পঙ্কজের গন্ধ পেলেই বনময়ূর ডেকে ওঠে। পিছনের দু’পায়ে দাঁড়িয়ে উঠে বারান্দার দরজার জালে থাবা রাখে তারপর ঝাঁকায়। সদরের বাইরে থেকে পঙ্কজ যখন সে আওয়াজ পায়, ওর মনে হয়, গোটা বাড়িটাই যেন জ্যান্ত হয়ে উঠে পঙ্কজের দিকে দু'হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে; সমস্তদিনের কেবল এই সময়টুকু নিজেকে দামি মনে হয়। যতদিন স্মিতা আর বুল্টি এ'বাড়িতে ছিল, বাড়ির ঢোকার ঠিক আগে সামান্য টেনশন হত পঙ্কজের- এত বছরেও সে যেন তার স্ত্রীর, সন্তানের মুখোমুখি হতে ক্ষণিকের অস্বস্তি বোধ করে-
বস্তুত পঙ্কজ জীবজন্তু ভয় পেত - ওদের মফস্সলের বাড়িতে সাপখোপের উপদ্রব ছিল, বাজারে ষাঁড় তাড়া করেছে, কুকুর কামড়ে দিয়েছিল একবার –সে’সব পুরোনো কথা। তারপর এ' দেশে এল, সংসার টংসার। বুল্টির ছোটো থেকেই কুকুরছানার বায়না, স্মিতারও ইচ্ছে ছিল খুব- শুধু পঙ্কজ নানা অজুহাতে পাশ কাটাতো- কখনও বলত, ওর অ্যালার্জি আছে- বাড়িতে কুকুর ঢুকলেই এমন হাঁচি হবে যে ও মরেই যাবে, কখনও কুকুর সংক্রান্ত ভয়াবহ সব ঘটনার রোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছে আর বুল্টি চোখ গোলগোল করে- "সত্যি!!" আর স্মিতা "যত্ত গুল" বলে উঠেছে; কখনও স্রেফ "বাড়িতে জায়গা কোথায়" বলে হাত উল্টেছে। শেষমেষ বুল্টি যখন ক্লাস সেভেন থেকে এইট - সদ্য টীনএজারের যুক্তিজাল আর বাক্যবাণের কাছে আত্মসমর্পণ করল পঙ্কজ; বনময়ূর এল এ'বাড়িতে - নাম রেখেছিল স্মিতাই। ইয়ামোটা ল্যাজ নিয়ে ছোটো কুকুরছানার নাচন কোঁদন দেখে স্মিতার 'বনময়ূরের নাচ দেখতে যাব' গানটা মনে পড়েছিল। পঙ্কজ কস্মিনকালে শোনে নি এ' গান। এই স্মিতার স্পেশালিটি- এক এক সময় এমন সব গানের লাইন বলে, আদৌ সেরকম গান আছে কী না পঙ্কজের সন্দেহ হত; স্মিতা অবশ্য এক্ষেত্রে সিনেমার দৃশ্যের বিশদ জানিয়েছিল- অনুভা গুপ্তার লিপে সন্ধ্যা মুখার্জী- স্মিতা ওর ছোটোবেলায় দিদার থেকে শিখেছিল গানটা- দু'কলি গেয়ে শুনিয়েছিল বুল্টি আর পঙ্কজকে। গানের সুর বেশ কিছুক্ষণ ভেসে ছিল ঘরে, থিতিয়ে গেলে, টুপটাপ খসে পড়ছিল শব্দ আর বনময়ূর নামটা লুফে নিয়েছিল বুল্টি।
স্মিতা আর বুল্টিই ওর দেখাশোনা করেছে এতকাল। বুল্টি ডর্মে চলে যাওয়ার পর স্মিতা একা সব পেরে উঠতো না, পঙ্কজ সাহায্য করত টুকটাক। তারপর স্মিতা কলকাতা চলে গেছে- সব দায়িত্ব পঙ্কজের।
