এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আখ্যানে বারুদ ও অস্থির সময় : তপনকর ভট্টাচার্যের গল্প

    ইন্দ্রাণী লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৪২৬ বার পঠিত
  • শ্রী তপনকর ভট্টাচার্যের গল্পগুলি পড়ে জার্মান এক্সপ্রেশনিজমের কথা মনে হয়েছিল - বাস্তবের প্রতিলিপির বদলে শিল্পীর নিজস্ব অনুভূতি পরিস্ফুট হত ছবিতে - সরল দেহাবয়ব, রং এবং বিশেষ ব্রাশস্ট্রোকে। মনে হয়েছিল হিন্টারল্যান্ড সিনেমার কথাও যেখানে ছবির স্বাভাবিক মাত্রাকে টেনে প্যানোরামিক ওয়াইড স্ক্রীনের মাপে করে দেওয়ায়, তদুপরি ডাচ টিল্টের ব্যবহারে গোটা পটভূমিই তমসাচ্ছন্ন আর অস্বস্তিকর, রাস্তার বাঁকে বাঁকে উঁকি দিচ্ছিল ভয়ংকর হিংস্রতা ও পাপ। বস্তুত, যাবতীয় সরলরেখা বেঁকে যাচ্ছিল, অসামঞ্জস্য তৈরি হচ্ছিল, ফলত অস্থিরতা।

    তপনকরের আখ্যানের ব্যাকড্রপে এই রকম অলীক অসামঞ্জস্য;  এক ধরণের অস্থিরতা ধোঁয়ার মত ছড়িয়ে যায় গল্পে - অস্থির সময়ের বারুদ জমা হতে হতে বুলেট ছুটে বেরোয়। দৃষ্টিকোণের তারতম্যে ছিটকে বেরোনো আগুনকে স্বর্ণকমল বোধ হয় কখনও। 

    তপনকরের অধিকাংশ গল্পে পিস্তল থাকছে, কিম্বা চাকু, ফলত রক্ত। অবশ্যম্ভাবী। অথবা কখনও গল্পের শুরুতেই মৃতদেহ পড়ে থাকছে, আর গোটা গল্প জুড়ে পিস্তলের খোঁজ চলছে, উঠে আসছে জীবনের চোরাগলি, কানা গলির কথা, গল্পের শেষ অশরীরী নাচে, যেখানে আখ্যানের এযাবৎ স্বাভাবিক মাত্রা প্যানোরামিক ওয়াইড স্ক্রীনে বদলে যাচ্ছে যেন নিয়তি। বারুদ পুড়ে পুড়ে উচ্চ চাপের যে গ্যাস তৈরি হয়, বুলেটকে ছুটে বেরোতেই হয়। তপনকরের গল্পে পিস্তল ছোঁড়ার বিজ্ঞান রূপকের কাজ করে আগাগোড়া। এই কবিতাটি মনে আসে -

     "Bringing a gun into a house
    changes it.
    You lay it on the kitchen table,
    stretched out like something dead
    itself: the grainy polished wood stock
    jutting over the edge,
    the long metal barrel
    casting a grey shadow
    on the green-checked cloth.
    At first it’s just practice:
    perforating tins
    dangling on orange string
    from trees in the garden.
    Then a rabbit shot
    clean through the head.
    Soon the fridge fills with creatures
    that have run and flown.
    Your hands reek of gun oil
    and entrails. You trample
    fur and feathers. There’s a spring
    in your step; your eyes gleam
    like when sex was fresh.
    A gun brings a house alive.
    I join in the cooking: jointing
    and slicing, stirring and tasting –
    excited as if the King of Death
    had arrived to feast, stalking
    out of winter woods,
    his black mouth
    sprouting golden crocuses."

