লিপিরা নদী পেরোচ্ছিল। টানা লম্বা ব্রিজ বেয়ে এবারে ঢালুর দিকে নামছে গাড়ি; দূর থেকেই জলের বিস্তার চোখে পড়ছিল, কাছে এসে ছলাৎ ছলাৎ শোনা যাচ্ছে- সকালের রোদ পড়েছে জলে, নিচু নিচু ঢেউ উঠছিল সার দিয়ে, তারপর ভেঙে যাচ্ছিল ; নদীর পাশের রাস্তা ধরে বোটশেড, ছোটো ক্যাফের সামনে উইকএন্ডের সামান্য দেরিতে ঘুম ভাঙা মানুষজন- তাদের ঢিলে ঢালা পোষাক, চপ্পল, অক্ষৌরিত, মেকাপবিহীন মুখ- কালো চশমায় সকালের রোদ ঝিলিক দিচ্ছিল, সঙ্গে কুকুর, অথবা বই কিম্বা বাইসাইকল, আর বসন্তদিনের রৌদ্রসঞ্জাত এই খুশিটুকু ; বড় একটা পার্ক দেখা যাচ্ছিল- ঘন সবুজ ঘাস, লাল, নীল স্লাইড, দোলনা টোলনা। জিপিএসের কথামত গাড়ি ঘোরাচ্ছিল সুবিমল; কিছুদিন ধরে বাড়ি কেনার সাইটগুলোতে সার্চ করছে - এলাকা, দাম এই সব খুঁটিয়ে দেখে, লিস্ট করেছে। এজেন্টের সঙ্গে কথা বলেছে তারপর। এখন প্রতি উইকএন্ডে লিপি আর তিন্নিকে নিয়ে একটা, দুটো বাড়ি দেখে আসা রুটিন হয়ে গেছে; হয়তো বড় রাস্তার ওপরে বাড়ি - উফ বড্ড আওয়াজ; কিম্বা হয়ত সে বাড়ি নির্জন রাস্তায়, গাছ ভরে ফুল টুল- তো, তিন্নি একা স্কুল থেকে ফিরবে কী করে! কোনো বাড়ি ছায়া ছায়া- রোদ ঢোকে না, কোনো বাড়ির সব ভালো- বড্ড দাম- এই সব চলছে-
লিপির ভালো লাগছিল এই নতুন ধরণের শনিবারগুলো- কত রকম ঘর দোর হয়; ঝাঁ চকচকে নতুন বাড়ি হয়তো - সে সব ঘরে ঢুকতেই রঙের গন্ধ পাওয়া যায়, নিঝুম সাদা দেওয়াল ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে থাকে লিপিদের দিকে; আবার কিছু বাড়ি যথাবিহিত প্রাচীন, কাঠের মেঝেয় পেরেক উঠেছে, খেয়াল করলে দেওয়ালে হাইট চার্ট দেখা যায়- পেন্সিলের রেখা আবছা হয়ে এসেছে যদিও; পিছনের ঘাসজমিতে রঙ চটা কেনেল, লাল নীল বল, ঝুপসি গাছে লম্বাটে ফল ধরে আছে - কত কী ভেবে বাড়ি করে মানুষ, তারপর বেচে দেয়-
ড্রয়িংখাতায় ছবি আঁকছিল তিন্নি; এমনই নিমগ্ন যে মনে হচ্ছিল, এই সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত তাদের অক্ষাংশ , দ্রাঘিমাংশ সমেত ধরে রাখার গুরুদায়িত্ব ওর ওপর বর্তেছে। গাড়ির পিছনের সিটে খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ে ছবি আঁকছিল সে, স্কেচপেন ঘষে ঘষে রং লাগাচ্ছিল - বাড়ি , গোল্লাকাঠি মা, বাবা, খুকী, সূর্য, পাখি , গাছ টাছ, নদীর জলে নীল হলুদ মাছও দেখা যাচ্ছিল। সেই সব ছবিতে বাড়ি ঘরের ছাদ সমতল , কোনো চিমনি ছিল না তাতে- লিপি খেয়াল করে দেখেছিল।
রোদ, ছায়ার নকশায় দূরে টিলার ওপরে সবুজের বিচিত্র শেড- লিপি ছবি তুলল তারপর জানলার কাচ নামাল; উল্টোদিক থেকে গাড়ি আসছিল সাঁ সাঁ করে, হাওয়া কাটার আওয়াজে মনে হচ্ছিল পাখা ঝাপটাচ্ছে গাড়িরা, নদীর ওপর সেতু যেন রানওয়ে হয়ে গেছে আচমকাই যা পেরিয়ে গিয়েই টেক অফ করবে গাড়ি; উইন্ডস্ক্রীনের ওপর তুলোর আঁশ উড়ে আসে- এই বসন্তে হঠাৎ তাদের পাখি বলে ভ্রম হয়ে যায়। লিপি এক বুক হাওয়া টেনে ছেড়ে দিল-
সুবিমল লিপিকে আড়চোখে দেখলঃ "কেমন বুঝছ লিপি?"