প্রথম প্রথম ভুল হয়েছে । হয়তো অফিস থেকে ফিরতে দেরি - বনময়ূরের খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেছে, কিম্বা উইকএন্ডে বন্ধুবান্ধবের ফোন এসে যাওয়ায় ভুলেই গেল বিকেলে হাঁটতে নিয়ে যাওয়ার কথা; একদিন সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে ফোনে করছে পঙ্কজ, পিছনে ছায়ার মত বনময়ূর; দরজার ঘন্টি বেজেছিল এই সময়- কানে ফোন নিয়ে দরজা খুলল পঙ্কজ- পিজ্জা আসার কথা। দরজা খুলতেই এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গিয়েছিল বনময়ূর। পঙ্কজের বাড়ির সামনে চওড়া রাস্তা , রাস্তার উল্টোদিকে বাড়ি, লাল ডাকবাক্স, স্ট্রীট লাইট , তার পিছনে জঙ্গল। হতচকিত হয়ে গিয়েছিল পঙ্কজ। তারপর সেও দৌড়ে পৌঁছে গেল উল্টোদিকের ফুটপাথে-কোথাও নেই বনময়ূর। ফুটপাথ ধরে একবার বাঁয়ে দৌড়োয়, আর একবার ডাইনে দৌড়োয় পঙ্কজ; ততক্ষণে ঘামতে শুরু করেছে, বুকের মধ্যে একটা হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে তার- একটা প্রাণীকে হারিয়ে ফেলল ? তখন পাড়ার কুকুরের দল বেড়াতে বেরিয়েছে- নীল সাদা ডোরা টিশার্ট পরা মহিলার সঙ্গে মলি, ডেভিডের সঙ্গে মার্লি, ঘুরিয়ে পরা বেসবল টুপি , গোলগলা টি শার্ট পরা রোগা ছোটোখাটো মানুষ আর তাঁর সানগ্লাস পরা সঙ্গিনী তিনটিকে নিয়ে মোড় ঘুরে এই ফুটে উঠেছেন- ইজি, ব্যাঞ্জো, ডেজি- তারা ছুটে যেতে চাইছে দিগ্বিদিক, তাদের লীশের ওপর মহিলার শিরাওঠা লম্বা আঙুল চেপে বসে আছে , ট্যারাব্যাঁকা মরা নখে কমলা পালিশ; পঙ্কজ শিউরে ওঠে- যদি জবাবদিহি চায়, যদি পুলিশ ডাকে-
পাঁচটি কুকুরের নিঃশ্বাস এখন পঙ্কজকে ঘিরে, চারটি মানুষ প্রশ্ন করে-
- হোয়াট হ্যাপেনড? আর ইউ অলরাইট?
-ইয়েস ও ইয়েস অল গুড।
কুকুরের দল চোখের আড়াল হতেই আবার দৌড়ে বেড়ায় পঙ্কজ- কোথায় বনময়ূর?
সন্ধ্যা হয়ে এসেছিল, হাওয়া দিচ্ছিল উথাল পাথাল, রাস্তার ওপারে বাড়ির দরজা হাট করে খোলা, দরজার সামনে পিজ্জার বাক্স, বসবার ঘরের আলো দেখা যাচ্ছে; পঙ্কজ বাড়িতে ঢুকে, ডগফুডের প্যাকেট থেকে একমুঠো পেলেট নিয়ে রাস্তা পেরোলো আবার- ডাকবাক্সের সামনে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে ডাকল-" বনময়ূর, আয়, আয়।" হাওয়ায় হাওয়ায় ডগফুডের গন্ধ, পঙ্কজের গলার কাঁপুনি ছড়িয়ে যাচ্ছিল। ইজি, ব্যাঞ্জো, মার্লি ডেকে উঠেছিল খুব জোরে আর জঙ্গলের ভেতর থেকে বিদ্যুতগতিতে ছুটে এসেছিল বনময়ূর; সাইডওয়াকের ওপর তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল পঙ্কজ। তার অভ্যন্তরে যে এতখানি কান্না ছিল, জানতই না সে । স্ট্রীটলাইট জ্বলে