বারো বাই পঁচানব্বই মিটারের টিবিএম চণ্ডী তার কাটিং হুইলে মাটি, পাথর খণ্ড খণ্ড করে এগোচ্ছিল ক্রমশ। সেইসব কাদা, মাটি, পাথরের টুকরো স্ক্রু-কনভেয়র দিয়ে পৌঁছে দিচ্ছিল বেল্ট কনভেয়রে; লস অফ স্টেবিলিটিকে কমপেনসেট করছিল সাপোর্ট প্রেশার। চব্বিশটা হাইড্রলিক মোটর গিয়ার র্যামে টর্ক তৈরি করছিল। আর ইনজেকশন সিস্টেম জল দিয়ে সামনের মাটি ভিজিয়ে নিচ্ছিল, প্রয়োজনমত।
মন্দিরের সামনের রাস্তায় পায়ের পাতা ডোবা জল – রুটের বাস, ট্যাক্সি গেলেই চাদর বিছিয়ে দেওয়ার মত করে ফুটপাথে উঠে আসছিল; এক কোণে প্লাস্টিক দিয়ে ঘেরাটোপ বানিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রফুল্ল – সেই রাত থেকে। একবার মুণ্ডু বের করে আকাশ দেখেছিল – চারদিক সাদা হয়ে বৃষ্টি পড়ছে, বেলা বোঝা যায় না। কাঁসি আর পটল ওর পাশেই কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল – প্রফুল্লকে মুখ বের করতে দেখে গা মোড়ামুড়ি দিল, আবার ঝিমোতে লাগল। গতকাল দুপুরে ফুটপাথে পটলকে এঁকেছিল প্রফুল্ল। শ্রীদেবী যেন পটলকে নিয়ে সমুদ্রের ধারে হাঁটতে বেরিয়েছে, আর সমুদ্র থেকেই সটান সূর্য উঠেছে আকাশে; শ্রীদেবীর চোখে গোগো সানগ্লাস, মাথার ওপর বিশাল ছাতা, তার পিছনে মা কালীর এই অ্যাতো বড় লাল জিভ – একটাকা, দু’টাকার কয়েন পড়ছিল ছবিতে - পাঁচ টাকার কয়েনও – দুটো। এখন বৃষ্টির ছাঁটে সেসব ছবি ধুয়ে গেছে, নতুন করে আঁকার জন্য এক ইঞ্চি শুকনো জায়গাও নেই; দু’দিকে হাত ছড়িয়ে হুইইই বলে যে রাস্তা ধরে একবগ্গা দৌড়বে – সে উপায় নেই; ডিগবাজি খেতে গেলেও ছপাৎ করে কাদাজলে পড়বে – কী করা যায় ভেবে পাচ্ছিল না প্রফুল্ল। কাঁসি আর পটলের গায়ে চাপড় দিতে দিতে সুরময়ি আঁখিয়ো মে ভাঁজল গুনগুন করে, হালকা ফুলকা শবনমিতে এসে গলা শুকিয়ে এল। কাশল দু’বার। পটল আর কাঁসি বেজায় খুশি হয়ে ল্যাজ নাড়ছিল। প্রফুল্ল মাথা চুলকে বলল – “চ’, নৌকো ভাসাই।” তারপর ঝোলা হাতড়ে পুরোনো খবরের কাগজ টেনে বের করে, ছিঁড়ল প্রথমে, প্লাস্টিকের তলার শানে বিছিয়ে ভাঁজ করল; দু’দিকের কোণা টেনে নামাতে, পাশাপাশি দুটো ত্রিভুজ হয়ে গেল – এবারে তলার দিকে ভাঁজ করে, আড়াআড়ি টান দিলেই একটা টোকা কিম্বা নৌকো হয়ে যাওয়ার কথা। নৌকোই বানাল। ঢাউস এক নৌকা, জলে ভাসাতেই টাল খেয়ে কেতরে গেল। তারপর নিমেষে কাগজের মণ্ড হয়ে জলের স্রোতে ভেসে যেতে যেতে ঝাঁঝরির মুখে আটকে রইল। চোখ পিট পিট করল প্রফুল্ল, মাথা চুলকোল – জলপথের এইসব বিপদজনক ব্যাপারস্যাপার শ্রীদেবীকে জানিয়ে রাখা দরকার – তার মনে হচ্ছিল।
পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ ভারি হয়ে নেমে আসছিল বয়েজ হাইস্কুলের ওপরে। দু’ঘন্টা ধরে সাহেবগলি বয়েজ হাইস্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে সাহিল – উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড, জং ধরা সবুজ গেট বন্ধ রয়েছে। পেল্লায় গেট চোখে পড়তেই সাহিলের মনে হয়েছিল, একজন বুড়ো মানুষকে টুলে বসে থাকতে দেখবে। অথচ ধারেকাছে একজনও নেই। বস্তুত বিকেল চারটেয় একটা স্কুলের সামনে যা যা চোখে পড়ার – সে সব কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সাহিল। উপরন্তু ঘন কালো মেঘ নেমে আসছিল মাথার ওপর – মনে হচ্ছিল, সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সাহিল ফটক ঝাঁকাল, জোরে জোরে ধাক্কা দিল, তারপর সবুজ দরজার খুব কাছে গিয়ে কান পাতল – সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ ওদিকটা। বড় ফটকের একপাশে আয়তাকার ছোট দরজা – ঠেলাঠেলি করেও খুলতে পারল না সাহিল। স্কুলের সামনের রাস্তা শুনশান – উল্টোদিকে পাশাপাশি দোতলা বাড়ি সব – বারান্দায় ভিজে শাড়ি, গেঞ্জি ঝুলছে; একটি বাড়ির নিচে জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছিল। এবারে মোবাইলে স্কুলের নম্বর সার্চ করল সাহিল – গোটা চারেক নম্বরে পরপর চেষ্টা করল। কেউ ধরে না। কঙ্কণার দুটো ফোন এল এই সময় – কেটে দিল সাহিল। ঘাড় গোঁজ করে ডায়াল করে যেতে লাগল।
একসময় জলরঙের ক্যানভাসে যেন দু’ফোঁটা জল পড়তেই মেঘেরা গলে গিয়ে নেমে এল – সাহিল চমকে উঠে মোবাইল পকেটে পুরল; তারপর এক দৌড়ে ক্রস করল রাস্তা। জয়গুরু মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে শেডের তলায় দাঁড়িয়ে ছাতা বন্ধ করে জল ঝাড়ল। দোকানের ভিতরে যতখানি দেখা যাচ্ছিল – মৃত মানুষের ছবিতে কালিঝুলি মাখা শোলার মালা, বিস্তর মাছি-টাছি আর বাসি রসগোল্লার টোকো গন্ধে মলিন দোকান; গামছা আর গেঞ্জি পরা দু’জন নির্লিপ্ত মুখে কাগজের বাক্স খাপে খাপে ভাঁজ করে ডাঁই করে রাখছিল।
- ভিতরে আইস্যা দাঁড়ান। এই বিষ্টি এখন ধরব না।
- না না, ঠিক আছে। অসুবিধে হচ্ছে না।
- কই যাইবেন আপনি?
- এই স্কুলে এসেছিলাম। হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দরকার –
- ভালো দিনেই আইছেন, আইজ তো ইস্কুল বন্ধ। এক ছাত্র মারা গ্যাসে –
- মারা গেছে!
- অ্যাক্সিডেন্ট। দোষ পোলাডারই, বোঝলেন? বয়স কম, রক্ত গরম হইলে যা হয়। রেস দিতাসিল এক লরির লগে। এই তো বড় রাস্তায়। পেপারে দিসে। দ্যাখেন নাই বুঝি? ভোগান্তি আপনের।
“অনেকদিনের দোকান?” দোকানের ছিরি সাহিলের মুখ থেকে প্রথম প্রশ্ন বের করে আনল।
- দোকান তো পুরাতন। মালিকের ঠাকুর্দার।
- আপনারা কাজ করছেন ক’দিন?
- আমার দুই, হারুদার ছয় বচ্ছর হইছে। নয় গো হারুদা?
এখানে জিগ্যেস করার অর্থ নেই। সাহিল, তবু খড়কুটো আঁকড়ে ধরেছিল- “নীলকমল নামে কাউকে চেনেন?”