    [The Gun,Vicki Feaver]

    তপনকরের গদ্যের ধরণে, আখ্যানের নির্মাণে শ্রী কমল চক্রবর্তী উঁকি দেন কোথাও - অন্তত এই পাঠকের কাছে। ছোটো ভাঙা বাক্য, সংক্ষিপ্ত সময়ের টুকরোকে ঘিরে গল্প ঘুরপাক খায়। ঘটনার বিবরণে তাকে স্বপ্ন মনে হয়, অলীক লাগে। আখ্যানে কখনও শিকার হয়ে যায় আততায়ী, কোথাও রবিবারের দুপুরের খাওয়ার বিবরণে মানুষের গোপন কামনা বাসনার ইঙ্গিত থাকে।
     
    আবার পিস্তল নয়, চাকু নয়, কোনো অস্ত্র নয়, স্রেফ লাথি মারা উঠে এসেছে গল্পে বিবিধ ব্যঞ্জনায় -অতীতকে লাথি মেরে গেরস্থালিতে ফেরে মানুষ অথবা লাথি মারা পা ব্যালকনি থেকে ঝাঁপ মারে আচম্বিতে। যেন কনসারভেশন অফ মোমেন্টামের কিক। পিস্তল ছোঁড়ায় যেমনটি হয়।

    তপনকরের গল্পের সমাপ্তি মিস্টিক, বস্তুত গল্পের শেষ কটি লাইনেই গোটা আখ্যানের সৌন্দর্য ও আত্মা- হাতের তেলোয় গল্পের প্রাণভ্রমরটিকে পেতে গোটা গল্পটি আবার ফিরে পড়ে পাঠক। ধরুন "ঝাঁপ" গল্পের শেষটুকুঃ
    "বিরাম দেখল তার প্রিয় শহরে একটাও গাছ নেই। অথচ কোকিল ডাকছে। হেড কোয়ার্টারে বোম মারো কমরেড। হাজার হাজার মানুষ। ছুটে আসছে। বিরাম দু'তলার ব্যালকনি থেকে ছোট্ট ঝাঁপ দিয়ে শান বাঁধানো কলতলা পেয়ে গেল।"
    এই যে হাজার হাজার মানুষের ছুটে আসার কথা বলে, পরমুহূর্তেই  একটি মানুষের নিঃশব্দে ঝাঁপ দেওয়া - এখানেও সেই শক্তির রূপান্তর -কেমিকাল এনার্জি যেন কাইনেটিক এনার্জি হয়ে গেল নিমেষে। আবার "শুয়োরের বাচ্চা" গল্পের একদম শেষ লাইনে কী মসৃণভাবে ন্যারেটিভ শিফ্ট ঘটে - মুহূর্তে বিষাদের তীক্ষ্ণতা অনুভব করে শিউরে ওঠে পাঠক।  বা ঠাকুর্দাকে ঘিরে লালিত মিথ ভেঙে যাচ্ছে গল্পের শেষ লাইনে - বাঘের থাবার মতই ভারি আর শাণিত লাইন। অথচ এতে চমক দেওয়া নেই - যা আছে তা  অবশ্যম্ভাবী নিয়তি। এ'পথেই গল্পে বিষাদ আসে।

    শ্রী তপনকর ভট্টাচার্যের লেখা জনচিত্তজয়ের  মসৃণ সরণিতে নেই, নিজের তৈরি করা পথে একলা হাঁটে সে। পথ বিজন। বন্ধুর।
     
    [প্রথম প্রকাশঃ:তপনকর ভট্টাচার্য বিশেষ সংখ্যা, নান্দীমুখ সংসদ, বইমেলা ২০২৪।]
     
    আমার পড়া তপনকর ভট্টাচার্যের বই গুলিঃ
    ১। বন্দুকের আগে ও পরে; প্রকাশক গ্রাফিত্তি; মূল্য ১০০ টাকা;
    ২। চিলেকোঠা; প্রকাশক নান্দীমুখ সংসদ; মূল্য  ৮০ টাকা;
    ৩। হাবা; প্রকাশক নান্দীমুখ সংসদ; মূল্য ১৫০ টাকা;
    ৪। নাচ ও পিস্তল; প্রকাশক নান্দীমুখ সংসদ; মূল্য ৮০ টাকা।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন