একতলা ছিমছাম বাড়ি, সাদা রং, ঢালু ছাদে লাল টালি, সামনে ছোটো বাগান, ব্যাকইয়ার্ডে ভেজি প্যাচে টমেটো, কুমড়ো ফলে আছে – পছন্দ হয়ে গেল সুবিমলদের। ফাইনাল করে ফেলবে। ফুরফুরে লাগছিল – মাটির এক ইঞ্চি ওপর দিয়ে হাঁটছিল সুবিমল। এজেন্টের অফিস থেকে ফেরার পথে আইসক্রিম খেল তিনজন। এখন ফেরার পথ ধরেছে গাড়ি; পিছনের সিটে ব্রোশিওর উল্টেপাল্টে দেখছিল তিন্নি, ফেল্ট পেনের ঢাকনা খুলে এ’ রং – সে’ রং চাপাচ্ছিল সাদা বাড়ির গায়ে; একটা কুকুরছানা আঁকল বাড়ির সামনে, বাড়ির রঙে আর কুকুরের রঙে মিশে গেলে, সাদা কুকুরকে বাদামি করে দিল দু’মিনিটে; আকাশে পাখি, সূর্য, চাঁদ, তারা সব পাশাপাশি সাজিয়ে রং করল পটাপট, তারপর সবুজ বাগানে দু’জন লম্বা, একজন ছোট মানুষ এঁকে ঘুমিয়ে পড়ল। লিপি সুবিমলকে দেখছিল – ওর দিক থেকে সুবিমলের সাইড প্রোফাইল দেখা যাচ্ছে – সানগ্লাসের ডাঁটির নিচে জুলফি, চোয়াল, চিবুক – আনন্দ আর গর্ব গাল বেয়ে গড়িয়ে চিবুকে জমেছে। সুবিমল ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েকে দেখল দু’বার – মায়ায় নরম হল চোয়াল – শিস দিয়ে এক্সিট নিল এবার, স্পিড না কমিয়েই।
“সাবধানে”, লিপি বলল।
“একদিন পঙ্কজদাকে খেতে বলি? আর রাঘবদের? হুঁ? লেটস সেলিব্রেট” – স্টিয়ারিং-এ তাল ঠুকল সুবিমল।
পেঁপে গাছের ফুল যে রজনীগন্ধার মত দেখতে হয়, পঙ্কজের ধারণা ছিল না। এই গ্রীষ্মে, দাবানলের তাত সমস্ত সবুজ ঝলসে দিয়ে, প্রথমে হলুদ, তারপর ধীরে ধীরে খয়েরি করে দিয়েছিল; ঘাসজমি, গাছের পাতা – সব মরে কাঠ, মনে হয়েছিল পঙ্কজের অথচ এখন, বর্ষার জল পড়তে না পড়তেই ওর বাগানকে ঘন সবুজ আর জঙ্গুলে দেখাচ্ছে। পাখিরা বার্ড ফিডারে জল খেয়ে যেত, ঠোঁটে ঠোঁটে এদিক ওদিক বীজ পড়েছিল – সে সব থেকে চারা গজিয়েছে; পেঁপে গাছ অবশ্য পুরোনো – স্মিতা লাগিয়েছিল। বেগনে-সাদা ফুল ধরা চারাগাছ রোদে নেতিয়ে ছিল – এখন লকলক করে বাড়ছে; পঙ্কজ দুটো কাঠি ঠেকনো দিয়ে, বাড়ির পিছনের দরজা খুলে, ক্লথ-লাইনার স্ট্যান্ডের কাছে রেখে দিয়েছিল টবটা – এ’দিকটা অত রোদ পড়ে না। এখন সবে ভোর হয়েছে। পঙ্কজ অফিসে বেরিয়ে যাচ্ছিল – একটা ডেডলাইন মিট করতে হবে। বাড়ি থেকে কাজ করতে অসুবিধে হয় – কনসেন্ট্রেট করতে পারে না। পেঁপেফুলের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে বেরিয়ে পড়ল।
অফিসে ক্লিনাররা সাধারণত খুব ভোরে আসে – করিডরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চলার আওয়াজ হচ্ছিল গুনগুন করে, পঙ্কজ ইয়ারফোন লাগিয়ে নিল। কফিতে চুমুক দিয়ে ল্যাপটপে লগ অন করল। তখনই গ্রাহাম এসে দাঁড়িয়েছিল – ট্র্যাশ নিতে।
“গুড মর্নিং।”
“মর্নিং”, পঙ্কজ ইয়ারফোন খুলে নিল কথা বলার সময়।
এই সকালে যখন আলো-টালো ফুটেছে, বড় কাচের জানলার ব্লাইন্ড ওপরে গুটিয়ে তোলা, আর ভোরের রোদ সেই সুযোগে পঙ্কজের ডেস্ক ছুঁয়েছে সবে – এই নিমেষ সম্ভবত মানুষকে কিছু মনে করায় – পুরোনো কথা, স্বপ্ন-ট্বপ্ন; সে তখন কিছু বলতে চায়, শোনার মানুষ খোঁজে। গ্রাহামও কিছু বলতে চাইছিল, পঙ্কজকে পেয়ে গেল। কালো বিন লাইনার হাতে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, “কী শুনছিলে? কী ধরণের গান শোন?”