“সে তো রূপকথার রাজপুত্তুর গো – আমার মেয়ের ইস্কুলে সেদিন ঠাকুমার ঝুলি হল, মেয়ে শুকপাখি না কী হয়েছিল – সেই নীলকমল?” এই প্রথম কথা বলল হারুদা, হাসতে লাগল।
- নীলকমল যাদুকর একজন। ম্যাজিক শো হত এই স্কুলে, অনেকদিন আগে।
- না, শুনি নাই। বসেন না। যান কই? বড় রাস্তা অবধি যাইতে যাইতে ভিইজ্যা যাইবেন।
অন্ধকার রাস্তাঘাট, অঝোর বর্ষণ, আবার এক কানাগলির মোড়ে এসে পড়েছে সাহিল। হাতের ভাঁজ করা ছাতা থেকে টুপটুপ করে জল ঝরে ঝরে লম্বা লাইন তৈরি করছিল – সাহিলের জুতোর সামনে থেকে সেই রেখা শুরু হয়ে রাস্তায় পড়ে ঢাল বেয়ে বড় রাস্তার দিকে যাচ্ছিল। সেই দিকে তাকিয়ে সাহিল জিজ্ঞেস করল, “সাহেবগলি রাস্তাটা কোথা থেকে শুরু?”
- এই যে দোতলা বাড়ির পাশ দিয়া গলি শুরু হইল। বড় রাস্তার দিক থিক্যা আর একখান মুখ আছে অবশ্য। বিস্তর লম্বা গলি। প্যাঁচ মারতে মারতে সেই কারখানার মাঠ অবধি গ্যাসে। সব নতুন নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি উঠতাসে। এই ইস্কুলের দুই একজন মাস্টারমশাই ফ্ল্যাট কিনসেন; তয় আজ যা অবস্থা, কাওরে পাইবেন না। আর একদিন আইস্যেন। সকাল কইর্যা।
কপিল আজ প্রফুল্লকে রেডিওর ব্যাটারি এনে দিয়েছে। মাঝে মাঝে শিয়ালদার দিকে কোথাও গাড়ি ধুতে যায় কপিল। সেখান থেকে পুরোনো জামা-প্যান্ট নিয়ে আসে নাথু আর প্রফুল্লর জন্য – চটি আনে, ঝলঝলে সোয়েটার, চাদর – বলে, মালিক দিয়েছে। কখনও গোলাপি বাক্সে কেক, ক্রিমরোল এনে ওদের দেয় – সে বাক্সের কাগজেরই কী সুবাস! কী কাগজ কে জানে! সেদিন শ্রীদেবীর সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা মনে হতেই প্রফুল্ল ওকে ব্যাটারি আনতে বলেছিল। চক দিয়ে ব্যাটারি এঁকে সাইজ বুঝিয়েছিল।
- ক্যা করোগে বেটারি লে কে?
প্রফুল্ল উত্তর দিল না। চক দিয়ে প্রথমে একটা আয়তক্ষেত্র আঁকল ফুটপাথে। পিছনে আর একটা। ওপরে আর নিচে ছোট সমান্তরাল লাইন দিয়ে চৌখুপি দুটো জুড়ে দিয়ে, এখানে ওখানে গোল চৌকো আকার, আর লম্বা টিকির মত অ্যান্টেনা আঁকল।
- রেডুয়া না কি রে? কাঁহা সে মিলা? কাঁচড়া সে উঠা লিয়া ক্যা?
প্রফুল্ল উত্তর না দিয়ে প্রণিপাত করল মন্দিরের সামনে। কপিল কিছু বুঝল না। প্রফুল্লর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে মাথা নেড়েছিল – এনে দেবে।
এখন রাতের দিকে, মন্দিরের সামনে প্রফুল্ল নীল রেডিওর তলার ছোটো খোপে ব্যাটারি ভরছিল। নব ঘোরাতেই সবুজ আলো জ্বলে উঠে ঘ্যাসঘ্যাস আওয়াজ হচ্ছিল। প্রফুল্ল অ্যান্টেনা টেনে লম্বা করে দিতে গম্ভীর গলায় কথা শোনা গেল – খবর হচ্ছে। প্রফুল্ল শুনছিল না, নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গানের স্টেশন খুঁজতে লাগল –
প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় বক্তার পরে চতুর্থও যখন তাঁর ভাষণের শুরুতে গলা কাঁপিয়ে ‘আজকের এই বর্ষণমুখর শ্রাবণ সন্ধ্যা’ বললেন, সাহিল বেরিয়ে এল সভাঘর ছেড়ে। পোর্টিকোতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল – বৃষ্টি থেমে গেলেই হাঁটা মারবে। সবাই একই শব্দ দিয়ে কথা শুরু করছে, যেন প্রত্যেকেই আজ সকালে শব্দটা আবিষ্কার করেছে আর সেই আবিষ্কারের আনন্দে শব্দটা মুখ থেকে প্রথমেই বেরিয়ে আসছে। এই ভাবনায় যথেষ্ট কৌতুকের উপাদান ছিল না, খুবই বিরক্ত লাগছিল সাহিলের। কঙ্কণাও বেরিয়ে এল।
- কী হ’ল?
