টুম্পা চা পাঁউরুটি খেয়ে কাপ টাপ ধুচ্ছিল। জল ভরল ফিল্টারে। টুম্পার মুখে মাণিকের আদল। ছন্দা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে খবরের কাগজ নাড়াচাড়া করল খানিক। রাশিফল দেখল। তারপর আলনা থেকে শাড়ি ব্লাউজ নিল , বারান্দার তার থেকে তোয়ালে টানল-
- টুম্পা, স্নানে গেলাম রে। বেরিয়েই রান্না বসিয়ে দেব। মামা বাজার থেকে ফিরলে লাউটা কেটে রাখিস। আর যদি মোচা আনে, আজ আর কুটিস না। ঝুড়িতে রেখে দিবি। মাছ ধুয়ে নুন হলুদ মেখে রাখিস। গুলগুলেটা মহা চোর। রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করবি খেয়াল করে। বুঝলি?
- মামা আজ বড্ড দেরি করছে , না মাসি? অন্যদিন এই সময়ে তো এসে যায়। একবার ফোন করে দেখো না-
- আসবে এখনই। পকেটে ফোন বেজে উঠলে বাজারের ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে সামলাতে পারবে না- মাঝখান থেকে এক কেলেঙ্কারি হবে রাস্তায়। তোর দেরি হলে তুই বরং বেরিয়ে পড়িস।
-সে ঠিক আছে, আসলে আজ একবার কাউন্সিলরের কাছে যেতে হবে- মা তো এসব পারে না-
- টাকা পয়সার ব্যাপারে?
- হ্যাঁ। মামা আজ একটা চিঠি লিখে দেবে বলেছে, সেটা নিয়ে যাব-
-তাহলে মামা ফিরলেই চলে যাস , দেরি করিস না। আমি সব কেটে কুটে নেব- তিনটে প্রাণীর তো রান্না, মিঠু হয়তো রাতে খাবেও না; আরে, এতদিন তো সবই করেছি একা হাতে- এখন যত ইয়ে..
ছন্দা গজগজ শুরু করল।
- মাসি? একটা কথা জিগ্যেস করব?
- বল
-মামা তোমার নিজের ভাই ?
- না
বাথরুমে ঢুকে গেল ছন্দা।
- রিক্সা নেন না কেন? ভারি ব্যাগ ঝুলিয়ে হাঁটছেন?
বিপ্লব মুখ তুলে দেখল, থানার এস আই- ব্লাস্টের পরেই একবার বাড়িতে এসেছিল ডিসেম্বর নাগাদ। এখন কথা বলতে বলতেই সিগ্রেট ধরাল, তারপর দেশলাইয়ের পোড়া কাঠি জুতোয় পিষে এগিয়ে এল । সিগ্রেটের ধোঁয়া বিপ্লবের নাকে ঢুকে যাচ্ছিল, বাজারের ব্যাগ ভারি লাগছিল ; পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে কপাল মুছে নিল সে ।
রাস্তায় ছাই ঝাড়ল এস আই: "আজই ফোন করতাম; দেখা হয়ে ভালই হল। কয়েকটা প্রশ্ন করার ছিল আপনাকে। বিকেলে বাড়ি থাকবেন?"
- কী প্রশ্ন বলুন।
- রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব কথা হয়? কিছু ইনফরমেশন লাগবে আর কি-
- ইনভেস্টিগেশন শেষ হয় নি এখনও?
-এ'সব মামলার অত সহজে কিনারা হয় না বিপ্লববাবু। আরে আপনি নার্ভাস হচ্ছেন কেন?
- কী ইনফরমেশন দেব বলুন তো? কোথা থেকে বোমা এল, কে বোমা রাখল মাণিকের ঝুড়ির পাশে- আমি কী করে বলব? পার্টির মধ্যে গন্ডগোল, না ডাকাত টাকাতের ব্যাপার..
- আরে সে আমরা বুঝে নেব- এ' তো আমাদের কাজ ; আপনি ব্যস্ত হবেন না। অন্য প্রশ্ন আছে। বাড়ি ফিরে স্নান খাওয়া করুন। বিকেলে আসি? না আপনি একবার আসবেন থানায়?
- আমিই যাবো। এই পাঁচটা নাগাদ গেলে হবে? কতক্ষণ লাগবে?
