ইমানুলদার 'কাদামাটির হাফলাইফ'-এ আমার শৈশব খোঁজা:
যে কোনো বই হাতে নিয়ে আমি প্রথমেই লেখক পরিচিতি অংশটায় চট্ করে একবার চোখ বুলিয়ে নি- স্বনামধন্য বা পূর্বপরিচিত লেখক নাহলে সে পাতায় হয়তো একটু বেশিক্ষণ চোখ রাখতে হয়। আমার হাতে এখন “কাদামাটির হাফলাইফ”, লেখক ইমানুল হক, আমার খুব খুব পরিচিত একজন মানুষ। যার কথা মনে পড়লে চোখে ভাসে ১৯৯২-৯৩এ আমার প্রথম কলকাতার হোস্টেল জীবন- আমার বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের মাস্টার্সের দুটো বছর, পি জি হসপিট্যালের হোস্টেলের ছোট্ট ঘরে দুপুর গড়ানো আড্ডা, গানের রিহার্স্যাল… ইমানুলদাকে চিনি আমি একজন অনর্গল কথা বলে যাওয়া মানুষ হিসেবে। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে অনায়াসে যাতায়াত করা বাগ্মী হিসেবে। ইমানুলদার কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের বক্তব্য কখনোই শুধু ওই বিষয়ে আটকে থাকে না… বেশিরভাগ সময়টা আনুষঙ্গিক বিষয়টাই বেশি হয়ে গিয়ে মূল বিষয়টা দু-একটা বাক্যে স্থান পায়। তার মধ্যেই এসে যায় অজস্র তর্ক-বিতর্কের অবকাশ। এক নিশ্বাসে কথা বলার মাঝে অন্য কেউ কিছু বলার সুযোগই পাবে না।
এখন ইমানুলদার এই বই হাতে পেয়ে বেশ স্বস্তিতে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবছিলাম বেশ ধীরে-সুস্থে বইটা পড়ব, ইমানুলদার বকবকানির মধ্যে পড়তে হবে না। কিন্তু কোথায় কী! “বই নিয়ে দু’কথা- কেন এই বই লিখতে হলো?”- লেখকের কথার পাতাগুলো পড়তে পড়তেই বুঝলাম আমার ভাবনা ভুল… আমায় এক নিশ্বাসেই পড়তে হলো। প্রথম পর্বে ঢুকেই মনে হলো ইমানুলদা একটা “audio book” লিখেছে। সামনা-সামনি ইমানুলদা যেভাবে, যে ভঙ্গিতে কথা বলে এই বইটাও যেন সেভাবে, সে কায়দায় কথা বলছে। ইমানুলদা বলে চলেছে অনর্গল ছোটবেলাকার কথা, সেসময়ের গ্রামের কথা, গ্রাম জীবনের কথা। আমারও মনটা এক ছুটে চলে গেছে আমার ছোটবেলায়, আমার সেই গ্রামে যেখানে আমার জন্ম থেকে পাঁচটা বছরের শৈশব কেটেছিল এরকমই কাদামাটির সাথে। আমার সেই অতি শৈশবের স্মৃতি-বিস্মৃতির মিল-অমিল, কল্পনা-বাস্তব সবকিছু মিশে গিয়ে আমি ক্রমশ কাদায় আটকে পড়ছি; আর যত কাদা ঘাঁটছি ততই কাদায় গেঁথে যাচ্ছি।
ইমানুলদা বলে চলেছে অনর্গল। মাঝে-সাঝেই যেভাবে কথা বলে- অগোছালো, এলোমেলো… বলা ভালো অগোছালো ভাবনার এলোমেলো বিচরণ- ঠিক সেভাবে। তাই 'কাদামাটির হাফলাইফ' একটা গল্প লেখা নয়, কোনো গল্প বলা নয়; এটা ইমানুলদার জীবনচরিত হয়ে ওঠার বই নয় শুধু, আরও অনেকের জীবনের হাফ বা আমার মতো জীবনের আরও ছোটো ভগ্নাংশকে ফিরে দেখার কথকতা। ইমানুলদার এই নিজস্ব লেখার শৈলীতেই রোজকার জীবনের বর্ণনায় সবকিছু যেন জীবন্ত ধরা দিয়েছে। মানুষের মন যেমন সদা চঞ্চল, চিন্তাগুলোকে যেমন এক জায়গায়, এক বিষয়ে বেঁধে রাখা যায় না, এই বইয়ের ঘটনা প্রবাহও তেমন।