উঠেছিল, রাস্তার ধুলোর মধ্যে থেবড়ে বসে পঙ্কজ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছিল বনময়ূরকে, পঙ্কজের গাল চেটে ল্যাজ নাড়ছিল ঘন রোমে ভরা প্রাণী; বনময়ূরের গায়ের গন্ধ, ঊষ্ণ শরীর, পঙ্কজের হাতের তলায় ধুকধুক করতে থাকা বনময়ূরের হৃদয়ের শব্দ সম্ভবত কানেকশন গড়ে তুলছিল একলা, নির্জন মানুষ আর পশুটির মধ্যে-
যেন ট্রেনে উঠেছিল লিপি- হুইশল দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে ট্রেন আর লিপি বার্থে উঠে বসছে, তারপর রেলের কামরা বদলে যাচ্ছে ওর বাপের বাড়ির পুরোনো ঘরদোরে - মলিন দেওয়ালে ঝুলে থাকা ছবি, ক্যালেন্ডার- খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আলো ঢুকছে আর দেওয়ালে ছবি তৈরি হচ্ছে- বকুল গাছ, জবা, টগর, এই উঁচু নারকেল গাছ তারপর মেপল। লাল হলুদ ঝরা পাতার রাশ পেরোচ্ছিল ট্রেন খুব আস্তে, সে ট্রামে করে চলেছে এরকম মনে হচ্ছিল - তারপর একটা লম্বা ব্রিজে উঠল , স্পীড বাড়াল- ঝমঝম ঝমঝম ঝমঝম; ট্রেনের তীব্র গতিতে ভেঙে গেল বাপের বাড়ির দেওয়াল, ঘরদোর, দেওয়ালের ছবি-
ঘুম ভেঙে উঠে বসেছিল লিপি। জল খেল।
বিকেলে যখন স্কুল থেকে নিয়ে ফিরছিল , কমিউনিটি নোটিশ বোর্ডে কুকুরছানার ছবি দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিল তিন্নি- কুকুর হারিয়েছে, খুঁজে পেলে পুরস্কার। তিন্নির পাশে দাঁড়িয়ে ছোটো ছোটো কাগজের টুকরো সাঁটা চৌকো বোর্ডে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিল লিপি -পিয়ানো শিক্ষক চাই, অভিজ্ঞ বেবি সিটারের জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন, যোগ শিখতে আসুন কিংবা ক্যারাটে, মেদ কমাতে চান? আগামী পরশু গ্যারাজ সেল, একখানি কুইনসাইজ খাট জলের দরে বিক্রি হবে ... তারই মাঝে সবুজ চৌকো কাগজে লেখা ছিল- ফ্রম মাদার্স টু ডটার্স : অ্যান একজিবিশন অফ প্যাচওয়ার্ক কুইল্টস- লাইব্রেরির দোতলায়। রুটিন ভাঙতে ইচ্ছে হচ্ছিল লিপির- একবার ঘুরে আসতে কতক্ষণ আর লাগবে?
টানা বারান্দায় কাচের চৌকো বাক্সে সারি সারি কুইল্ট টান টান করে পিন দিয়ে আটকানো - কাঁথা না কি বালাপোষ বলবে ভাবল লিপি। সেই কবে জাহাজে করে এই দেশে আসতে আসতে হয়তো মা সেলাই করেছেন কাঁথা, দিয়ে গেছেন মেয়েকে, আল্টিমেটলি নাতনির ঘরে সে কাঁথা এখন। কাঁথার এত রকমফের- অবাক লাগছিল লিপির। দেখছিল, মহার্ঘ্য সিল্কের বালাপোষের পাশে ময়দার মিলের বস্তা দিয়ে তৈরি কাঁথার গায়ে দরজির দোকানের পুরাতন স্যাম্পল