ভিজিটিং আওয়ার শেষ হলে রাস্তায় বেরোল স্মিতা- চা খাবে। জেম্মা একই রকম- ঘোরের মধ্যে যেন। রোজই কানের কাছে মুখ নিয়ে জেম্মাকে ডাকে স্মিতা, একাধিকবার। আজ একবার উঁ বলে সাড়া দিয়েছিল। তারপর আবার যেন ঘুমোচ্ছে। নড়া চড়া নেই- ধীরে নিঃশ্বাস বইছে শুধু। ডাক্তারবাবুর রাউন্ডে আসার কথা ঘন্টা দুয়েক বাদে- কথা বলতে হবে। চা খেয়ে অপেক্ষা করবে স্মিতা।
শনি রবিবার হলে, বাবলুদা, বৌদি, ঝিমলি, মেজোপিসি কেউ না কেউ আসেই ভিজিটিং আওয়ারে। পল্টনরা কালীপুজোর সময় দিল্লী গিয়েছিল- ফেরেনি এখনও। ঝিমলিরাও কোথায় যেন বেড়াতে যাবে বলছিল। আজ বুধবার, স্মিতা একাই জেম্মার পাশে বসেছিল সারাক্ষণ।
কাচ দরজা পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নামতে স্মিতার আরাম লাগছিল - এতক্ষণের এসির হিমঠান্ডার পরে ঈষৎ আর্দ্র উষ্ণতা পাতলা কাঁথার মত- ছাড়তে ইচ্ছে করে না। এই সময় কে যেন ডাকল ওর নাম ধরে।
কোন কোন দিন এমন হয়। হয়তো স্মিতা শাওয়ারের তলায় তখন। জল পড়ছে। কেউ যেন ডাকল স্মিতার নাম ধরে। চেনা গলা- অথচ মনে পড়ে না নাম। সে নিজে ঠিক যে কোথায়- গুলিয়ে যেত তার। বাষ্পে ভরা ঘর, জানলা, আয়না। শাওয়ার কার্টেন, দরজার নব হাতড়ে হাতড়ে কোনো ক্রমে বেরিয়ে আসত সে। ভেজা আঙুলে ফোনের স্ক্রীনে মিসড কল খুঁজত। তারপর নিজেই ফোন করত একে তাকে। কিম্বা হয়ত এমন হয়েছে, রাতের দিকে ট্র্যাশ ফেলছে সে; কাচের ওপর কাচে শব্দ উঠে জাস্ট মিলিয়ে গিয়েছে আর স্মিতার মনে হয়েছে, কে যেন ডাকল -তারপর লম্বা একটা গাছ দেখেছে- রাতের আকাশের রঙের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে। মরা চাঁদের ওপর মেঘ ভেসে যেতে দেখেছে তারপর। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকে ফোন করেছে -" পায়েল, জেম্মা ভালো আছে? কথা বলতে পারবে? একটু দে।" আসলে তখন ওর ছোটোবেলার কথা মনে পড়ত। মা, বাবা, জেঠু, জেম্মা, বাড়ি, পেয়ারাগাছ আর বাড়ির পিছনের পুকুর, যেখানে জলের তলায় সে আর এক শহর দেখেছিল।
স্মিতাদের বাড়ির পিছনে অনেকটা ঘাসজমি -তাতে নিমগাছ, পেয়ারাগাছ , টগর, বকুল, জবা, কলাবতীর ঝাড়, বুগেনভিলিয়ার অগোছালো বাগান, সে বাগান পেরিয়ে পুরোনো পুকুর, বাঁধানো ঘাট। বুল্টুকাকুর বিয়ের সকালে ঘুম ভেঙে সে পুকুরের দিকে গিয়েছিল সুষমা পিসির সঙ্গে। জলভরা শেষ করে ঘাটের সিঁড়ি ভেঙে বাগানের পথ ধরেছিল বাকিরা, সেই সময় কেউ ডেকেছিল তাকে। স্মিতা পিছন ফিরেছিল, অন্যমনস্ক পিসির হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে গিয়েছিল পুকুরের দিকে। হলফ করে স্মিতা বলতে পারে, সে দেখেছিল জলতল যেখানে শেষ হয়েছে ঠিক সেখান থেকেই আর একটা শহর মাথা নিচু করে ঝুলে আছে-একটা গোটা শহর যেন ঐ পুকুরের তলায় ঢুকে পড়েছে। শহরে পাহাড়, তার গায়ে ছোটো ছোটো বাড়ি, চার্চ, ঘোড়সওয়ারের মূর্তি, জলের তলার