এই বই পড়তে পড়তে আমি প্রথমেই যে কাজটা করেছি তা হলো আমার ছোটবেলার কিছু ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া খাবার-দাবার পুনরুদ্ধার করেছি। প্রথমেই খেয়েছি রুটি-চিনি, তারপর খেলাম পরোটা-গুড়, সুজি-মুড়ি, মুড়ি-বিস্কুট, চিনি-মুড়ি, ডাল-মুড়ি, ফ্যানাভাত। এই বই এর পাতায় চোখ থাকাকালীন এই খাবারগুলোর অনুষঙ্গ যেন সিনেমা-থিয়েটারের আবহসঙ্গীতের মতো অপরিহার্য হয়ে গেছিল। পুরো বইতেই খাবার-দাবারের প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। কিছু চেনা, বেশিরভাগই অচেনা-অজানা … আজও। কারণ কিছুটা স্থানভিত্তিক, কিছুটা সংস্কৃতি-সম্প্রদায়ভিত্তিক বলে আমার মনে হয়েছে। অনেককিছুই অনাস্বাদিত হলেও বর্ণনায় জিভে জল আনার মতো। ইমানুলদা, তোমার কাছে আবদার রইল কুমড়ো দিয়ে মাংস রান্নাটা একবার করে খাইও। খুব মনে পড়ছে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী বুদ্ধদেব গুহর লেখায় খাবারের বর্ণনা থাকত এমনই যে পড়তে পড়তে তার স্বাদ পাওয়া যেত। কুর্চি তার পৃথুদাকে যে মুড়িটা মেখে দিয়েছিল, সে তো সেই কবেই, সেই স্বাদ এখনও জিভে লেগে আছে। ইমানুলদা সেদিক থেকে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে।
একজন নিরীশ্বরবাদী, ধর্মহীন, অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে আমি ইমানুলদাকে চিনি-জানি। এই বইয়ের নির্যাসে এই মানবিক আঙ্গিক, এর চলন-বলন আমার হৃদয়ের খুব কাছাকাছি তাই।
সবাই আমরা কল্পনা করি- তারও বোধহয় একটা পরিধি আছে, সীমারেখা আছে, আছে সীমাবদ্ধতা।
ইমানুলদা এক জায়গায় লিখেছে - “লক্ষ্মী প্রতিমার মতো ব্যবহার”, লেখেনি “লক্ষ্মী-ব্যবহার” বা “লক্ষ্মীর মতো ব্যবহার”। হিন্দু দেব-দেবীর মানবিক চেহারা হলেও মূর্তি বা প্রতিমার ব্যবহার নিয়ে কখনো তলিয়ে ভাবি নি। ইমানুলদা, তুমি তাদের এতটাই মানবীয় ভাবতে পেরেছো! এটা আমাকে ভাবিত করেছে।
ইমানুলদার গ্রামের তৎকালীন অসাম্প্রদায়িক মেলামেশা, পাশাপাশি বসবাস, যেকোনো উৎসবে ভেদাভেদহীন অংশগ্রহণ -- আমার আবছা মনে সেরকমই সব স্মৃতি মনে করায়।
ইমানুলদার বই আমাকে অনেক কিছু মনে করিয়ে দিয়েছে। আমার স্কুল শিক্ষক দাদুর সুবাদে স্কুলের কোয়াটার্সে আমার প্রথম পাঁচটা বছর কেটেছিল। বেশ কয়েকটা শিক্ষক-কোয়াটার্স নিয়েই আমার ছোটবেলার পাড়া, স্কুল-কেন্দ্রিক ছিল সবার জীবন-যাপন। খানিকটা গণতান্ত্রিক পরিবেশেই আমার বেড়ে ওঠা। পড়াশুনোর প্রাধান্য, শিক্ষার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তবে ইমানুলদা, তোমার জীবনে ছোট থেকেই যেমন রাজনীতির প্রভাব ছিল, আমার সেরকম কিছু মনে পড়ে না। তোমার বাবার সক্রিয় রাজনীতির ধরন এবং ওরকম অবিশ্বাস্য সমর্পণ, একটা আশ্চর্য উদাহরণ। ভাবলে অবাক হতে হয়। ওরকম একজন মানুষের সঙ্গে ঘর-সংসার করা তোমার মায়ের প্রতিও জানাই শতকোটি প্রণাম।
প্রতিটা পর্ব পড়তে পড়তেই মনে পড়ে আমার ছোটবেলার আরও ‘অনেক কিছু করতাম’ সেসব কথা।
