এইভাবে অসংখ্য বন বাংলোর কথা ভাবতে ভাবতে বুকিং করা বাংলোটার কথা গুলিয়ে গেল এরকম সমস্ত এফ আর এইচ-য়ের ক্ষেত্রেই হয়। এসব জায়গা সাহেবরা খুঁজে, পেতে, ঘোড়ার পিঠে চড়ে, হেঁটে ঘুরে ঘুরে আবিষ্কার করেছে তারপর জঙ্গল চিহ্নিত করে, দখল করে, সুরক্ষিত করে বানিয়েছে আর প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় করে তুলেছে—জঙ্গলের প্রতিনিধি হল বনবাংলো বা এফ আর এইচ, এরকমই চেয়ে এসেছে বৃটিশ সাহেবরা। যাদের স্থান মাহাত্ম্য বুঝতে হত যুদ্ধের কারণে। দুর্গম পাহাড় জঙ্গলে অভ্যস্ত নানান দেশীয় সেনাবাহিনীকে হারিয়েছে তারা এই কৌশলেই। এবারো কি আমাদের জঙ্গল বেড়ানোর সবাই সত্যি সত্যি পৌঁছে যাব যে বাংলোটা বুকিং করা হয়েছে সেখানে? আমরা কথা বলতেই থাকি :
------- কুমু তুই যাবি?
------- কেন?
----- ছুটি পাবি তো?
------- মানে?
------ না মানে…
------- জিজ্ঞেস করছ কেন?
------ তাইতো।
------ হ্যাঁ , তুই জিজ্ঞেস করছিস কেন?
------- ঠিক, এটা কী জিজ্ঞেস করার মতো কথা হল?
------- আসলে কী জান বাঘাদা, মেয়ে বলে জিজ্ঞেস করছে।
------- সকলে ছেলে আর একজন মেয়ে।
------ কেউ কারুর নয়।
------ কারুর হলেই ক্যাঁচাল।
------ চূড়ান্ত ক্যাঁচাল।
------ এটা সেটা।
------ ওটা অন্যটা।
------ এটা নয় , সেটা নয়।
------ ওফফ ... আমরা পাঁচজনই …
------ যাচ্ছি।
------ যাচ্ছি।
------ যাচ্ছি।
------ যাচ্ছি।
------ বাবা এতো এফারমেটিভ!
------ নেগেটিভও।
------ হ্যাঁ নেগেটিভও।
------ আবার শুরু করলি!
এভাবে কখন দিল্লীর ট্রেনে উঠে পড়েছি পাঁচজন। গোটা পথটায় খুব কথা হল তার মধ্যে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছাড়া সব ধরণের কথাই ছিল। বেড়াতে যাওয়া নিয়ে কথার কী আছে বেড়াতে যাবার সময় ? রাজু খুব ভালো রান্না করতে পারে। সে রান্নাবান্না নিয়ে কথা বলতে থাকে। বাঘা বলে , ''চিকেন কেনা একটা ব্যাপার।"
------ চিকেন কেনা আবার ব্যাপার হতে যাবে কেন?
------ আরে ব্যাপার আছে।
------ কী ব্যাপার?
------- আমি আগে যে কোন দোকান থেকে কিনতাম।
------- সে তো সবাই করে।
------- নারে ব্বাবা, এত সহজ নয়।
------ কী সব বলে!
------ আগে দেখতাম যতই কষা হোক ছিবড়ে থেকে যাচ্ছে।
রাজু বলল , ''নিজে রান্নাটা শেখ আগে।'' কুমু প্রথম থেকেই বই নিয়ে ওপরের বাঙ্কে চলে যায় ,সে বলে ওঠে, ''এটা একদম ঠিক বলেছ রাজুদা।, একদম ঠিকঠাক বলেছ মাইরি।''
------ বেশি রাজুদা! রাজুদা! করতে হবে না!
----- আচ্ছা বাবা বল না যা বলছিলি।
----- আমি বেছে বেছে একটা দোকান থেকেই কিনি।
------ কী কিনিস রে?