শহরে তখন রাত, চাঁদ দেখা যাচ্ছে। আরও ভালো করে দেখবে বলে স্মিতা মাথা ঠেকিয়ে দিয়েছিল জলের ওপর। কানে, চোখে নাকে টের পাচ্ছিল কনকনে ঠান্ডা জল- তখনই সুষমাপিসি ঝপ করে স্মিতাকে কোলে তুলে নিয়ে চিল চীৎকার-"কী করছিলি এখানে?" স্মিতা এক ঝলক তাকিয়ে দেখে নিয়েছিল, পুকুরের ওপর আবার কুয়াশা - যেন একটা দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বিয়ের পর, বাপের বাড়ির পুকুরের নিচে অচেনা শহরের স্মৃতি তীব্র হয়ে ফিরে এসেছিল। তার নতুন বরকে ঐ পুকুরের মত মনে হয়েছিল স্মিতার - যেন সে যাকে বিয়ে করেছে তার অভ্যন্তরে আর এক মানুষ উল্টো হয়ে ঝুলে আছে, আর পঙ্কজ সেই উল্টো মানুষকে সযত্নে আড়াল করছে স্মিতার থেকে। এই আড়াল করার বেদনা যেন একটা বিবর্ণ মশারির মত গুটিয়ে ঝুলে থাকছে ওদের দুজনের ওপর , তারপর ভার বইতে না পেরে একদিন সটান নেমে আসছে - ক্রমে এই বসবাসেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে দুজন।
আজ এই হেমন্তের সন্ধ্যায় হাসপাতালের সামনের ফুটপাথে সেই কুয়াশা তাকে আবার ঘিরে ধরেছিল- যে কুয়াশা তাকে এই ক'বছরে বারে বারে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে তার শৈশবে আর সে কখনও মা, কখনও বাবা , কখ্নও জেম্মার সঙ্গে কথা বলেছে ফোনে। আজ সে' উপায় ছিল না- তার শৈশবের শেষ যোগসূত্র এই হাসপাতালের চারতলার ঘরে নাকে মুখে নল নিয়ে শুয়ে ছিল তখন। হাসপাতালের কাচ দরজা খুলছিল, বন্ধ হচ্ছিল। নীল আলো জ্বালিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এসে থামছিল পরপর। হিম নামছিল ফুটপাথে। সেই হিমের সঙ্গে হাসপাতালের চারতলা থেকে কুয়াশার মত মৃত্যুর ছায়া এসে মিশছিল যেন।
রাস্তা পেরিয়ে চায়ের দোকান। স্ট্রীটলাইটের আলো পিচরাস্তায় রিফ্লেক্ট করছিল। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে স্মিতা সময় দেখল; তারপর পঙ্কজের সময় হিসেব করে, যখন মোবাইল ঢুকিয়ে নিতে চাইছিল ব্যাগে- হাতের রুমাল, মোবাইল দুইই পিছলে গেল ফুটপাথে। নিচু হয়ে কুড়িয়ে নিতে গিয়ে স্মিতা পিঁপড়ে দেখতে পেল - ছোটো কালো এক বিন্দু হেঁটে আসছিল । ফুটপাথের ওপরে সিগারেটের খালি প্যাকেট, তোবড়ানো কোকের ক্যান, চকোলেটের র্যাপার - সে সব পেরিয়ে পিঁপড়ে আসছিল। এক মোচড়ানো স্ট্রয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়েছিল। তারপর সামান্য থেমে শুঁড় বুলিয়ে নিয়েছিল ফুটপাথের শানে, শুঁড় উঁচু করেছিল। স্মিতার মনে হল, যেন গ্রীট করল তাকে তারপর পাশ কাটাল ।