স্কুলের পুকুরে সাঁতার শেখা, লাঠির আগায় দড়ি বেঁধে ছিপ ফেলা, হরতুকি চিবিয়ে স্কুলের ‘টিউকলে’ জল খাওয়া, সাঁই-বাবলার প্যাঁচানো প্যাঁচানো ফল পেড়ে খাওয়া, আঁশফল গাছে ওঠা। ধান গাছের নাড়ার ওপর হেঁটে পা ব্যথা করা, আবার বৃষ্টিতে ওই জমিতে জমা জলে মাছ ধরতে যাওয়া, পুকুরের জলে ভেসে শাপলার ডাঁটি তুলে কচমচ করে খাওয়া… আরও কত কী! মনে পড়ে উঠোনের শিউলি গাছটার কথা, রান্নাঘরের পেছনের তালগাছটার কথা, স্কুলের ভেতরের কদম গাছটার কথা। খালের পাড়ে দাদুর বাগানে মার সঙ্গে ধামায় করে সিম তোলার কথা। ছিল ছেলেধরার গল্প, ব্রহ্মদৈত্যর গল্প, ভিক্ষুক বহুরূপী, শিবের গাজন, সন্ন্যাসীর ঝোলার কৌতুহল। আর কাঠের পোল আর বাঁশের সাঁকোয় অজস্রবার পারাপারের স্মৃতি।
অনেক নতুন শব্দ পেয়েছি পড়তে গিয়ে। বাংলা ভাষাটা খারাপ জানি না, তাও আমার কাছে একেবারে অচেনা; কিছু কিছু শব্দ তো আছেই শুধু সেই অঞ্চলের নিজস্ব বা কিছু সম্প্রদায়ের ভেতরেই চলাচল করে। মনে রাখার চেষ্টা করেও এখন ভুলে গেছি।
আর পড়তে ভালো লেগেছে তখনকার বিয়ের গল্প। মুসলমান বাড়ির বিয়ের অনেক রীতি-বিধি-আচার আমি খুব বেশি দেখিনি, জানি না। এই বই সেগুলো জানতে সাহায্য করেছে। কিছু কিছু আমার দেখার সঙ্গে মিল পেয়েছি। আবার অনেক কিছুই অজানা বা অমিল।
তখনকার গ্রামজীবনের বিনোদনের কথায় এসেছে মেলার কথা। চড়কের মেলায় সন্ন্যাসীর ঝাঁপ, আরও কতরকমের কসরত যা রাশিয়ান সার্কাসের থেকেও রোমহর্ষক ছিল। আমারও দেখা। আবারও মনে পড়ে গেল। যেমনটা তুমি লিখেছ, তখন নজরুলগীতির উপস্থিতি ভীষণভাবে ছিল, শুনে শুনে ওই বয়সেই শিখে নিয়েছিলাম বেশ কয়েকটা গান। আর খুব মনে পড়ে তখনকার খুব জনপ্রিয় একটা গান- “এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে”। সব মেয়েরাই প্রায় গাইতো।
যাত্রার কথায় নট্ট কোম্পানী, নটী বিনোদিনী এসবের উল্লেখে আমার ছোটবেলাও সমুজ্জ্বল। কাছেই ছিল আমারও মামারবাড়ি- বনেদী, নাম-ডাক, প্রতিপত্তিওয়ালা… যাত্রার আয়োজক। বিখ্যাত বিখ্যাত নায়িকারা মামারবাড়িতে এসে থাকতেন। বিশ্রাম নিতেন। তখন দোতলায় উঠতে হোতো পা টিপে টিপে। ওনারা সারাদিন নাকি ঘুমোতেন, রাত জাগতে হবে যে।
ইমানুলদার এই বই আমাকে এমনভাবে শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে, এই বই নিয়ে লিখতে বসে আমার নিজের এক আখ্যান লেখা হয়ে যাবে এত কিছু মনে পড়ে যাচ্ছে। বইটার পরতে পরতে তখনকার সমাজ ব্যবস্থা, দৈনন্দিন সাংসারিক জীবনের খুঁটিনাটির এমন বর্ণনা আছে যে যেকোনো পাঠকের চোখেই সেসময়ের দৃশ্যকল্প তৈরি হতে বাধ্য। পড়তে পড়তে কখনো সখনো মনে হয়েছে ইমানুলদার ছিল সচ্ছলতা আর অসচ্ছলতার পর্যায়ক্রমিক পৌনঃপুনিকতা… একটা অন্যরকমের লড়াই ছিল। এরকমই এক প্রেক্ষাপটে নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনের ভর্তি পরীক্ষা দিতে যাবার দিনটার বর্ণনা আমায় কাঁদিয়েছে। এসেছে অনেক আদর্শবান শিক্ষকের কথা, স্কুলজীবনের কথা… পড়তে খুব ভালো লেগেছে; আমার দাদুকে খুঁজে পেয়েছি অনেকের মধ্যে। ট্রেন থেকে নেমে ছুটতে ছুটতে বাড়ির ধানকলের জন্যে ডিজেল কিনে দৌড়ে ফিরে আবার ওই ট্রেন ধরে নেওয়া -- সেই ছোট্ট বালকের একজন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, পরিশ্রমী, সংগ্রামী যুবক হয়ে ওঠার জমি তৈরি করেছে বলেই আমার মনে হয়। ইমানুলদার পরের বই “ইটকাঠপাথরের জীবন” পড়ার ঔৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।