-ভাল তো- কী সুন্দর। নদী, গাছ...বাড়িটা ঠিকঠাক হলেই-
- আরে আসল কথাই তো বললে না! দামটা যদি সাধ্যে কুলোয় তবেই না! স্পেসিফাই করেনি কিছু-
- সাধ্যের মধ্যে হ'লে হবে। না হয় তো না- কিছু না হোক, আউটিং তো হল।
মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হয়ে গেল সুবিমল।
-আর কত আউটিং লিপি?
-বেশ লাগে ঘুরতে- কত নতুন জায়গা, কত রকম বাড়ি- ভালো লাগে না?
-নিজের পয়সায় তেল পুড়িয়ে ঘুরো।
দুম করে ইউ টার্ন নিয়ে গাড়ি ঘোরালো সুবিমল।
"যথেষ্ট হয়েছে। আমারই ভুল। এখানে সেটল করতে চাও না তুমি"- নাটুকে ভঙ্গিতে স্টীয়ারিং ছেড়ে হাত জোড় করল -সামান্য টাল খেলো গাড়ি-
" কী হচ্ছে কী?"- ইঙ্গিতে তিন্নিকে দেখাল লিপি -"সেটল যে করতে চাই না যে তুমি জানো, জানো না ?
-কী আছে তোমার ঐ এঁদো গলির বাড়িতে? ভেঙে ভেঙে পড়ছে- কী মধু ছিল শুনি? কিসের এত টান? কিসের?
গলা চড়িয়ে কথা বলতে গিয়ে বাক্যের শেষটা গিলে নিল সুবিমল। শিসের মত শোনাল। লিপি জানলার কাচ তুলে দিতে ঐ শিসটুকু বদ্ধ গাড়িতে শঙ্কুর মত ঘুরতে ঘুরতে তিনজনকে গিলে নিল একসময়।
একটু আগে পঙ্কজকে বিলে করার টেকনিক শেখাচ্ছিল বুল্টি- এখন হারনেস পরতে সাহায্য করছে। ক্যারাবিনার লক করে চেক করে নিতে বলছিল। পঙ্কজ নার্ভাস ছিল প্রথমে। "ভেরি ইজি বাবা, ভেরি ইজি -শুরু করলেই হাত সেট হয়ে যাবে"- মেয়ে তাকে বলেছিল।
এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি এসেছে বুল্টি। পঙ্কজ ছুটি নিল। আজ রক ক্লাইম্বিং করতে এসেছে বনময়ূর সমেত। সাত আটটা উঁচু বোল্ডার পাশাপাশি- নিচে মাটি, ঘাস, জংলা লাল, হলুদ ফুল ফুটে রয়েছে - সেইখানে বাবা মেয়ে দাঁড়িয়ে; বনময়ূর থাবার ওপর মাথা রেখে বসেছিল - একটা প্রজাপতি দেখে মাথা ঘোরালো এইমাত্র।
-রেডি বাবা?
বুল্টি নিজের হারনেস পরেছিল। তারপর দড়িতে গিঁট দিয়ে পঙ্কজকে বলল-" চেক করো তো"
-ফিগার অফ এইট নট?
-ওয়াও!! তুমি জানো বাবা? ওভারহ্যান্ড, ক্লোভহিচ জানো?
লাজুক হেসে মাথা নাড়ল পঙ্কজ- " ক্লাইম্ব আপ"-
দুপুরের পরে টিলার ওপর বসে স্যান্ডুইচ খাচ্ছিল বাবা, মেয়ে। বনময়ূর পাশে বসে ল্যাজ নাড়ছে- পঙ্কজ ওকে পাঁউরুটির টুকরো দিচ্ছিল মাঝে মাঝে। টিলার নিচে জল দেখা যাচ্ছে আর সারি সারি গাছের মাথা- সূর্যের আলোয় সব কমলা এখন। দুটো সাদা বক উড়ে গেল পায়ের তলা দিয়ে-
-ম্যাজিকাল ইভনিং। না বাবা?