------ চিকেন।
আমি চুপচাপ হাসছিলাম। কোন শব্দ করিনি। শব্দ করতে ভালো লাগে না সব সময়। ট্রেন চলতে শুরু করেছে তার যাওয়ার একটা নির্দিষ্ট শব্দ আছে। সেই শব্দকে ছাপিয়ে ছাপিয়ে নানা কথা হতেই থাকবে তাতে যোগদান না করে আমি খাবারের অর্ডার দিতে শুরু করে দিতে থাকি। অনেকক্ষণ ধরে অর্ডার দিয়েছি বেছে বেছে। এইসব বেড়ানোর প্রস্তাবক আমাকেই হতে হয়, রাখতে হয় হিসেবে টিসেব। মনে রাখতে হয় কখন ট্রেন ছাড়ছে, কখন পৌচচ্ছে। দিতে হয় পৌঁছ সংবাদ প্রতিটা বাড়িতে। নিজে না দিলেও মনে করিয়ে দিতে হয় অনেককেই। এসব আমি করি কেন? কারণ জানি যবে থেকে বন্ধ করে দেব করা আর কেউ আগ বাড়িয়ে বেড়ানোর কথা তুলবে না।
------ যাঃ তা হয় নাকি!
------ হয় হয়!
------ এসব মনগড়া!
------- মোটেই না!
------ তোমার ওপর কিচ্ছু না।
------ কী!
------ কিচ্ছু না!
------ কী!
------ তুমি ভাবছ নির্ভর করছে?
------ করছেই তো!
------ ঘন্টা!
------ কী রে, তোরা বল না! বল!
পার্থ বলল, ''কী ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করছ। চা খাবে। "আর আমি হঠাৎ ঘুমের চটকা ভেঙে ট্রেনের কামরার কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না কেন? এরপর আমরা চা খেলাম তারপর রাতের খাবার খেয়ে ট্রেনের যাওয়ার আর যাওয়ার শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি।
সকালে কুমু ডাকল, আমি বললাম, ''দিদি চা দাও।'' কুমু বলছে , ''ওসব দিদি ফিদি কেউ নেই। রেল কোম্পানির চা খাবে তো খাও। লাটসাহেব! কাজের মাসি বেড টি ধরাবে।'' আমি বলেছি, ''ধরাবেই তো।'' সুন্দর শেষ ফেব্রুয়ারির সকালে কমে আসা ঠাণ্ডায় হাসিরা দেখেছি ঘোরাঘুরি করছে ট্রেনময়। সকলে হাসছে, আমিও। ট্রেন নিউ দিল্লী পৌঁছেছে বিফোর টাইম, আগে পৌঁছনোয় গাড়িতেও আগে উঠে যাই। ট্রেনেই চা টা খাওয়া, পটি সারা হয়ে গেছে। স্টেশনের রেফ্রেশমেন্ট রুমে চান সারা হচ্ছে। হালকা কিছু খেয়ে রামনগরের দিকে ইনোভা রওনা দেয়। ঠিক হল করিমের কোন একটা আউটলেটে সাঁটিয়ে লাঞ্চ সারা হবে।
যেতে যেতে কয়েকটা জায়গায় থামতে থামতে সাড়ে চারটে নাগাদ করবেট জাতীয় উদ্যানের পাশে মোহনের চৌকির কাছে পৌঁছে গেলাম। আক্রম ভাই এনে তুলেছে এই রিসর্টে যার নাম হল গিয়ে করবেট ইন।একটা চারজনের থাকার ঘর আর পাশেই কুমুর জন্য আলাদা একটা। মালপত্র রেখে সবাই হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলাম। আগের দিন দুপুর থেকে জার্নির ধকল চলছে। রিসর্টটা অনেক জায়গা নিয়ে। বেশ বড় একটা দোতালা বাড়ি আছে। দেখে মনে হল হয়ত মালিকও থাকে, ঠিক রিসর্ট রিসর্ট ভাব নয়। ওই বাড়িটার একতলাতেই আমাদের থাকার জায়গা হয়েছে। এলোমেলো বাগান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে চারদিকে, এ ছাড়া কিছু কটেজ টাইপের ঘরও এদিক ওদিক রয়েছে। বড়সড়ো একটা রেস্তরাঁ আর একটা কনফারেন্স হলও করে রেখেছে আলাদা ভাড়া দেওয়ার জন্য। ঐসব হলগুলো এক একটা আপদ। নানা অনুষ্ঠানে ভাড়া দেয় আর তারস্বরে ডিজে বাজতে থাকে জঙ্গলের পশে। সে আওয়াজ জঙ্গল ফুঁড়ে ফুঁড়ে দেয়। হলটা দেখেই মনে