেশ কিছুজন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। ওই যে কোণের ছেলেটি শুয়ে আছে ও কিন্তু...। হ্যাঁ ঠিক বলেছেন ওর নাম। আস্তে আস্তে ওর অবস্থা আরও খারাপ হচ্ছে। আমরা প্রতিদিন ওর স্বাস্থ্যের প্রতি নজর রাখছি। কিন্তু...।” থেমে গেলেন এক তরু্ণ ডাক্তার। সবার হাতে মোবাইল। সবার হাতে ক্যামেরার ঝলকানি। কেমন যেন কনসেনট্রেশান ক্যাম্প ঘুরে দেখার কথা মনে হল। মনে হল এইবার আহুতি দেওয়ার জন্য যোগ্য সব ছাত্রদের পাওয়া গেছে। আমরা নিশ্চিন্ত। যাবতীয় দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে। আপাতত ফেসবুক স্ট্যাটাসের বিপ্লবে ফিরে যেতে পারবো।
কিন্তু কী চেয়েছিল ওরা? ওরা চেয়েছিল ওদের ন্যায্য অধিকার। আপাত অর্থে খুবই সামান্য। কিন্তু অত্যন্ত জরুরি।
না আমি ওদের ছবি তুলতে পারিনি।
হাত কেঁপেছিল।
ওরা তাকিয়ে ছিল আমারই দিকে।
ওরা তাকিয়ে ছিল আমার না পারার প্রতিটি গলনাঙ্কে।
আর কিছুক্ষণ পরেই গণ কনভেনশনে অনেকে অনেক কথা বলবেন। আমরা হাঁটবো মিছিল করে রাজপথ দিয়ে। কত মিছিল এমন দেখেছে কলকাতা? কতদিন ধরে দেখে চলেছে? কতদিন ধরে আমরা আমরা আমাদের ন্যায্য দাবিতে হেঁটে চলেছি? কতবার কত মুখ এসে আমাদের বোকা বানিয়েছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে। তোমাদের ভালো করছি বলে।
দাঁড়াবার জায়গা নড়বড়ে হয়। অনেক রাতে একটা শক্তপোক্ত লেখা তৈরি করতে বসলে কি প্যাড কেঁপে ওঠে। সবাই সবার দিকে তাকায় সন্দেহে। দাঁত নখ বের করে। উন্নয়নের রোশনাই ছুয়ে যায় আমায়। আমার পাশে হাঁটা আদিত্যকে। শুভঙ্করকে। আরও দূরে যে বৃদ্ধ দম্পতি এই বৃষ্টিতেও এসেছেন। চুপ করে বসে থেকেছেন ছেলে গুলোর পাশে। কী তাপ পোয়াচ্ছেন তাঁরা? কেন ওই মহিলার চোখে জল? এইসব কিছু জানতে চাইবে সময়। এই সব কিছুর হিসেব নেবে পৃথিবী। ঠিক তার দাঁড়াবার জায়গায় পরিসর নিতে। আগেও যেভাবে নিয়েছে। তখন মাননীয় শাসককুল আপনারা রাতের আঁধারে পুলিশ পাঠাতে পারবেন তো? যারা না খেয়ে আছে তাদের অপমান করতে পারবেন তো? যাদের ভোটে জিতে এসে সশস্ত্র সৈন্য বরকন্দাজ নিয়ে ঘুরছেন তারাই আপনাকে ঠেলে ফেলে দেবে না তো? পৃথিবীর ইতিহাস তাই বলে। এ শুধু এক টুকরো স্ফুলিঙ্গ। এক সাথে জ্বলে ওঠার আগুন নিশ্চিত অপেক্ষা করবে সময়ের।
মিছিলটা বৃত্তাকারে ঘোরে। আবার এক জায়গায় মিলিত হয়। আগামী মঙ্গলবার আরও অনেকে জড়ো হবেন। ততদিন ছেলে গুলো যেন এইভাবে কষ্ট করে থাকে। এইভাবে টিঁকে থাকে। এইভাবে প্রশ্নতোলার অঙ্গীকারে আবদ্ধ হয়। আর আমরা যারা নিতান্তই দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে বেড়াচ্ছি তারা যেন আমাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারি। সন্তানসম মানুষগুলোর পাশে থেকে। তখন যদি মুখে রক্ত ওঠে তবুও। কারণ অনেক দিন আগে এক ক্ষীণকায় কবি লিখে গিয়েছিলেন কয়েকটি লাইন। যেগুলোকে পুরনো করতে চেয়েও কেউ পারলো না। এই শহর...এই সময় মনে করালো বারবার। মনে করাবে আরও অনেকবারও।
“মুখে যদি রক্ত ওঠে
সে-কথা এখন বলা পাপ।
এখন চারিদিকে শত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই,
এ-সময়ে রক্তবমি করা পাপ; যন্ত্রনায় ধনুকের মতো
বেঁকে যাওয়া পাপ; নিজের বুকের রক্তে স্থির হয়ে শুয়ে থাকা পাপ।”
[মুখে যদি রক্ত ওঠে/বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়]
