পিট স্ট্রীটের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে জেব্রা ক্রসিংএর ওপর আলোর রং বদলে যেতে দেখছিল পঙ্কজ । অফিস থেকে বেরোনোর পর এইখানে দাঁড়িয়ে কলকাতার কথা মনে পড়ে - ওর চোখের সামনে উঁচু উঁচু বাড়ির পিছনে সূর্য ডুবে যায়, রাশ আওয়ারে অফিস ফেরতা মানুষের দীর্ঘ ছায়া ফুটপাথে পড়ে , আলো কমে আসে এই সময় অথচ স্ট্রীট লাইট জ্বলতে দেরি আছে; গোধূলিতে সব মানুষের রং সবজেটে, মাথার দিকটা কমলা হলুদ- সবাইকে একলা আর সন্ত্রস্ত লাগে পঙ্কজের। কিওস্ক থেকে ভাজা মাংসের সুবাস বাতাসে ভাসতে থাকে , ক্রসিংএ লাল, হলুদ সবুজ আলো জ্বলে নেভে - সে আলোয় ট্যাক্সি, ট্রাক, বাস আর পথচারীর জট পাকায়, খুলে যায় আবার। স্ট্রীট লাইট জ্বলে উঠলে মানুষ আবার স্টীল গ্রে হয়ে যায় , তখন একটা মানুষের চারটে করে ছায়া। নিজের ছায়া দেখতে দেখতে বাড়ি যায় পঙ্কজ।
আজ অবশ্য ভর দুপুর- পঙ্কজ হাফ ডে নিয়ে সুবিমলের বাড়ির দিকে চলেছে ; লিপি, সুবিমলের মেয়ে তিন্নির আজ পাঁচ হ'ল; ওদের অ্যাপার্টমেন্টেই ছোটো পার্টি। পঙ্কজ অফিস ফেরত খেলনার দোকানে ঢুকেছিল। সফ্ট টয়, বারবি ডল, রকিং হর্স, ট্রাইসাইকেল, লেগো- কী নেবে সে? স্মিতাকে একবার ফোন করে দেখবে? ঘড়ি দেখল পঙ্কজ তারপর স্মিতার সময় হিসেব করে মোবাইল ঢুকিয়ে নিল পকেটে। বনময়ূরের জন্য একটা সফ্ট টয় তুলল ট্রলিতে - কী করছে বনময়ূর এখন? একবার মনে হল- বাড়ি চলে যায়, বনময়ূর কত খুশি হবে!
তারপর ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এগোলো আবার। সামনের আইলে ম্যাজিক সেট ফর কিডস- নানা ব্র্যান্ডের চৌকো বাক্স- ওয়ান ফিফটি ক্লাসিক ট্রিকস, হোকাস পোকাস কালেকশন, ম্যাজিক ইন স্ন্যাপ- খরগোশ, টুপি, তাস, জাদুকাঠি এই সব ছবি বাক্সের ওপর- মুখ ফিরিয়ে নিল পঙ্কজ। পরের আইলে পুতুলের গায়ে হাত বোলালো, লেগোর বাক্স তুলে নিল-
একটু আগেই ঘন কালো পিচ রাস্তার ওপর দুপুরের রোদ ঠিকরে পড়ছিল অথচ এখন এই বেলা তিনটেয় রোদ মরে আসছে দ্রুত। দোকান থেকে বেরিয়ে পঙ্কজ দেখল, আকাশের উত্তর দিক থেকে ঘন কালো মেঘ দৌড়ে আসছে। একই দিক থেকে ধেয়ে আসছিল ডাউনের বাস। চৌমাথার মোড়ে কে আগে দাঁড়াবে মেঘ না বাস- মনে মনে বাজি রাখতে রাখতে সিগ্নাল লাল হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল পঙ্কজ । সেই সময় উল্টো দিক থেকে জোর হাওয়া উঠল- ধুলো, ভাজা সসেজের গন্ধ, টিউব রেল স্টেশনের চত্ত্বরের চিনে বৃদ্ধর ছড় টানা যন্ত্রের সুর শঙ্কুর মত পাক খেতে খেতে পঙ্কজকে ঘিরে নিল; মেঘের পাল টার্ন নিল সম্পূর্ণ বিপরীতে। বাসগুলো আচমকা ওয়াক ওভার পেয়ে সিগন্যালে পা ছেতরে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর ম্যাজিক শব্দটা মুহূর্তে পঙ্কজের মনে ঢুকে তার শাখাপ্রশাখা ছড়াল; এই ক্রসিং থেকে যেমন একটা রাস্তা ডাউনে গিয়েছে, অন্যটা আপে; পঙ্কজের মগজের মধ্যে মুহূর্তে একটা রাস্তা বহু বছর আগের সাহেবগলিতে বাঁক নিয়ে ঢুকল।
সুবিমলের অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায় গাড়ি পার্ক করছিল পঙ্কজ। রাস্তার দুধারে জ্যাকারাণ্ডা গাছ- সন্ধ্যের আকাশ ঘন নীল হয়েছে জ্যাকারান্ডার বেগুণী ফুলে- মেঘ কেটে গিয়ে মিটমিটে তারা ফুটছিল। এদিক ওদিক অ্যাপার্টমেন্টের জানলায় আলো - একটা লম্বা ক্রেন উত্তর দিকের আকাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে; ওর মনে হল হুবহু এই রকম আকাশ, এই রকম একটা ক্রেন ও আগে কোথাও দেখেছে। কোথায়? ও মাথা চুলকালো তারপর পকেটে হাত ঢুকালো যেন স্মৃতিরা সব ছোটোবেলার মার্বেলের মত ওর পকেটেই আছে- পকেট হাতড়ালেই মার্বেলে মার্বেলে ঠোকাঠুকির আওয়াজ হবে আর ও হাতের তেলোয় তুলে আনবে সেই মার্বেলটা যার ভেতরে একটা বুদ্বুদের মধ্যে বেগুনী আকাশে হেলানো ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে। একটা হাত পকেটে রেখেই দরজার ঘন্টা বাজালো পঙ্কজ। সুবিমলের ফ্ল্যাটের দরজার তলা দিয়ে দুধ উথলানোর গন্ধ আসছিল- সম্ভবত পায়েস রেঁধেছে।
সুবিমলের বৌকে এক এক দিন এক এক রকম দেখতে লাগে পঙ্কজের- কোনোদিন চশমা পরা, কোনোদিন চশমাহীন, চশমার ফ্রেমের রং বদলে বদলে যায়, কোনোদিন কোঁকড়ানো খোলা চুল, আবার একদিন হর্স্টেল; ওর মনে হয়, রাস্তায় দেখলে চিনতে পারবে না যদি না লিপি নিজেই পঙ্কজের কাছে এসে হেসে কথা বলে ওঠে। লিপিকে নিয়ে পঙ্কজের একটা কৌতূহল আছে- মনে মনে ও যেন এক পরীক্ষা চালাচ্ছে লিপি র অজ্ঞাতে। দেখা হলে ডাটা কালেক্ট করে আর জমিয়ে রাখে- একদিন হিসেব করে দেখবে- এই দেশ মানুষকে কত দ্রুত বদলে দেয়। নিজেকে দিয়ে, স্মিতাকে দিয়ে পরীক্ষা চালানোর কথা যখন ভেবেছিল তখন অলরেডি দেরি হয়ে গিয়েছে। লিপিরা এই দেশে নতুন - একদম জিরো আওয়ার থেকে হিসেব রেখে যাচ্ছে পঙ্কজ। ওর নিজস্ব একটা ফোরকাস্ট করা আছে মানুষের বদলে যাওয়া নিয়ে- লিপি আমূল বদলে গেলেই সময়টা মিলিয়ে নেবে।
আজ লিপির খোলা চুল, কপালে টিপ, একটাও ইংরিজি শব্দ নেই কথায় -"আসুন আসুন পঙ্কজদা, এত দেরি হল? "
-সুবিমল বলেছিল, হুরী পরী কারা আসবে, পরী তো অন্ধকার হলেই আসে- তাই না? কে আসবে? সিন্ডারেলার ফেয়ারি গড মাদার?