-থ্যাঙ্ক ইউ। একঘন্টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারবেন। জাস্ট দু' একটা ব্যাপার ক্লীয়ার হলেই-
শীত চলে গেছে , তবু বাস থেকে নেমেই হাল্কা চাদর দিয়ে মাথা ঢাকল মিঠু। আর লাইটপোস্টের তলা থেকেই ওর সঙ্গ নিল মশারা-ঝাঁক বাঁধল মাথার ওপর। গলির বাতাসে ধোঁয়া আর ড্রেনের গন্ধ চাপ ধরে ছিল। রাস্তার বাতি জ্বলে উঠছিল এক এক করে। অন্ধকার আকাশের গায়ে নতুন সব ফ্ল্যাটবাড়ি- তাদের ঘরে ঘরে নীলচে সাদা আলো তারার মত জ্বলে; তারারা এত কাছে চলে এলে চমকে ওঠে মিঠু- কী বদলে যাচ্ছে গলি; অথচ বেদনার পরিবর্তে নির্ভার লাগে তার- আর ক'বছর পরে এ'পাড়ার কেউ তাকে চিনবে না, কে তার বাবা, মা, মামু - জানবেও না কেউ, মিঠুর বরকে নিয়ে , মোটা হওয়া নিয়ে কারোর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা থাকবে না- বস্তুত কেউ তার দিকে তাকিয়েও দেখবে না ; অচেনা মানুষেরা একই গলি, একই পাড়ায় পাশাপাশি ঘুরে বেড়াবে দিনের পর দিন- যেন মাল্টি লেন হাইওয়ের সাদা কালো সোনালী রূপালী লাল নীল সবুজ গাড়ি সব।পাশের বাড়ির মীনা আর সুধীন গলির মুখে ফুচকা খাচ্ছিল, লেন চেঞ্জ করল মিঠু ।
এদিকটায় ত্রিফলা লাইট আসে নি, মিটমিটে আলোয় গলির বাঁকগুলো রহস্যময় লাগছিল; এক এক দিন এরকম হয়- যেন প্রথম বাঁকের মুখে যে স্টেশনারি দোকান, সেটা জাস্ট নেই হয়ে যেতে পারে মিঠুর পৌঁছোনোর আগেই, অথবা, তিন নম্বর বাঁক থেকে বাঘ বেরিয়ে আসতে পারে হঠাৎ। আলো খুঁজল সে । মিষ্টির দোকানে ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলো- আজ অমৃতি ভেজেছে- ঘোর কমলা , ডাঁই করে রাখা; দোকানের সামনে ভীড় ছিল- খুরি, ঠোঙা, প্লাস্টিক হাতে মানুষজন যাওয়া আসা করে; বাঁ দিকে জটলা করে দাঁড়িয়ে মিষ্টি খাচ্ছিল ক’জন- রসে চুমুক মেরে বাটিটা টান মেরে ফুটপাথে ফেলল খয়েরী শার্ট ; মিঠুর পেটে মোচড় পড়ল হঠাৎ- সনৎ ? একেবারে সনতের হাইট- চুলের ছাঁট, শার্টের রঙ, কাঁধের ব্যাগ- সব মিলে যাচ্ছিল; মিঠু চাইছিল সটান দৌড় মারতে -ইচ্ছেকে পায়ে ট্র্যান্সফার করতে গিয়ে বুঝল-পারবে না। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে রিক্সা খুঁজল তখন- বলাই আসে নি। এবারে সটান উল্টোবাগে, বাস রাস্তার দিকে হাঁটা লাগাল, বাস স্টপের ছাউনির তলায় দাঁড়িয়ে পিছন ফিরল তারপর। দেখল, দোকানের সামনে সিগ্রেট ধরাচ্ছে লোকটা - সাদা আলোয় চাপ দাড়ি দেখল স্পষ্ট- সনৎ নয়।
"দিদি ও'দিকে কোথায় যাচ্ছেন? এই তো আমি এসে গেছি।" বলাই হর্ন বাজালো।
নিশ্চিন্ত হয়ে রিক্সায় উঠল মিঠু। অমৃতি থাক। সামনের দোকান থেকে ক্রীম রোল নেবে -
-বলাই, একটু থামবে কৃষ্ণা স্টোর্সের সামনে?