সকালের রোদ সবাইকে এক ভাবে ছোঁয় না। পঙ্কজ এই মুহূর্তে ওর ল্যাপটপের স্ক্রিনে কনসেন্ট্রেট করতে চাইছিল – ফার্স্ট আওয়ারের মধ্যেই কাজটা অর্ধেক সেরে নিতে হবে – তদুপরি, ধরা বাঁধা কিছু শোনে না – এই মান্না দে, তো এই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে এড শিরানে গেল হয়তো, অথবা অতুলপ্রসাদী শুনল খানিক। কী বলবে ভাবতে ভাবতেই, গ্রাহাম গল্প শুরু করেছিল – “হ্যাভ ইউ ওয়াচড দ্য বোট দ্যাট রকড?” পঙ্কজ কিছুক্ষণ ভেবে “না” বলতে, গ্রাহাম কোকের ক্যান তুলে বিন লাইনারে ফেলেছিল, তারপর মৃদুগলায় বলেছিল ঐ সিনেমায় ওকে এন্সেমবল করা হয়েছে। “আই ওয়জ আ ডিজে, অ্যান্ড আ পাইরেট রেডিও অপারেটর। ডু ইউ নো এনিথিং অ্যাবাউট পাইরেট রেডিও?”
পঙ্কজের উত্তরের প্রত্যাশী ছিল না গ্রাহাম, তার আজ সকালে সম্ভবত অনেক কিছু বলার ছিল; সে শুরু করে দিয়েছিল বিস্কুটের টিনের মধ্যে ট্র্যান্সমিটার বানানোর কথা। আসলে এ সবই ছিল ষাটের দশকে ব্রিটেনের গান শোনার গল্প। সেদিন গল্পে পেয়েছিল গ্রাহামকে। কালো বড় ট্র্যাশব্যাগ হাতে গ্রাহাম অনর্গল কথা বলে যাচ্ছিল। পঙ্কজের কিউবিকলে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গল্প বলছিল। সমুদ্র আর গান। বলছিল পাইরেট রেডিওর কথা। বলছিল, গ্রাহামরা কয়েকজন সমুদ্রের ওপরে জাহাজ থেকে রক, পপ বাজাত। ব্রডকাস্ট করত ব্রিটেনে। রেডিওয়। গ্রাহাম বলেছিল, সেসব অবৈধ ব্রডকাস্ট ছিল। ইল্লিগাল। ‘লি’র ওপর খুব জোর দিয়েছিল, হেসেছিল। পঙ্কজের কাঁধে রোদ পড়ছিল, কাজ ফেলে কথা বাড়াল সে – “ইল্লিগাল? টেল মি অ্যাবাউট ইট।”
ফিউমহুডে রিফ্লাক্স চলছে। লরেল হিটিং অ্যাডজাস্ট করে জলের ফ্লো দেখছিল। তারপর সলভেন্টে টিএলসি প্লেট ঢুকিয়ে জারের মুখ চাপা দিল। কাজটা সীতারই করার কথা। গ্যাব্রিয়েলা সীতার কিছু কাজ লরেলকে অ্যালট করেছে। সীতার পাঁচ মাস চলছে – সলভেন্ট নিয়ে কাজ করা বারণ। লিপি জয়েন করার পর সীতার সঙ্গেই সামান্য ভাব – কাছাকাছি বয়স, গায়ের রংও। সীতার একটি ছেলে – বছর চারেকের, মেয়ের খুব শখ। মেয়েই হবে – সীতা একদিন লিপিকে বলেছিল।
খুব মন দিয়ে কাজ করছিল সীতা। সকাল থেকে মর্টার পেসেলে স্যাম্পল গুঁড়ো করছে। শক্ত আর হলদেটে সাদা স্যাম্পেলের ফ্লেক। অ্যাপিয়ারেন্স কমপ্লায়েড লিখে সই করে উঠল – বাথরুম যাবে। গ্যাব্রিয়েলা যেন ওঁত পেতে ছিল – “দিস ইজ দ্য টেনথ টাইম। হাউ মেনি টাইমস ডু ইউ নিড টু ভিজিট দ্য টয়লেট? উই আর লুজিং টাইম হিয়ার।” বাঁ-হাতের কবজি তুলে ঘড়ি দেখাল গ্যাব্রিয়েলা, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ডায়াল ঠুকল। সীতার মনে ঘাই মারল একটা শব্দ। দরজা পেরোতে পেরোতে মন থেকে কণ্ঠনালীতে তুলে নিল, তারপর বাথরুমের দরজা বন্ধ করে জিভ আর দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের করে দিল – ‘বিচ্!’