- এসে গেছে অনেকক্ষণ। টিংকার বেল। অল্পবয়সের পরী চাই এখনকার বাচ্চাদের। পাঁচ বছরের মেয়ে, তারও কত প্যাখনা-
অনেকদিন পরে প্যাখনা কথাটা শুনল পঙ্কজ। এই দেশে শব্দটা সে শোনে নি- বস্তুত টানা বাংলা সুবিমলদের কাছে এলেই শুনতে পায়। আর ক' বছর যাক- লিপি, সুবিমল প্যাখনা কথাটাই ভুলে যাবে।
বসবার ঘরের সিলিং, দেওয়াল বেলুনে স্ট্রীমারে ঢাকা। জনা পনেরো বাচ্চা পরীকে ঘিরে বসে। কার্পেটেও প্রচুর বেলুন , রঙীন কাগজের টুকরো। পরীর হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, হাতে গলায় ফুলের গয়না। জুতো খুলতে খুলতে পঙ্কজের মনে হল প্লাস্টিকের ফুল। তিন্নি হাঁ করে পরীর রঙীন ডানা, বাহারি গোলাপী জামা দেখছে।
গল্প বলছিল পরী। পঙ্কজ পাশ কাটিয়ে ভেতরের ঘরে ঢুকল -রাঘব, পরাশর, তপন, শান্তা, সুপ্রিয়া আর দোলন অনর্গল কথা বলে চলেছে; সুবিমল রান্নাঘরে- বিরিয়ানিতে ফাইনাল টাচ দিচ্ছে। লিপি এ ঘর ও ঘর করছিল- বাচ্চাদের সামনে মাফিনের ট্রে ধরছিল পরক্ষণেই রান্নাঘরে, তারপরেই বন্ধুদের কাছে হাসিমুখে পকৌড়া নিয়ে।
শান্তা বলল- " কী পঙ্কজদা, স্মিতাদি কবে ফিরবে?অনেকদিন তো হয়ে গেল"
পঙ্কজ এই প্রশ্নের সামনে অসহায় বোধ করত একদা, এখন একটা বর্ম ওর সঙ্গে থাকে, মুহূর্তের মধ্যে সেটা পরে নিতে হয়।
-" স্মিতার জেঠিমার অবস্থা এখন তখন- কী করে আসে? আর তো কেউ নেই"
-স্মিতার কাজিন কেউ নেই? জেঠিমার ছেলে মেয়ে ? আচ্ছা, লোক টোক রেখে দেওয়া যায় না? আয়া সেন্টার থেকে? প্যালিয়েটিভ কেয়ার টেয়ারের কনসেপ্টটাই নেই, নাকী?
বর্মের ওপর শিরস্ত্রাণ পরে নেয় পঙ্কজ। তারপর ধনুকে তীর জোড়ে।
- স্মিতা এসে গেলে তোমার সঙ্গে ফ্লার্ট করাই মাটি । হা হা হা
শান্তার পরের প্রশ্ন হাসির দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলে লিপি পঙ্কজের হাতে গ্লাস ধরিয়ে গেল।
বসার ঘরে পরীকে ঘিরে বাচ্চাদের নাচ শুরু হয়ে গিয়েছে। মুঠো মুঠো ফেয়ারি ডাস্ট ওড়াচ্ছিল পরী। হাততালি দিয়ে গাইছিল-"ইফ ইউ হ্যাপি অ্যান্ড ইউ নো"
লিপি ভিডিও করছিল; সুবিমল কিচেন থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালো - মুখে তৃপ্তির হাসি। শান্তা, রাঘব মোবাইলে ছবি নিল। হাততালি দিল তালে তালে।
টিংকার বেল জিনিসপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল। তিন্নি বলল- "উইল ইউ ফ্লাই ফ্রম দিস ব্যালকনি?"
টিংকার বেল হেসে হেসে ললিপপ দিল-" উইল ফ্লাই ফ্রম দ্য পার্ক। "
-হোয়াই?
-তোমার ব্যালকনি থেকে উড়তে গেলে যে দেওয়ালে ধাক্কা খাব। পার্কের দিকটা ফাঁকা।
পঙ্কজের গরম লাগছিল, সামান্য ক্লান্তও। কিছুক্ষণের জন্য বর্ম খোলার প্রয়োজন বোধ করছিল সে। বলল, "আমি আপনাকে পার্ক অবধি পৌঁছে দিচ্ছি। "
"সো কাইন্ড অফ ইয়ু পঙ্কজদা। আমি বিরিয়ানিটা নামিয়ে ফেলি এই তালে।" সুবিমল আবার রান্নাঘরে ঢুকে গিয়েছিল।
- না না আমি একলাই চলে যাব, টিংকার বেল বলল। ওর মুখ থেকে খিদের গন্ধ পেল পঙ্কজ।
-খেয়ে যান কিছু । পরীরা কী খায়? লিপি?