বুক থেকে নেওয়া কাপড়ের টুকরোর প্যাচওয়র্ক, ছেঁড়া মোজা, ছেঁড়া সোয়েটারের ইন্সুলেশন। বারান্দার মোড় ঘুরে অভিবাসী আর শরণার্থীদের বানানো কাঁথার সামনে দাঁড়াল লিপি। প্যাচওয়ার্কের কাজে একটা অদ্ভূত প্যাটার্ন দেখছিল সে- ফেলে আসা দেশ, বাড়ি, ঘর, প্রকৃতির মোটিফ ক্রমে বদলে গিয়েছে এ'দেশের পশু পাখি ফুল আর পতাকায়। মা মেয়ে কাচের বাক্সে নাক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠায়। দুজনের নিঃশ্বাসের অভ্যন্তরের জলীয় বাষ্প শো কেসের গায়ে একটা প্যাটার্ন তৈরি করছিল, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছিল। রোঁয়া ওঠা পুরোনো বালাপোষের নকশার ফোঁড় ওদের চোখের মণি ছুঁয়ে ঢুকে যাচ্ছিল মগজে-
যদি আজ এই মুহূর্তে তিন্নির জন্য বালাপোষ সেলাই করতে বসে লিপি, নারকেল গাছ না কী মেপল ট্রীর নকশা বসাবে ভাবতে ভাবতে জানলার পর্দা সরিয়ে রাতের রাস্তায় তাকালো। বরফ পড়ছিল সে রাতে। আকাশ থেকে নেমে আসা গুঁড়ো তুষার, সাদা হয়ে যাওয়া সাইডওয়াক, নীলাভ স্ট্রীটলাইটকে ওর অলীক লাগছিল। মনে হচ্ছিল, যেন ও এক স্বপ্নের মধ্যে আটকে পড়েছে- ছটফট করে জেগে উঠতে চাইছিল লিপি- ফলত জল খেতে গিয়ে বিষম লাগল। সুবিমল জেগে গিয়েছিল।
- কী হ'ল লিপি? জেগে বসে আছ? কথা হয়েছে আজ বাড়িতে? ঠিক তো সব?
- মা বলছিল, কিছুদিনের জন্য রাণাঘাট গিয়ে থাকবে, রান্না করতে করতে আজ নাকি মনে হয়েছে দেয়াল টেয়াল দুলছে-
- আমি তো আগেই বলেছিলাম, ঐ তো বাড়ির অবস্থা , তার মধ্যে এই মেজর খোঁড়াখুঁড়ি- তোমার বাবা তো শুনতেই চান না
- বাবা বলছিল, বাড়ি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, মা প্রেশারের ওষুধ খায় নি সকালে ,আসলে মাথা ঘুরছিল-
-তবু... কিছুদিন রাণাঘাটে গিয়ে থাকাটা ভালো- মেট্রোর কাজটা মিটে যাক-
-জানো?
-কী ?
-ঘুমোলে?
- হুঁ…
- ভালো লিখতে শিখেছে তোমার মেয়ে
-কী লিখল? স্কুলের এসে?
-না না। আজ বলছিলাম, তুই লেখ না একটা গল্প - ফুল নিয়ে। ভেবে টেবে বলল- ফার্স্ট লাইন ভেবেছি; এভরি সামার কামস উইথ ইটস ওন স্মেল।
-এ তো ডেনজারাস-
- আরো আছে। বললাম, বাংলায় লেখ গল্পটা। বলল- তাহলে ফার্স্ট সেন্টেন্স হবে- গরমকালের নিজের একটা গন্ধ আছে
- বলো কী? এই বয়সে এরকম লাইন! সেলিব্রেট করতেই হয়-
-বলছি, ফিরে গেলে হয় না?
-কোথায়?
-বাড়ি-
-আমার বাড়ি তো এইখানে- এই তো আমার বাড়ি, তাই না? আমার বাড়ির একটা নিজের গন্ধ আছে- আমার লিপিমণির নিজের একটা গন্ধ আছে-কী তাই না? উঁ?