বেশ ক’দিন পরে গ্রাহাম এসেছে ট্র্যাশ নিতে। এ’ক’দিন প্যাট্রিক আসত। পঙ্কজ জিগ্যেস করেছিল গ্রাহামের কথা। প্যাট্রিক বলেছিল, গ্রাহাম সিইও-র অফিস পরিষ্কার করে। তারপর মুখ বেঁকিয়ে বলল – “সিইও-র অফিসের কাজ তো ওকেই দেবে।”
পঙ্কজ হেসে ফেলেছিল, “কেন?”
“বলব একদিন।”
আজ গ্রাহাম এসেছে।
পঙ্কজ গুড মর্নিং বলল, চোখ নাচাল।
কালো বিন লাইনার ডান হাত থেকে বাঁ হাতে নিল গ্রাহাম, পকেটে হাত ঢুকিয়ে চকোলেট বের করে পঙ্কজকে দিল – “নাও।”
“কী হল হঠাৎ? হোয়াটস দ্য অকেশন? আসোনি তো অনেকদিন। প্যাট্রিককে জিগ্যেস করছিলাম...”
“চাকরি ছেড়ে দিচ্ছি। আর দেখা হবে না।”
“তাই? উইল মিস ইউ। কোথায় জয়েন করবে? ঠিক করেছ কিছু?”
“বাকিংহাম প্যালেস থেকে একটা অফার আছে। দেখি।”
লিপি প্রচণ্ড ব্যস্ত ছিল সমস্তদিন, এখন কাজ গুটিয়ে ফেলবে – বিকেল পড়ে আসছে; ওর ল্যাপটপে পর পর ফাইল খোলা, রিপোর্টের প্রিন্ট নিচ্ছিল লিপি, সই করছিল – গ্যাব্রিয়েলা নিয়ে যাবে একটু পরে। কিছু ইমেলের উত্তর দেওয়া এখনও বাকি। হঠাৎ লরেল টোকা দিল ওর দরজায়, তারপর মাথা গলাল ঘরের ভেতর; হাঁফাচ্ছিল লরেল, “সামথিং ইজ ভেরি রং – সীতা টয়লেট থেকে মেসেজ করছে – ওখানে যেতে বলছে, কী ব্যাপার লেখেনি; তোমাকে কল করেছে নাকি, তুমি ধরোনি।” মোবাইল বের করল লিপি – পাঁচটা মিস্ড কল। গ্যাব্রিয়েলা গোটাকয়েক কাগজ হাতে লিপির অফিসের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল। “সরি, একটু পরে দেখছি” – গ্যাব্রিয়েলার পাশ কাটিয়ে মেয়েদের টয়লেটের দিকে দৌড়ল লিপি, পিছনে লরেল। লিপি অফিসের দিকের টয়লেটের দিকে টার্ন নিতে যাবে, লরেল আঙুল তুলে উল্টোদিক দেখাল – অফিস পেরিয়ে উঠোন, উঠোন পেরিয়ে ল্যাব,তারপর মেয়েদের বাথরুম। সারি সারি দরজা। একটা বন্ধ। ভেতর থেকে কান্নার আওয়াজ আসছিল। দরজায় ধাক্কা দিয়ে সীতাকে ডাকল দু’জনে।
“দরজা খোলো, কী হয়েছে?”