হচ্ছে এখনই ডিজে বেজে উঠবে তার বদলে শুনলাম জলের শব্দ। সাজানো গোছানো না হলে জায়গাটার রহস্য বাড়ে , ঘুরে ঘুরে দেখতে ভালো লাগছিল জঙ্গলের কাছেই , তার গা ঘেঁষে থাকা এমন রিসর্ট হয়েও রিসর্ট নয় জায়গাটা। এই সময় কুমু এগিয়ে আসে। আমাকে বললো, '' চল চা দিয়েছে?'' আমি বললাম , ''কোথায়?'' শুনে ও বলে, '' চল তো।'' জলের শব্দটা বাড়ছে কিন্তু চা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, জলের আকর্ষণ ছেড়ে তাই চা খেতেই যেতে হচ্ছে। আমাদের ঘরটা লম্বাটে , পর পর চারটে খাট পাতা। একটা কৌচও রয়েছে বেশ বড়সড় একটা সেন্টার টেবিল সামনে , মনে হয় চা - মদ খাওয়ার জন্য জায়গা করে রেখেছে। কুমুর ঘরটাও বেশ বড় আমাদের কিছু মালপত্তর ওখানে রাখা হল। ঘরে সবাই চিতিয়ে ছড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। আমি বললাম , ''বিছানায় ফেলিস না।'' রাজু বলেছে , ''ফেললে কী হবে।'' বাঘা বলল, ''ফাইন।'' মদ ও টুকিটাকি নানা কিছু কেনার আছে, সিগারেটও।আমরা বেরিয়ে পড়েছিলাম কেনাকাটা করতে। কুমু বলল , '' আমার একটু ল্যাদ খেতে ইচ্ছে করছে, তোমরা যাও।'' কাল থেকে আবার জঙ্গল সাফারির ধকল শুরু হবে ও যেতে চাইছে না থাক।
আমরা বাকিরা বেরিয়ে পড়েছি। রিসর্টের হাতা ছাড়িয়ে সামনে রাস্তা চলে গেছে। রাস্তা আর রিসর্টকে ভাগ করেছে সামনে বাইরে, গেটের বাইরে একটা প্রবলস্রোতা নালা। বেশ পাহাড়ি, অজস্র পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে নালার খাত জুড়ে। অত স্বচ্ছ জল তীরবেগে নালা বেয়ে যাচ্ছে। সেই জলের সঙ্গে অসংখ্য খড়কুটো, প্লাস্টিকও ভাসছে উদ্দেশ্যহীনভাবে।সারাক্ষণ আওয়াজ হচ্ছে একটা, সেই জলের আওয়াজই শুনেছিলাম । বেশ বেলা হয়ে এসেছে, সূর্য ডুবু ডুবু। এখানে অনেকক্ষণ সূর্যের আলোরা থেকে যায়। বেরোতে যাবার সময় হোটেলের মালিক বলে, 'দূর নেহি যানা। তুরন্ত লোটকে আইয়ে।' তখনও কারণ বুঝিনি শুধুই শুনে চলে গেছি। বেরোনর সময়ে রিসর্টের পাঁচিলের লাগোয়া নালাটার সামনে দঁড়িয়ে ছিলাম আমরা।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয় জলের স্রোত আরো বেড়ে গেছে। আর ঠিক তখনই নালাটার দিকে তাকাতে জঙ্গলের জলের অন্ধকার শরীর দেখতে পাই। সেই শরীরে অসংখ্য রহস্য ঘিরে বসে আছে আর চতুর্দিকে নুড়ি বিছানো। জলের শব্দটা আরো যেন বেড়েছে। জঙ্গলের একটু ধারে ধারে বেশ সংখ্যক এই রকম রিসর্ট গিজগিজ করছে। সেগুলোতে সবে আলো জ্বলে জ্বলজ্বল করছে। আকাশে আর আকাশের বাইরে ছটার পরও বেশ আলো। সে সব আলো জ্বালিয়ে করবেট ইন রিসর্টের গেটের লাগোয়া পাহাড়ি নালার জল আরো বেশি করে শব্দ করতে করতে ছুটতে থাকে। বোঝাই যায় সন্ধে ঘনিয়ে এলে তবেই না আমরা ফিরে আসব আর তখন হয়ত নালায় জল বেড়ে গভীর হয়ে জলের আওয়াজ আর শোনাই যাবে না। এমনই গভীর আর নিঃশব্দ অন্ধকার আর জলের অপেক্ষায় বসে না থেকে আমরা হাঁটতে আরম্ভ করলাম।