- এক কথা আর কত শুনব? এঁরাই সব এখন হর্তা-কর্তা-বিধাতা তাহলে!
- ওভাবে কেন বলছ? হর্তা কর্তা হয়তো নন। নামডাক আছে। ওঁদের কথাবার্তা তোমার মত নবীন লেখকের ভালো লাগতে পারে ভেবে তোমাকে আসতে বলেছিলাম – নীলকমলের বাইরে যদি কিছু ভাবতে পারো –
- ভাবতে যে পারছি না – এটা ফ্যাক্ট। আর নীলকমল মানে স্পেসিফিকালি ঐ নীলকমলই হতে হবে তা তো নয় – এমন কেউ, যে আমাকে কানেকশনের টেকনিক শেখাবে। এই বক্তৃতা শেখাতে পারবে না – সেটা তো অবভিয়াস –
- আচ্ছা বেশ, এবারে রাগ না করে বল, সেদিন যে বললে, নীলকমলকে না পেলে তোমার লেখাই হবে না – সেটা কি রাগের কথা ছিল? সিরিয়াসলি বলেছিলে?
- না না, রাগ কেন হবে? মে বি হতাশা...
“লিখবেই না তাহলে? নীলকমলকে পাওয়ার কোনো উপায়ই তো দেখছি না।” কঙ্কণা চুপ করে গেল। সাহিল কিছুক্ষণ ইতস্তত করল, ধোঁয়া ছাড়ল- “...একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম – ইনটু গ্রেট সাইলেন্স। জার্মান ডিরেক্টর। ফ্রান্স, সুইট্জারল্যান্ড আর জার্মানির কো-প্রডাকশন ছিল – ফ্রেঞ্চ আল্পসের একটা মনাস্টারিতে কাথ্যুজিয়ান মঙ্কদের নিয়ে। পুরো ন্যাচারল লাইটে শুট করেছিলেন পরিচালক – একা শুট করেছেন, রেকর্ডিং করেছেন। আমি অবাক হয়েছিলাম, কেন জান? এই ভদ্রলোক, ফিলিপ গ্রুঁনিং ষোলো বছর অপেক্ষা করেছিলেন ঐ মঙ্কদের অনুমতি পেতে। ষোলো বছর! ভাবো। এত বছর উনি এই ইচ্ছেটা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন – বাঁচিয়ে শুধু নয়, সজীব রাখা – এই ব্যাপারগুলো, জানো, খুব ইনস্পিরেশনাল। আমি অপেক্ষা করতে রাজি।”
- শোনো, ক’দিন ধরে একটা কথা মনে হচ্ছে আমার। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, তুমি ভুল জায়গায় অপেক্ষা করছ –
- মানে?
- তুমি যে বাসের জন্য অপেক্ষা করছ, সেই রুটের বাসস্টপে না দাঁড়িয়ে অন্য কোথাও দাঁড়ালে সে বাস তো পাবে না কোনোদিন।
- সে তো বুঝলাম। কিন্তু ঠিক কী বলতে চাইছ?
- ধরো, তুমি যদি আমাদের সঙ্গে থাক – আমরাও তো কানেক্ট করছি – চেষ্টা করি অন্তত – মানছি, আমরা স্ক্র্যাচ থেকে শুরু করি না, খানিকটা ইস্যুভিত্তিক আমাদের কানেকশন – তবু কানেকশনই তো – তুমিও জানো।
- হ্যাঁ, তা তো বটেই। কিন্তু আমি কী করব?
- ক’দিন না হয় থাকলে আমাদের সঙ্গে, ঘুরলে, কাজকর্ম দেখলে, হয়তো নীলকমলকে আমাদের মধ্যে থেকে পেয়ে গেলে –
“মাফ করো ভাই, এই দলাদলি, মারামারি, গুণ্ডামি, মাইকের সামনে কান ফাটিয়ে চেঁচানো – আমার কুৎসিত লাগে – তুমি জানো – আমি পারবই না – লেখাই বন্ধ হয়ে যাবে আমার”, কপালে হাত ঠেকাল সাহিল।
- জানি।
- তবে বললে কেন?