ডাক্তার দেখানো ছাড়া নেহাত যদি পারিবারিক সম্পর্ক না থাকে ডাক্তারের খোঁজ রাখি না আমরা। রাখার কথাও নয়। মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রছাত্রীসংখ্যা কত কজন খবর রাখি বরং ছাত্রছাত্রীরা জয়েন্টে পাশ করলে আনন্দ হয়। টিভিতে দেখি এবার কে ফার্স্ট হল জয়েন্টে। যারা মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সুযোগ পাবে তাদের হস্টেলের খোঁজ নেওয়ার কথা কখনও ভাবতে হয়েছে কি আগে? ভাবার কথাও নয় আমার আপনার। কলেজের একান্ত অভ্যন্তরীণ একটা ব্যাপার এটা।
তবু মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সেই সামান্য হস্টেলের ঘর পাওয়া নিয়ে সহস্রাধিক মানুষের মিছিল দেখল কলকাতা। তার আগে একটা বর্ষণ মুখর রবিবার দুপুরে সহস্রাধিক উদ্বিগ্ন মুখ দেখা গেল মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে। এমনই কিছু উদ্বিগ্ন মুখ কদিন ধরে রয়েছে ওখানে। ঘিরে রয়েছে কিছু ক্লিষ্ট কিন্তু অপরাজিত হাসিকে।
একটা গণ কনভেনশন করতে হল মেডিক্যালের ছাত্রছাত্রীদের, করতে হল টানা তেরোদিন অনশন করে থাকার পরেও হস্টেলের কোনও সুস্থ সুষ্ঠু সমাধান না হওয়ায়। তাতেই যোগ দিতে আসা আশঙ্কাগ্রস্ত চিন্তিত মুখেরা উদ্বেগের কথা জানালেন, ছাত্রছাত্রীদের কথা শুনে শুকিয়ে গেলেন ভিতরে ভিতরে, ফেটে পড়লেন রাগে, কুঞ্চিত হলেন ঘেন্নায়। নিজেরাই প্রস্তাব দিলেন মিছিলের। নিজেরাই চাইলেন ওদের সঙ্গে অনশনে বসতে। আসলে এমন এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে ঠিক কী ভাবে রিঅ্যাক্ট করা উচিত সেই উদ্বিগ্ন মানুষেরা জানেন না।
বিগত তিন বছর কোনও কাউন্সিলিং হয়নি ওদের। সেই দাবি জানাতে গেলে ওদেরই অধ্যক্ষের কাছ থেকে ধাতানি শুনেছে ওরা। গত পাঁচ তারিখে কলেজ ক্যাম্পাসে পুলিশ ডেকে পেটানো হয়েছে ওদের। ১০ তারিখে ওরা অনশনে বসে প্রথমে ছজন। পরে আরও পনেরোজন যোগ দেয় ওদের সঙ্গে। এর মধ্যে ওদের বাবামাকে ফোন করে হুমকি দেওয়া হয়েছে। বাড়িতে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এমনকি অনশনকারীদের শারীরিক রিপোর্টে ভুল তথ্য ঢুকিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
হস্টেলের ঘর বণ্টনের যে বিজ্ঞানসম্মত মান্য পদ্ধতি আছে, তা মেনে ঘর বণ্টন করতে কলেজের হস্টেল কমিটিই যথেষ্ট, অধ্যক্ষের দরকার পড়ে না, সেই সাধারণ একটা হস্টেলের ন্যায্য দাবি মেটাতে তিনজন অধ্যক্ষ বদলে গেছেন মেডিক্যাল কলেজে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে। বর্তমান অধ্যক্ষ কলেজের হস্টেলের জন্য স্বাস্থ্য শিক্ষা আধিকারিকের কাছে গেছেন যখন ছাত্ররা বারো দিন অনশনে। সেদিন শনিবার বলে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি। এমনকি গোটা বিষয়টা পড়ে রয়েছে স্বাস্থ্য শিক্ষা আধিকারিকেরও ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ’র অনুমোদনের জন্য। সেটাও আদৌ অনুমোদিত হবে কিনা সোমবারের আগে হবে না। কারণ রবিবার সরকারি অফিস ছুটি। সেদিন অনশনের চোদ্দতম দিন হবে। এই পরিস্থিতিতে এই কনভেনশন। সেই কনভেনশন এবং মিছিলের শেষে পাওয়া খবরে দেখা যায় স্বাস্থ্য শিক্ষা আধিকারিক সরকারি রিপোর্টে লিখেছেন ছাত্ররা নাকি প্রতীকি অনশন করেছে!
মেডিক্যালের হস্টেলের ঘর নেমে এসেছে মহানগরীর রাস্তায়। রাস্তায় পথ হাঁটছে মাত্র সাড়ে চারশো ছেলেমেয়ের জন্য কয়েক হাজার ঘর। যে হস্টেলের ঘরের কথা মিছিলের মানুষদের জানার কথা নয় আজ তারা তাদের বুকের মধ্যে একটা কুঠুরি বানিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন ছেলেগুলোকে। সেই কুঠুরির সামনে নদীর ঘাটের মতো ছলাত ছল আওয়াজ আসছে মানুষের উষ্ণ রক্তের।
আজ তের দিন হয়ে গেল।
ওদের মুখে যদি রক্ত ওঠে তাহলে কিন্তু সেই রক্ত পাত্র খুঁজবে, আধার খুঁজবে। ধারণ করতে পারবে তো আমার শহর?