রাজু বাতাস শোখে ভালো সে পিচের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে বাতাসের গায়ে গন্ধ পেল। তখন আমরা করবেট ইন রিসর্ট থেকে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছি আর নালার জলের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না। আকাশের দিকে তাকাতে তখনও অনেকটা অবশিষ্ট আলো লেপ্টে থাকতে দেখা বা না দেখা যাচ্ছে আর এই সময়ই রাজু বাতাস শুখতে আরম্ভ করল। আমরা একটু আগে পরে করে যাচ্ছিলাম। মাখনের মতো রাস্তা বানিয়েছে। তার ওপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে গাড়ি যাচ্ছে আর পাশেই জঙ্গল। রাস্তা এপার ওপার করে যে শুঁড়িপথগুলো ছিল সেগুলো হাওয়া। ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায় এখনো সেসব শুঁড়িপথের দাগ রয়েছে রাস্তার এপারে আর ওপারে। তার মানে এখনো বন্যপ্রাণী এপার ওপার করে আর রাস্তার ওপর দিয়ে যাবার সময় গাড়ি চাপা পড়ে। সেই রাস্তা দিয়ে আমরাও যাচ্ছি। রাজু বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া তার শোখার বিষয় নিয়ে কথা বাড়ায় না। যখন কথা বলে আমরা জঙ্গলে বহুবার গিয়ে বুঝতে পারি তার গুরুত্ব আছে তাই আমরা সবাই কান খাড়া করে ওর কথা শুনলাম—রাজু বলছে,
------'একটা গন্ধ'
------গন্ধ?
------হ্যাঁ।
------তো কী?
------মানে পাচ্ছি।
------সে তো সব সময়ই পাস। সবাই পায়। তুই একটু বেশি পাস—গন্ধ।
------না, এটা সে রকম না।
------কী রকম?
------মানস জাতীয় উদ্যানের ভেতরে নদীর তীর বরাবর গিয়েছিলাম মনে আছে?
------থাকবে না। সন্ধে হব হব করছিল। রাস্তাটা বেশ উঁচু নিচু ছিল, তাই না ?
------ঠিক তাই উঁচুনিচু ছিল।
------আর অন্ধকার। অন্ধকার। গাছের ফাঁকে ফাঁকে আলো দেখা যাচ্ছিল আর নদীর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল।
------এখানে নদী নেই। নালার আওয়াজটাও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক দূর চলে এসেছি।
------মানসের জঙ্গলে একই গন্ধ পেয়েছিলাম।
------তাই?
------হ্যাঁ।
------মানসের নদীর ধারে তো অন্ধকার করা গাছেদের আচ্ছাদন ছিল তবে সন্ধে হয়ে আসছিল।
------এখনও সন্ধে হয়ে আসছে। যদিও আকাশে অনেক আলোরা আছে তবু একই গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
------বাঘের?
রাজু বাঘের গন্ধের ব্যাপারে কিছু বলল না। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে কম বেশি সবাই আমরা কজন একটু বেশি দেখতে পাই। তাই পিচের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কিছু দূর অন্তর অন্তর রিসর্টদের দেখতে থাকি। কোনটা ছোট, কোনটা বড়, কোনটা মাঝারি সব রিসর্টরা আর ভাবছিলাম জঙ্গল কই। রাজু আমার ভাবনা পড়ে ফেলার মতো বলল, ''ওই তো রিসর্টের পেছনেই হাতার মধ্যে জঙ্গল।''
------নাকি জঙ্গলের হাতার মধ্যে রিসর্ট।
------তা বলতে পারিস?
------আর গন্ধ?
------একটা তো পাচ্ছি বটেই।
------ বাঘের?
------ মানসের জঙ্গলের মতো।
------ কী রকম?
------ বোটকা, তীব্র, ঝাঁঝালো, পচা ….
------ মাংসের টুকরো
------পচা মাংসের টুকরো নখের ফাঁকে, দাঁতের ফাঁকে থাকলে যেমন হয়।
------ কী রকম?
------ মানসের জঙ্গলের ভেতরে, নদীর ধারে, অন্ধকার অন্ধকার হয়ে আসা অঞ্চলে যেমন পেয়েছিলাম।
----- ঠিক ওইরকম?
----- অবিকল।