- র্যাফট অফ দ্য মেডুসা পেন্টিংটা ভাব।
- হুঁ। প্রিন্ট দেখেছি। কেন?
- তোমার বয়সী একটা ছেলেই তো এঁকেছিল। মর্গে মর্গে ঘুরেছিল, মুমূর্ষু মানুষ, মৃত মানুষের চামড়ার রং স্টাডি করত – এ সবই তো অসুন্দর, তাই না? সেসব থেকে ঐ ছবি – মাস্টারপিস –
সাহিল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল কঙ্কণার দিকে- “তুমি আমার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছ। হয়তো ঠিক বলছ – কিন্তু... জানি না... আরে, ভিজে যাচ্ছ তো, এদিকে সরে এস।”
কঙ্কণা সরল না। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল- “সাহিল, একটা কথা বলার আছে -”
- কথা বলার অনুমতি চাইছ? হ’ল কী?
- একটা কথা, মানে ডিসিশন নিয়েছি – অনেক ভাবলাম, তারপর –
সাহিলের সর্ব শরীর কেঁপে উঠল- “-ক্কী ডিসিশন?”
- আমি কলকাতা ছেড়ে চলে যাচ্ছি –
- মানে? কোথায়? কী ইয়ার্কি করছ?
- দিল্লিতে একটা স্কলারশিপ পেয়েছি। আপাতত সেটাই নিচ্ছি কয়েক মাসের জন্য। কিন্তু যেটা ঠিক করেছি – ফুলটাইম রাজনীতি করব; তার আগে একটা খুব বড় কাজ – সেটাই বলার – আমি প্রিয়ম আর শিখা – চেনো তো তুমি – আমরা গোটা ভারত ঘুরব – মানুষের সঙ্গে কথা বলব, থাকব – কানেকশন গড়তে হবে; কতদিন লাগবে জানি না – প্ল্যান করছি বিরাট করে –হয়তো আরো দু’তিন জন জয়েন করবেন – তারপর হয়তো আরো – পথে আমাকে বেরোতেই হবে-
“এটা কী তোমাদের পার্টি অ্যাপ্রুভড কর্মসূচী, না মোটরসাইকেল ডায়ারিজ ইন্সপায়ার্ড?” সাহিল হাসার চেষ্টা করেছিল। গলা বুজে আসছিল অভিমানে – কঙ্কণা এত বড় কথা তাকে না বলে রইল এতদিন!
- সত্যি বলি, তুমি ইন্সপায়ার করেছ – তোমার ঐ কানেকশনের টেকনিক শেখার জন্য নীলকমলের খোঁজ করে যাওয়া আমাকে ইন্সপায়ার করেছে – ইন্সপায়ার বললে কিছুই বলা হয় না – আরো বড় কিছু সাহিল –
- কবে চলে যাবে?
- পুজোর পরেই
“এত বড় ডিসিশন নিলে, কিচ্ছু বলনি আগে!” সাহিলের গলা কেঁপে গেল।
কঙ্কণা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। দু’জনেই চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। সিগারেটের ধোঁয়া আর না বলা কথারা অনেকক্ষণ ঝুলে রইল হাওয়ায়, তারপর বৃষ্টির ছাঁটে ভিজতে ভিজতে মাটিতে পড়ে কাদা হয়ে গেল। দু’জনে সে দিকে তাকিয়ে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কারো হাত ধরল না, কাছে সরে এল না; যে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সে জায়গা ছেড়ে নড়ল না একচুল। তারপর আর কোনো কথা না বলে কঙ্কণা হাঁটতে শুরু করল বৃষ্টির মধ্যে -
সাহিল পিছু ডাকেনি। দেখছিল। দেখছিল, জনশূন্য রাস্তার দু’দিকের দেওয়ালে বৃষ্টিতে ভেজা দেওয়াল লিখন, আধছেঁড়া পোস্টার, ঝোড়ো হাওয়ায় লটপট করছে ফ্লেক্স, চেন ফ্ল্যাগ ছিঁড়ে গিয়ে রাস্তায় লুটাচ্ছে – আর এসবের মধ্যে দিয়ে ঝমঝমে বৃষ্টি মাথায় একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে সটান -