-বাঁদিক সাইড করে রাখি দিদি। আমাকে বলে দিন না কী আনতে হবে-আমি নিয়ে আসছি।
প্লাস্টিকের ঠোঙায় ক্রীম রোল আনলো বলাই।
-তুমি একটা প্যাকেট রাখো। মেয়েকে দিও।
হ্যান্ডেলে ক্রীমরোল ঝুলিয়ে প্যাডেল করছিল বলাই। মুখ ঘুরিয়ে কথা বলছিল টুকটাক- এখনই গরম পড়ে গেল, পর্শু সকালে জল আসবে না; তারপর তিন নম্বর বাঁক পেরিয়ে বলল, " দিদি, মামাবাবুকে পুলিশ হেনস্থা করছে কেন?"
- হেনস্থা? কে বলল?
- ক্লাবের ছেলেরা বলছিল। আজও এস আই কথা বলছিল-বাবলা দেখেছে ।
মিঠু ব্যাগ হাতড়ে মোবাইল বের করে অন করল- ছন্দার মিসড কল তো নেই
- কই, মা তো ফোন করে নি। বাবলা কাকে দেখেছে -
-না দিদি, সবাই বলছে- আপনি মামাবাবুকে জিগ্যেস করে নিন। তারপর ক্লাবে বলুন- পুলিশকে একটু কড়কানি দিলেই হবে-
- তাড়াতাড়ি চালাও বলাই, শরীর খারাপ লাগছে।
বলাইকে টাকা দিয়ে কলিং বেল বাজাল মিঠু । টুম্পা দরজা খুলতেই ভাত ফোটার গন্ধ রান্নাঘর থেকে বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে রাস্তায় নেমে এল।
- কী রে টুম্পা, মা কই?
-মাসি বেরিয়েছে। মামাও। থানায় গেছে। চা খাবে তো?
- থানায়?
শঙ্কিত দেখাচ্ছিল টুম্পাকে। বাইরের আলো জ্বেলে জানলার পাল্লা খুলতে খুলতে মিঠুকে বলল- " পার্টির ছেলেরা পেটো রেখেছিল। সেই ফেটে মরল বাবা। পুলিশ মামাকে কেন ডাকছে বারবার?"
-কী করে বলব! তুই বাড়ি চলে যা টুম্পা। আমি ভাত নামিয়ে নিচ্ছি। কাল সকালে আসিস।
-আমার তাড়া নেই। দুটো মুড়ি দিই দিদি? চায়ের সঙ্গে খাও।
ঘন্টাখানেক পরে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছিল বিপ্লব। একটু পিছনে ছন্দা। টুম্পা ওড়না গুছিয়ে নিয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে নামল। ছন্দা জিগ্যেস করল- “ভাত হয়ে গেছে?” বিপ্লবের ঘাড় ঝুঁকে পড়েছিল। হা ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাকে। পাপোষে পা মুছছিল এমন যেন গত ক’ঘন্টাকে শরীর থেকে বের করে দিতে চাইছে। ঘরে ঢুকেই ছন্দা চেঁচাতে শুরু করবে- আশঙ্কা করছিল মিঠু। কিন্তু ছন্দা চুপ, কিছুটা থমথমে-হাত মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেল । রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসছিল- কড়াই খুন্তি আর গরম তেলের কম্বিনেশনে যেমন হয়।
ছন্দার কাছে মিঠুর শৈশব আজও কাটে নি- সে জানে। বেশি প্রশ্ন করলে মা তাকে কিছুই বলবে না, উল্টে বিয়ে, সনৎ এই সব তুলে কান্নাকাটি শুরু করবে। মামুকে জিগ্যেস করে সব জেনে নিতে মিঠু সামান্য দ্বিধাগ্রস্ত ছিল- ওর মনের একটি অংশ এই মুহূর্তে জেনে নিতে চাইছিল থানায় কী হল- অন্য অংশ সময় দিতে চাইছিল বিপ্লবকে।