-ভালো অ্যাডজেক্টিভ বুল্টি, কিন্তু ম্যাজিকটা ঠিক কোথায়? তুই, আমি , বনময়ূর কি বদলে গেলাম, হ্যাঁ রে? না বদলালে ম্যাজিক কই?
"কেন এই যে তোমার গোমড়া মুখে হাসি, মাথাটা কমলা হয়ে গেছে"-হা হা করে হাসছিল বুল্টি।
পঙ্কজও হাসল।
-এই কমলা রংটা অবভিয়াসলি সূর্য থেকে। যা অবভিয়াস তা তো ম্যাজিক নয় বুল্টি-
-উফ তুমি যেন কী- সব রুইন করে দাও- আচ্ছা এই যে তুমি খুশি, আমি খুশি, বনময়ূর খুশি- এটা? হ্যাঁ, অনেকদিন পরে আমি এসেছি, দেখা হয়েছে- অবভিয়াস ফ্যাক্টর , কিন্তু এটাই তো সব নয়- তাই না?
- ছোটোবেলায় তোর একবার খুব জ্বর হয়েছিল। ভয়ের স্বপ্ন দেখে চেঁচিয়ে উঠতি থেকে থেকে- একটা বিরাট গাছ তোকে হাঁ করে খেতে আসছে-এই সব বলতি। জ্বর ছেড়ে গেল যখন, পরদিন সকালে বললি- জঙ্গল দেখেছিস, পাহাড়, ঝর্ণা, জল বয়ে যাচ্ছে- তার তলায় মাছ, আর অনেক পাথর - একজন বুড়ো মানুষ পাথরগুলো বাজাচ্ছে- পিয়ানোর মত - অদ্ভূত একটা সুর- ঘুম থেকে উঠে তুই সুরটা মনে করতে পারছিলি না- কী বোর্ড বাজাতে বসেছিলি- সুরটা মনে করতে- সেই প্রথম একলা বাজালি নোটেশন না দেখে, নিজের মত-
-মনে আছে তোমার?
-তুই বুঝি ভুলে গেছিস? ঐটা ম্যাজিক মোমেন্ট বুল্টি। ঐটা ম্যাজিক।
-স্বপ্নে পাওয়া সুর- মা বলেছিল , খুঁজে যেতে হবে- সারাজীবন-
-কী খুঁজতে হবে? সুর?
-সুর। মা কী খুঁজতে কলকাতা গেল?
পঙ্কজ কথা ঘোরালো-" আচ্ছা স্বপ্নের জায়গাটা কেমন ছিল? এই রকম?"
- মনে নেই
-ভাব না
- আই কান্ট বাবা।
-কেন? ভাবলেই মনে পড়বে-
- এক কথা বার বার বলছ কেন? চুপ করো। আমার অসুখ করেছে-
-অসুখ!! কী অসুখ?
- আই অ্যাম সাফারিং ফ্রম আফ্যান্টেসিয়া। ডু ইউ নো হোয়াট ইজ দ্যাট? ডু ইউ? ইউ নো নাথিং। কবে আসবে মা? কবে আসবে?
তেড়েফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালো বুল্টি- "ভালো লাগছে না"
পরদিনই ডর্মে ফিরে গিয়েছিল সে।
-আবার কবে আসবি রে?
-আসব -
-বনময়ূর খুব মিস করে তোকে-
বনময়ূরের মাথায় হাত বোলালো বুল্টি, পিঠ চাপড়ে দিল-" ওকে স্নান করাও না? কী রকম একটা গন্ধ। গিভ হিম আ নাইস বাথ বাবা।"
ব্যাগ পিঠে বেরিয়ে গেল মেয়ে।
-লিপি?
-উঁ? ঘুমাও নি?