মিলিত হওয়ার মুহূর্তে জানলার বাইরে চোখ গিয়েছিল লিপির- এরোপ্লেন উড়ে যাচ্ছিল রাতের আকাশ ফুঁড়ে -
সকালে হাল্কা রোদ, সুবিমল অফিসে বেরিয়ে গেছে, তিন্নিকে স্কুলে দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল লিপি। ফেরার পথে পাঁউরুটি, দুধ আর চকোলেট কিনছিল পাড়ার দোকানে। বাড়ি ফিরে কমপিউটার খুলে বসবে- চাকরি খুঁজবে, অ্যাপলাই করবে, তারপর ফোন করবে এ'দিন ও'দিক; বিকেল হলে তিন্নিকে আনতে যাবে।
স্মিতা চলে যাওয়ার পরে, সমস্তদিন বনময়ূর একলা থাকে- শেড দেওয়া ঘেরা বারান্দা; সকালে বেরোনোর সময় জল, খেলনা, খাবার দিয়ে ওকে বারান্দায় রেখে যায় পঙ্কজ- দু' থাবার ওপর মুখ রেখে এমন করুণভাবে তাকায়, পঙ্কজের মনে হয় -আজ অফিস না গেলে কী ক্ষতি? এক দিন মাঝপথ থেকে ফিরেও এসেছিল- দেখেছিল, বারান্দায় একলা বনময়ূর এ' মাথা ও'মাথা করছে- যেন মেলার ভীড়ে হারিয়ে যাওয়া বালক।
গত মাসে সাইক্লোন হয়েছিল। অফিসে গিয়ে টিঁকতে পারে নি পঙ্কজ- বাজ, বিদ্যুতে ভয় পাচ্ছে বনময়ূর। ওয়র্ক ফ্রম হোম করব বলে বাড়ি চলে এসে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে। এই শীতে ওকে কোট পরিয়ে রেখে যায় আর অফিস গিয়ে গুগল করে দেখে, কতখানি ঠান্ডা সইতে পারবে বনময়ূর। কিছুদিন আগে একটা সারভেইল্যান্স ক্যামেরা কিনেছে পঙ্কজ -বারান্দার দেওয়ালে এক কোণায় লাগিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছে- অফিসে গিয়ে মোবাইল ফোনে ঘন্টায় ঘন্টায় বনময়ূরকে দেখা যায় এখন।
অফিস থেকে ফিরে, বাড়িতে ঢুকতে একটু সময় লাগে কোনদিন - হয়ত চাবি ঘুরিয়ে দরজা খুলতে দেরি হল, হয়ত বাড়িতে ঢোকার মুখে কথা শুরু করল পাশের বাড়ির অ্যালেন- দুজনেই অধৈর্য হয়; তারপর ঘরে ঢুকে বারান্দার দরজা খুলে দিলে বনময়ূর ছুটে এসে পঙ্কজের গায়ে গা ঘষে, হাত মুখ চাটতে থাকে। তখন বনময়ূরের গায়ে এই বাড়িটার সমস্তদিনের গন্ধ , রোদের গন্ধ, বৃষ্টির গন্ধ- অফিসে বসে যা কিছু থেকে বঞ্চিত পঙ্কজ, বাড়ি ফিরে বনময়ূরের থেকে সে যেন সব পেয়ে যাচ্ছে- এই রকম মনে হয়।
ক্রিসমাসের ছুটি শুরু হবে - বুল্টি ডর্ম থেকে বাড়ি আসবে। পঙ্কজ অগোছালো ঘর দোর গোচ্ছাচ্ছিল, ক্রিসমাস ট্রী সাজাল, ফুলদানিতে ফুল, বাহারি পাতা - কমলা লাল হলুদ সবুজ রঙ মিলিয়ে, বুল্টির ঘর বার কয়েক ভ্যাকুয়াম করে চাদর , বালিশের ঢাকা বদলালো, বাথরুমে নতুন তোয়ালে, সাবান - স্মিতা এখানে থাকলে যা যা করত সব হল কী না ভাবতে ভাবতে সিগারেট ধরালো একটা। গ্যারাজ ঢুঁড়ে নিয়ে এল বাক্সভরা ফেয়ারি লাইটের গোছা -বাগান সাজাতে গেল পঙ্কজ ।
ফোন করেছিল বুল্টি।
- কী করছ?
- এই তো আলো লাগাচ্ছি বাগানে- তোর গোছগাছ হল?
-প্লীজ কিছু মনে কোরো না বাবা। পরশু বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে যাব -
- আসবি না বাড়িতে? কতদিন বাড়ি আসিস নি-
-আসব তো- পরশু আসছি না-
- বনময়ূরকে দেখিস নি কতদিন -ওকে দেখে যা -যদি পারিস।
- দেখি তো -স্কাইপে তো দেখছি -তোমাকে , বনময়ূরকে-
-কবে আসবি জানাস-
-চলে আসব, আগে থেকে জানানোর কী আছে?
-সবাইকে আসতে বলতাম সেই মত আর কী - একটা গেট টুগেদার ধর- পরাশর আঙ্কল, লিপিমাসিরা, সুপ্রিয়া আন্টি-
- না -
-কেন? ওরাও তো কতদিন দেখে নি তোকে, তুইও-
-তুমি আসলে দেখাতে চাও উই আর স্টিল আ হ্যাপি ফ্যামিলি- তাই না?
-দেখানোর কী আছে ? নই?
-মা কেন চলে গেল?
- সে তো তুই জানিস- জেঠিদিদার অসুখ-
- সে'টা সব নয়, তুমিও জানো বাবা-
পঙ্কজ চুপ করে যায়। মাথা নামিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল বেঁকায়, মেঝের অদৃশ্য ময়লা ঘষে ঘষে তুলতে থাকে, ব্যথা করে উঠলে সরিয়ে নেয় আঙুল।
-বেশ বলব না ওদের। ওরা যদি যেতে বলে যাবি তো?
- এই সব পার্টি ফার্টি বাদ দাও। গেলেই তো এক কথা- মা কবে আসবে, আমার কোর্স কবে শেষ হবে, আমি এরপর কী করব-
ফোন রেখে দিল বুল্টি।
পঙ্কজ লাথি কষাল ফেয়ারি লাইটের বাক্সে। ঘরে ঢুকে ক্রিসমাস ট্রীর ডগা মুচড়ে দিল- ঝকমকে তারা, ঝুলন্ত বল খসে পড়ে খানখান হল আওয়াজ তুলে - সেই শব্দে ছুটে এল বনময়ূর।
পঙ্কজ গাড়ির চাবি নিল--আয় বনময়ূর, আয়।
গাড়ির দরজা খুলে দিতেই একলাফে বনময়ূর গাড়ির মধ্যে।উত্তাল গাড়ি ছোটাল পঙ্কজ। রোদ উঠে বরফ গলে গিয়েছিল। সমুদ্রের দিকে গাড়ি ঘোরালো প্রথমে । তারপর পার্কে গেল। বেঞ্চে বসে রইল ঠায় বনময়ূরকে সঙ্গে নিয়ে- ঠান্ডা হাওয়ায় কেটে কেটে যাচ্ছিল পঙ্কজের নাক, মুখ, চোখ; ছোটো বুল্টিকে নিয়ে উইকএন্ডে কোথায় কোথায় যেত-মনে মনে লিস্ট করছিল পঙ্কজ। পরের রবিবার লংড্রাইভে যাবে ভাবছিল।
রাতে নিজের খাবার গরম করতে দিয়ে, বনময়ূরকে খেতে দিল পঙ্কজ- ছোটো বাটিতে জল আর মাপমতো পেলেট। নিজের প্লেট থেকে মাংস তুলে জলে ধুয়ে খেতে দিল তারপর- স্মিতা থাকলে এই নিয়ে রাগারাগি করত। তারপর হাঁটতে বেরোল দুজনে- বিশাল আকাশের নিচে দীর্ঘ ছায়ার পাশে চৌকো ছোটো ছায়া- হাঁটতে হাঁটতে পঙ্কজের মুখের দিকে তাকায় বনময়ূর আর মায়ায় মায়ায় ভরে যেতে থাকে পঙ্কজ- রাতে একলা সোফায় টিভি দেখে, ল্যাপটপ খুলে কাজে বসে। বনময়ূর ওর পায়ের পাতার ওপর পড়ে থাকে কম্বলের মত- ভারি আরাম হয় পঙ্কজের; নিরালা এই গৃহকোণ, সে আর এই প্রাণীটি- পঙ্কজের অতীত নিয়ে যার কৌতূহল নেই, কোনো সন্দেহ নেই, কোনো রাগ নেই, কোনো ক্ষোভ নেই, অভিমান নেই-
- চাকরি ছেড়ে দেব, তারপর সারাদিন তুই আর আমি একসঙ্গে- দেখিস তুই-
বনময়ূর তার কান পটপট করে, ল্যাজ নেড়ে যায় অবিরাম। বনময়ূরের ছোট্টো মাথায় হাত বোলায় পঙ্কজ - "খোকা রে"-
পঙ্কজের অতীত খুঁজতে গেছে স্মিতা; গর্ত খুঁড়ে প্রাচীন হাড়গোড় হাতে ঠেকলে হয়ত আর কোনদিন ফিরবে না এখানে- পঙ্কজ এ’কথা জানে।