বেগুন ভাজার গন্ধে ঘরের পরিবেশ সহজ হয়ে আসছিল। টিউব লাইটের আলো ঘরময়, বারান্দার আলোর নিচে টবের ক্যাকটাস; কুন্তী, গুলগুলে সোফায় গোল্লা পাকিয়ে ঘুমোচ্ছিল, পুরোনো সব ছবির আড়াল থেকে মুখ বের করছিল গায়ে ছিট ছিট টিকটিকি- এই সব মুহূর্তগুলো অদ্ভূত- মিঠুর খিদে পাচ্ছিল আবার; মনে হচ্ছিল, যেন কিছুই ঘটে নি, যেন এ যাবৎ মৃত লোকজন বেঁচে বর্তে আছে- যেন অফিসফেরতা ট্রেন থেকে নেমে কমলালেবু, সন্দেশ কিনছে স্টেশনের কাছে, একটু পরেই বাড়ি ঢুকবে কড়া নেড়ে। বারান্দা থেকে মুখ বাড়ালেই যেন দেখা যাবে, মাণিক বেগুন বিক্রি করছে কুপি জ্বেলে। মুড়ি খাচ্ছে। মায়া জমছিল মিঠুর গলায়। গলা খাঁকরে নিল সে-
-আমার কলীগ যে মৈনাক- দেখেছ তো- ওদের ফ্যামিলিতে বড় বড় উকিল, ব্যারিস্টার। ওকে বলি বরং। পুলিশ এত হ্যারাস করছে কেন তোমাকে-
- দ্যাখ মিঠু, সে তুই বলতে পারিস। কিন্তু একদিন কথা বলতে যে ফীজ নেবে- আমার তো এক পয়সা রোজগার নেই। এসবের কী দরকার বল?
- টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমার- কথা বলে রাখা ভালো। হঠাৎ যদি অ্যারেস্ট করে-
-না না সে কেন করবে? বলল তো, সময় টময়্গুলো মিলিয়ে নিচ্ছে কল লিস্ট ধরে-
-তাই বলল থানায়? এতক্ষণ ধরে?
-থানায় গেলে সময় লাগে। জানা কথাই। গেলাম। তো, বসতে বলল। চা দিল। এস আই নেই, এ নেই, ও নেই-কোন কেসে বেরিয়েছে- তারপর বাবুরা এলেন, কথা বললেন- ভয়ের কিছু নেই মিঠু-
- এতবার করে সময় মিলিয়ে নেওয়ার কী তাও তো বুঝি না। তুমি তো বলেই দিয়েছ, পরদিনের বাজারের ব্যাপারে ফোন করেছিলে-
- আসলে অনেকগুলো কল তো- আমি কেন মাণিককে অত কল করি- সেইটা বুঝতে চাইছে-
-করি মানে? রোজ ফোন করতে?
-সে তো করতামই। বাজার তো রোজই লাগে-
বিপ্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে মিঠুর অস্বস্তি হতে থাকে- মুখ লালচে হয়ে উঠেছে, কপালের দুপাশে দপদপ করছে সবুজ শিরা- চোখ একবার দেওয়ালে , একবার মাটিতে, পরক্ষণেই মিঠুর মুখে- না কামানো পাকা দাড়ি, চুল কাটে নি কত দিন।
-মামু, কী হয়েছে? আমাকে বলতে পারো- আমি মৈনাককে বলে-
-কিছু হয় নি রে মিঠু। বলছি তো, কিছু হয় নি, ঘাবড়াস না। আসলে একটা বয়সে পৌঁছে, অতীতের সামনে দাঁড়াতে সবাই তো চায় না। তুইও হয়ত চাইবি না একদিন। তোর মা, তোর বাবা আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। নইলে-
বিপ্লব চুপ করে গিয়ে জল খেল। তাড়াহুড়োয় বিষম খেয়ে কাশল , তারপর সামলে নিল। টিভি চালিয়ে চ্যানেল বদলাতে লাগল তারপর। একটা কথাও বলল না আর।
মিঠু বিপ্লবের অতীত জানে না। নিজের শৈশবের স্মৃতি বিশেষ নেই। বাবার বদলির চাকরি ছিল- মিঠুর শৈশব ঘুরে ঘুরে কেটেছিল। তারপর , আবাল্য বিপ্লবকে এ' বাড়িতে দেখেছে। মামু বলে ডেকেছে তাকে। গল্প বলা, স্কুলের পড়া দেখিয়ে দেওয়া- ভাবতে গেলে বাবার থেকেও মামুর কথাই বেশি মনে হয় মিঠুর।