- সরি লিপি। আমি জানি, তোমার খারাপ লাগে- আমার রুড বিহেভিয়ার- সরি লিপি। সরি সরি সোনা। আমরা খুব ভালো থাকব লিপি। দেখো তুমি। একটা বাড়ি , তিন্নি, তিন্নির ভাই, বোন। বাগান করব । ফুল গাছ। লেবু গাছ। একটা পাপি আনব তিন্নির জন্য। বনময়ূয়ের মত। তোমার বাবা মা কে নিয়ে আসব এখানে। দেখো। আজই কথা বলছিলাম তোমার মা র সঙ্গে- মেট্রোর কাজ পুরোদমে চলছে তো- বলেছি এবারে নিয়ে আসব। লিপি লিপি লিপি আমার লিপি সরি লিপি সরি-
লিপি মুখ ঘুরিয়ে আনল সুবিমলের দিকে- বুকে মাথা গুঁজে দিল। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল তারপর। লিপির লম্বা বিনুনী বনময়ূরের ল্যাজের মত লাগছিল একটা অ্যাঙ্গল থেকে । নড়ছিল , নড়ছিল আর নড়ছিল।
আজ অফিস থেকে ফিরে আঁশটে গন্ধ পাচ্ছিল পঙ্কজ। জানলা খুলে দিল সব কটা, দরজাও- একদম হাট করে। কীসের গন্ধ বুঝতে পারছিল না পঙ্কজ। কিচেনের কাবার্ড, ফ্রিজ খুলে খুলে দেখছিল - আলু পচেছে? মরা ইঁদুর টিঁদুর নাকি? ছায়ার মত পঙ্কজের পিছু নিয়েছিল গন্ধটা। পঙ্কজ যেখানেই যাচ্ছিল, ওর ঠিক পিছনে দাঁড়িয়ে থাকছিল - নড়ছিল না একটুও । ফিকে গন্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছিল , পঙ্কজের নাসারন্ধ্র পেরিয়ে মস্তিষ্কের গহ্বরে ঢুকে যাচ্ছিল যেন-
মাথার থেকে গন্ধটা তাড়ানোর জন্য বনময়ূরকে বেবি পাউডার মাখাতে বসল পঙ্কজ। উইকেন্ডে স্নান করাবে। পাউডার মাখাল, ব্রাশ করল, কান পরিষ্কার করে দিল। কুটকুট করে পঙ্কজের আঙুল কামড়ানোর চেষ্টা করছিল বনময়ূর - পঙ্কজ ওর কান নেড়ে দিল, নাকে আদর করল আর তখনই গন্ধটা যেন ঝাপট মারল সটান-
-হাঁ করত আর একবার। কী এটা, এটা কী? দেখি- কিছু খেয়ে এলি নাকি বাগান থেকে?
মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বড় করে হাঁ করাল বনময়ূরকে। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে মুখের ভেতরটা দেখল। মাড়ির ঠিক ওপরে ফুলে গেছে অনেকখানি, ফ্ল্যাশলাইটের তলায় টকটকে লাল দেখাচ্ছে , পচা গন্ধ পাচ্ছিল পঙ্কজ-
সার্জারির তিন দিন পরে বনময়ূরকে দেখতে পেয়েছিল পঙ্কজ। ওকে হাসপাতালে রেখে আসতে পঙ্কজের বুক ফেটে গিয়েছিল- এই তিনদিন খায় নি, ঘুমোয় নি, অফিস যায় নি; ডাক্তার আজ দেখা করতে বলায় , পঙ্কজ দাড়ি কাটলো, স্নান করল; বনময়ূরের জন্য একটা খেলনা কিনে রওনা হয়েছিল তারপর। হাসপাতালের ওয়ার্ডে দেখা হয়েছিল বনময়ূরের সঙ্গে। পঙ্কজের গন্ধ পেতেই উঠে বসার চেষ্টা করল - এলিজাবেথান কলার পরানো ছিল বনময়ূরকে, গোটা মুখ, গলা ফুলে গিয়েছে- খয়েরী রঙের লালা কফ অঝোরে ঝরছিল; পঙ্কজ ওকে জড়িয়ে মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিল, কান্না গিলছিল শব্দ করে-
" ক্যানসার। খুব খারাপ ধরণের । দ্রুত ছড়িয়েছে।" ভেট বলছিলেন -
পঙ্কজের মাথা ঘুরে উঠেছিল।
- আর কিছু করার নেই। ইউথ্যানেসিয়া, পুটিং হিম টু স্লিপ-আই সাজেস্ট।
"ও আর থাকবে না! কী বলছেন! কত বয়স ওর! ছয়ও হয় নি- এ কী করে হয়! এ কী করে হয়! ভাবার সময় দিন আমাকে। প্লীজ। প্লীজ"- হাহাকার করছিল পঙ্কজ- যেন ওর শরীর থেকে হৃদয় উপড়ে নিয়ে কাপড় মেলার দড়িতে উল্টো করে শুকোতে দেওয়া- খোবলানো বুক নিয়ে পঙ্কজ নিজের হৃদয়ের দিকেই তাকিয়ে আছে -টপ টপ করে জল অথবা রক্ত ঝরে পড়ছে সেখান থেকে -
সুবিমল এসেছিল। লিপি, পরাশর, শান্তা।
- পঙ্কজদা, বুল্টিকে জানাবেন না?