- পার্ক থেকে ফুলের মধু খেয়ে নেব।
হাসতে হাসতে পরী রাস্তায় নেমে জ্যাকারান্ডার তলা দিয়ে হেঁটে গিয়েছিল- এক হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, অন্য হাতে ভারি ব্যাগ। স্ট্রীটলাইটের নিচে লম্বা একটেরে ছায়া পড়ছিল পরীর। ব্যালকনিতে ভীড় করে বাচ্চারা-পরী একবার হাত নাড়ল ওয়ান্ডসমেত তারপর রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে গেল।
"আমি জানি, ও সত্যি পরী নয়। আমি জানি ও উড়তে পারে না। ও হেঁটে গেছে।" তিন্নি চেঁচিয়ে বলেছিল। লিপি একবার তিন্নির দিকে তাকাল তারপর সুবিমলের দিকে। ম্লান দেখাচ্ছিল লিপিকে । অকারণ গলা তুলে বলল-" খেতে দিয়ে দিই তোমাদের"।
ডিনারের পরে কথা হচ্ছিল টুকটাক। সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছিল তিন্নি। ওর বন্ধুরা ফিরে গেছে অনেকক্ষণ।
" আজকালকার বাচ্চারা আর পরী , ম্যাজিক এইসবে বিশ্বাস করে না", সিংকে বাসন নামাতে নামাতে লিপি বলেছিল।
সুবিমল সিগারেট ধরাল, " আচ্ছা পঙ্কজদা, সাহেবগলির সেই লোকটার কথা তোমার মনে আছে? খুব ফরসা, মোটা জুলফি? ম্যাজিক দেখাত নীলকমল না লালকমল নামে?"
পঙ্কজ থমকাল। তারপর গলা খাঁকরে বলল, "নীলকমল।"
- অনেক গুণ ছিল লোকটার। দারুণ বাঁশি বাজাত। চেহারায় একটা নায়ক নায়ক ভাব ছিল-যাত্রা টাত্রাও করত বোধ হয়। তাই না পঙ্কজদা? খুব ভালো ম্যাজিক দেখাত, বুঝলে লিপি... আমরা তখন স্কুলে, নীলকমলের বয়স কমই ছিল মনে হয়, এই পঁচিশ টচিশ- যাই হোক, বস্তার মধ্যে পুরে, পাথর টাথর বেঁধে ওকে পুকুরে ফেলে দিত ওর অ্যাসিস্ট্যান্ট- দু'মিনিটের মধ্যে উঠে আসত- সে কী হাততালি -
" হুডিনির খেলা? পি সি সরকারও দেখিয়েছেন তো" শান্তা ঘড়ি দেখল।
- আরে সে তো বড় বড় ম্যাজিশিয়ান। বড় বড় ব্যাপার। এ’ আমাদের পাড়ার জাদুকর- বস্তা, ইঁট, আর পাড়ার একটা ছেলে- স্রেফ এই নিয়ে রিস্কি খেলা দেখাত-
"এখন কী করে? সিরিয়াল?" শান্তা হাসির ভঙ্গি করেছিল।
- জানি না কী করে। আদৌ বেঁচে আছে কী না কে জানে। খুব অদ্ভূত ছিল লোকটা- মানে রহস্যময় টাইপ- পিন্টুকে নিয়ে কী একটা কান্ড হয়েছিল। মনে আছে?
পঙ্কজ চুপ করে ছিল। উসখুস করল । জল খেলো। এবারে উঠতে হবে- কতক্ষণ একলা আছে বনময়ূর। সকালে বেরোনোর সময় আলো জ্বালিয়ে রেখে এসেছে বারান্দার।সুবিমল বকে যাচ্ছিল- কথায় পেয়েছে ওকে, "আরে তখন অনেক কথা শুনতাম। অত বুঝতাম না। একদিন হঠাৎ হাওয়া হয়ে গেল- পুলিশ ধরেছিল নাকী-"
পঙ্কজ উঠে দাঁড়াল-" কদিন আগে সাহেবগলির কাছেই কোথাও একটা ব্লাস্ট হয়েছে। জানিস?
- সে কী গো!
- বোমা রাখা ছিল একটা গ্যারাজে-পার্টির ব্যাপার ট্যাপার হবে আর কী- কাল পরিতোষকে ফোন করেছিলাম- ও বলল। দুজন স্পট ডেড। কাগজেও বেরিয়েছে দেখলাম।
- চেনা কেউ ?
-পরিতোষ বলল, চেনেনা। কাগজে খুব বেশি ডিটেলস নেই। লোক্যাল বাজারে সব্জী নিয়ে বসত একজন, আর একজন সম্ভবত ভবঘুরে-
একটা জন্মদিনের সন্ধ্যা যেভাবে শেষ হওয়ার কথা, দুটি মৃত্যু তাকে বদলে দিল। দু'জন অচেনা মানুষ মারা গিয়েছে- কেউ কেউ তবু বিষণ্ণ হয়, আলতো আঙুল বোলায় নিজের গালে , ঘুমন্ত সন্তানের গায়ে চাদর টানে, কেউ চুপ করে যায়, জল খায়, গলা খাঁকরায়।
সব অতিথি ফিরে গেলে ক্লোজেট থেকে ভ্যাকুয়াম ক্লীনার বের করল লিপি- তারপর সুইচ অন করে ফেয়ারি ডাস্টের শেষ কুচিটুকুও তুলে নিল।