“হেল্প মি লিপি, হেল্প মি। আই থিংক আই হ্যাভ লস্ট হার।”
হাউ হাউ করে কাঁদছিল সীতা। সাদা কমোড রক্তে মাখামাখি হয়ে রয়েছে।
অ্যাম্বুলেন্স এসে সীতাকে নিয়ে গিয়েছিল। লিপি কপালে হাত দিয়ে বসেছিল, খোলা ল্যাপটপের দিকে তাকাল – এবার বাড়ি যেতে হবে। এই সময়, লরেলের সঙ্গে ওর অফিসে ঢুকছিল ক্যাথি, মেরি চুং, স্টিভ; লিপির অফিসের পশ্চিমের জানলা দিয়ে রোদ আসছে – যেন একদল কমলা মানুষের লাইন – মনে হচ্ছিল লিপির –
“কী ব্যাপার?”
ইতস্তত করছিল সবাই। লরেল মুখ খুলল প্রথমে – “লুক, উই অল নো হাউ গ্যাব্রিয়েলা ট্রিটেড সীতা। আমরা এইচআর-কে ডিসক্রিমিনেশনের কেস হিসেবে ব্যাপারটা জানাতে চাই। আর স্টিভ বলছিল, গ্যাব্রিয়েলা সীতাকে কিছু স্যাম্পল হ্যান্ডল করতে দিয়েছিল, যেগুলো হ্যাজার্ডাস। স্টিভের কাছে লিস্ট আছে। আমরা জানি না কীভাবে অ্যাপরোচ করা উচিত। উই নিড ইয়োর হেল্প হিয়ার লিপি। প্লিজ একটা ড্রাফট করে দাও।
লিপি এক সেকেন্ডও সময় নিল না, সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল।
“বোসো। লিখে দিচ্ছি। লিস্টটা আছে, স্টিভ?”
“কাজকর্ম ফেলে কী হচ্ছে এখানে?” দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকেছিল গ্যাব্রিয়েলা – লরেল, স্টিভ, মেরির সুপারভাইজর। লিপির দিকে আঙুল তুলে বলেছিল – “ব্লাডি ইন্ডিয়ান, লোক খ্যাপাচ্ছ?”
ল্যাপটপের ব্যাগ ঝুলিয়ে বাসস্টপ থেকে বাড়ির দিকে হাঁটছিল পঙ্কজ। গাড়ি সার্ভিসিং-এ দিয়েছে – ফলে, দিন তিনেক বাসে যাতায়াত করবে। এইখানে ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থামলে, রোজই দোকানটার দিকে চোখ যায় পঙ্কজের, সস্তা জিনিসের দোকান – বার্গেন ওয়ার্ল্ড। একটেরে অন্ধকার – দোকানের ভেতর কোনোদিনই দেখা যায় না গাড়ি থেকে। দোকানের বাইরে প্লাস্টিকের ফুল, নাইলনের দড়ি, চটি, পাপোশ রাখা থাকে, হ্যালোউইনের ছদ্মবেশ দিনের পর দিন হ্যাঙ্গারে ঝোলে; টেরাকোটার টবে মানিপ্ল্যান্ট, ছোট বাঁশ। তার পাশে দাঁড়িয়ে দোকানি উদাস চোখে সিগারেট টানে। পঙ্কজ এইরকমই দেখে রোজ। আজ হাঁটতে হাঁটতে দেখল, গমগম করছে এলাকা – দোকানের সামনে অজস্র বেলুন, রঙিন শিকলি, লোকের ভিড় আর ভিড়ের মধ্যে গ্রাহাম। চমৎকার স্যুট, বো, চকচকে জুতো। মাথায় টুপি। হাতে মাইক্রোফোন। স্প্রুইকিং করছে। অনর্গল বলে যাচ্ছে শস্তার চটি-পাপোশ-ফুলদানির আশ্চর্য গুণাবলির কথা; লোক ডাকছে, গান গাইছে, রসিকতা করছে চোখ মটকে – এইসব চটি, এই পাপোশ, ফুলদানি যে বস্তুত জাদুভরা – এসব বলছিল। বলছিল ম্যাজিকাল, বলছিল বাড়ি বদলে যাবে। গমগম করছিল ওর গলা। একটা সুর ছিল, যা লোক টানে। ওকে ঘিরে ভিড় জমছিল। সরু সাইডওয়াক। তবুও। রাজার মত লাগছিল ওকে। কিংবা খুব শক্তিশালী কেউ একজন। কবি বা বিপ্লবী। অথবা ম্যাজিশিয়ান। পঙ্কজকে দেখতে পেয়েছিল গ্রাহাম। টুপি খুলল, হাত নাড়ল, তারপর আবার শুরু করেছিল বকবক করতে। পঙ্কজ চোখ নামিয়ে নিয়েছিল – ও আর কোনোদিন ম্যাজিশিয়ানের চোখের দিকে তাকাবে না। পঙ্কজ জুতো ঘষল ফুটপাথে, অকারণ; হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। রাস্তার আলো জ্বলে যাওয়ায়, স্ট্রিট লাইটের তলায় পঙ্কজের চারটে ছায়া পড়ছিল যথারীতি।