চোয়াল শক্ত করল পঙ্কজ-"কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। পরে.."
- হোয়াট অ্যাবাউট স্মিতা? ও তো খুব ভালবাসত-
-বলব। আজ রাতেই বলব।
ভেট ঘুমের ওষুধ পুশ করেছিলেন-" পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বে। ও কিছু বুঝতে পারবে না। কিচ্ছু ফীল করবে না। নিশ্চিন্ত থাকুন।"
পঙ্কজের কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল বনময়ূর। ওর মাথায় গায়ে হাত বোলাচ্ছিল পঙ্কজ। অন্য হাতে ধরে রইল বনময়ূরের ছোট্টো থাবা। হু হু করে কাঁদছিল লিপি। সুবিমল চোখে রুমাল চেপে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। খুব ল্যাজ নাড়ছিল বনময়ূর। চোখ বুজে আসছিল ওর । ল্যাজ নাড়ছিল তবু। নেড়েই গেল ঘুমোনো পর্যন্ত। গাঢ় সবুজ তরল বনময়ূরের শরীরে ঢোকার পরে জাস্ট এক মিনিট তারপর। বাঁ পাটা একটু কেঁপেই থেমে গেল।
-হি ইজ গন
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে, পঙ্কজ আকাশের দিকে তাকাল- চাঁদ টাঁদ যথারীতি উঠেছে, বসন্তের হাওয়াও ফুলের গন্ধ বয়ে আনছিল একদম ঠিকঠাক; পঙ্কজের মনে হ'ল- স্নান করা হল না বনময়ূরের।
বাড়ির ঘেরা বারান্দা রোদে রোদে ভরে ছিল পরদিন সকালে- আনাচে কানাচে বনময়ূরের লোম চিকচিক করছিল। পঙ্কজ এক বাটি জল রাখল বারান্দায়। অফিসে বেরিয়ে গেল তারপর।
ফ্রী ওয়ে ধরে ড্রাইভ করছিল লিপি - চাকরির প্রথম দিন।ছোটোমাপের ফার্মাসিউটিকাল প্রডাকশন কম্পানির ল্যাব- সেখানে কনিষ্ঠ ম্যানেজার লিপি, রিপোর্ট লিখবে, সই টই করবে। ওর ইন্টারভিউ হয়েছিল শহরের কেন্দ্রে-ল্যাবের অবস্থান শহর থেকে দূরে। যদিও রেলস্টেশনের কাছে অফিস, ট্রেনেই যাওয়া যেত- গাড়ি নিতে বলেছিল সুবিমল। আধঘন্টা মত ড্রাইভ করল লিপি - এবার একজিট নেবে। এইখানে যেটা ঘটল , তা লিপির কাছে খানিক আকস্মিক -
পুরীতে প্রথম সমুদ্র দেখার কথা লিপির মনে ছিল, মোড় ঘুরতেই রাস্তার ওপরে আকাশ নেমে আসে - গোটা নীলটুকু গলে জল হয়ে দিগন্ত ছুঁয়ে দেয়, মেঘ হয়ে যায় ঢেউ- ছোটো বাড়ি, ছোটো রাস্তা, ট্রেনের ছোটো কামরা, বাথরুম, রিক্সার ছোটো সীট থেকে একদমে বিরাটের সামনে পড়ে যাওয়া- এ দৃশ্য মানুষ শেষ দিন অবধি মনে রাখে। একজিট নিতে যেন একদম উল্টোটা হল- বস্তুত এর উল্টো ব্যাপার যে হতে পারে এ যেন আবিষ্কার করল লিপি- এত নীল, আকাশ, বাতাস, ফুলের গন্ধ হুট করে মিলিয়ে গিয়ে কালচে ইঁটের ছোটো ছোটো বাড়ী, দোকান, ধূ ধূ মাঠময় চোরকাঁটা শুধু। বন্ধ ক্যাফের জানলায় ধুলো জমা ভারি পর্দা ঝুলছিল। পুরোনো গ্যাস স্টেশনের পাশ দিয়ে ক্রীক বইছিল। মহানগরের পেটের ভেতর থেকে যেন একটা অন্য শহর বেরিয়ে এল লিপির চোখের সামনে। আরো তিন মিনিট ড্রাইভ করল লিপি- অফিস