ফুটপাথ ঘেঁষে হাইড্র্যান্ট- ধাতবজালের ঝাঁঝরি। পিঁপড়ে হেঁটে গেল-যেন সার্কাসের রোপ ওয়াকিং । সামান্য হাওয়া উঠেছিল হঠাৎ। অথচ সে এঁটে রইল লোহার জালে। শুঁড় বুলিয়ে পরখ করে নিল সামনের পথ। এগোলো আবার। এই সময় ট্র্যাফিক সিগনাল গ্রীন হয়েছিল। সমস্ত গাড়ি স্পীড তুলেছিল একসঙ্গে । হাওয়ার দমকে উড়ে পিঁপড়ে উড়ে এসে পড়েছিল ফুটপাথে । পড়েই ছিল খানিকক্ষণ। স্মিতা অবাক হয়ে দেখল, আবার সে শুঁড় বোলাচ্ছে বাঁধানো ফুটপাথে , আবার পেরোচ্ছে লোহার জাল - সন্তর্পণে। রাস্তায় নামল পিঁপড়ে, আবার। রেড সিগনালে সেই মুহূর্তে পথ ট্র্যাফিকহীন। স্মিতা লক্ষ্য করে পিঁপড়ে এগোচ্ছে। এইসময় সিগনালের আলো বদলায়- অবশ্যম্ভাবী। স্মিতা দেখে, গাড়ীর চাকা, একের পর এক , বিরামহীন। ধূসর অ্যাসফল্ট। একটি কালো বিন্দু ওকে নাম ধরে ডাকে। ট্রাফিকের স্রোত ওকে টানে । সিগনাল তখনও সবুজ- স্মিতা পা রাখল রাস্তায় তারপর সরিয়ে নিল। ওর মনে হয়েছিল, ওকে আপের পথে হাঁটতে হবে আরো অনেকদিন। ফুটব্রিজ দিয়ে রাস্তা পেরোল স্মিতা। দোকানের বেঞ্চে বসে আদা চা চাইল।
কয়েক পশলা বৃষ্টির ফোরকাস্ট ছিল। অথচ আকাশ পরিষ্কার - তারায় তারায় ভরে আছে এখন । সন্ধ্যার পরে এই রকম সময় একলা মানুষজন আকাশের দিকে তাকায়, তারা দেখে, সামান্য অন্যমনস্ক হয়। তারপর হোঁচট খেলে, রাস্তায় চোখ নামিয়ে ঘরবাড়ির দিকে হাঁটে। রাস্তার ওপর পড়ে থাকা নুড়ি, ইটের টুকরো সরিয়ে দেয় যত্ন করে।
অফিসের পরে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে সনৎ তারাদের কথা ভাবছিল। ছোটোবেলায় সব বাচ্চাকেই মা বলে, মানুষ মরে গেলে তারা হয়। সনতের মাও বলেছিল তারপর স্টোভ ফেটে নিজেই স্টার হয়ে গিয়েছিল। সম্ভবত লিটল স্টার ; সনতের মনে হত- ওর রোগা ছোট্টো মা- সে কী করে জায়ান্ট স্টার হবে? রাতের আকাশে মা কে খুঁজতে খুঁজতে নিতান্ত শৈশবেই সনতের মাথার মধ্যে গ্রহ তারা সেঁধিয়ে গিয়েছিল , মস্তিষ্কের শিরা ধমনী ফুঁড়ে দিয়ে রক্তে মিশে গিয়েছিল একদম-
সনতের মাথার ওপর দুশো বিলিয়ন তারা থাকা উচিত এখন-যদিও, এই মুহূর্তে মা'কে খুঁজছিল না সনৎ; আকাশের দিকে তাকিয়ে সে বিশাল বিশাল হাইড্রোজেনের মেঘ কল্পনা করছিল - লাল বেনারসী, কনে চন্দন পরা হাইড্রোজেনের মেঘ একের পর এক অরিয়ন কমপ্লেক্স ফর্ম করছে। কী বিশাল কী বিশাল - সনৎকে তারা যেন টেনে নিচ্ছিল তাদের দিকে- জুতোর নিচে পাড়ার রাস্তাকে ফীল করছিল না সনৎ, মাথা টলটল করছিল তার। সে ঘাড় নামাল। এ কাঁধ থেকে ও কাঁধ করল অফিসের ব্যাগ।
পুকুরের পাশের বাড়িটার দোতলার জানলা আজও বন্ধ। গোটা বাড়ি ঝিম মেরে পড়ে আছে। অনেকখানি অন্ধকার মাড়িয়ে বাড়ি ঢুকল সনৎ। কদিন আগেও ও'বাড়ির জানলা খোলা ছিল। আলো জ্বালা ছিল ঘরে।
সনতের ঘরদোরে আজ গরম রুটির গন্ধ। তার মানে মন্টুর মা এই সবে রান্না সেরে বেরিয়েছে। চাবিটা ছুঁড়ে ফেলে ঢকঢক করে জল খেল সনৎ তারপর শোয়ার ঘরে ডেস্কটপ অন করল । ইসরোর সাইটে লঞ্চিংএর নতুন ডেট কী দিয়েছে দেখতে হবে- মোবাইল থেকে খোলা যাচ্ছিল না। আজই অফিসে তন্ময়ের সঙ্গে এই সব নিয়ে তর্ক । তন্ময় বলছিল, “যত ভাঁওতাবাজি, প্রজ্ঞান না অজ্ঞান।“ সনৎ কমার্সের ছাত্র। কিন্তু ইস্রোর সাইট মুখস্ত করে উগরে দিচ্ছিল অফিসে। তন্ময় হাসছিল-" শালা, তুই যেন কী। যেন তোর মেয়ের বিয়ে"। বলেই চুপ করে গিয়েছিল।