আজ সুবিমল অফিসে দীর্ঘসময় কাটিয়েছে। লিপিকে মেসেজ করে দিয়েছিল তিন্নিকে নিয়ে ফেরার জন্য। এখন শিস দিতে দিতে অ্যাপার্টমেন্টের সিঁড়ি ভাঙছিল – টপকে টপকে যাচ্ছিল সিঁড়ির ধাপ। টিম বিল্ডিং-এর ইভেন্ট অর্গানাইজ করার দায়িত্ব পেয়ে গেছে – স্ট্রেস ফ্রি ওয়র্কপ্লেস ফোকাস করে একটা প্ল্যান খাড়া করে ফেলেছে অলরেডি; প্রেজেন্টেশন বানাবে আজ রাতে। সামনে বাড়ি বদলানো - ঈষৎ চিন্তা রয়েছে সেই সব নিয়ে। চাপ কাটাতে শিস দিচ্ছিল জোরে জোরে। এই সময় ল্যান্ডিং, সিঁড়ি ভরে থাকে রাঁধাবাড়ার গন্ধে – বারবিকিউ-র গন্ধ, দুধ ওথলানোর, ভাত ফোটার গন্ধ কিংবা মাছভাজার, কখনও পুড়ে যাওয়া তেলের, কাফির লাইমের অথবা ভিনিগারের; এত গন্ধের ভিড়ে নিজের দরজার নিচ দিয়ে আসা গন্ধ সে ঠিক চিনে নেয় এই সময় – তার খিদে পায়, তিন্নি আর লিপিকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে হয় – ভালবাসি, বড্ড ভালবাসি।
আজ দরজার বাইরের আলো জ্বলছিল না – বাল্বটা কেটে গেছে হয়তো, দেখতে হবে; পরক্ষণেই মনে হল – আর তো মাসখানেক মোটে – এ’ সিঁড়ি দিয়ে আর উঠবে-নামবে না সে। চাবি ঘুরিয়ে সুবিমল ঢুকল অ্যাপার্টমেন্টে। কিছুদিন ধরেই বাঁধাছাঁদা চলছিল। বসার ঘরের মেঝেতে আট-দশটা কার্ডবোর্ডের বাক্স পড়ে আছে আজ কয়েকদিন – কোনোটা ভর্তি – দড়ি দিয়ে বাঁধা হয়ে গিয়েছে; কোনো বাক্স বাঁধা হয়েছিল, আবার খোলা হয়েছে – তিন্নি তার ভিতর থেকে খেলনা বের করেছে, আবার ঢুকিয়ে রেখেছে। সুবিমল দেখল, আজ ঘর অন্ধকার, রাশিকৃত বাক্স ছড়ানো-ছেটানো – তার মধ্যে চুপ করে বসে আছে লিপি।
“কী হল, আলো জ্বালাওনি কেন? কী হয়েছে? তিন্নির জ্বর নাকি? অ্যাঁ?”
“তিন্নি পাশের ঘরে, ঠিক আছে।”
“কী হয়েছে বলবে তো – ”
“আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি আজ – ”
“কী বলছ কী! পাগল হয়ে গেছ? এই বাজারে আবার কবে চাকরি পাবে তুমি? আমি তো তোমার চাকরির ওপর ভরসা করে বাড়ি কিনেছি লিপি। অ্যাতো মর্টগেজ – আমি একা পারব কী করে? এটা কী করলে? এই ক্রিটিকাল সময়ে ছেড়ে দিলে? আর তুমি চাকরি ছাড়বে কেন তাও তো বুঝতে পারছি না – কেন? লিপি? আন্সার মি নাউ।”
সুবিমলের গলা চড়ছিল। মেঝেতে বসেছিল লিপি – গোঁজ হয়ে; দু’হাত দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে, ঈষৎ দুলছিল। এই সময় পুতুল-কোলে দরজায় এসে দাঁড়াল তিন্নি। বাবা মা-র মুখের দিকে তাকাল, তারপর কেঁদে উঠল জোরে।