পৌঁছে গেল। অ্যাক্সেস কার্ড ঢোকালে একপাশে সরে গেল ভারি গেট, সঙ্গে ধুলো,শুকনো পাতা ,খড়কুটো। লবিতে আদ্যিকালের কার্ড পাঞ্চিং মেশিন যত্ন করে রাখা ;আর একটা ঘড়ি- দুটো কাঁটার একটাও নেই। পুরোনো কার্পেটে ধুলোর গন্ধ ছিল। সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে লিপির কিউবিকল ; যেন মাত্রিওশকা পুতুলের প্যাঁচ খুলে ক্রমাগত বেরিয়ে আসছে এক দুই তিন চার- এইবারে শেষতম ক্ষুদে পুতুল- যার চোখ মুখ, জামার কারুকাজ ঈষৎ ঘষা খাওয়া - যেখানে লিপি চাকরি শুরু করল এই বসন্তে।
পঙ্কজের মনে হ'ল বনময়ূর এসেছে। সকালে পঙ্কজের উঠতে দেরি হ'লে যেভাবে ওর পায়ের পাতায় মুখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকত আর ভেজা ঠান্ডা নাকের ছোঁয়া লেগে চমকে জেগে উঠত সে- সকালের দিকে ঠিক সেভাবে জেগে উঠেছিল পঙ্কজ ; দেখেছিল পায়ের ওপর চাদর সরে গিয়েছে, শেষ রাতের বৃষ্টিতে বাতাস জোলো আর ঠান্ডা। জানলার পর্দা সরিয়ে দেখল, ভেজা ঘাস , ভাঙা ডাল পাতা; ছোটো গর্তে জল জমে আছে অযত্নের বাগানে - কোথা থেকে ঝুঁটি ওলা পাখি এসে মাথা ভেজালো, ডানা ঝাড়ল, পঙ্কজের দিকে ঘাড় ঘোরালো। পঙ্কজ দরজা ঠেলে বাইরে এসে ডাকল- "বনময়ূর, আয় বনময়ূর আয়।" পাখিটা বাগানময় ঘুরে বেড়ালো নাচের ভঙ্গিতে তারপর নিজের ডানার কথা যেন মনে পড়ল তার- হুস করে উড়ে গেল।
অনেকদিন পরে আজ খালি পায়ে বাগানে এসেছে পঙ্কজ- পায়ের তলা ভিজছে; কত দিন ঘাস ছাঁটা হয় না- একরাশ ভিজে সবুজে গোড়ালি ডুবে যাচ্ছে ওর। পাখি উড়ছে, সামনের গাছে বসছে , একটা দুটো তিনটে চারটে পাখি- বনময়ূর তুই পাখি হয়ে এলি? বনময়ূর বনময়ূর...
অফিসফেরত বার্ড ফীডার আর বাথ কিনে এনে বাগানে বসাল পঙ্কজ। সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল, এখন আর কোনো পাখি আসবে না- তবু বার্ডফীডারে এক মুঠো শুকনো সূর্যমুখীর বীজ রাখল সে। মাথার ওপরে বিশাল এক আকাশ রং বদলাচ্ছিল- ঘননীল থেকে কালো হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ, তারা ফুটছিল- কতদিন পরে আজ তারা দেখছে পঙ্কজ , যেন সাহেবগলির বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ওকে তারা চেনাচ্ছে মা, খিড়কীর দরজা খুলে সাইকেল দিয়ে বাড়ি ঢুকছে বাবা। এই সময় স্ট্রীট লাইট জ্বলে উঠছিল, রাস্তার উল্টোদিকে লাল ডাকবাক্স এখন কালো দেখাচ্ছে, তার ছায়া লম্বা হয়ে পড়েছে রাস্তায়-
মাথা টলটল করে পঙ্কজের; সে মাথা ঝাঁকাল দুবার যেন সব চিন্তা সব দুঃখ ঝরে পড়ে যাবে এইভাবে, তারপর লম্বা ছায়াদের দিকে তাকিয়ে ডাকল, " আয়, খেতে আয়"; বোকার মত অপেক্ষা করে রইল, যেন একটা ম্যাজিক হবে এখনই- যেন ঘন অন্ধকার চিরে টগবগিয়ে বেরিয়ে আসবে বনময়ূর-