ছোটোবেলা মানে অতীত। বিপ্লব অতীতের কথা বলছিল। ঘরে টিউব লাইটের আলো। সাদা দেওয়াল। সবুজ জানলার পাল্লা খোলা। ফ্যান ঘুরছে। ডালে ফোড়ন দেওয়ার গন্ধ আসছিল। চার দেওয়ালের মাঝে এই সব সময় এক খাবল দার্শনিকতা আসে গৃহস্থের। সে আয়নায় নিজেকে দেখে, ছোটোবেলার কথা ভাবে, বেড়ালছানাকে আদর করে খেতে বসে। রাস্তার আলো পর্দার ফাঁক দিয়ে তার পিঠে পড়ে তখন।
খবরের কাগজের হেডলাইনের ওপর চোখ চালিয়ে নেওয়ার মত, মিঠু দ্রুত নিজের অতীত ভাবল- তার শৈশব, স্কুল, কলেজ, বাবা, মা, মামু। তারপর চাকরি পাওয়ার দিনের কথা ভাবল , আর বিয়ের কথা। সনতের মুখ মনে করতেই ছ্যাঁত ছ্যাঁত করল বুকের ভিতর। বসে থাকতে পারছিল না মিঠু। অস্থির লাগছিল। খয়েরী শার্ট, চাপদাড়ি লোকটার কথা মনে হল - সত্যি যদি সনৎ হত? বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল মিঠু-রান্নাঘর থেকে বসার ঘর, আবার রান্নাঘর। কুন্তী ঘুম ভেঙে ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল। ল্যাজ তুলে পিঠ বেঁকিয়ে মিঠুর গায়ে গা ঘষছিল আগাগোড়া। অতীত কতদূর বিস্তৃত হয় ভাবছিল সে; ভাবছিল তার কাছের অতীত কী ভাবে দূরের অতীতকে খেয়ে ফেলেছে। মামুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয়ত উল্টো- মিঠুর মনে হচ্ছিল।
টিভিতে খবর শুরু হয়ে গিয়েছে - দশটা বাজল।
- মা, খেতে দেবে না?
এই সময় দরজায় বেল বেজেছিল। সনৎ, নিশ্চয়ই সনৎ - বাথরুমে ঢুকে সটান ছিটকিনি তুলে দিল মিঠু। ছন্দার চটির আওয়াজ পেল - রান্নাঘর থেকে বাইরের ঘরের দিকে যাচ্ছে। আলো জ্বালল প্যাসেজের। মামুকে কিছু বলল । দরজা খোলার আওয়াজ পেলো তারপর। ছন্দা এসে বাথরুমে ধাক্কা দিল- 'শম্পা আর ওর বর এসেছে। বেরো। বেশিক্ষণ বসবে না ওরা।'
"দেরি হয়ে গেল রে। বিকেলেই বেরিয়েছি। মাসিমাকে আর মামুকে কার্ড দিতে এসেছিলাম। তোর শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা নিতাম মাসিমার থেকে। তোকে এখানে পেয়ে যাব ভাবি নি"-কার্ড বাড়িয়ে দিল শম্পা- "ছেলের অন্নপ্রাশন। সবাই আসবি। তুই, তোর বর, মামু, মাসিমা আপনি। তোর বরকে তো দেখিই নি।" ছন্দা নিজের আর বিপ্লবের প্রেসার, সুগারের ফিরিস্তি শুরু করল গুনগুন করে- যাওয়া হবে না হয়ত, এই সব বলছিল।
খাম খুলে কার্ড বের করতেই যেন নিজেকে দেখতে পেল মিঠু- পাত পেড়ে রাধাবল্লভি, আলুর দম খাচ্ছে, ঘন ছোলার ডালে নারকেলের কুচি, এর পর ফিস ফ্রাই আসবে , সঙ্গে কাসুন্দি- সে যেন হাত তুলে আরো দুটো রাধাবল্লভি দিয়ে যেতে বলছে- সাদা প্লেটের এক পাশে শেপ করে কাটা সবুজ শশা, বেগনে পেয়াঁজ - মুখ ভরে জল আসে। সনতের ভয় তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল । মৃত লোকদের ছবির পিছন মুখ বের করেছিল টিকটিকিরা, কুন্তী আর গুলগুলে গা ঘষছিল পায়ে; আচম্বিত বড় সুখবোধ হল মিঠুর, বলল- "যাব তো। নিশ্চয়ই যাব।"