সনৎ প্লাগের ওপর দুবার হাত দিয়ে চাপ দিল- কানেকশন স্লাইট লুজ ছিল; এবার সুইচ টিপলে, গোঁ গোঁ করে সিপিউ তে সবুজ আলো জ্বলল । সনৎ ডেস্কটপের ঢাকনা খুলল যত্ন করে। ল্যাপটপ কিনতে হবে। ডেস্কটপটা কোনোরকম জোড়াতাপ্পি দিয়ে চলছে, এবার খারাপ হলে আর সারানো যাবে না।
তিনবারের চেষ্টায় ডেস্কটপ চালু হলে ইউটিউবের সাবস্ক্রাইবড চ্যানেলের নোটিফিকেশন আসছিল টুং টাং করে- সনৎ সটান ইউ টিউবে গেল। নাসার চ্যানেলে হাবল টেলিস্কোপের ওপর ডকুমেন্টারি চালু করে ফ্যানের সুইচ অন করল - ঘাম শুকিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেবে; শীত আসছে শহরে- ভোর রাতে হিম পড়ছে আজ ক'দিন।
সে শার্ট প্যান্ট বেল্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ল। পাজামা গেঞ্জি গলাতে গলাতে ডকুমেন্টারি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওর অন্ধকার ঘরে টেবিলের ওপর রাখা মনিটর এখন বেগুনী আলো ছড়াচ্ছে- স্ক্রীনের ওপর নীল সাদা হলুদ লাল সবুজ রঙের অজস্র শিরা উপশিরা শঙ্কুর মত প্যাঁচ খেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে, সেখানে চোখের মণির মত সুগোল বৃত্ত। কখনও সমুদ্রের ঢেউএর মত লাগছিল, কখনও মনে হচ্ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘার রেঞ্জের টপ ভিউ- সনৎ জিভ চাটল। খরখরে দাড়িতে হাত বোলালো। বিড়বিড় করে বলল , থার্টিটু মিলিয়ন লাইটইয়ারস। থার্টিটু মিলিয়ন। ওর শরীর কাঁপছিল। নিজের নাভিতে তর্জনী ঠেকালো সনৎ, হাতের চেটো বুলিয়ে নিল আলতো করে, যেন এম সেভেন্টি ফোরের গ্র্যান্ড স্পাইরালকে ছুঁচ্ছে এইভাবে নখ বসাল গভীরে তারপর পাজামা নামাল। রক্তে ঘুরে বেড়ানো গ্রহ তারাদের ছুঁয়ে ফেলছিল সনতের আঙুল। কুইপার বেল্ট পেরিয়ে ওর্ট ক্লাউড। যেন মহাজাগতিক ধুলোকণা হিমের মত ওর আঙুল বেয়ে নামছে।
খালি গা, ভেজা পাজামায় ডকুমেন্টারির বাকিটুকু দেখছিল সনৎ- দেখছিল এনজিসি ইলেভেন থার্টি টু - থ্রীটুয়েন্টি মিলিয়ন লাইট ইয়ার্স দূরে, দেখছিল কেমন করে গ্যালাক্সি মিশে যাচ্ছে আর এক গ্যালাক্সিতে, দেখছিল বিশাল আলোকময় সেতু, দেখছিল সহস্র তারার নদী, দেখছিল আবছা কচি কচি আকর্ষর আঙুল- মহাজাগতিক ধুলোর তৈরি- এই আছে, এই নেই।
পুকুরের পাশের হলুদ বাড়ির দোতলার জানলায় তখন আলো জ্বলছিল। হাসপাতাল থেকে ফিরে জানলা খুলছিল স্মিতা। পাশের বাড়ির অন্ধকার ঘরে নীল বেগুণী গোলাপী হলুদ আলো জ্বলছিল, নিভছিল- প্রথমে টুনি বাল্বের মত লাগছিল স্মিতার, তারপর দেখল, সেই আলোর তরঙ্গ যেন রঙীন সুতোর মত জানলা পেরিয়ে বাইরে আসছে আর রাতের ঘন আলকাতরার মত অন্ধকার ক্রমশ তরল হয়ে আকাশ বেয়ে গড়িয়ে নামছে।
জানলা বন্ধ করল স্মিতা।
বৃষ্টি নেমেছে। যেমন কথা ছিল।